"রন্তু'র কালো আকাশ" সব পর্ব
কুয়াশাভেদ করে গুচ্ছ গুচ্ছ সূর্যকিরণ ছাদের উপর এসে পড়ছে, আকাশে লম্বা লম্বা ইয়া মোটা মোটা আলোর রেখাগুলো অদ্ভুত এক নকশা তৈরি করছে। রন্তু অনেকক্ষণ ধরে এই রোদের খেলা দেখতে লাগলো। ছাদের শেষ মাথায় টাঙানো বাংলাদেশের পতাকাখানি কেমন নেতিয়ে আছে, দূর থেকে ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। রন্তু বুঝতে পারলো সারারাতের কুয়াশায় ভিজে নেতিয়ে আছে পতাকাটি। গত পরশু বিজয় দিবস ছিল। তার আগের রাতে রন্তু তার ছোট মামার সাথে কি মজা করে রাতের বেলা ছাদে পতাকা সাজিয়েছে। পাটের চিকন দড়িতে ছোট ছোট লাল-সবুজের পতাকা একটা একটা করে আটকে দিয়ে পতাকার মালা বানিয়ে সারা ছাদজুড়ে সাজিয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত। মা-নানু দুজনেই ছাদে এসেছিল রাতের বেলা। সবচেয়ে মজার কথা রাতের বেলা রন্তু ছাদে থাকার জন্য কোন বকাঝকা খায় নাই দুজনের কারো কাছ থেকে। ইস... রোজ রোজ কেন এমন হয় না। আজ সকাল বেলা ছাদে এসে বার বার তার এই কথাই মনে হচ্ছিল।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু, শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। অপর দিকে রন্তুর মা শায়লা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে, যেখানে তার এক সিনিয়র পোস্টের সহকর্মী’র সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে প্রণয়ের দিকে, যার ইঙ্গিত গত পর্বে পাঠকরা পেয়েছেন। আর পিতামাতা’র সম্পর্কের এই টানাপোড়নে পড়ে কেমন চলছে আমাদের রন্তুর জগত তা জানার জন্য আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
ভাল জিনিসগুলো সবসময় হুট করে শেষ হয়ে যায়, যেমন হাওয়াই মিঠাই। রন্তুর খুব প্রিয় ছিল হাওয়াই মিঠাই, কিন্তু এখন সে আর ওটা পছন্দ করে না। হুট করেই মজা শেষ হয়ে যায়। রন্তুর জীবনে আনন্দ অনেক কম বলেই কিনা জানা যায় না, সে ক্ষণস্থায়ী কোন আনন্দে আগ্রহ পায় না এই ছোট বয়সেই। ছয় পেরিয়ে সাতে পড়তে যাওয়া রন্তু কীভাবে যেন এই বয়সেই অদ্ভুত এক মানসিক জগত নিয়ে বড় হচ্ছে। ছোট শিশু মনে এগুলো ধরা না দিলেও তার কেমন নীরবতা’র প্রতি অদ্ভুত একটা টান তৈরি হয়েছে। আর আট দশটা ছেলেমেয়ের মত শিশুসুলভ চাঞ্চল্য তার মাঝে খুঁজে পাওয়া ভার। আজ এই সকালের প্রথম লগ্নে খোলা ছাদে কুয়াশার চাদরের নীচে দাঁড়ানো রন্তু’র ভাবনাগুলো একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অতি অল্প বয়সেই কেমন অদ্ভুত এক পরিপক্ক মনোজগৎ গড়ে উঠেছে তার মাঝে।
রন্তু ধীর পায়ে পতাকা যে বাঁশটিতে টাঙানো হয়েছে তার নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। তার ছোট্ট হাত দিয়ে বাঁশটিকে নাড়াচাড়া করে ভিজে নেতিয়ে পড়া পতাকাটিকে বাতাসে উড়ানোর চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। শেষে ব্যর্থ হয়ে ছাদের পাঁচিল এর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চোখ দিল, এখনো মানুষজনের তেমন আনাগোনা আরম্ভ হয় নাই। ফাঁকা রাস্তা, নেতিয়ে পড়া পতাকা, বিজয় দিবসের উৎসবমুখর সময় শেষে আজকের সকালবেলার এই মনখারাপ করা সকালবেলা... সবকিছু মিলে রন্তু’র কেন যেন খুব মন খারাপ হল; সাথে খুব কান্না পেল। আর আজব করা ব্যাপার হল কান্না পেলেই রন্তুর ইদানীং খুব বাবার কথা মনে হয়। কেন এতো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে? সেদিন মা খাটে শুয়ে গল্প করতে করতে কি কারনে যেন হঠাৎ করেই রন্তুকে জিজ্ঞাসা করল তার কাকে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে? রন্তু কিছুই না ভেবে অকপটে বলে বসল, ‘বাবাকে...’