somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ব্যর্থ ভ্রমণ রেকি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে সাতটি লাশ উদ্ধার।

১৯ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভোর পাঁচটা, ফোনে রবিউল হাসান খান মনা জানালো তাদের বাস এখন টঙ্গীতে। ঘটনা কিছুই বুঝলাম না, ঢাকা থেকে আসবে সিলেট, টঙ্গীতে গাড়ী কি করে? সেই রাত দশটায় গাড়ী ছেড়েছে ঢাকা থেকে, এতক্ষনে সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কথা। মনা’র আবার গাড়ীতে ভালো ঘুম হয়, ভাবলাম ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বকছে। লাইন কেটে দিয়ে তাহসিন’কে (ব্লগার তাহসিন মামা ) ফোন দিলাম। “কোথায় এখন আপনারা?” জিজ্ঞাসা করতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘টঙ্গী’!!!!...। মানে কি? হালকা যা...ও... ঘুমের রেশ চোখে ছিল সব নিমিষে উধাও।

ভালো একটা ঘুমের লোভে জাফলং উপজেলা পরিষদের পিয়াইন নদীর তীরের রেস্ট হাউজে উঠেছিলাম আমি আর ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সভাপতি আরশাদ হোসেন টুটুল ভাই। আগের দিন প্রচণ্ড ঝড় হওয়ায় বিদ্যুতের তার সব ছিঁড়ে লণ্ডভণ্ড। সারারাত গরমে ঘুমাতে পারিনি, সাথে ছিল ইয়া বড় বড় ভীমরুলের মত কালো কালো পোকার উপদ্রব। ভ্রমণ বাংলাদেশের উদ্যোগে গত ১লা মে’র ছুটিকে সামনে রেখে ১ - ৩ মে সিলেটের জাফলং, জৈন্তাপুর রিসোর্ট, বিছানাকান্দি, লালাখাল, রাতারগুল – এই স্পট নিয়ে তিনদিনের একটা ট্র্যাভেল ইভেন্ট দেয়া হল। ৩০ জনের দলের জন্য প্রি-এরেঞ্জমেণ্ট করতে আমি আর টুটুল ভাই দুই দিন আগে ২৯ তারিখ রাতের গাড়ীতে সিলেটের উদ্দেশ্যে ঢাকা হতে রওনা হই।

ইভেন্ট দেয়ার পর থেকে কনফিউশন ছিল বিছানাকান্দিতে পানি থাকবে কি না তা নিয়ে। আর স্থলপথে বিছানাকান্দি পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ। গত বছর যখন আমি গিয়েছিলাম, খুবই বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এবার অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার ছিল, ৩০ জনের দলের তিন দিনের আবাস, ট্রান্সপোর্ট, ফুড এরেঞ্জমেণ্ট এর ব্যাপারও ছিল। আর আমার নিজের একটা ব্যাক্তিগত প্ল্যান ছিল, লোভাছড়া নদীতে ভ্রমণ সাথে লোভাছড়া চা বাগানে ঢুঁ মারা। আমরা দুজন যখন ৩০ তারিখ ভোর বেলা সিলেট পৌঁছই তখন তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হোটেলের খোঁজ, বন্দর বাজারের আশেপাশে খোঁজ করে করে জেল রোডের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী "হোটেল অনুরাগ" এ উঠলাম। সাথে ২ তারিখ রাতে আমাদের দলের ৩০ জনের জন্য রুম বুকিং করে ফেললাম।

এবার ঠিক করার পালা হিউম্যান হলার, বন্দর বাজার স্ট্যান্ড হতে ৩ তারিখের জন্য তিনটা হিউম্যান হলার খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান হয়ে রাতারগুল যাওয়ার জন্য ভাড়া করে নিলাম। নৌকা ভাড়া করার দায়িত্ব হিউম্যান হলার ড্রাইভার নিল। এখানে আমাদের আর একটা কাজ বাকী ছিল। আমাদের পুরো দল ঢাকায় ফিরবো ৩ তারিখ দুপুর তিনটার ট্রেনে, ঢাকা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটার উপরে বাজবে। তাই সেদিন সন্ধ্যায় ভালো একটা স্নাক্স আইটেমের খোঁজ করা দরকার। খুঁজে পেতে একটা ভালো কনফেকশনারি পেলাম, যেখানে ৩ তারিখের জন্য চিকেন বার্গার অর্ডার করে দিলাম, যদিও উনারা বলছিলেন, আসলেই পাওয়া যাবে, তারপরও রিস্ক নেই নাই। অসাধারণ ছিল সেই চিকেন বার্গারগুলো।

