সময়টা ১৯৯৮ সাল, সাতক্ষীরা স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তৎকালীন সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক জনকণ্ঠ হাতে নিতেই প্রথম পাতায় একটা লিড নিউজ করা ছবি দেখে সদ্য ভার্সিটি লাইফে পা দেয়া তরুন মন সত্যি কেঁদে উঠে। এক অশীতিপর বৃদ্ধা গলা সমান পানির মাঝে দিয়ে অসহায় হয়ে চেয়ে আছে। সাথে সাথে মনে হল কিছু একটা করা দরকার। নাশতা সেরে দুদিন আগে পাওয়া টিউশনির টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বন্ধু মনা’র সাথে আলোচনা করে প্রথমে গেলাম নয়াবাজার, ছাপাখানা পাড়ায়। নিউজপ্রিন্ট কাগজে হাজারখানেক লিফলেট বানালাম বন্যা দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে। তখন কোন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তাই এই পদক্ষেপ। নয়াবাজারে প্রেসে দাঁড়িয়ে থেকে বেলা এগারোটা নাগাদ লিফলেট হাতে নিয়ে চলে এলাম পুরাতন ঢাকার লালবাগ। আরও কিছু ছোট-বড় সঙ্গী যোগাড় করে নেমে পড়লাম কাজে।
এক গ্রুপ বের হলাম বিভিন্ন মার্কেট এলাকায়, সাথে একটা ভাড়া করা ভ্যান গাড়ী এবং মাইক; হাতে লিফলেট। অনেক ব্যাঙ্গ, বাঁকা চোখ, উপেক্ষা, অপমান সহ্য করে সারাদিন শেষে সন্ধ্যায় মোটামুটি একটা ভালো সংগ্রহ দাঁড়ালো। আমরা, নগদ টাকার সাথে সাথে শুকনো খাবার, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরন হ্যালোজেন ট্যাবলেট এবং কাপড়ও সংগ্রহ করেছিলাম। বিশেষ করে পথিমধ্যে পাওয়া প্রতিটি ফার্মেসী থেকে খাবার স্যালাইন এবং হ্যালোজেন ট্যাবলেট নিয়েছিলাম, দোকানীরাও খুব আন্তরিক ছিল।
আরেক গ্রুপ পুরাতন ঢাকার আমাদের আশেপাশের প্রতিটি বাসায় বাসায় গিয়ে ঘরে ঘরে বন্যার্তদের পাশের দাড়াতে সবাইকে আহবান করে। একটা বিষয় সেদিন আমরা লক্ষ্য করি, অনেকেই এই ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী, কিন্তু কীভাবে কিংবা কোন মাধ্যমে কিছু সাহায্য বন্যার্তদের পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া যায় তা না জানার কারণে মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়। যাই হোক সেই ডোর টু ডোর নক করেও ভালো সারা পাওয়া যায়।
আমাদের তৃতীয় আরেকটা গ্রুপ কাজ করেছে, পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদের কাছ থেকে একটা ভালো অঙ্কের সাহায্য ব্যাক্তিগত অনুরোধ দ্বারা সংগ্রহ করতে। অনেকের কাছে ব্যাপারটা কেমন কেমন লাগতে পারে, কিন্তু আমার মতে এটা খুবই কার্যকর একটা পন্থা। কেননা, অনেকের সামর্থ্য আছে, কিন্তু মাথায় এই ব্যাপারটা তেমনভাবে ক্যাচ করে না। তাদের এই পন্থায় না ফেলে উপায় নাই।
যাই হোক মোটামুটি ভালো পরিমানে ত্রান সংগ্রহ হল। পরেরদিন রাত্রে পার্শ্ববর্তী এক ক্লাব থেকে সাতক্ষীরা যাচ্ছে ত্রান নিয়ে, তাদের কাছে আমাদের হাতে থাকা শুকনো খাবার, ঔষধ আর জামা কাপড় দিয়ে দিলাম। প্রথমে চেয়েছিলাম আমরা দুয়েকজন যাই, কিন্তু আমাদের যাওয়া আসা বাবদ যে টাকা খরচ হত তা দিয়ে আরও কিছু ত্রান কিনে দেয়া যাবে। শেষে অবশ্য বন্ধু মনা ওর মা’র কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে ঐ গ্রুপের সাথে গিয়েছেল।