। কিন্তু কথাটা বলেই মনে হল এই উত্তরে মা খুশী হয় নাই, কষ্ট পেয়েছে। রন্তুর তখন খুব মন খারাপ হয়েছিল, রন্তু মা’কে খুব ভালবাসে, খুব। কখনো মা’কে বুঝতে দেয় না। মা বাসায় থাকলে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ নাকে আসে রন্তুর, রন্তু এই ঘ্রাণের নাম দিয়েছে ‘মা ঘ্রাণ’। এই পৃথিবীতে রন্তু সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে তার মা’কে। কিন্তু সেদিন মা কেন তার উপর অখুশী হল রন্তু ভেবে পায় না। তার বাবা’কে খুব ভালো লাগে এটা কি দোষের? বাবা মানুষটা কেমন অদ্ভুত! রন্তুর কাছে সিনেমার কোন নায়কের মত মনে হয়। মাঝে মাঝে যার দেখা পাওয়া যায় তার স্কুল গেটে। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে, রাগী রাগী কণ্ঠে কথা বলে। রন্তুর কিন্তু বাবার সেই রাগী রাগী কণ্ঠস্বর শুনে খুব হাসি পায়, কিন্তু সে হাসি চেপে রাখে অনেক কষ্টে। সে এই হাসি চেপে রাখার একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। তা হল দাঁত দিয়ে জিহবা চেপে রাখা। আর এটা করতে গিয়ে সে বাবা’র সাথে দেখা হওয়ার সময়টায় প্রায় কথাই বলতে পারে না। বাব খুব রেগে যায় সে কোন প্রশ্নের উত্তর না দিলে, তখন রন্তু খুব ভয় পেয়ে যায়। সেই রাগী বাবাকে রন্তুর খুব অচেনা মনে হয়, খুব অচেনা।
কিছুক্ষণ ছাদে মুখ গোমড়া করে ঘোরাঘুরি করে নীচে নেমে এল রন্তু। মা আজ অফিস যায় নাই, খাটে লেপের তলায় শুয়ে আছে, চোখ খোলা, ঘরের সাদা দেয়ালে কি যেন একমনে দেখে আছে। রন্তু চুপটি করে গিয়ে মায়ের পাশে বসল।
‘কিরে? এখনতো স্কুল নেই, রোজ সকাল সকাল উঠে যাস যে... ঘুম ভেঙ্গে যায় বুঝি?’
‘হুমম’
‘অভ্যাস... সবই অভ্যাস’ বলে মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। রন্তু মা’কে ইদানীং বুঝতে পারে না, কেমন অচেনা মনে হয়। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কেমন মুড বলতে যায়। রন্তু’র ছোট মন আর মস্তিস্ক এই পরিবর্তন ধরতে পারে না। রন্তু’র মা শায়লা, এক অদ্ভুত মানসিক দ্বিধা’র মধ্যে রয়েছে। দিন দিন সে অফিসের ফাইন্যান্সের জিএম, ইরফানের সাথে তার সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে এগিয়ে অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে। কিন্তু শায়লার মনে হয় তার কিছুই করার নেই, অজানা এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে টেনে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের দিকে প্রতিদিন হু হু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোন প্রতিরোধ করার শক্তি যেন তার নেই, নিয়তির লিখন যেন লিখে চলেছে শায়লার জীবনগাঁথা। সেই কৈশোর পেড়িয়ে তরুণী হওয়ার সময়টায় প্রেম করে পারাবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেছিল জাভেদকে। কত ভালবাসার সেই সম্পর্ক! কিভাবে সব বদলে গেল? বদলে গেল জাভেদ, বদলে গেল সে নিজেও... বদলে গেল তাদের জীবনটাই। মাঝে মাঝে শায়লা ভাবে কি স্বপ্ন একেছিল আর কি বাস্তবে হয়ে গেল। কোথায় কতদূর চলে গেছে জাভেদ আর