এবার রওনা হলাম গোয়াইনঘাটের দিকে। সেখানে গিয়ে খোঁজখবর করে জানা গেল নদীতে পানি একেবারেই নেই, পাথরের বাথান খটখটে হয়ে আছে, আর রাস্তা ভেঙ্গেচুরে একাকার। কি করা যায়? টুটুল ভাইকে বললাম, চলেন লোভাছড়া ঘুরে আসি। কানাইঘাট হয়ে গেলাম লোভাছড়া, সেখানেও হাঁটুপানি, তারপরও নৌকা চলে। সব দেখে, ঘুরে সিদ্ধান্ত নিলাম লালাখাল দেখে লোভাছড়া চলে আসবো, বিছানাকান্দি এবার বাদ যাবে। আমাদের মূল দলের প্রথম রাত থাকার প্ল্যান জৈন্তাপুর রিসোর্টে। পরেরদিন লালাখালে এবং লোভাছড়া। তাই একটা মিনিবাস ভাড়া করে ফেললাম, ২ তারিখ সকালে আমাদের রিসোর্ট হতে পিক করবে, লালাখাল-কানাইঘাট হয়ে লোভাছড়া ভ্রমণ শেষে আমাদের সিলেটে ‘হোটেল অনুরাগ’ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, অর্থাৎ সারাদিনের জন্য রিজার্ভ। লোভাছড়ায় তিনটা নৌকাও ভাড়া করে এলাম।

তৃপ্ত মনে পরদিন ৩১ তারিখে জাফলং চলে এলাম, জৈন্তাপুর রিসোর্টে রুম কনফার্ম করার সাথে সকালের নাশতা ভুনা খিচুড়ি অর্ডার করে দিলাম। সারারাত ত্রিশ জন মানুষ জার্নি করে আসবে, তাই একটু ভালই হোক নাস্তাটা। রাতে হবে বারবিকিউ পার্টি, তার এরেঞ্জমেণ্ট এর প্রাথমিক কাজও সেরে রাখলাম ম্যানেজারের সাথে কথা বলে।

দুপুরে চলে গেলাম জাফলং, পিয়াইন নদীর হাঁটু পানি পেরিয়ে ওপারে ‘সংগ্রামপুঞ্জি রেস্তোরাঁয়’ ত্রিশ জনের লাঞ্চ অর্ডার করলাম। ডাউকি’র পাহাড় দেখতে দেখতে লাঞ্ছ করা, অসাম। ঐদিনের লাঞ্চটাও আমরা ঐখানে সেরে নিলাম। সাথে নদী পেরুনোর নৌকা, লাঞ্ছ শেষে খাসিয়া পল্লী, চা বাগান এগুলো ঘুরে দেখার জন্য সাতখানা ভ্যান-রিক্সা রিজার্ভ করে রাখলাম। এপারে ফিরে এসে জাফলং থেকে জৈন্তাপুর রিসোর্ট ফেরার জন্য তিনটা হিউম্যান হলার ভাড়া করে রাখলাম। সব কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন। আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভালো থাকার জায়গা খুঁজে খুঁজে গিয়ে উঠলাম ঐ উপজেলা পরিষদের পিয়াইন নদীর তীরের রেস্ট হাউজে। তখনও কি জানতাম এটা হবে আমাদের সবচেয়ে জঘন্ন একটা ট্যুর!

শুরুতে যেখানে ছিলাম, বাস টঙ্গীতে। তাহসিন যা জানালো, তার সারমর্ম কাল রাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে গুম হওয়া ছয়জনের লাশ উদ্ধার হয়, এই নিয়ে চলে ব্যাপক ভাংচুর, রাস্তা বন্ধ করে দেয়। শেষে রাত বারোটার দিকে গাড়ী ঘুরিয়ে টঙ্গী হয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সারারাত গাড়ী জ্যামে টঙ্গীতেই আটকে আছে। এক কাপল রাত দুইটার দিকে বাস হতে নেমে বাসায় চলে গেছে। গাড়ী কখন সিলেট পৌঁছবে কেউ জানে না।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কাল রাতেই টুটুল ভাইকে বলছিলাম, এবারের রেকি এবং প্রি-এরেঞ্জমেণ্ট ইজ দ্যা বেস্ট। এখনতো সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। সব জায়গায় ফোন দিয়ে দিয়ে খাবার অর্ডার কোথাও ক্যান্সেল, কোথাও স্টপ; পরিবহনগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাবস্থা নিতে হল। এরপর আর কি? পুরো ট্যুরটাই অগোছালো হয়ে গেল, সব প্ল্যান ভেস্তে গেল, আনন্দ সব মাটি। কারণ আগের দিন রাত দশটায় রওনা দিয়ে পরদিন সন্ধ্যা ছয়টায় সবাই সিলেট পৌঁছে।

আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে এবং ভয়াবহ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ছিল ঐ ট্যুর। কোথায় শীতলক্ষ্যা নদীতে সাতটি লাশ উদ্ধার হল; আর তার ইফেক্ট কতশত জায়গায় হল। এমনকি আমাদের মত অনেকগুলো ভ্রমণ দলের উপরও। এতো সুন্দর গোছানো ট্যুর এরেঞ্জমেণ্ট এর পুরো পরিশ্রমটাই ভেস্তে গেল। এই ট্যুরের কথা মনে হলেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। :(
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:২৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×