আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত।দেশটি বাংলাদেশের তুলনায় বেশ বড়। ভারতের সাথে নানা বিষয়ে আমাদের টানাপোড়েন আছে।সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ও ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে এলে ভারতের সাথে আমাদের টানাপোড়েন কমতে পারে।কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রতিদিন যেভাবে গুলী করে পাখির মতো বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করছে তাতে তো সৎ প্রতিবেশীর প্রমাণ মেলে না।
ফারাক্কার পর এখন আবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তৎপরতায়ও প্রতিবেশী দেশটির আগ্রাসী মনোভাবের ক্রমবর্ধমান মাত্রাটা টের পাওয়া যায়। কোন বড় প্রতিবেশীর এমন আগ্রাসী নীতি ছোট দেশগুলোর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ আসলে বড় সমস্যার মধ্যে আছে। এমন অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার পালন করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সচেতন আছে বলে মনে হয় না। বরং সরকার ও সরকারি দল বর্তমানে এমন ভূমিকা পালন করছে, যাতে মনে হতে পারে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং বিরোধীদলকে কোণঠাসা করাই তাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর বিডিআর বিদ্রোহ ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিষয়ে সরকারের ভূমিকাও জনমনে সৃষ্টি করছে নানা প্রশ্ন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা বিধানে বর্তমান সরকার কতটা সচেতন সে বিষয়েও জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আশংকা।
প্রতিবেশী দেশ যখন বড় ও আগ্রাসী হয়, তখন ছোট দেশের সরকারও রাজনীতিবিদদের পরিপক্কতার পরিচয় দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে। আর সরকারের ঘাটতিটা বড় হয়ে ধরা পড়ছে সবার চোখে। ভারত প্রসঙ্গে কোন কথা উঠলেই আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা কেন যেন একটু অস্বাভাবিক হয়ে ওঠেন এবং কখনো কখনো ক্ষেপেও যান। যেমন গত মঙ্গলবার এফবিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলে উঠলেন, আমাদের দেশের কিছু লোক না বুঝে ও না জেনেই ভারতের টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কথা বলছে। মন্ত্রী যে মন্তব্যটি করলেন এবং যে অবস্থান নিলেন, তাতে তো মনে হতে পারে, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত। কিন্তু একই সময়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ?আমিও এ বিষয়ে কিছু জানি না। শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল টিপাইমুখ বাঁধ পরিদর্শনে যাবে। এ প্রতিনিধিদলের মতামতের পরে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো।'- এই যদি হয় বাস্তব অবস্থা তাহলে বাণিজ্যমন্ত্রী কী করে বললেন, আমাদের দেশের কিছু লোক না বুঝে ও না জেনেই টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কথা বলছে! নিজে কিছু না জেনে অপরের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করা যায় কি? অথচ আমাদের জানা মতে বাংলাদেশে এমন অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা টিপাইমুখসহ ভারতের অন্যান্য বাঁধ সম্পর্কে কমবেশি অবহিত। এবং নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা তাদের উদ্বেগের কথাও প্রকাশ করছেন।
শুধু বাণিজ্যমন্ত্রীই নন, টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার রাতে টিভিতে চটে যেতে দেখলাম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদকেও। তিনি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বিরোধী দলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বাড়ি ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা আন্দোলনের পর এখন তারা নেমেছেন টিপাইমুখ বিরোধী আন্দোলনে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা এ ভাষায় কথা বলছেন কেন? তাদের আচরণে দুর্মুখদের বক্তব্যই যেন হালে পানি পেয়ে যাচ্ছে। তারা বলছিলেন, ভারতের কাছে দাসখত দিয়েই মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ভবিষ্যৎই বলে দেবে তাদের কথা কতটা ঠিক বা বেঠিক। এছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের বক্তব্যেও লক্ষ্য করা যায় গড়মিল। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রী ড. মোঃ আফছারুল আমিন বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি আরো বলেন, ফারাক্কার সময় আর এখনকার সময় এক নয়। জানি না এই 'সময়' বলতে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? অপরদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, টিপাইমুখে ভারত ড্যাম নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো, আর ব্যারেজ নির্মাণ করা হলে ক্ষতির পরিমাণ হবে আরো বেশি। আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানাবো। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতের হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান যে, ভারত আসামে বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখে ড্যাম নির্মাণের পাশাপাশি ব্যারেজও নির্মাণ করছে। তাই প্রশ্ন জাগে, ভারতের হাইকমিশনার যখন স্পষ্টই ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণের কথা বলছেন, তখন আমাদের মন্ত্রী বাহাদুররা এমন লুকোচুরি খেলছেন কেন? যেন তারা কিছুই জানেন না!