সেই সাথে তাদের সেই ভালবাসা; শুধু চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে তাদের সন্তান রন্তু। শায়লা’র খুব কষ্ট লাগে তার ছয় বছরের ছোট্ট ছেলে রন্তুর জন্য। তাদের দুইজনের ভুলের কি চরম মাশুল এই শিশু রন্তুকে দিতে হচ্ছে। এই অপরাধবোধ শায়লা প্রতিদিনই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, আর সেই অনুতপ্ত ক্ষণগুলোতে খুব কষ্ট হয় শায়লার। আজ এই সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গেই খুব মন খারাপ হয়ে গেল। গতকাল ইরফান তাকে স্পেশাল লাঞ্চের দাওয়াত দিল, খুব নামকরা এক রেস্টুরেন্টে। আজ দুপুরে তাদের সেখানে খাওয়ার কথা, শুধু শায়লা আর ইরফান, ইরফান বলল স্পেশাল ট্রিট, তার পক্ষ থেকে শায়লাকে। শায়লা’র কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল, সে বুঝতে পারছিল বিশেষ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আগামীকাল দুপুরে। আর তাই আজ ঘুম ভাঙ্গতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ অফিস যাচ্ছে না। অসুস্থতার কথা বলে দিবে অফিসে ফোন করে। সে জানে ইরফান খুব অবাক হবে, কষ্ট পাবে, কিন্তু শায়লা ভেবে পাচ্ছে না সে কি করবে? চোখ জ্বালা করে অশ্রু’র দল উঁকি দিচ্ছে। এইসময় ছেলে এসে তার সামনে বসায় তার কষ্ট যেন আরও বহুগুন বেড়ে গেলে। ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো শায়লা। রন্তু মায়ের কাছ থেকে হঠাৎ পাওয়া বাড়তি আদর উপভোগ করতে লাগলো মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে। সকালবেলার মন খারাপ ভাবটা হুট করেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল, মনটা খুব ভাল হয়ে উঠল। শুধু একটা আক্ষেপ শিশু মনে জেগে রইল... এখন যদি পাশে বাবাও থাকতো, তবে কি ভালই না হত। রন্তু মনে মনে বলল, ‘এই যে বাবা, তুমি কি শুনছো? প্লিজ রাগ না করে চলে আস না এখানে... প্লিজ... প্লিজ... প্লিজ...’
[ 'রন্তু'র কালো আকাশ' প্রথমে একটি এক পর্বের ছোট গল্প আকারে লিখেছিলাম। কিন্তু 'রন্তু' আমার খুব প্রিয় একটি চরিত্র বিধায় আমি সিদ্ধান্ত নিই ২৫ পর্বের একটি ধারাবাহিক আকারে উপন্যাস লিখবো (যদিও জানি সে যোগ্যতা আমার নেই, তারপরও অপচেষ্টা আরকি)। সেই থেকে এই লেখা। তবে প্রতিটি পর্ব আমি এমনভাবে লেখার চেষ্টা করছি যেন একেকটা পর্বই একটা ছোট গল্প হিসেবে পাঠক পড়তে পারে। গত জুলাই মাসে শেষ পর্ব-৪ লিখেছিলাম। এরপর অনেক লম্বা বিরতি পড়ে গেল। এরপর পর্ব-৫ সহ একসাথে পাঁচ পর্ব দিয়ে পোস্ট করলাম গত সেপ্টেম্বর মাসে; তারপর আরও দুটি পর্ব ৬ এবং৭ লিখে আবার লম্বা বিরতি পড়ল। আসলে আমি নিজেই শিওর না কোন ধারাবাহিক গল্প লেখার যোগ্যতা আমার আছে কি না তা নিয়ে। আসলে আমি কোন গল্পকার নই, তারপরও নিজেকে গল্পকার হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে। আর তাই মাঝে মাঝে গল্প লেখার এমন অপপ্রয়াস ঘটাই। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে বিরতি দিয়ে এই ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। একজন পাঠক হিসেবে আপনাদের পাশে পাবো এই আশা রাখি। রন্তু আমার খুব প্রিয় একটা চরিত্র, আর তাই আমি এই উপন্যাস শেষ করবোই, আর তা সম্ভবত ২৫ পর্বে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ]
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৩১