somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩)

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা০২)

মেলা জিনিষটা আমার একেবারেই অপছন্দের একটা বিষয়। বানিজ্য মেলা, বই মেলা, বৈশাখী মেলা, বস্ত্র মেলা, কম্পিউটার মেলা, লালন মেলা... কত যে মেলা!!! এইসব মেলা’র আয়োজন দেখলে আমার মনে হয় অহেতুক অর্থ আর সময়ের অপচয়। মানুষ এই দুটো নষ্ট করে মেলা’য় ঘুরে বেড়ায়। আমি ছোট বেলায় হয়ত মেলায় গিয়েছি, কিন্তু বড় হয়ে মেলায় যাওয়া হয় না। কিন্তু এবার খুব আগ্রহ নিয়ে আমি বইমেলার জন্য অপেক্ষায় আছি। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে, মহারাণী বইমেলা’য় ঘুরে ঘুরে বই কিনে সারা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। তার সাথে ফেব্রুয়ারি মাসে আছে অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি... আহ এগুলোর মাঝে আমি আর মহারাণী।

তো জানুয়ারি মাস খুব আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে কাটিয়ে দিলাম আগত সুখ সময়ের কথা ভেবে। কিন্তু বইমেলার প্রথম দিনই আমার স্বপ্নভঙ্গ হল, মহারাণী’কে বইমেলায় যাওয়ার কথা বলতেই সে কপালে ভাঁজ তুলে বলল, “বইমেলায় যাব বই কিনতে, তো তুমি সাথে যাবে কি কারণে? তুমি কি মাস্টার মশাই নাকি? হাতে সিলেবাস নিয়ে ঘুরবে?”

আমি ধাক্কা সামলে নিয়ে বললাম, ‘উহু, আমি তোমার কেনা বইগুলোর ব্যাগ বহন করব, বলতে পারো তোমার সেবক হিসেবে বইমেলায় তোমার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াবো’

‘বইয়ের ব্যাগ বহন করবে? মানে কুলিগিরি? তাহলে এক কাজ কর না কেন, কমলাপুর অথবা সদরঘাট চলে যাও, সেখানে গিয়ে মানুষের ব্যাগ বহন করে বেড়াও... তাতে কিছু পয়সা পাবে।’

মুখের অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন না এনে কথাগুলো বলল মহারাণী। আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এটাকে সিরিয়াসলি নিব, নাকি ফান হিসেবে, নাকি মহারাণীর রাগ হিসেবে? আমাকে আরও অপদস্ত করতেই কিনা জানি না, মহারাণী আমায় বলল, ‘শোন আমি এখন বইমেলায় যাব, কিছু বই কিনতে হবে। খবরদার তুমি যেন পিছু পিছু না আস। আর হ্যাঁ, তুমি কখনোই বইমেলায় ঢুকবে না, এটা আমার অর্ডার।’

‘ওমা কেন? আমি বইমেলা’য় গেলে সমস্যা কি?’

‘সমস্যা আছে...’

‘ধুর, কি সমস্যা বলবা তো’

‘কেন, গত মাসে বানিজ্যমেলা’র কথা উঠতেই তুমি বলছ না... তুমি মেলা-টেলা একেবারেই পছন্দ কর না’

‘বলছি নাকি? হবে হয়ত’ আমি ধরা খেয়ে একটু অভিনয়ের আশ্রয় নিলাম। গতমাসে মহারাণী বানিজ্যমেলায় যেতে চাইলে আমি এই কথা বলে এড়িয়ে গেছি, ও তখন কিছু বলে নাই, কিন্তু মনে রেখেছে। এখন সেটা’র প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমি বসে বসে মহারাণীর চলে যাওয়া দেখলাম।

===========================================

হরতালের দিনে দোকানপাট তেমন খুলবে কিনা এই দ্বিধা নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম, বহুদিন তেমন শপিং করা হয় না। শেষ কবে ঘটা করে শপিং করতে বের হয়েছি বলতে পারবো না। আজ বের হতে হচ্ছে, তাও টানা তিনদিনের হরতাল মাথায় নিয়ে। তিনদিন পর পহেলা ফাল্গুন, মহারাণী অবশেষে আমায় বইমেলায় প্রবেশের প্রবেশাধিকার দিয়েছে, তবে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী, সাথে সাদা রঙের পায়জামা এবং কোলাপুরি চপ্পল থাকতে হবে পায়ে। কি মহা যন্ত্রণা!

বন্ধু সফিক’কে ফোন করে এগুলো প্রাপ্তির সম্ভাব্য জায়গা জেনে নিয়েছি। কাল রাতে টিউশনির টাকাটাও হাতে এসেছে, ঝামেলা করল মাঝখানে এই বেরসিক হরতাল। এখন এই টানা তিনদিন যদি কোন দোকান না খুলে তাহলে কি হবে? এই ভাবতে ভাবতে আমি নিউমার্কেটে’র দিকে রওনা হলাম একটা রিকশা নিয়ে। ওমা সব দোকানপাট খোলা, তবে প্রায় দোকানেই অর্ধেক সাটার নামানো, কিন্তু মার্কেটের ভেতরের দিকে সব দোকান পুরোই খোলা। আমি নিউমার্কেটে খোঁজ করে কোলাপুরি চপ্পল কিনে নিলাম। এবার যেতে হবে সায়েন্সল্যাব, পাঞ্জাবী আর পায়জামা’র জন্য।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সায়েন্সল্যাবে পাঞ্জাবী খুঁজে বেড়ালাম, কোথাও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পাওয়া গেল না। কয়েক দোকানদার দেখলাম গেরুয়া রঙের নামই শোনে নাই!!! শেষে এক দোকানদার বুদ্ধি দিল মৌচাক চলে যেতে, সেখানে পেতে পারি। এভাবে আমি সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিকেলে পৌঁছলাম গুলিস্তান পীর ইয়েমেনি মার্কেটে। সেখানে এক দোকানদার আমায় ভাল বুদ্ধি দিল, বলল, ‘ভাই আপনি কোথাও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী খুঁজে পাবেন না। তারচেয়ে বরং ইসলামপুর থেকে গেরুয়া রঙের কাপড় কিনে পাঞ্জাবী বানিয়ে নেন’। আমারও মনে ধরল কথাটা, চলে গেলাম ইসলামপুর। খুঁজে পেতে পাওয়া গেল গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী'র কাপড়। প্রয়োজনীয় কাপড় কিনে নিয়ে এবার টেইলার্স খুঁজতে আবার রওনা দিলাম রমনা ভবন, গুলিস্তানে।

গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের সামনে দিয়ে হাঁটছি আর হাতের গেরুয়া রঙের কাপড়ের পিসের দিকে তাকিয়ে ভাবছি তিনদিন পরে বইমেলা চত্বরে এই কাপড়ের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মহারাণীর সাথে ঘুরে বেড়ানো’র সম্ভাব্য স্মৃতিকথা। কিন্তু বিধিবাম। রমনা ভবন গিয়ে শুনি কোন টেইলার্সই এক সপ্তাহের আগে পাঞ্জাবী বানিয়ে দিতে পারবে না। আমি পড়লাম মহাসমুদ্রে, এখন আমার কি হবে। হাতে সময় তিনদিন, কীভাবে এই তিনদিনে পাঞ্জাবী বানাবো? একজনের পরামর্শে হাঁটা শুরু করলাম চকবাজারের দিকে, সেখানে নাকি বেশ কিছু পাঞ্জাবী বানানোর দোকান আছে।

মিনিট পাঁচেক হেঁটে বঙ্গবাজারের দিকে এগুতেই কোথা থেকে টপাটপ তিন চারটা ককটেল বোমা এসে রাস্তায় প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হতেই শুরু হল লোকজনের দৌড়াদৌড়ি। আমিও দিলাম ছুট, ছুটে গিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পাশের ফুটপাতে উঠতেই দেখি আমার গেরুয়া কাপড়ে গাঢ় লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ। হায় হায় একি? হঠাৎ করে বাম হাতের কুনইয়ে ব্যাথা অনুভব করলাম, চেয়ে দেখি সেখান থেকে চামড়া ছড়ে গিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। আমি ভেবে পেলাম না কেম্নে কি? আমার হাত কাটলো কীভাবে? আর কাটলোও যদি, তো রক্ত গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী’র গায়ে লাগল কীভাবে?

=========================================

আমি কখন, কীভাবে হাসপাতালে এলাম বলতে পারবো না। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যেতে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি। চারদিকে চোখ মেলে দেখতে গিয়ে দেখি পাশে মহারাণী বসে আছে, তার চোখ লাল। কেঁদেছে নাকি মেয়েটা? উফ... নড়তে গিয়ে দেখি পায়ে ব্যাথা করছে, পায়ে রানের কাছে হাত দিয়ে বুঝলাম ব্যান্ডেজ করেছে। কীভাবে আমি এতো আঘাত পেলাম বুঝতে পারছি না। বোমা ফাটার পর দৌড় দিলাম, তারপর সেই রক্তে ভেজা গেরুয়া কাপড়... কিছুই বুঝতে পারলাম না।

‘এখন কেমন লাগছে? ব্যাথা করছে খুব?’ মহারাণী মায়া ভরা আদ্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘নাহ, তেমন কিছু না।’

‘তুমি এই হরতালের মধ্যে গুলিস্তান কি কাজে গেলে?’ মহারাণী কান্না কান্না সুরে বলল।

‘গেরুয়া পাঞ্জাবী... ’ বলতেই আমার মনে পড়ল আমার পাঞ্জাবীর কাপড় আর পহেলা ফাল্গুনে মহারাণীর সাথে বইমেলায় ঘুরে বেড়ানোর কথা। ছলছল চোখে মহারাণীর দিকে চেয়ে দেখতে দেখি বিরক্তি এবং গম্ভীর মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে।

‘আচ্ছা তোমার মাথায় কি এতটুকু ঘিলু নাই? তুমি ঠাট্টা আর সিরিয়াস কথা আলাদা করতে পারো না?’

‘বুঝি নাই, আমি আবার কি করলাম?’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্নটা মহারাণীর উদ্দেশ্যে করলাম।

‘আমি তোমায় গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী’র কথাটা এমনি এমনি বলেছি, আর তুমি সত্যি মনে করে ছুটলে গেরুয়া পাঞ্জাবী বানাতে। তুমি এতো কিছু বুঝো, আর এই ফাজলামোটুকু বুঝতে পারলে না’

মহারাণীর মায়াবী হরিণ চোখে মুক্তো’র দোলা দেখলাম ছলছল করছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে জানাল দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আহ, জীবনটা এতো সুন্দর কেন? কতক্ষণ বাহির পানে চেয়ে ছিলাম জানি না, মহারাণীর কোথায় সম্বিত ফিরে পেলাম, ‘তুমি যদি ঐ গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পরে পহেলা ফাল্গুনে আমার সাথে দেখা করতে, তবে তোমার খবর ছিল। ইহজীবনে আমার আর দেখা পেতে না’

আহা রঙ, আহারে জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৩
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×