somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের দ্বৈত শিল্পী (অনুগল্প যুগল)

২৯ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১।

জুয়েল ওপাশ থেকে মা’র কণ্ঠ শুনতে পেল, “বাবা টাকা পাইছি”।

হযরত শাহজালাল (রহঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরব আমিরাত থেকে ঘণ্টাখানেক আগে আগত মালেয়শিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রী হিসেবে অবতরণের পর বিমানবন্দর কাস্টমস এর চেকিং এ নয় কেজি স্বর্ণ নিয়ে ধরা পড়েছে জুয়েল। সে লোকটার দিকে তাকালো, নেমপ্লেট থেকে আগেই নাম জেনেছে, সোলায়মান জোয়ারদার। এই লোকটাই হল পুরো প্ল্যানিং এর কো-অর্ডিনেটর। জুয়েলকে বলা ছিল, বিমানবন্দরেই তার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে তার প্রাপ্য দুই লাখ টাকা তার মা’র কাছে পৌঁছে যাবে। সে অনুযায়ী একটু আগে মা সেই টাকা পেয়েও গেছে। জোয়ারদার তার দিকে কিছু একটা ইশারা করলো, মনে হয় বলতে চাইলো ভয় পেয়ো না। না জুয়েল ভয় পাচ্ছে না, সে আগে থেকেই জানে তাকে কি করতে হবে, তারপর কি হবে।

বছর তিনেক আগে জুয়েল গ্রামের ধানী জমি বিক্রি করে পাড়ি জমায় আরব আমিরাত, অধরা স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখবে বলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। ছয়মাসের মাথায় ধরা পড়ে পুলিশের হাতে, জাল ভিসার কারণে। টানা দুই বছর জেল খাটে। জেলখানায় পরিচয় হয় আব্দুস সালাম নামের এক লোকের সাথে। সেই লোক তাকে বলে জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার একটা উপায় আছে, সাথে ক্যাশ লাখ দুয়েক টাকাও পাওয়া যাবে। সালাম সব তাকে খুলে বললে সে রাজী হয়, অতঃপর আজ ঢাকায় ফেরা এবং ফিরেই স্বর্ণ চোরাচালানের দায়ে গ্রেফতার।

পুরো ঘটনা খুব নিখুঁতভাবে সাজানো। এই একই ফ্লাইটে জুয়েল ছাড়াও অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তাদের দলের আরও দুইটা ফ্যামিলি ছিল, চারজন করে প্রতিটিতে, সাথে একটা করে ছোট বাচ্চা। তাদের কাছে ছিল প্রায় দুইশত কেজির মত স্বর্ণ আর জুয়েলের কাছে নয় কেজি। প্ল্যানিং মোতাবেক টিকেট করা হয়, চেকিং আগে পড়বে জুয়েলের লাগেজের, সেই ব্যাবস্থাও করা হয়। জুয়েলের লাগেজে নয় কেজি স্বর্ণ ধরা পড়া নিয়ে যখন হইচই পড়ে যাবে, তখন জোয়ারদার ঐ দুই পরিবারের লাগেজ পাশ করে বিমানবন্দর থেকে বের করে দিবে।

ইতিমধ্যে বিমানবন্দরে কাস্টমস পুলিশ জুয়েলকে নিয়ে স্বর্ণসহ সাংবাদিক সম্মেলন করে ফেলেছে। আগের থেকে বলে দেয়া ফর্মুলা মত জুয়েল অস্বীকার করেছে ঐ লাগেজ তার নয় বলে। সে এও বলেছে যে, জাল ভিসার ফাঁদে পড়ে সে দুই বছর জেল খেটে ছাড়া পেয়েছে, এত স্বর্ণ সে কথায় পাবে? তার এই অভিনয় শিল্প যত নিখুঁত হবে, ততই তার সুবিধা। কেননা, সবকিছু ঠিক থাকলে ছয় মাস কারাবাস শেষে জুয়েল ফিরে যাবে তার মায়ের কাছে, আপন ঠিকানায়।


