"রন্তু'র কালো আকাশ" সব পর্ব
হালকা শীত পড়েছে, খুব ভোর বেলা এখন হালকা কুয়াশা দেখা যায়। এই হালকা কুয়াশা কেমন যেন একটা দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টি করে। কখনো কখনো একজন মানুষ নিজের অজান্তেই হয়তও আরেকজন মানুষের হৃদয়ে এই কুয়াশার ন্যায় বিভ্রম তৈরি করে। শায়লার কাছে ইরফান একটা কুয়াশাচ্ছন্ন বিভ্রম বৈ অন্য কিছু কি? শায়লা নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করে করে দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে একটু একটু করে খসে পড়ছে তার বিবেক-আবেগে’র বালি-পাথরের বাঁধ। আজকের এই শীত শীত সকালে মনটা খুব বিষণ্ণ, একেবারেই অফিস যেতে মন চাচ্ছে না।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। তাদের মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা-বাবার এই টানাপোড়নে শিশু রন্তুর মানসিক জগতের গল্প, সাথে তার নিত্যদিনকার প্যাচালি, এই হল এই গল্পের উপজীব্য। গত এক বছর হল জাভেদ, রন্তুর বাবা রন্তুকে স্কুলের গেটে মাসে এক-দুইবার দেখা করতে আসে। এখন রন্তু’র ক্লাস টু এর ফাইনাল এক্সাম চলছে। গত পর্বে জাভেদ ছেলেকে দেখতে এসেছিল, তার কথাবার্তা আর আচরণে মনে হয়েছে সে শেষবারের মত ছেলেকে দেখতে এসেছে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
শুরুতে ইরফানের সাথে সহকর্মী হিসেবে জাস্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সৌহার্দ ছাড়া আর কিছু ছিলনা। শায়লা কোম্পানি এমডি’র পার্সোনাল এসিস্ট্যাণ্ট হওয়ায়, তার সাথে অফিসের সকল ডিপার্টমেন্টের উপরের দিককার পদস্থদের সাথে পরিচয় হতে থাকে। ইরফান হল ফাইন্যান্সের জিএম। আইবিএ থেকে ফাইন্যান্সে বিবিএ-এমবিএ করে লন্ডন থেকে সিএফএ করে এসেছে। এতো মেধাবী এবং ব্রিলিয়াণ্ট একটা লোক, কিন্তু তার আচার ব্যাবহার দেখে কেউ আঁচ করতে পারবে না। যেমন মিশুক, তেমনি মন খোলা আমুদে মানুষ। কখনো কখনো তার ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভ লেভেলের কারো ডেস্কে বসে তাকে খোশ গল্প করতে পর্যন্ত দেখা যায়। আর তার সাথে প্রকৃতি প্রদত্ত পুরুষালী সৌন্দর্য তাকে করেছে হাজারের ভিড়ে আলাদা একজনে।
ফাইন্যান্সের কাজে ইরফানকে প্রায় রোজ দিনই বারে বারে এমডি স্যারের রুমে আসা যাওয়া করতে হয়। কখনো তার নিজের প্রয়োজনে, কখনো এমডি স্যার ডেকে পাঠায়। আর এই নিত্যদিনকার অফিসিয়াল কর্মব্যাস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ইরফানের সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে শায়লার। জবে ঢোকার আগে অফিসিয়াল পিএ’র জব নিয়ে নানান ভয়াবহ কাহিনী নানান জনের কাছে শুনেছিল সে। কিন্তু এই অফিসের পরিবেশ একেবারেই ব্যাতিক্রম। যাই হোক বন্ধুত্ব'র সম্পর্ক গাঢ় হতে হতে কখন যে অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করলো, শায়লা বুঝতে পারে নাই। গতকাল ইরফান তাকে প্রপোজ করে বসেছে, শায়লা কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে বাসায় চলে এসেছে। সেই থেকে শায়লার মনোজগৎ যেন এক আজব কুয়াশার ন্যায় ঘোলাটে ঘোরের মাঝে ডুবে আছে।
শায়লা খাটের এক প্রান্তে বসে ছেলেকে দেখছে। রন্তু বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে বই পড়ছে। ছেলেটার বার্ষিক পরীক্ষা চলছে, কিন্তু পড়া শোনায় এতটুকু মনোযোগ নাই। জোর করে ধরে ধরে পড়তে বসাতে হয়। পড়তে বসলে আধঘণ্টা-একঘণ্টায় তার সব পড়া শেষ। এতো ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন ছেলেটা! কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট খুব একটা খারাপ করছে তা নয়, বরং আশানুরুপ। কিন্তু এখন থেকে পড়াশোনায় মনোযোগী না হলে উপরের ক্লাসে উঠার পর তার এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে, পড়াশোনার লোডের সাথে টাইমিং এর সামঞ্জস্য করতে হিমশিম খাবে। কিন্তু এতোটুকুন ছেলে কি আর এতসব বুঝে। রন্তু’র দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শায়লা চোখ ভিজে উঠে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, বড্ড বেশী অসহায়।
মা উঠে রান্না ঘরের দিকে যেতেই রন্তু হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আজ কোন এক্সাম নেই, মাঝখানে একদিনের এই গ্যাপ যে কেন দেয় এক্সামগুলোতে রন্তু ভেবে পায় না। আজ সারাদিন নানুর ঘ্যানর ঘ্যানর শুনতে হবে, ‘রন্তু পড়, কাল এক্সাম’। রন্তু অবশ্য একটা বুদ্ধি বের করেছে, ছোট মামাকে সে তার দলে টেনেছে। ছোট মামার কাছে পড়া বুঝতে যাচ্ছে নানুকে এই বলে সে দশটার দিকে চলে যাবে ছোট মামার চিলেকোঠার ঘরটায়। মামা পড়া ধরবে, রন্তু সব পটাপট উত্তর দিতে পারলে মামার সাথে দাবা খেলা যাবে। রন্তু ঘড়ির দিকে তাকালো, এখন সকাল আটটা, মা নয়টার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। তারপরও আরও একঘণ্টা বই সামনে নিয়ে বসে থাকা... উফ!
