ব্যাথায় রন্তু কুঁকড়ে উঠলো, হাঁটুর কাছটায় চামড়া ছড়ে গিয়ে হালকা রক্ত বেড়িয়েছে। রন্তু দৌড়চ্ছিল ঠিকই, কিন্তু কিসে যেন পা একটু আটকে গিয়ে মনে হল পেছন থেকে জোরে কেউ ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। ভারসম্য হারিয়ে প্রায় তিনচারটা ডিগবাজী মত খাবার পর সে স্থির হল। প্রথমে ব্যাথার চেয়ে লজ্জা পাচ্ছিল বেশী, ব্যাথার তীব্রতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি হওয়ার পরপরই তার চোখ মুখ কুঁকড়ে উঠলো। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে, রন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তার পা’টা না আবার ভেঙ্গে গেল, সে এই ভাঙ্গাটাঙ্গা খুব ভয় পায়। বছর খানেক আগে ছোট মামার পা ভেঙ্গেছিল, উফ... কি যে ভীষণ কষ্ট। রন্তু ভয়ে কেঁদে দিল। তার কান্না দেখে গেম টিচার ছুটে এল তার কাছে।
‘এই রন্তু, খুব বেশী ব্যাথা পেয়েছিস’
রন্তু মাথা নেড়ে জানালো হ্যাঁ।
‘ইস... চামড়া ছড়ে গেছে দেখি। দৌড়তে গিয়ে পড়ে গেলি কীভাবে?’
‘ম্যাডাম কে যেন পেছন থেকে মনে হল ধাক্কা দিয়েছিল’
‘আবার মিথ্যা কথা বলিস, গাধা কোথাকার। সবার শেষে ছিলি তুই, তোকে আবার কে ধাক্কা দিবে? আমিতো ভালো মতই সব দেখছিলাম।’
রন্তু কোন কথা বলল না, চুপচাপ চোখের জল ফেলতে লাগলো।
‘নে উঠে দাঁড়া এবার’
‘ম্যাডাম পারবো না, আমার পা ভেঙ্গে গেছে’
‘মানে! পা ভাঙলো কীভাবে? তুই দাঁড়া দেখি।’ ম্যাডাম হাত ধরে রন্তুকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। রন্তু দাঁড়িয়ে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার পর দেখল সে ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে।
‘এই তো হাঁটতে পারছিস, পা ভাঙল কোথায়? ভীতুর ডিম কোথাকার, কিছু হলেই ভ্যা করে শুধু কান্না আসে?’
রন্তু কোন কথা বলল না, চুপচাপ হেঁটে হেঁটে মাঠের কিনারের দিককার ছাতিম গাছটার নীচে এসে বসল। সে নিজে কিন্তু কোন খেলায় অংশ নিতে চায় নাই। এইসব দৌড়ঝাঁপ তার ভালো লাগে না, কিন্তু বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তাকে অংশগ্রহণ করতেই হবে। এমনটাই নাকি নিয়ম, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয়। তাই গেম টিচার জোর করে তার নাম দৌড় প্রতিযোগিতায় দিয়ে দিয়েছে। রন্তুর এসব খেলা মোটেও ভালো লাগে না, তার ভালো লাগে গান, কবিতা, গল্প বলা এসব। রন্তু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল সবকয়টায় নাম দেয়ার, কিন্তু একজন নাকি তিনটার বেশী বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাই সে কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা আর গল্প লেখা এই তিনটায় নাম দিয়েছে। আজ সকালে সে তার নিজের লেখা গল্পটা জমা দিয়েছে। রন্তু, মা আর বাবা, এই তিনজনকে নিয়ে একটা গল্প, যেখানে তারা সবাই মিলে সাগর দেখতে গেছে। সেখানে গিয়ে রন্তু হঠাৎ হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে, তারপর অনেক কষ্টে তার বাবা-মা তাকে খুঁজে পায়। এই নিয়ে লেখা গল্প, রন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে লিখেছে।
আগামী পরশু স্কুল মাঠে মূল অনুষ্ঠান, আজ শেষ দিনের বাছাই চলছিল। রন্তুর ইচ্ছা ছিল যেমন খুশী তেমন সাজো প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেয়ার। এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না, ইচ্ছে হচ্ছে কবিতা, আর ছবি আঁকাটাও বাদ দিয়ে দিতে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। খুব কান্না পাচ্ছে, বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আজ কতদিন হয়ে গেল বাবাকে দেখেনা। কয়মাস? রন্তু হিসেব করে ভাবতে পারছে না। তার খুব কান্না পাচ্ছে, এই কান্নাটা এত্ত পচা না, যখন তখন চোখের কোণে এসে হাজির হয়।
