
বেলা একটা। কার্জন হলের সামনের রাস্তার পাশে যাত্রীছাউনির নিচে অনেক মানুষের জটলা। হাসি তামাশা করছে লোকজন। কেউ খাবার খাচ্ছে। কেউ টাকা গুনছে। কয়েকজন একসঙ্গে মিলে মোবাইল ফোন সেটে গান শুনছে। হাঁটাচলা করছে। এদের একজন রওশন বালা। এক হাতের কনুই পর্যন্ত নেই। যাত্রী ছাউনিতেই তাকে দেখা গেল হাঁটাহাঁটি করছেন এবং এক হাতে টিপছেন মোবাইল ফোন সেট। ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলেন। এর একটু পরেই তিনি একটি গাড়িতে ওঠে বসেন। ২৮-৩০ বছরের এক যুবক ওই গাড়ি ঠেলে নিয়ে যায় হাইকোর্টের গেটে।
এভাবে যাত্রী ছাউনিতে থাকা লোকরা একে একে কাঠের তৈরি বিশেষ ধরনের ঠেলাগাড়িতে চড়ে চলে যান যার যার গন্তব্যে। কারও নির্ধারিত গন্তব্য হাইকোর্ট মাজার আবার কারও গন্তব্য শিক্ষাভবনের সামনের রাস্তা বা হাইকোর্টের গেট, বটতলা আবার কেউ কেউ যান গুলিস্থান, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ বা কমলাপুরে। ভিক্ষাবৃত্তি তাদের পেশা। এদের একেক জন দিনে আয় করেন তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা। এ টাকা আবার ভাগ বাটোয়ারা হয়। গাড়ি ঠেলানোর জন্য নিয়োজিত লোককে দেয়া হয় একদিনের মজুরি। আর নিজের গাড়ি না হলে এরও ভাড়া দিতে হয় দিনে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এলাকায় নির্বিঘ্নে থাকার জন্য মাজারের প্রভাবশালীদের দিতে হয় নিয়মিত চাঁদা। তারপরও দিব্যি আরামে চলছে তাদের পেশা।
হাইকোর্ট এলাকায় এরকম ভিখারির সংখ্যা ৮০ থেকে ১০০। শুক্রবারে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। আর তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি ব্যবসা চক্রও। তাদের খাবার সরবরাহের জন্য রয়েছে নির্ধারিত লোক। বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য আছে লোক। দূরে যারা থাকেন তাদের বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্যও আছে বাড়ায় চালিত ভ্যান। আয় করা টাকা জমানোর জন্য আছে কয়েকজনের সমিতি। তারা খাবার খান এক সঙ্গে। আছে খাবারের নির্ধারিত মেনুও। পেশা ভিক্ষা হলেও অনেকে থাকেন সপরিবারে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। দিনের অর্ধেক সময় করেন ভিক্ষা আর বাকি অর্ধেক সময় কাটান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গল্পগুজব করে। দিনের অর্ধেক সময় ভিক্ষা করলেও এ আয়ে চলে নিজেদের থাকা খাওয়ার খরচ। প্রতিমাসে টাকা পাঠান বাড়িতে। নানা জায়গার প্রতিবন্ধী লোকদের এখানে এনে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবসাও করছেন কেউ কেউ!
নাজিম উদ্দিন নামের একজন জানান, নাম পরিচয়হীন এক প্রতিবন্ধীকে গুলিস্থানের ফুটপাত থেকে মানবিক কারণে নিয়ে আসেন। এখন তার খাওয়া আর ওষুধের জন্য এ প্রতিবন্ধীকে নিয়ে ভিক্ষা করতে হয়। এতে নিজের পরিবারের খরচের টাকাও আসে বলে জানান তিনি। গতকাল দুপুরে হাইকোর্টের সামনে একসঙ্গে খাবার খাচ্ছিলেন কয়েকজন। তাদের জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার এক হোটেল কর্মচারী। দুপুর ও রাতে প্রতিবারের জন্য খাবারের বিল ২৫ টাকা। আর সকালের নাস্তা ১০ টাকা। কার্জন হলের সামনে খাবার নিয়ে বসেছিলেন এক মহিলা। তিনি জানান, প্রতিদিন মাজারে যারা ভিক্ষা করে তাদের কাছে তিনি খাবার বিক্রি করেন। প্রতিদিন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন তার কাছ থেকে খাবার কিনে খায়। একবেলার খাবারের দাম নেন তিনি ১৮ থেকে ২০ টাকা। তবে শুক্রবারে খাবার বন্ধ থাকে। এদিন সবাই মাজারের খাবার খান।
১১ বছর ধরে কার্জন হলের সামনের রাস্তার ফুটপাতে থাকেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ইছাক। স্ত্রীকে নিয়ে ফুটপাতেই থাকেন তিনি। অসুখে তার হাত ও পায়ের আঙ্গুল কুকড়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি বেছে নিয়েছেন এ পেশা। ভিক্ষা করে যা আয় করেন তা থেকে নিজে থাকা খাওয়ার পর প্রতিমাসে ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতেও টাকা পাঠান তিনি। ইছাক জানান, হাইকোর্ট এলাকায় ৪০-৪৫ বছর ধরে ভিক্ষা করে এমন লোকও আছে। এদের কারও সন্তান জন্ম নিয়েছে এখানে। এরাও এখন ফুটপাতে থেকেই ভিক্ষা করে। তিনি জানান, খাবার-দাবারের সব আয়োজন ফুটপাতেই। গোসল করতে হলে যেতে হয় রমনা পার্কের লেকে অথবা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গণশৌচাগারে। তবে রমনার লেকে গোসল করলে টাকা লাগে না। গণশৌচাগারে গেলে গোসল করতে পাঁচ টাকা লাগে।
সাত বছর ধরে হাইকোর্টের সামনে ভিক্ষা করছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মুসলেম। তিনি জানান, মিরপুরের মাজার রোডে দেড় হাজার টাকা ভাড়ার বাসায় থাকেন। প্রতিদিন সেখান থেকে হাইকোর্টের সামনে আসেন। দিনে ২০ থেকে ২৫ টাকা দিতে হয় বাস ভাড়া। দুপুরের খাবারের জন্য লাগে ২৫ টাকা। মুসলেম জানান, তার কোন কোন দিন আয় দুইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা। কোন দিন এর চেয়েও বেশি আয় হয়। সব খরচ করেও মাসে অন্তত দুই হাজার টাকা জমান। তিনি জানান, তার গাড়ি ঠেলানোর জন্য আছে ১২-১৪ বছরের একটি ছেলে। প্রতিদিন তাকে এ কাজের জন্য দিতে হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
জব্বার নামের আরেক ভিক্ষুক ভিক্ষা করেন হাইকোর্ট মাজারে। ঠেলাগাড়িতে সারাদিন শুয়ে থাকেন। চোখে দেখেন না এমনটি বলে নিজেই ভিক্ষার জন্য আবেদন করেন লোকজনের কাছে। তবে ভিক্ষা শেষে একাই তিনি ফিরতে পারেন বকশীবাজারে তার ভাড়া করা বাসায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





