somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডুব রিভিউ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কেউ রহস্য পছন্দ করে, কেউ সমাধান। কারো চিন্তা করতে ভালো লাগে, কেউ আবার সহজেই সব প্রশ্নের উত্তর আশা করে। বহু রুচির, বহু শ্রেণীর দর্শক। কিন্তু দেশ কালের গন্ডি পেরিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতা অনস্বীকার্য। গভীর সব মানবিক সমস্যা নিয়ে মানুষ পাড়ি দেয় এক জীবন। সেই সম্পর্কের গল্পের চোরা স্রোতে নিমজ্জনের আহবান জানিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী উপহার দিলেন , ‘ডুব’ (No Bed of Roses)। উঠলো ঝড়, আলোচনা-সমালোচনা পেল নতুন মাত্রা। এ যেন সিনেমা নয় বরং কোন মতবাদ, যার উপর ভর করে দ্বিখন্ডিত হলো দর্শককুল। এই বেলায় তবে ‘ডুব’ নিয়েই কিছু কথা বলা যাক।

অধিকাংশ পরিচালকই চান তার সিনেমার এক নিজস্ব ভাষা তৈরি হোক, নির্মাণে যেন তার নিজস্ব সিগনেচার থাকে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ইতিমধ্যেই সেই ভাষা খুঁজে পেয়েছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ দর্শক তার সিগনেচারের সাথে পরিচিত। তবে ‘ডুবে’ তিনি ভেসে উঠলেন নতুনভাবে, নিজেকে ভাঙলেন নতুন আঙ্গিকে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের দর্শক পরিচিত সেই দৃশ্যের সাথে যেখানে বাসা বদল শেষে চরিত্রগুলো বিরক্ত গলায় বলে উঠবে, ‘ধ্যাত! বাসা বদলের কি প্যারা!’; অথচ একজন নির্মাতার মুন্সিয়ানা কিন্তু সেখানেই যদি সে কোন সংলাপ ছাড়াই শুধুমাত্র অভিনয় আর দৃশ্যের সাহায্যে বাসা বদলের ভোগান্তি ফুটিয়ে তুলতে পারে। ফারুকী অন্তত পুরো ছবি জুড়ে সেই চেষ্টাই করেই গেছেন। কারো কারো কাছে ডুবের গল্পকে খাপছাড়া বা অহেতুক দীর্ঘায়িত মনে হতে পারে। তবে আমার মনে হয়েছে, নির্মাতা স্বেচ্ছায় এমন এক গল্প আর স্টোরি টেলিং বেছে নিয়েছেন যা আমাদের বিরামহীন কর্মব্যস্ত জীবনে ছুটি এনে দিবে, ঠান্ডা মাথায় আমরা জীবনের গভীরতম সত্যকে নিয়ে ভাববো। নীতুর সাথে জাভেদ হাসানের প্রেম কিভাবে হলো, সামান্য শর্টফিল্ম নির্মাতা কিভাবে জননন্দিত নির্মাতা হয়ে উঠেন ইত্যাদি প্রশ্নের জন্য আমাদের কল্পনাই যথেষ্ট, বরং আমরা পর্দায় মূল প্রসঙ্গ মানে সম্পর্কের টানাপোড়েনটাই দেখবো। আসলে যেখানে চিন্তাই কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত, সেখানে ধুমধারাক্কার গতিময়তা অর্থহীন।

প্রচুর টপ শট বা ড্রোণের ব্যবহার কোথাও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি, বরং এক নজরে লোকেশন স্পষ্ট হয়েছে। তবে অবশ্যই আলাদা করে বলতে হবে ফ্রেইম উইদিন ফ্রেইম আর রিফ্লেক্সশনের কথা। শুধু দরজা-জানালার চৌকাঠে নয়, ফ্রেইমের ভিতরে ফ্রেইম বানানো হলো গাড়ীর উইন্ডস্ক্রিন থেকে শহরের বৈদ্যুতিক তার দিয়েও। বাংলাদেশের আর কোন চলচ্চিত্রে ক্যামেরার এই খেলা এত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেখিনি। রিফ্লেকশনের জন্য শুধু আয়না নয় ব্যবহৃত হয়েছে বন্ধ টেলিভিশনের পর্দা থেকে জানালার কাঁচ। পুরো ছবি জুড়েই মানুষগুলো ঘুরে ফিরে যেন নিজেরাই নিজেদের মুখোমুখি হচ্ছে। নির্মাতা চরিত্রগুলোর যে অসহায়ত্ব তুলে ধরতে চেয়েছেন তা প্রকাশের জন্য এই হাঁসফাঁস অবস্থা জরুরি ছিল। অনেকবারই মনে হয়েছে, চরিত্রগুলো যেন নিজেরাই নিজেদের কাছে বন্দী ও অসহায়। আর এখানেই ক্যামেরাগিরির সার্থকতা।

অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে বলবো রোকেয়া প্রাচীর কথা। নিরব ও নির্বিকার ‘মায়া’কে যতবার দেখেছি মনে হয়েছে একটা ঝড় থেমে আছে। তবে ইরফান খানের উচ্চারিত বাংলা আসামের বাংলা বলে মনে হয়েছে। এই ছবিতে তিশা নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গেলেন। সাবেরি চরিত্রে ডায়লগ থ্রো বা কান্নাকাটি ছাড়াও অভিনয়ের বেশ সুযোগ ছিল, ফুটিয়ে তোলা দরকার ছিল কিশোরী থেকে তরুণীতে রূপান্তরের সূক্ষ্ণ বিষয়গুলি। আর তিশা বেশ ভালোভাবেই তা করতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে এই ছবি তার ক্যারিয়ারে মাইলফলক হয়ে থাকার দাবি রাখে। নীতু চরিত্রে পার্নো মিত্রকে পর্দায় আরো দেখতে পেলে ভালো লাগতো। নিতুকে অনেকেই খলনায়িকা মনে করেছেন। তবে আমার তাকে খল নয় বরং পার্শ্বচরিত্র মনে হয়েছে। বাবা-মেয়ের সম্পর্ককে মূখ্য রেখেই কিভাবে পার্নোর ভূমিকা আরো বাড়ানো যেত তা হয়তো নির্মাতা ভেবে দেখতে পারতেন।
স্বল্প পরিসরে হলেও প্রায় তিন দশক আগের ঢাকা ও বাংলাদেশ পর্দায় তুলে ধরা সহজ ছিল না। কিন্তু ডুবের শিল্প নির্দেশনার দল এই বিষয়ে সাফল্য দেখিয়েছেন।
যারা এই সিনেমায় প্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের আত্নজীবনী খুঁজতে গিয়েছেন অথবা তার যাপিত জীবনের সাথে তুলনা করতে গিয়েছেন তাদের জন্য সিনেমা হলের সিটটাই হয়ে গেল কন্টকময়! কেননা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কোন হিসাব মিলে নাই। চরিত্ররা যখন পর্দায় হাঁসফাঁস করেছেন, সেই দর্শকরা করেছেন অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে। ছায়া আর কায়া কখনো এক না। তাই সিনেমার অতল অকূল দরিয়ায় একশ্রেণীর দর্শক হুমায়ূন আহমেদকে ডুবুরীর মত শুধু খুঁজেই গিয়েছেন।

সিনেমা সীমাবদ্ধ কিছু নয়, বরং তার সম্ভাবনা অসীম। বছরে বছরে সিনেমা ও তার গল্প বলার ঢং বদলে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের অনেক দর্শক তাদের পরিচিত গন্ডিতে স্বেচ্ছাবন্দী । সীমানার বাইরে কিছু দেখলে তারা বলেন না, ‘বাহ! সিনেমা তবে এমনও হয়! এভাবেও তাহলে সিনেমা হতে পারে!’ বরং খুব সহজেই বিচারকের মত রায় দিয়ে দিচ্ছেন ‘এটাতো টিভি নাটক, এটা কোন সিনেমা হয় নি’! এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে কি ডুবের মত চেনা গল্পের ব্যতিক্রম স্টোরি টেলিং কে গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের অধিকাংশ দর্শক প্রস্তুত!?



‘ডুব’ ইতিমধ্যেই বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন ‘ডুব’ কি অনেকের অভিযোগ আর আপত্তির চাপে হারিয়ে যাবে নাকি বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশি ঝান্ডা উড়ানোর পাশাপাশি এইখান থেকেই আমাদের চলচ্চিত্রে এক বাঁকের উদ্ভব হবে? সেই উত্তর দিতে পারে শুধুমাত্র সময়। আমরা অপেক্ষা করবো। সেইসাথে মন বলছে, বৈচিত্র্যই সুন্দর এবং পরিবর্তনই কাঙ্খিত। বিরহ ও ভালোবাসার দরদী দ্রবণে, তাই নিমজ্জনের নিমন্ত্রণের জন্য ‘ডুব’কে স্বাগত জানাই

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×