শীত, বর্ষা অথবা শরতের আগমন মানুষ টের পায়, কিন্তু টের পায় না কখন কেমন করে বদলে যায়, হুট করে এক নিমিষেই ছোট্ট এক শিশু থেকে কিশোর অথবা কিশোর থেকে যুবক হয়ে যাওয়া টের পাওয়া যায় না। একদিন হুট করে খেয়াল হয় জীবনটা বদলে গেছে, হুট করেই যেন বয়স বেড়ে গিয়ে অনেক পরিণত হয়ে গেছে সে নিজেই। এমনই এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে সন্ধ্যা শেষের আলো আঁধারির মাঝে রন্তু চুপটি করে বসে আছে ছাঁদের উপর থাকা ছোট মামার চিলে কোঠার ঘরের চৌকাঠের আগে ইটের গড়া তিন ধাপের সিঁড়ির মাঝে। গালের মাঝে এখনো ভেজা ভেজা অনুভূতি, চোখের জল কোনমতেই আর থামতে চায় না যেন।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু, শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। তাদের মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা-বাবার এই টানাপোড়নে শিশু রন্তুর মানসিক জগতের গল্প, সাথে তার নিত্যদিনকার প্যাচালি, এই হল এই গল্পের উপজীব্য। কয়েক মাস আগ পর্যন্ত জাভেদ রন্তুকে স্কুলের গেটে মাসে এক-দুইবার দেখা করতে আসতো, গত মাস ছয়েক আগে শেষবারের মত ছেলেকে দেখতে এসেছে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। অপর দিকে রন্তুর মা শায়লা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে, যেখানে তার এক সিনিয়র পোস্টের সহকর্মী ইরফানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে গড়িয়েছে প্রণয়ের। ইদানীং রন্তুর মাঝে একটি মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সে বাবা-মা সহ নিজেদের একটি পরিবার খুব মিস করে। আর সেই অপ্রাপ্তি থেকে সে নিজের মনে একা একা এক কাল্পনিক জগতে বিচরন করে। এরমাঝে শায়লার প্রবাসী বড়ভাই দেশে এসেছে ছুটিতে। কিছুদিন আগে রন্তু মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিল, ডাক্তাররা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কোন বিপদ ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু বিপদ যখন আসে, চারিদিক দিয়েই আসে। পিতামাতা’র সম্পর্কের এই টানাপোড়নের সাথে তার শিশু মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং পরিবারের মানুষগুলোর মিথস্ক্রিয়া’য় কেমন চলছে আমাদের রন্তুর জগত তা জানার জন্য আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
দুপুরের ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে ছিল রন্তু, স্কুল থেকে আজ ফিরেছে খুব ক্লান্ত হয়ে। অনেক অনেক দিন পর আজ স্কুল মাঠে সহপাঠীদের সাথে ফুটবল খেলে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফিরেই গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিল, খাওয়ার পরপরই রাজ্যের ঘুম যেন দুচোখে একটু ঠাই চাইছিল মনে প্রাণে। কোন এক ফাঁকে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে বুঝতে পারে নাই রন্তু। হঠাৎ করে বড় মামার জোরালো গলার চিৎকারেরে সাথে কোন কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল রন্তুর। ঘুম থেকে উঠে খাটে বসতে বসতে রন্তুর মনে হল সে যেন কোন স্বপ্ন জগতে আছে। বাবার গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উঠোনের ঐখানে। তাহলে কি রন্তুর এতোদিনের স্বপ্ন পূরণ হল। বাবা আবার ফিরে এল তাদের মাঝে? তাহলে বড় মামা এমন করে চিৎকার করছে কেন?
এসব ভাবতে ভাবতে ঘর হতে উঠোনে পা দিতে যে দৃশ্যটি রন্তু দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ছোট মামা বাবাকে ধরে বাসার দরজা হতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে মা আর নানু বড় মামাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বড় মামা রাগে ফুঁসছে আর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালাগাল করছে। বাবার চেহারা দেখে রন্তু প্রথমে চিনতে পারে নাই। চোখ দুটো গর্তে ঢুঁকে পড়েছে, তার নীচে গাঢ় কালচে ছাপ, গালের চোয়াল দেবে গিয়ে কেমন লম্বাটে হয়ে গেছে চেহারাটা। সারা মাথা ভরা চুলগুলো কেমন উশকো-খুসকো, সারা মুখের মাঝে দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। বাবাকে দেখেই রন্তুর চোখে জল চলে এল, তার সাথে বড় মামার বাবার প্রতি মারমুখো আচরণ, ছোট মামার বাবাকে টেনে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, সবকিছু একসাথে যেন রন্তুর হৃদয়টাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। সেই মুহূর্তে বাবা ছাড়া বাসার আর সবাইকে অনেক অনেক পচা মানুষ বলে মনে হল রন্তুর। ঘরে ফিরে এসে কাঁদতে লাগলো হু হু করে।
অনেকটা সময় পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসলে, একসময় রন্তুর মা শায়লা ঘরে এসে দেখতে পায় রন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ছেলে কাঁদতে দেখে শায়লার চোখ জলে ভরে এল, শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ছেলের কাছে এসে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করল,
‘কিরে কাঁদছিস কেন?’
