অন্নদা শঙ্কর রায়, একমাত্র প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক যার হাতেখড়ি হয়েছিল ভ্রমণ সাহিত্য দিয়ে। তাই তার সাহিত্যে ধরা দেয় এক পর্যটকের দৃষ্টি। উনার ভাষায়, ‘সাহিত্যের ইতিহাসে যেসব ভ্রমণের বই থেকে যায় সেসব বই একটি বিশেষ ব্যক্তির একজোড়া বিশেষ চোখের ও একটি বিশেষ মনের দ্বারা একটি বিশেষ যুগে দেখা বিশেষ একটি দেশের প্রাণচিত্র। আমি যদি আমার গ্রন্থে বিদেশের প্রাণটিকে সঞ্চার করতে পারি তা হলেই আমি সার্থক। সেইজন্যে আমাকে একশো রকমে তৈরি হয়ে বেরোতে হয়।আর তেমন প্রস্তুতি না থাকলে আমি ঘরের কোণে বসে ভ্রমণ কথা পড়তে ভালোবাসি।’
আমি ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখি করার অপচেষ্টা করার সময় বার বার অন্নদা শঙ্কর রায় এর একটি কথা কানে বাজে, ‘ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়।’ আর একথা মনে হলেই লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে হয়। কিসব ছাইপাশ প্রতিনিয়ত প্রসব করে চলেছি। এই সম্পর্কে উনার পূর্ণাঙ্গ উক্তিটি ছিল এরকম, ‘ভ্রমণ করার সুযোগ পাওয়া এক জিনিস, ভ্রমণ কাহিনী লেখায় অনুপ্রেরণা পাওয়া আরেক জিনিস। ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণকাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়। যাঁদের হাত দিয়ে হয় তাঁদের যদি লেখার হাত না থাকে তো ঢের বেশী অভিজ্ঞতাও সাহিত্যে স্থায়িত্ব লাভ করে না। এক জীবনে কেই বা কতটুকু দেখতে পারে? দেখলে লিখতে পারে? লিখলে স্থায়ী সম্পদ রেখে যেতে পারে? বেশীরভাগই হয়ে যায় সমসাময়িক বিবরণ।’
অন্নদা শঙ্কর এর ভ্রমণ বাতিক ছিল সেই শৈশবেই রক্তের কনায় কনায়। নিজের ছোটখাট বেড়ানোর ভ্রমণগল্প সমবয়সীদের শুনাতে এমন সুন্দর করে যে, বড়রাও সেই গল্প তন্ময় হয়ে শুনত। তার আগ্রহ ছিল ভ্রমণকাহিনী পড়ার দিকে। শিশুকালে সমুদ্রযাত্রা, ভাগ্য পরীক্ষা, রাজকন্যার সঙ্গে পরিণয়ের কথা এসব পাঠ করে দোলা দিত শিশু মন এডভেঞ্চার এর নেশায়। আরেকটু বড় হলে রামমোহন আর দ্বারকানাথের সাগরযাত্রা তাকে হাতছানি দিত ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। আর তাই বুঝি মাত্র তেইশ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন এই পরিব্রাজক সাহিত্যিক। উনার ভাষায়, ‘একটি প্রিয় নারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি তেইশ বছর বয়সে ভারত থেকে ইউরোপ যাত্রা করি। আর একটি প্রিয় নারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি পঁচিশ বছর বয়সে ইউরোপ থেকে ভারতে পাড়ি দি।’অন্নদা শঙ্কর রায়ের প্রথম ভ্রমণ কাহিনী ‘পথে প্রবাসে’ যা বাংলা সাহিত্যে আজও অমর হয়ে আছে। প্রথম যৌবনে লেখা এই ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সাহিত্য, নতুন কোন ভ্রমণকাহিনী এসে তাকে পুরানো করে দিতে পারে নাই। পথে প্রবাসে শুধু ভাষা ও স্টাইলের দিক থেকে নয়, আইডিয়া ও আইডিয়ালের দিক থেকেও আদর্শ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে, প্রাচীন ও আধুনিকের মধ্যে এক মেলবন্ধন। ভ্রমণকাহিনীর রূপ ও রীতির বৈচিত্র্য নিয়ে অন্নদা শঙ্কর রায় নানাভাবে ভেবেছেন। এই ব্যাপারে উনার বক্তব্য ছিল, ‘সকলের দৃষ্টিভঙ্গী একই রকমের নয়। কারো দৃষ্টি রসিকের, কারো ক্রিটিকের। কারো দৃষ্টি ভাবুকের দৃষ্টি, কারো পণ্ডিতের। কারো দৃষ্টি টুরিস্টের দৃষ্টি, কারো অনুসন্ধিৎসুর। কারো দৃষ্টি তীর্থযাত্রীর দৃষ্টি, কারো কারো ধর্মপ্রচারকের। যাদৃশী দৃষ্টি সৃষ্টিও তাদৃশী।’
লেখকের দ্বিতীয় ভ্রমণকাহিনী ইউরোপের চিঠি, এটি প্রবন্ধাকারের নয়, চিঠির আকারে লেখা এবং লেখাগুলো কিশোর-কিশোরীদের জন্য। পথে-প্রবাসের রূপ-রস উপচে এসে পড়েছে কিছুটা এই ইউরোপের চিঠিতে। এই গ্রন্থের যা মূল সুর তা হল, প্রত্যেক দেশের একটা নিজস্বতা আছে, ভৌগলিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক নিজস্বতার বাইরে আর এক নিজস্বতা, যেটা থাকে সেই দেশের গন্ধে, জলে, মাটিতে, হাওয়ায় – তার সূচনা ও বিকাশ ঘটেছিল মূলত পথে প্রবাসেই।
লেখক পরবর্তী ভ্রমনে যান জাপান, মধ্য বয়স পেড়িয়ে। ইউরোপে তিনি ছিলেন দুই বছর, জাপানে মাত্র একমাস। জাপান ভ্রমণ নিয়ে লেখা ‘জাপানে’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখন বলেছেন, ‘এ কাহিনী কেবল জাপানের নয়, কেবল ১৯৫৭ সালের শরৎকালের নয়, কেবল আমার নয়, একসঙ্গে এই তিন দেশকালপাত্রের। সেইজন্য এর নাম ‘জাপান’ নয়, ‘জাপানে’। এ শুধু ভ্রমণকাহিনী নয়, তার চেয়ে কিছু বেশী।
... ... অপ্রত্যাশিত রূপে জাপানে নীত হয়ে প্রতিদিন আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, কে আমাকে এখানে এনেছে, কেন এনেছে। জাপান থেকে ফিরে... ‘জাপানে’ লিখতে বসে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবাক হয়ে চিন্তা করেছি, কে আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে। বছর ঘুরে গেছে। এতদিন পড়ে একটু একটু করে ঠাওর হচ্ছে জীবনবিধাতার উদ্দেশ্য। ... ... সৌন্দর্যের দীক্ষা যে পূর্বে কোনো দিন হয়নি তা নয়, কিন্তু পরিপূর্ণ সৌন্দর্য অভিষেক জাপানে গিয়েই হল।' ওয়াহ, কি কথা!!!