রন্তুর খুব ইচ্ছা করছে বাইনোকুলারটা নিয়ে ছাঁদে যেতে। গত সপ্তাহে বাবা তার ম্যাথ এক্সামের দিন স্কুল গেটে দেখা করতে এসে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেড় হয়। কথা ছিল তারা শিশু পার্ক যাবে, কিন্তু হঠাৎ করেই বাবা ডিসিশন চেঞ্জ করে কি মনে করে রিকশা ঘুড়িয়ে তাকে নিয়ে গেল নিউমার্কেট। সেখান থেকে এই বাইনোকুলারটা তাকে কিনে দিয়েছে। বাইনোকুলারটা রন্তুর খুব পছন্দ হয়েছে, খুব দূরের সব জিনিষই কত বড় হয়ে কাছে চলে আসে। রন্তু বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা রাতের বেলা কি তারাগুলোও এটা দিয়ে দেখা যাবে?’। বাবা বলেছে না, তারা দেখতে টেলিস্কোপ লাগে। রন্তু একবার ভাবলো বাবাকে বলে, টেলিস্কোপ কিনে দাও তাহলে। কিন্তু তা কি আর রন্তু বলতে পারে? বাবা দেখা করতে আসলে রন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, খুব ভালো লাগে, খুব... কিন্তু কেমন এক জড়তাও কাজ করে। বাবাকে মনে হয় অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খুব কাছের কোন একটা মানুষ।
ছোট মামা বাইনোকুলারটা খুব পছন্দ করেছে, মজা করে বলেছে আমাকে তুই এইটা দিয়ে দিলে আমি রোজ তোর কাছে দাবা খেলায় হেরে যাবো। মামাটা যে কি সব বলে না। তবে মজার কথা হল, মামা প্রমিজ করেছে রন্তুর এক্সাম শেষ হলে তাকে স্টেডিয়াম নিয়ে যাবে, বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখাতে। তখন নাকি খুব কাজে দিবে বাইনোকুলারটা। মামা অবশ্য আরও একটা কথা বলেছে, সেটা গোপন রাখতে হবে, কাউকে বলা যাবে না। এই বাইনোকুলার নিয়ে মামা কোথায় যেন পাখি দেখতে যাবে, কোন মতেই নানু যেন না জানতে পারে। রন্তু প্রমিজ করেছে, আর রন্তু’র প্রমিজ মানে...প্রমিজ।
=====================
'রন্তু'র কালো আকাশ' প্রথমে একটি এক পর্বের ছোট গল্প আকারে লিখেছিলাম। কিন্তু 'রন্তু' আমার খুব প্রিয় একটি চরিত্র বিধায় আমি সিদ্ধান্ত নিই ২৫ পর্বের একটি ধারাবাহিক আকারে উপন্যাস লিখবো (যদিও জানি সে যোগ্যতা আমার নেই, তারপরও অপচেষ্টা আরকি)। সেই থেকে এই লেখা। তবে প্রতিটি পর্ব আমি এমনভাবে লেখার চেষ্টা করছি যেন একেকটা পর্বই একটা ছোট গল্প হিসেবে পাঠক পড়তে পারে। গত জুলাই মাসে শেষ পর্ব-৪ লিখেছিলাম। এরপর অনেক লম্বা বিরতি পড়ে গেল। তাই নতুন করে শুরু করা, পর্ব-৫ সহ একসাথে পাঁচ পর্ব দিয়ে পোস্ট করে পুনরায় পথ চলা শুরু করে আজ পব-৭ নিয়ে হাজির হলাম। চেষ্টা থাকবে প্রতি তিনদিন বিরতি দিয়ে এই ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে এগিয়ে নেয়ার। একজন পাঠক হিসেবে আপনাদের পাশে পাবো আশা রাখি। রন্তু আমার খুব প্রিয় একটা চরিত্র, আর তাই আমি এই উপন্যাস শেষ করবোই এমনটাই ইচ্ছা, যদি আপনাদের সাথে পাই, আর তা সম্ভবত ২৫ পর্বে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৫