২।

মেকআপ ম্যানটা মনে হয় নতুন, হাত কেমন কাঁপছে। কিন্তু কাজের প্রতি খুব যত্নশীল। খুব মনোযোগ দিয়ে রুহুলের মেকআপ করে দিচ্ছে। লোকটা একটু বোকাও, নইলে রুহুলের মত একটা এক্সট্রার মেকআপ কেউ এতো মনোযোগ দিয়ে করে নাকি? অথবা এমনও হতে পারে এই লোক সবকাজেই খুব সিরিয়াস টাইপ। রুহুলের খুব নার্ভাস লাগছে, এই কাজ জীবনে সে আগে করে নাই কখনো। না কোন অভিজ্ঞতা, না কোন ট্রায়াল, না কোন অডিশন; একেবারে ডাইরেক্ট অ্যাকশন।

দুইদিন শেভ না করায় এমনিতেই একটু পর পর গাল চুলকায়, তার উপর দুনিয়ার রঙচঙ মেখে একাকার করে দিয়েছে ঐ মেকআপ ম্যান ব্যাটায়। এখানে রুহুল কাউকে চেনে না, না চেনায় ভালোই হয়েছে; কাজটা নির্বিঘ্নে করা যাবে। কিন্তু রুহুল খুবই নার্ভাস, সাথে প্রচণ্ড ভয়ও কাজ করছে। একটু দূরে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় লাল টুপি দেয়া লোকটাই ডিরেক্টর, সবাইকে খুব ধমকাচ্ছে। কয়েকবার লোকটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেছে রুহুলের, সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়েছে।

খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, এখানে কাউকে বললে কি চা পাওয়া যাবে? মনে হয় না। রুহুল এফডিসি’র মেইন গেট দিয়ে বাইরে গিয়ে এককাপ চা খেয়ে আসবে কি না বুঝতে পারছে না। এই মেকআপ নেয়া চেহারা নিয়ে সে কি বাইরে যাবে? লোকে লোকারন্য এফডিসি’র গেইটে গিয়ে না আবার কোন ঝামেলায় পড়তে হয়। এই চিন্তা সে বাদ দিল, যদিও তার ধারনা নিশ্চয়ই মানুষজন মেকআপ নিয়েও বাইরে যায়, যেতেই পারে; কতসময় কত প্রয়োজন পড়তেই পারে। ট্রলি, রিফ্লেক্টর বোর্ড, লাইট, ক্যামেরা সব নিয়ে বেশ ব্যাস্ততা; কিছুক্ষণের মধ্যে হয়ত শুটিং শুরু হবে।

দৃশ্যটা একটা মারামারি’র। নায়িকা কলেজে যাওয়ার পথে একদল বখাটে নায়িকাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে আবির্ভাব ঘটবে নায়কের এবং তার বন্ধুদের। শুরু হবে ব্যাপক মারামারি, এই অংশেই রুহুলের কাজ। রুহুলের ডান হাত কাঁপছে, আপ্রাণ সে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। বাম হাত দিয়ে কোমরে কি যেন খুঁজলো, সাথে সাথে চেহারায় একটু শান্ত ভাব চলে এল। এখন নায়ক নায়িকার কোন শুটিং হবে না, উনাদেরটা দুপুরের দিকে। তারা আসার আগে, সকাল সকাল নায়ক আর ভিলেনের বন্ধুদের মারামারির দৃশ্যটা করে ফেলছেন ডিরেক্টর সাহেব।

ডিরেক্টর “অ্যাকশন” বলার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল দৌড়ঝাঁপ, লাফালাফি, চিৎকার চেঁচামেচি। এই ব্যাপক কোলাহল যেন রুহুলের মাঝে এক আশ্চর্য স্থিরতা এনে দিল। সে এক দৌড়ে ডিরেক্টরের কাছাকাছি চলে এসে মাথা লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি করে দৌড় দেয়া শুরু করলো দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের সীমানা প্রাচীরের দিকে। প্রাচীর লাগোয়া একটা গাছ বেয়ে সে দেয়াল টপকে এক লাফ দিল রেললাইন সংলগ্ন বস্তিতে। দৌড়ানো আরম্ভ করতেই টের পেল পা মচকে গেছে, প্রচণ্ড ব্যাথায় সে কুঁকড়ে উঠলো। কিন্তু এখন ব্যাথাকে পাত্তা দিলে চলবে না। তাকে দৌড়তে হবে, যে কোন উপায়ে তাকে এই এলাকা ছেড়ে সোজা মহাখালী বাস টার্মিনালে চলে যেতে হবে। সেখান থেকে গাবতলী হয়ে সোজা গ্রামের বাড়ী পঞ্চগড়।

