somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিঠির পাতায় হুমায়ুন আহমেদের একগুচ্ছ গল্প শিরোনাম।

১৯ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রিয় কুটুমিয়া,

আজ চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস, আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ ছিল আমাদের সাদা বাড়িতে, এসে ফিরে গেছ তাইনা? কিন্তু মজার ব্যাপার আমরা কেউ বাসায় নেই, এসেছি অচিনপুর, যেন এক যশোহা বৃক্ষের দেশে। তুমি আবার ভেবোনা সবাই গেছে বনে, এটা একটা ছোট ইষ্টিশন, গৌরীপুর জংশন এর কাছে। এখানে আকাশ জোড়া মেঘ, এই মেঘ রৌদ্র ছায়া। যেদিন এখানে এসে পৌঁছলাম দিনের শেষে, অপরাহ্ণ; চারিদকে যেন অন্ধকারের গানঅনন্ত নক্ষত্র বীথি আমাদের পথে আলো দেখিয়ে যাচ্ছে। অপার্থিব এক অনুভূতি, আমি গুণগুণ করে গাইছিলাম বাউলা কে বানাইলো রেতোমাদের এই নগরে মনটা কেমন যেন বসন্ত বিলাপ করছিল, তাইতো গৃহত্যাগী জোছনার আলোয় নিজেকে ভাসাতে আমাদের এই প্রস্থান।

শুভ্র আর মৃণ্ময়ীকেও সাথে এনেছি, যদিও মৃণ্ময়ীর মন খারাপ। কারণ, আজ চিত্রার বিয়ে, চিত্রা হল মৃণ্ময়ীর বান্ধবী, বড়ই একজন মায়াবতী মেয়ে। তার উপর ভুল করে তিথির নীল তোয়ালে নিয়ে এসেছে নিজেরটা ভুলে। এখানে আমাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে সাথে আছেন অন্তরার বাবা। উনার ছেলেটা, নাম হিমু, একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক নিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকে। কাল রাতে দেখি হিমু এবং কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা এখানকার ঘেঁটুপুত্র কমলা’র সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাক্ষণ বুঝি ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে ছেলেটা। আজ সকালে দেখি হিমুর হাতে কয়কেটি নীলপদ্ম, সাথে ছিল তার ছোট বোন ইরিনা, মেয়েটা যেন পেন্সিলে আঁকা পরী, ওর হাতে পুতুল। দুজনেই পড়ে জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে। ওদের দেখে মনে পড়ে যায় আমার ছোট বেলা

গত পরশু আমাদের কেয়ারটেকার আঙ্গুল কাটা জগলু সাথে নিয়ে এল কালো জাদুকর, ম্যাজিক মুন্সি। তোমার ভাবী, নবনী, এই লোককে দেখেই রেগে গেল। জাদু আর দেখা হল না। নীল হাতী চেপে নীল মানুষ নাকি উড়ে যাবে তার মেঘের উপর বাড়িতে, অদ্ভুত জাদু না? গতকাল আসলেন নলিনী বাবু বি.এস.সি. উনি নাকি পোষেন মজার ভূত, শখ করে ডাকেন বোতল ভূত। আমি মজা পাচ্ছি, কিন্তু নবনী এসবে খুব বিরক্ত হচ্ছে, “একি কাণ্ড! এ যে সাক্ষাত বিপদ” বলে ঝেটিয়ে এদের বিদায় করেছে। গম্ভীর স্বরে বলল, “রাবনের দেশে আমি এবং আমরা বেড়াতে চলে এলাম নাকি? কিছুক্ষণ পর হয়ত দেখতে হবে রাক্ষস খোক্ষস এবং ভোক্ষস। আসলে এরকম জায়গায় না বেড়াতে এসে দারুচিনি দ্বীপ গেলেই পারতাম, অথবা রূপালী দ্বীপ”। বলে হাসতে লাগলো, জবাবে আমি কি বলব, মনে মনে বললাম তোমাদের জন্য ভালবাসা আছে বলেই তো একান্ত সময় কাটাতে এই নির্জন নিবাস।