জাপানে প্রকাশিত হওয়ার পর লেখক পশ্চিম জার্মানি থেকে সেদেশে ভ্রমণের আমন্ত্রণ পান। আর ওদের বিশেষ আগ্রহ দেখে লেখকও তাঁর হারানো যৌবনকে চৌত্রিশ বছর বাদে খুঁজতে বেরোন। সে তাঁর স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে ফেরা। সেই সুযোগে তিনি ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে দিন কয়েক কাটিয়ে আসেন। লেখকের বক্তব্য শুনুন, ‘সেটা আমার সেন্টিমেন্টাল জার্নি। একজন বাদে কেউ আমাকে চিনতে পারে না, আমিও কাউকে চিনতে পারিনে। সেই একজনেরও চেহারা বদলে গেছে। আমারও চেহারা কি একই রকম আছে? ভাগ্যে পুনর্দর্শন হলো। এ জন্মে আবার হবে তাঁর কিংবা আমার কারো সে বিশ্বাস ছিল না। দেখা গেল অঘটন আজও ঘটে। সেটা হলো আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। তাঁর জন্য আমার নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে যায়।’
লেখকের সবশেষ ভ্রমণ গ্রন্থ, ‘চেনাশোনা’। এটি বিদেশকে নয়, স্বদেশকে আর একটু চেনার বৃত্তান্ত। পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত ও সিংহল! সিংহল তো লেখকের কাছে বিদেশ ছিল না। মজার ব্যাপার লেখকের প্ল্যান ছিল, ‘পথে প্রবাসে’র পর উনার দ্বিতীয় ভ্রমণকাহিনী হবে ‘চেনাশোনা’। কিন্তু বের হয়েছিল পঁয়ত্রিশ বছর পর, শেষ ভ্রমণকাহিনী হিসেবে।
অন্নদা শঙ্কর রায় এর ভ্রমণ কাহিনী সমূহঃ
(১) পথে প্রবাসে
রচনাকালঃ ১৯২৭-১৯২৯
প্রকাশকালঃ ১৯৩১
প্রকাশকঃ এম সি সরকার অ্যান্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড
(২) ইউরোপের চিঠি
রচনাকালঃ ১৯২৭-১৯৩০
প্রকাশকালঃ ১৯৪৩
প্রকাশকঃ এম সি সরকার অ্যান্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড
(৩) জাপানে
রচনাকালঃ ১৯৫৭-১৯৫৮
প্রকাশকালঃ ১৯৫৯
প্রকাশকঃ এম সি সরকার অ্যান্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড
(৪) ফেরা
রচনাকালঃ ১৯৬৪-১৯৬৫
প্রকাশকালঃ ১৯৬৬
প্রকাশকঃ এম সি সরকার অ্যান্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড
(৫) চেনাশোনা
রচনাকালঃ বিভিন্ন সময়ে
প্রকাশকালঃ ১৯৭৫
প্রকাশকঃ ডি. এম. লাইব্রেরী
অন্নদা শঙ্কর রায় এর এই পাঁচটি ভ্রমণকাহিনী’র গ্রন্থ এক মলাটে কলকাতার ‘বাণীশিল্প’ প্রকাশনী থেকে প্রথম বের হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ছাপানো মূল্য দুশো পঁচিশ টাকা (ভারতীয় মুদ্রা) (আমি যে মুদ্রণ কিনেছি)। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো হতে কিনতে পারবেন আশা করি। আমি কিনেছিলাম প্রথমা থেকে, পাঠক সমাবেশেও দেখেছিলাম। মূল্য পড়েছিল চারশত টাকার মত।
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
“ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই” - পর্ব ০১ (“য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র”)
'পাঠাননামা' - “ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই” - পর্ব ০২ (“দেশে বিদেশে - সৈয়দ মুজতবা আলী”)
বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন - মুহম্মদ আবদুল হাই (“ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই” - পর্ব ০৩)
কাবুলের ক্যারাভান সরাই – মঈনুস সুলতান (ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই – ০৪)
পালামৌ – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই – ০৫)
চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই - ০৬)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৫১