উনারা ফিরে আসার পর আমরা বুঝতে পারি আসলে বন্যার্ত এলাকায় কি ত্রান বেশী জরুরী। প্রথমত বিশুদ্ধ খাবার পানি। আমরা আমাদের সাহায্যে পাওয়া টাকা দিয়ে প্লাস্টিক কারখানা হতে পাঁচ এবং দশ লিটারের ছোট ছোট গ্যালন পাইকারি দরে কিনে নিয়ে তাতে পানি ফুটিয়ে এবং হ্যালোজেন ট্যাবলেট দিয়ে শখানেক গ্যালন পানি রেডি করি। দ্বিতীয় হল শিশু খাদ্য। আমাদেরে ফান্ড খুব বেশী না থাকায় আমরা স্থানীয় এক ডাক্তারের পরামর্শে খাবার সুজি’র সাথে শিশুর খাদ্য উপযোগী গুড়ো দুধ এবং চিনি মিশিয়ে (পরিমাণ ডাক্তারের বর্ণনা মোতাবেক ছিল) প্রতি একবেলার পরিমানে প্যাক করে হাজারের উপর প্যাক তৈরি করি। আর দরকার কিছু পানিবাহিত রোগের ঔষধ। এবার বাকী টাকা থেকে মিটফোর্ট এর পাইকারি ঔষধের দোকান থেকে পানি বাহিত রোগের ঔষধ, সাথে খাবার স্যালাইন এবং একজনের সহায়তায় পাওয়া আইসিডিডিআরবি’র চালের গুঁড়োর স্যালাইন যোগাড় করা হল। পরের দিনই আরেক গ্রুপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলাম।
একটা বিষয় আমরা অবশ্যই মাথায় রেখেছিলাম, যাদের মাধ্যমে ত্রান পাঠাচ্ছি তাঁরা প্রত্যন্ত বন্যাকবলিত এলাকায় যাবেন কি না। আমাদের লক্ষ্য ছিল তাদের কাছে ত্রান পৌঁছানো, যেখানে ফুটেজ আর মিডিয়া কাভারেজের জন্য ত্রান পৌঁছায় না।
দেশে এখন বন্যা পরিস্থিতি চারিদিকে। তরুন থেকে এখন যুবা সার্কেল শেষ করার পথে, আগের সেই সাঙ্গপাঙ্গরা সবাই চারদিকে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে... মন চায় সব ফেলে আগের সেই সময়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু সময় বড় নির্মম। তবুও চেষ্টা থাকে যে কোন মানবিক বিপর্যয়ে দূর থেকে হলেও অল্প একটু হলেও কিছু করার। হয়ত তাতে দায় এড়ানো যায় না, কিন্তু কিছুটা মানসিক প্রশান্তি হয়তো পাওয়া যায়। ব্লগে কত ছাইপাশ রোজ লিখছি, কেননা এই নিয়েও লিখি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তাই এই লেখা। ‘রাইস বাকেট’ একটি চমৎকার উদ্যোগ, এতে সবার সম্পৃক্ততা আশা করছি।
একটা জরুরী কথা মনে রাখবেন, বন্যা কবলিত লোকজন মাত্রই কিন্তু দারিদ্র পীড়িত নয়। অনেকে সচ্ছল কিন্তু প্রয়োজনীয় কোন কিছু তার কেনার আয়ত্তের চৌহদ্দিতে নেই, সব পানির নীচে। তাই নগদ টাকা ত্রান হিসেবে না দিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি, প্রয়োজনীয় ঔষধ আর খুব সাদামাটা কিন্তু কয়েকদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যায় এমন শুকনো খাবার তাদের কাছে পৌঁছে দেয়াটা বিশেষ জরুরী। খুব ইচ্ছে করছে ১৬ বছর আগের সেই সময়টা ফিরে পেতে। খুব...খুব...খুব...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:২৯