মন্ত্রীত্বে থেকে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে না জানাটা লজ্জার বিষয়, বরং জানাটাই গর্বের। অথচ আমাদের মন্ত্রী বাহাদুররা না জানাটাকেই গর্বের সাথে প্রকাশ করছেন! শুধু তাই নয়, আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রীতো টিপাইমুখ বাঁধ থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হওয়ার আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। জানি না তাদের এমন নতজানু ভূমিকার কারণ কী? অথচ একজন সাধারণ মানুষও জানে যে, প্রবাহমান নদীতে বাঁধ দিলে ভাটির দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ উপলব্ধির জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, দেশপ্রেমই যথেষ্ট।
বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত টিপাইমুখে দ্রুততার সাথে স্টোরেজ ড্যাম ও ভাটিতে নীচে ব্যারেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। ভারতীয় হাইকমিশনারের বক্তব্যেও একথার সমর্থন পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের এ প্রকল্প চালু হলে শুষ্ক মওসুমে গোটা সিলেট এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। সেই সাথে মেঘনা বেসিনের সব নদী শুকিয়ে যাবে। আর বর্ষায় বন্যায় ভাসবে গোটা মেঘনা অববাহিকার সকল এলাকা। সেই সাথে ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতো আছেই। যৌথ নদীকমিশনের সাবেক সদস্য এবং পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে বলেন, ভারত টিপাইমুখে যদি শুধু ড্যাম নির্মাণ করে তাহলেও সিলেট অঞ্চলের হাওড় এলাকায় ব্যাপক পানিবদ্ধতা দেখা দেবে। সেই সাথে বন্যার সময় ড্যামের মুখ খুলে দিলে ভাটি এলাকায় ব্যাপক পাবনের সৃষ্টি হবে। আর যদি ড্যামের সাথে ব্যারেজও নির্মাণ করে তাহলে গোটা মেঘনা বেসিনের নদীগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়বে। তদুপরি পরিবেশগত বিপর্যয়তো আছেই। তিনি বলেন, এ ধরনের স্থাপনা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই বহুবিধ ঝুঁকির মুখে ফেলবে। তিনি আরো বলেন, ভারত যাই বলুক না কেন, কার্যত এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ভারত বরাক নদীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে চাচ্ছে। তবে ভারতের উচিত হবে বন্ধুপ্রতীম দু'টি রাষ্ট্রের মধ্যে এ নিয়ে যাতে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয় সে জন্য অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া। যাতে দু'দেশের পানি বিশেষজ্ঞ, কারিগরি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এতে উভয় দেশ লাভবান হবে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর হবে।
বাংলাদেশের পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত তো যৌক্তিক ও সঙ্গত প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাবের প্রতি ভারতের কোন আগ্রহ আছে কি? বহুল ঘোষিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত যদি গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সনদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা রাখতো, তাহলে প্রবহমান একটি আন্তর্জাতিক নদীর ওপর ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণের আগে কি ভাটির সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো না? ভারত তেমন কোন গরজ অনুভব করেনি। ভারত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে একা একাই ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখন বাঁচার তাগিদেই বাংলাদেশের সরকার রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার হতে হবে। এ ভাবেই হয়তো ভারতকে আলোচনার টেবিলে কিছুটা সঙ্গত অবস্থায় আনা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সরকার ভারতের সামনে যেভাবে নতজানু হয়ে পড়ছে তাতে ভারতের টনক নড়বে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের সরকার চুপ থাকতে চাইলেও কিন্তু খোদ ভারতের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোক বেশ আগে থেকেই এই বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত করেছে। আমাদের সুবোধ সরকারের অবগতির জন্য এখানে তার কিছুটা তুলে ধরা হলো।
টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর কাছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনগণের পক্ষে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয় গত ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ তারিখে। আর স্মারকলিপি প্রদানকারীরা হলো-
১. টিপাইমুখ প্রকল্পের বিরোধী একশন কমিটি (ACTIP), ২. জিলিয়ানগড়ং ইউনিয়ন (ZU), ৩. নংবা এলপি গ্রাম কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান সংঘ (NAVACA), ৪. জিলিয়ানগড়ং ছাত্র ইউনিয়ন, মনিপুর নংবা এলাকা (ZSUM Nangba Zone), ৫. টিপাইমুখ বাঁধ দ্বারা আক্রান্ত গ্রামসমূহের কমিটি।
স্মারকলিপি প্রদানকারীরা ২০০৭ সালের ১৪ মার্চকে ?বাঁধ বিরোধী এবং নদী, পানি ও জীবনের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস' হিসেবে পালন করে। জানি না আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা এ বিষয়ে কোনো খবর রাখেন কিনা। উক্ত দীর্ঘ স্মারকলিপির এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, ??৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ আহু (বরাক) নদী হল জিলিয়ানগড়ং-এর আদিবাসী এবং অন্যান্য বহু আদিবাসী ও অ-আদিবাসীসহ এর অববাহিকায় বসবাসরত ভারত ও বাংলাদেশের অগণিত মানুষ ও সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন উৎস। এসব এলাকার মানুষ বেঁচে আছে এ নদীকে কেন্দ্র করেই। টিপাইমুখ বাঁধ এই নদীকে গলা টিপে হত্যা করবে; নদীটির সুদীর্ঘ প্রাচীনজ্ঞাত ও নির্ভরযোগ্য স্বভাব পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং আমাদেরকে চিরদিনের জন্য দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত করবে। সুতরাং এ প্রকল্প জনগণের জন্য নয়।' স্মারকলিপিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে উদ্দেশ্য করে সর্বশেষে বলা হয়, ??টিপাইমুখ বাঁধ বাতিল করুন, আহু (বরাক) নদীকে মুক্তভাবে প্রবাহিত হতে দিন এবং আমাদের নিজেদের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করত আমাদের সঙ্গেই থাকুন।?? বরাক নদীর তীরবর্তী ভারতের জনগণ যখন বলছে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প জনগণের জন্য নয়, তখন আমাদের মন্ত্রীরা ওই বাঁধ থেকে উপকৃত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কোন্ কান্ডজ্ঞানে? আসলে প্রকৃতি ও মানবাবিরোধী এই বাঁধ শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, ভারতের জনগণের জন্যও ক্ষতিকর। স্মারকলিপিতে সেই সত্যই প্রকাশিত হয়েছে। এই সত্যকে স্বীকার করে নিতে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিধা কেন? বিষয়টি ভেবে দেখার মত দায়িত্ববোধ সরকারের আছে তো?