রেললাইন ধরে রুহুল দৌড়াচ্ছে, বেলা এগারটার তীব্র রোদে রেললাইন মোটামুটি ফাঁকা। সকালের মাছের বাজারের কোলাহলের পর এই জায়গাটা এমনিতেই একটু ফাঁকা হয়ে যায়। আর এই জন্যই এই সময়টা বেছে নেয়া। ফাঁকা রেললাইন ছেড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় আসতেই রুহুল একটা দোকানের কাছে বালতিতে রাখা পানি পেয়ে মুখে ঝাঁপটা দেয়া শুরু করলো, মেকআপ তুলে ফেলা দরকার। দোকানি দোকানের ভেতরের দিকে থাকায় প্রথমে রুহুলকে দেখতে পায় নাই, দেখতে পেয়ে তেড়ে এল। রুহুল আবার দৌড়াতে লাগলো। মাথায় বাঁধা কস্টিউমের গামছা দিয়ে মুখ ঘষতে ঘষতে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলল মহাখালীর দিকে।

ঘটনার শুরু গত সপ্তাহে। রুহুলের গ্রামের বাড়ী থেকে ফোন এলো, ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে; সপ্তাহখানেকের ভেতর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে রুহুল যেন গ্রামে চলে আসে। রুহুল গত তিনমাস বেকার, যে কোম্পানিতে সে পিয়নের কাজ করতো, সেই কোম্পানিটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তার রুমমেট ইকবালের সাথে সেদিন বিকেল বেলা রমনা পার্কে গেছে হাওয়া খেতে, ইকবালই তাকে জোর করে নিয়ে গেল। সেখানে ঘোরাঘুরি করতে করতে এক জায়গায় দেখে রাইফেল দিয়ে বেলুন ফোটানোর খেলা চলছে। সেখানে কিছুক্ষণ খেলা দেখে ইকবাল রুহুলকে নিয়ে পাঁচ টাকায় দশটা দরে বেলুন ফুটানোর খেলা খেলল। রুহুলের নিশানা দেখে ইকবাল তাজ্জব। বেলুনওয়ালা মামার কথা মত একটা বিড়িতে পর্যন্ত গুলি করে নিশানা ভেদ করে রুহুল সবাইকে অবাক করে দিল।

ঘটনা শুরু রাতের বেলা, ইকবাল রুহুলকে বলল, “দোস্ত তোমার এমন ভালো নিশানা, তুমিতো শুটিং এ কাম করতে পারো”। রুহুল প্রথমে ভাবলো শুটিং খেলার কথা বলছে ইকবাল, কিন্তু পড়ে জানলো সিনেমার শুটিংও নয়, এ হল “রিয়েল লাইফ শ্যুট”। অনেক ভেবে মনস্থির করলো, নিজেকে প্রবোধ দিয়ে পরেরদিন ইকবালের সাথে মগবাজারে এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করে, উনি রুহুলের নিশানা দেখে তাকে অফার করেন একটা “খুন” করার। পুরো প্ল্যানিং উনি করে দিবেন, ব্যাবস্থাও উনার, রুহুলকে শুধু গুলি ছুড়তে হবে এবং যথাসময়ে সেখান হতে পালাতে হবে। বিনিময়ে রুহুল পাবে ক্যাশ এক লাখ টাকা, তাও কাজ করার আগেই। কিন্তু কাজে ব্যর্থ হলে বা ধরা পড়লে কোনমতেই কারো নাম বলা যাবে না।

না, রুহুল ব্যর্থ হয়নি, ধরাও পড়েনি, সে পেড়েছে। নিজ পরিবারের জন্য, বোনের সুখের জন্য, সে পেড়েছে। পেড়েছে শিল্পী হতে, নিখুঁত শিল্পী, যেখানে শিল্পটা হল “খুন” আর শিল্পী হল “খুনী”।


(Disclaimer: দু'টি ঘটনাই নিছক গল্প, বাস্তবতার সাথে ইহার কোন সম্পর্ক নেই)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৩১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×