‘জানি না’
‘ঘুম কখন ভাঙলো?’
‘জানি না, যাও তুমি আমার সাথে কথা বলবে না, তোমার কেউ আমার সাথে কথা বলবে না।’ রন্তু চিৎকার করে কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এতো দিন পর বাবা ফিরে এল, আর এরা সবাই মিলে কি না বাবাকে মেরে তাড়িয়ে দিল। সবাই খারাপ, খুব খারাপ।
শায়লা ভেবে পেল না, ছেলেকে কি বলবে; তবে বুঝতে পারলো জাভেদ যখন বাসায় এসেছে তখন কোন একটা সময় রন্তুর ঘুম ভেঙ্গেছে। সে হয়ত বড় ভাইয়ার সেই অগ্নিমূর্তি রূপ দেখেছে, দেখেছে কিভাবে তার বাবাকে বাসা হতে বের করে দিল সবাই। তাই হয়ত সে বলছে, তোমরা সবাই খুব খারাপ।
শায়লা ভেবে পাচ্ছে না কি করে এতো দিন পর, এতো দিন বলা যায় না, এতো বছর পর জাভেদ শায়লার মুখোমুখি হল। দুপুর শেষ হয়ে বিকেলের মিষ্টি আলোতে উঠোনটা আলোকিত হয়ে ছিল, শায়লা সেই মিষ্টি আলোতে হাঁটছিল উঠোনের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে। বেশ কিছুদিন ধরে মনটা খুব অস্থির, মাঝে মাঝে একটা সিদ্ধান্তে আসাটা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। হাঁটছিল আর ভাবছিল, বাসায় সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত, আজ অফিস বন্ধ ছিল, তাই বাসায় ছিল সারাদিন। পড়ন্ত দুপুরে এই হাঁটাহাঁটি করা উপভোগই করছিল শায়লা, এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ হল। কে এল এমন ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল শায়লা। ওর ভাবনাতে ছিল ছোট ভাই শিবলির বন্ধু কেউ এসেছে বুঝি, প্রায় দিনই বিকেল বেলা বন্ধুদের নিয়ে ছাঁদের ঘরে আড্ডা দেয় তার কলেজ পড়ুয়া এই ছোট ভাইটি। কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখতে পেল তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। পুরোপুরি বদলে যাওয়া অচেনা একটা মুখচ্ছবি, কিন্তু তারপরও চিনতে এতোটুকু অসুবিধা হয় নাই। একটা মানুষের কতটুকু শারীরিক পরিবর্তন হলে সেই শারীরিক অবয়ব দেখে আগের মানুষটি বলে ভাবতে কষ্ট হয় তা আজ জাভেদকে না দেখলে শায়লা উপলব্ধি করতে পারতো না। দরজা খোলার পর হতভম্ব ভাবটা কেটে যাওয়ার সময়টুকু পায় নাই শায়লা, জাভেদ হুড়মুড়িয়ে বাসায় ঢুঁকে পড়ল, শায়লা তার পথ আগলে ধরে জানতে চাইলো,
‘কি চাই এখানে?’
‘তোকে চাই? তোর কাছে উত্তর চাই?’
‘দেখ জাভেদ তুই তোকারি করবে না, এক্ষনি বাসা থেকে বের হও’
‘কেন ভেতরে কি নাগরটা বসে আছে?’