আজ মধ্যাহ্নভোজের পর শুভ্র গেছে বনে , সাথে গেছেন মিসির আলী আর তার পোষা বেড়াল পুফি। এখানে আসার পর থেকে সে মেতে আছে মিসির আলী সাহেবকে নিয়ে, ওর পাল্লায় পড়ে একেবারে বাঘবন্দী মিসির আলী। দুদিন আগে তারা তিনজন একদিন তেতুল বলে জোছনা দেখতে গেল। কি অদ্ভুত প্ল্যান, আসলে মিসির আলী সাহেব একজন শখের ছবি নির্মাতা। এই অজপাড়া গাঁয়ের কেউ এমন ভাবনা নিয়ে বসে আছে চিন্তা করতে পার। উনি যে ছবি বানাতে চান, তার নাম দিয়েছেন “জোছনা ও জননীর গল্প”, এই গল্পের জন্যই নাকি সেই জোছনা দেখতে যাওয়া। অন্যদিন উনার ছবি বানানোর গল্প শোনাবো তোমাকে। উনি আবার একজন ভাব কবি, পায়ের তলায় খড়ম গলিয়ে কাঁচা মাটির উঠোনে প্রিয় পদরেখা এঁকে দেন, লিখে যান হাজারো কবিতা।

চক্ষে আমার তৃষ্ণা, আর তা মেটাতেই বুঝি একদিন দেখি আকাশ জুড়ে বৃষ্টি ও মেঘমালা। আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলাম সেই বৃষ্টিতে বর্ষা বিলাস করে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম দীঘির ধারে, কাককালো জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেকেই জিজ্ঞাসিলাম, “দীঘির জলে কার ছায়া গো?”। আসলে অদ্ভুত এই জীবন, চলে যায় বসন্তের দিন; জল জোছনা আসে চলে যায়, ঝরে যায় কত না অশ্রু জল।

বুঝলে মন চাইছে অনেক কিছু লিখে রাখি, কিন্তু আমার ফাউনটেন পেন আনা হয়নি, লিখছি কাঠপেন্সিল দিয়ে, তুমি কিছু মনে কর না যেন। এই আমি, একা একা বসে ভাবি দিনের শেষে কেউ কোথাও নেই, একেবারে জনমানব শুন্য। আমার ভেতর কে কথা কয়? সে আসে ধীরে, নিয়ে যেতে চায় যেন নন্দিত নরকে। কিন্তু এখনো যে ছুঁয়ে দেখা হয় নাই বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল, উড়ালপঙ্খী চড়ে ঘুরে দেখা হয় নাই উঠান পেড়িয়ে দুই পা ফুটে থাকা নীল অপরাজিতা অথবা দূরের নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ। বাইরে নক্ষত্রের রাত, আমায় ডেকে যায় নিশীথিনী তার আয়নাঘরে, অপেক্ষা আমায় শোনাবে তার প্রেমের গল্প। চলে যাব অন্যভুবন, যখন নামবে আঁধার, গায়ে মেখে লিলুয়া বাতাস। এখন যদিও সন্ধ্যা, কিন্তু মনে হয়ে জনম জনম বসে আছি কৃষ্ণপক্ষ রাতে এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি পাণে চেয়ে। দিনের শেষে চেয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই, তবুও আমার মাঝে এ কে কথা কয়? যেন আমায় নিয়ে যেতে চায় অচিনপুর, শোনাতে চায় অন্ধকারের গান। যেথা হতে আর হবে না ফেরা, পড়ে থাকবে আমার ইপিটাফ, যদিও আমি কোন বাদশাহ নামদার নই। আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই এখনো, চলে যাব যখন নামবে আঁধার, কোন এক অন্যভুবন

থাক এসব মন খারাপের উদাসী কথা। আসছে মাসে তুমি এসো আমার বাড়িতে, সেদিন কেউ ডাকলেও বলে দেব আজ আমি কোথাও যাব না। তুমি কিন্তু আবার খোটা দিও না দেখা হলে এই বলে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। সেদিন তোমাকে শোনাবো আরও অদ্ভুত সব গল্প, সাথে আমার প্রিয় ভৌতিক গল্প, তুমি আবার ভয় পেয়ো না যেন। চাইলে শোনাবো শীত ও অন্যান্য গল্প

ইতি
সৌরভ

=============================================================================

হুমায়ুন আহমেদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ রচিত

=============================================================================
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:৪০
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×