যা চেয়েছি কেন তা পাই না, যা পেয়েছি কেন তা চাই না... উঁহু, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। যা চেয়েছি তা পাই না বেশীরভাগ সময়ই হয়তো, কিন্তু যা পাই তাও কিন্তু কম নয়। এই যেমন সপ্তাহ দুয়েক আগে, যে কোন একটা ভবিষ্যৎ ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে একটু গুগল ম্যাপে মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এ চোখ বুলাতে বুলাতে একটা জায়গা মনে ধরে গেল। ব্যাস, মন হল উতালা, যেতেই হবে ওখানে, সামনের শুক্রবারে। কিন্তু বেশ কয়েকজন ভ্রমণ বন্ধুকে ফোন দিয়ে দেখি সবাই ব্যস্ত, দুয়েকজন বলল, ঈদের পরে চলেন, বর্ষায় আরও ভাল হবে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল, কেমন যেন অস্থিরতা ভেতরে। ঠিক সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে ছোট ভাই জানাল, অফিসের একটা কাজে ও দিনাজপুর যাবে শুক্রবার রাতে। আমি সাথে সাথে বায়না ধরলাম আমিও তার সাথে যাব। তারপর আর কি সাথে সাথে বসে গেলাম ট্যুর প্ল্যান করতে।
রাত বাজে এগারটা, অনলাইনে রেলওয়ের টিকেট কাটা যাবে না। তাই নোট প্যাডে টুকে নিলাম আমার দেখার তালিকা। পরদিন বিকেলের দিকে কমলাপুর গিয়ে দেখি কোন বাসের সিট নেই, যা আছে একেবারে শেষের দিকে, যেটাতে আমি শারীরিক সমস্যার কারনে কখনোই ভ্রমণ করি না। ফলে ঢুকলাম রেলষ্টেশনে, খুঁজে পেতে ফার্স্ট ক্লাস চেয়ারে দুটো টিকেট মিলল, এবং ঐ দুটোই শেষ টিকেট ছিল। সিট নাম্বার ১ ও ২, মানে একেবারে প্রান্তে, টয়লেট এর কাছে...
যাই হোক যাত্রার দিন সন্ধ্যের পরপর দুইভাই রিকশাযোগে হাজির হলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে আগে থেকেই ট্রেন দাঁড়ানো ছিল, ট্রেনে উঠে নিজ নিজ সিটে বসে পড়লাম, নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেল, ট্রেনের কোন নড়চড় নেই। এদিকে লোকাল যাত্রী একে একে উঠে দুই পাশের দুই গেটের কাছে জটলা পাকিয়ে জমা শুরু করল। আমি সেই জটলার মাঝে সিট নাম্বার ০১ এর সিঙ্গেল সিটে পুরাই নাস্তানাবুদ। প্রথম কিছুক্ষণ কয়েকজনকে বলে করে, বকাসকা দিয়ে সরালেও একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। সারাটা রাত যতগুলো ষ্টেশনে ট্রেন থেমেছে, সেখান থেকেই লোক উঠেছে। শুধু লোক উঠেই রেহাই নেই, সাথে নানান মালপত্র। আর সব ডাম্পিং হচ্ছিল আমার আশেপাশে। একসময় আমার দুই সারী সামনের এক সত্তরোর্ধ্ব বয়সের আংকেল রাতের খাবার খাওয়ার আগে এলেন টয়লেট যাবেন বলে। ওমা! টয়লেটের ভেতর নাকি মালামাল রাখা!!! বেচারা বয়স্ক ভদ্রলোক’কে ফের অপর প্রান্তের টয়লেটের দিকে ধরে ধরে নিয়ে গেল উনার মেয়ে। আমি আর সাথে আরেকজন কয়েকবার পেছনের সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “টয়লেটের ভেতর মালামাল কার?” কেউ কোন উত্তর দেয় না। শেষে টিটি’কে খোঁজ করা হল। ঘণ্টা দুয়েক পর টিটি সাহেব যখন উপস্থিত হয়ে টয়লেট থেকে মালামাল (একটা ইয়া বড় বেতের ঝুড়ি যা খড়কুটো দিয়ে ভরা, আর কিছুই নেই... !!!) চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিতে উদ্যত হলেন, তখন আমার সিটের পেছনেই বসে থাকা বছর পঞ্চাশের এক প্রবীণ বললেন উনার ঝুড়ি। মেজাজ তখন এতো খারাপ হল... উনাকে শুধু একটা কথাই বললাম, ‘আপনি যদি বয়সে বড় না হতেন, আপনাকে শুদ্ধ এই ট্রেন থেকে ফেলে দিতাম, ফাজিল কোথাকার।’। চিন্তা করেন বিবেচনা বোধ, তার সব মিলে ২০০ টাকা মূল্য হবে কি না সন্দেহ, সেই জিনিস একটা বগির প্রায় শখানেক মানুষের ব্যবহারের জন্য থাকা টয়লেটে রেখে টয়লেট বন্ধ করে উনি বসে আছেন ফার্স্ট ক্লাস এর বগিতে, স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে, তাও মাঝ পথের... আমাদের ট্রেন সার্ভিস যে কবে ভাল হবে...