‘কি? কে বসে আছে? অসভ্য কোথাকার, এতোটা ইতর আর নীচ হয়ে গেছ? বের হও বাসা থেকে।’ কথাটুকু চিৎকার করে বলে শেষ করতে পারে নাই শায়লা, অকস্মাৎ জাভেদ তাকে একটা চড় মেরে বসল। ঘটনার আকস্মিকতায় শায়লা নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠোনে পড়ে গেল, আর সেই সময় শায়লার বড় ভাই শিপলু ঘর হতে বের হয়ে এল। বের হয়ে বোনকে উঠোনে অগোছালো অবস্থায় ছলছল চোখে বসে থাকতে দেখে বুঝে নিল ঘটনা। সাথে সাথে সে যেন হামলে পড়ল জাভেদের উপর; চড়, ঘুষি, লাথি মারা আরম্ভ করল। এতো শব্দের কারণেই কিনা শায়লার ছোট ভাই শিবলি তার ছাঁদের ঘর থেকে নীচে নেমে এল এবং বড় ভাইকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে জাভেদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। শিবলি নেমে এসে বড় ভাইকে না থামালে আজ বুঝি মেরেই ফেলত জাভেদকে। শরীর স্বাস্থ্যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া জাভেদের পক্ষে সেই আঘাত প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না।
এতো অল্প সময় এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পর যেটা শায়লা বুঝতে পারলো, সেটা হল জাভেদ কোথাও শায়লাকে এক রিকশায় দেখেছে ইরফানের সাথে, তাও একাধিকবার। শায়লা ভেবে পায় না, আইনিভাবে শেষ করে পেছনে ফেলে আসা কোন সম্পর্কের জেরে কিভাবে একটা মানুষ বাসায় এসে জেরা করতে পারে? শুধু কি তাই, গায়ে হাত তোলার সেই পুরানো অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারে নাই লোকটা। কোন অধিকারে শায়লার গায়ে সে হাত তুলল? বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ কি এই কাজ করতে পারে? শায়লা ভেবে পায় না, ভাবতেও চায় না। জাভেদ মানেই এখন তার জীবনে পেছনে ফেলে আসা এক ধুসর অধ্যায়ের নাম।
বিকেল বেলা শিবলি রন্তুকে জোর করে তার সাথে ছাঁদে নিয়ে গেল। রন্তু তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিল, শিবলি ছাঁদে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখল রন্তুকে। কান্না একসময় থেমে গেলে পরে জিজ্ঞাসা করল,
‘কিরে তুই কাঁদছিস কেন? বাবা’র জন্য’
‘তুমিও আমার সাথে কথা বলবে না’
‘কেন রে? আমি আবার কি করলাম?’
‘তুমি বাবাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ’
‘তাই নাকি? তোর বাবা বাসায় এসে কি কাণ্ড করেছে তা দেখেছিস’
রন্তু কিছু বলল না, সে জানে না বাবা কি এমন করেছে। কারণ বাবা যখন বাসায় এসেছে তখন সে ঘুমিয়ে ছিল, হৈহুল্লোড়ে ঘুম ভেঙ্গেছে, তাই সে জানে না ঠিক আগে কি ঘটেছে।
‘কি রে উত্তর দিস না কেন?’
‘জানি না’
‘তোর বাবা যে বাসায় এসে তোর মাকে মারলো সেই খবর রাখিস’
‘মিথ্যে কথা, আমি বিশ্বাস করি না।’
‘বিশ্বাস করিস না! তোর বাবাতো আবার তোর সুপার হিরো’
রন্তু প্রথমে এই কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ ছোট মামা আর রন্তু চুপ থাকার পর, রন্তু প্রথম কথা বলল,
‘সত্যি?’
‘শুধু তাই না, আরও অনেক অনেক নোংরা কথাও বলেছে’ এই কথা শুনেই রন্তু ছোট মামাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। একসময় উঠে ছাঁদের কোনায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু কান্না কিছুতেই থামতে চায় না যেন। এ যে স্বপ্ন ভাঙ্গার কান্না, স্বপ্নের ছবি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাওয়ার কান্না। রন্তু খুব আশা নিয়ে ছিল যে, বাবা আবার ফিরে আসবে, তারা আবার ফিরে যাবে তাদের আগের বাসায়, বাবা-মা’র সাথে অনেক অনেক আনন্দে থাকবে তারা সবাই। কিন্তু সেটা যে মিথ্যে স্বপ্ন ছিল, ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্নগুলোর মত, তা বুঝতে পারে নাই ছোট্ট শিশুমন। একসময় রন্তুকে একা রেখে শিবলি নীচে নেমে এল, ছোট মানুষ, তাকে একা একা কিছুটা সময় কাঁদতে দিল। কেঁদে যদি এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারে ছেলেটা। কিন্তু মানুষের জীবনে কিছু কিছু ধাক্কা থাকে যা কখনো মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারে না। জীবনে বারে বারে সেই ধাক্কা যেন ফিরে ফিরে আসে, নানান ঢঙ্গে, নানান ভঙ্গিতে, নানান সঙ্গী তে।
'রন্তু'র কালো আকাশ' এর আগের সব পোস্টগুলোঃ
রন্তু'র কালো আকাশ - ১
রন্তু'র কালো আকাশ - ২
রন্তু'র কালো আকাশ - ৩
রন্তু'র কালো আকাশ - ৪
রন্তুর কালো আকাশ - (১-৫)
রন্তু'র কালো আকাশ - ৬
রন্তু'র কালো আকাশ - ৭
রন্তু'র কালো আকাশ - ৮
রন্তু'র কালো আকাশ - ৯
রন্তু'র কালো আকাশ - ১০
রন্তু'র কালো আকাশ - ১১
রন্তু'র কালো আকাশ - ১২
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৩
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৪
রন্তু'র কালো আকাশ (পর্ব ১-১৪ ফিরে দেখা)
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৫
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৬
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৭
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৮
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৯
রন্তু'র কালো আকাশ - ২০