দুইদিন পর, আজ স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। গতকাল সকল স্পোর্টস ইভেন্টের ফাইনাল হয়ে গেছে। আজ রন্তু তার মা শায়লার সাথে স্কুলে এসেছে। আজ রন্তুর দুটো ইভেন্ট রয়েছে, একটা ছবি আঁকা আর একটা হল কবিতা আবৃত্তি। রন্তু এখন বড় হলঘরটায় ছবি আঁকায় ব্যস্ত। এক ঘণ্টা সময়ে একটা বড় আর্ট পেপারে জলরঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকা, রন্তু আঁকছে ‘আমাদের পরিবার’ নামের একটা ছবি। যেখানে একটা পরিবারে একটা ছেলে তার বাবা-মা তিনজন তিনটা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবা মা দুজনই বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আর ছেলেটা একটা ঘরের দরজায় মাথা নিচু করে বসে আছে। রন্তু কি কারণে এই ছবিটা আঁকছে তা হয়ত সে নিজেও জানে না। কিন্তু তার পারিপারিক জটিলতাই তার শিশু মনে এই ছবি এঁকে দিয়েছে।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু, শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। তাদের মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা-বাবার এই টানাপোড়নে শিশু রন্তুর মানসিক জগতের গল্প, সাথে তার নিত্যদিনকার প্যাচালি, এই হল এই গল্পের উপজীব্য। কয়েক মাস আগ পর্যন্ত জাভেদ রন্তুকে স্কুলের গেটে মাসে এক-দুইবার দেখা করতে আসতো, গত মাস দুয়েক আগে শেষবারের মত ছেলেকে দেখতে এসেছে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। অপর দিকে রন্তুর মা শায়লা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে, যেখানে তার এক সিনিয়র পোস্টের সহকর্মী ইরফানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে প্রণয়ের দিকে। ইদানীং রন্তুর মাঝে একটি মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সে বাবা-মা সহ নিজেদের একটি পরিবার খুব মিস করে। আর সেই অপ্রাপ্তি থেকে সে নিজের মনে একা একা এক কাল্পনিক জগতে বিচরন করে। পিতামাতা’র সম্পর্কের এই টানাপোড়নের সাথে তার শিশু মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’য় কেমন চলছে আমাদের রন্তুর জগত তা জানার জন্য আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
শায়লা স্টেজের সামনে অভিভাবকদের জন্য যে চেয়ারপাতা নির্দিষ্ট স্থান আছে সেখানে একেবারে শেষের দিকে একটা চেয়ারে বসে আছে অনেকক্ষণ। আজ সকালবেলাই সে রন্তুর সাথে স্কুলে এসেছে। ছেলেটা গত পরশু দৌড়তে গিয়ে পা ছিলে ফেলেছে, সেই ব্যাথায় রাতে এল জ্বর। ছেলেটার যে কি হল খোদাই জানে, একটু কিছু হলেই জ্বর চলে আসে। আজ বলতে গেলে শায়লা জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে, ছেলেতো আসতেই রাজী না। বলে, ‘আমি এসব কম্পিটিশনে যাব না’। শেষে শায়লার ধমকে রাজী হল, আজ রন্তুর ছবি আঁকা আর কবিতা আবৃত্তি করার কথা। ছবি আঁকা পর্ব শেষ, এখন চলছে কবিতা আবৃত্তি, একটা ছোট মেয়ে স্টেজে কি চমৎকার করে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে... কবিতাটি আবৃত্তি করছে। এক পায়ে কথাটি বলার সময় সে একটা পা উঁচু করে রাখছে, সাথে মুখের অভিব্যক্তি মিলে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ডায়াসে দাঁড়ানো ম্যাডাম রন্তুর নাম ধরে বলতেই শায়লা নড়েচড়ে বসল। গুটি গুটি পায়ে রন্তু স্টেজে এসে দাঁড়াল, মাইক যখন এডজাস্ট করার জন্য টেকনিশিয়ান ব্যস্ত তখন শায়লা চমকে উঠলো। রন্তু’র মাঝে অবিকল জাভেদের প্রতিচ্ছবি, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ঘাড় একটু কাত করে মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছে। ঠিক জাভেদের কপি যেন। শায়লা নির্বাক বসে রইল।