এই ঝামেলা শেষ না হতে মধ্যরাত থেকে শুরু হল আরও নানান ঝামেলা। এক মহিলা উঠে পুরো বগি ঘুরে বসার পছন্দমত জায়গা না পেয়ে (যদিও দুই গেটের কাছে কিছু দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ছাড়া পুরো ট্রেন ফাঁকা, সিট ব্যতীত); ‘অন্য বগিতে যাই’ বলে নেমে পড়ল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোককে বললাম একটু দেখেন তো কোথায় যায় এই মহিলা, দরজা দিয়ে উকি দিয়ে দেখে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে একটা কোনে বসে রইল। আমাদের বগি ছিল লাস্ট বগি... যা বুঝার বুঝে নেন, তাই ট্রেনে উঠলে একেবারেই ঘুমানো উচিত না...
এরপরের যন্ত্রণা শুরু হল ঈশ্বরদী জংশন থেকে। এক জটা বাবা এই গরমে দশ বারোটা নোংরা জামা গায়ে ভয়াবহ দুর্গন্ধ নিয়ে উঠল আমাদের বগীতে। আমার সিটের পেছনে যে দরজা সেখান দিয়ে। উঠতেই নাকে ভয়ানক দুর্গন্ধে চারিপাশে চেয়ে দেখি জটা বাবা। আমার সিটের পাশে দাঁড়ান দুই ভদ্রলোক’কে বললাম, ‘ভাই একটু আমার সিটের দিকে সরে এসে দাঁড়ান’। দুইজন বুঝল উল্টা, তারা আরও সরে দাঁড়াল, আর এই ফাঁকে জটা বাবা সেখানে ধপ করে বসে চোখ বন্ধ করে ভান ধরে বসে রইল। আমি জানালা দিয়ে মাথা সাবধানে বাইরে দিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণ পর উনার সুবাসে সবাই অতিষ্ঠ, হাজারো চেঁচামেচিতে কোন সাড়া নেই। শেষে একজন কোথা থেকে একটা মোটা লাঠি এনে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, ‘ওঠ এখান থেকে নইলে দিলাম মাথায় একটা বাড়ি’!!! বলতেই বাবার ধ্যান ভাঙ্গল, একটু প্যা...প্যু... করে সামনে চলে গেল। কিছুক্ষণ বগির মাঝে ছিল, সবাই ঘুমে বলে টের পেল না। কয়েক ষ্টেশন পরে বাবাকে আর দেখা গেল না বগিতে।
এসব যন্ত্রণা সইতে সইতে একসময় আমরা চলে এলাম আমাদের গন্তব্য ফুলবাড়ী ষ্টেশন, তখন মাত্র ভোর হয়েছে। ভোরের প্রথম প্রহরে ষ্টেশনে নেমে মন ভাল হয়ে গেল। চারিদিকে কেমন শান্ত একটা পরিবেশ। চায়ের দোকানে পানি গরম হয়েছে, রঙ চা পাওয়া যাচ্ছে, দুই ভাই চা পান করলাম। ষ্টেশনে একটা ওয়েটিং রুম আছে, সেখানে আমাদের মোবাইল চার্জে দিয়ে দিল আমার ভাই, আর আমি এই ফাঁকে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। ভাই যে প্রতিষ্ঠানে এসেছে অফিসের কাজে, সেখান থেকে গাড়ী নিয়ে আসবে আমাদের রিসিভ করতে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কি আর করা অপেক্ষা করি... আপনারাও করেন... পরের পর্বে বাকী গল্প হবে না হয়। (চলবে)
কিছু ছবি তো দিতেই হয়, ভ্রমণ পোষ্ট বলে কথা! প্রথম দুটো ছাড়া বাকী সব ফুলবাড়ী ষ্টেশন এর আশেপাশের ছবি, সেই মায়াময় ভোরবেলায় তোলা...
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ১১:৩৩