হঠাৎ করে মাইকে চমৎকার একটা কণ্ঠে আবৃত্তি শুরু হতেই শায়লা দেখতে পেল রন্তু কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’।
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।।
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ – ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মাগো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে -
অন্ধকারে দেখা যায় না ভাল।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁ রে রে রে রে’
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে...
এতোটুকু আবৃত্তি করে রন্তু থেমে গেল। শেষের দিকে তার গলা ধরে আসছিল, কান্না জড়ানো কণ্ঠে আবৃত্তি করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল। শায়লা ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন যে শিক্ষক তিনি এগিয়ে গিয়ে রন্তুকে ধরে স্টেজ থেকে নামিয়ে আনলেন। শায়লা গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে একপাশের চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। রন্তু বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল, একসময় একটু ধাতস্ত হয়ে এলে শায়লা তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল? কবিতা কি ভুলে গিয়েছিল? নাকি ভয় পেয়েছিল? রন্তু কোন কথা না বলে শুধু ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিল, না এমন কিছু নয়।
কিন্তু রন্তু যে কথাটা মা’কে বলতে পারে নাই, তা হল... সে যখন কবিতা পাঠ করছিল বারবার তার বাবার কথা মনে হচ্ছিল। চারিদিকে বাবার মুখটা খুঁজতে খুঁজতে কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছিল। আবৃত্তি করতে করতে যখন “এমন সময় ‘হাঁ রে রে রে রে’
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!” এই অংশটা আবৃত্তি করছিল, তখন সে যেন দেখতে পেল বাবা ডাকাতের পোশাক পড়ে রন্তুদের দিকে তলোয়ার উচিয়ে হাঁ রে রে ডাক ছুঁড়ে এগিয়ে আসছিল। রক্তাক্ত চোখের বাবাকে দেখে রন্তুর খুব ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পুরোটা কবিতা পড়তে পড়তে সত্যি বাবা ডাকাতের বেশে এসে রন্তু আর মাকে মেরে ফেলবে। বাবার এই রূপ রন্তুর মনে কেন এল রন্তু নিজেও জানে না। কিন্তু রন্তু বড় ভয় পেয়েছে, তারচেয়ে বড় কথা ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে। এমন কল্পনা রন্তুর মনোজগতে যে ঝড় তুলেছিল তা কেউ জানতে পারবে না, কক্ষনো না।
রন্তু'র কালো আকাশ - ১
রন্তু'র কালো আকাশ - ২
রন্তু'র কালো আকাশ - ৩
রন্তু'র কালো আকাশ - ৪
রন্তুর কালো আকাশ - (১-৫)
রন্তু'র কালো আকাশ - ৬
রন্তু'র কালো আকাশ - ৭
রন্তু'র কালো আকাশ - ৮
রন্তু'র কালো আকাশ - ৯
রন্তু'র কালো আকাশ - ১০
রন্তু'র কালো আকাশ - ১১
রন্তু'র কালো আকাশ - ১২
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৩
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৯