বইকেনার গল্প দিয়েই শুরু করি। বইকেনার বাতিক প্রথম শুরু হয়েছিল ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকে। সেসময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমাদের স্কুল শাখার কর্মীর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। মূলত বই কেনাটা তার কিছুদিন পর থেকেই নেশায় পরিণত হয়েছে।মনে আছে, শুধুমাত্র বইকেনার জন্যই মানিকগঞ্জ শহর থেকে আজিজ সুপার মার্কেটে চলে এসেছিলাম। তখন থেকেই বই সংগ্রহ চলছে; স্বপ্ন একটি নিজস্ব লাইব্রেরী গড়ে তোলা। এই বই সংগ্রহ সবসময় যে সৎভাবে হয়েছে তা অবশ্য নয়।সেরকম কয়েকটি ঘটনা বলি।
স্কুলে আমার এক বন্ধু ছিল -জনি। তবে তার বিশেষ কর্মে বিশেষ পারদর্শীতার জন্য আমি বলতাম "চোর জনি।" আমার বই সংগ্রহের শুরুর দিনগুলোতে এই"চোর জনি"র ভূমিকা অনস্বীকার্য। ওর দায়িত্ব ছিল শহরের গণপাঠাগার থেকে আমার পছন্দের বই চুরি করে দেয়া। বিনিময়ে ওকে হুমায়ুন আহমেদের বই দিতে হবে; সেই বয়স থেকেই সে নিজেকে হিমু ঘোষণা দিয়েছিল। আমার ছোটবোনও ছিল হুমায়ুন আহমেদের একনিষ্ঠ পাঠিকা। ওর বইগুলো লুকিয়ে চোরজনিকে দিয়ে ওর কাছ থেকে আমার পছন্দের বইটি নিতাম। এভাবে ক্লাস নাইন-টেন ২ বছরে চোরজনি আমাকে অসংখ্য বই জোগাড় করে দিয়েছে গণপাঠাগার থেকে।এখন বুঝতে পারি, কাজটা ভুল ছিল, কিন্তু সেজন্য অপরাধবোধের পরিবর্তে তৃপ্তি কাজ করে_ মার্কটোয়েনের মত মহান হতে না পারি, বই চুরিতে তাকে অনুসরণ তো করতে পেরেছি।
নটরডেম কলেজে পড়ার সময বই পড়া এবং বইকেনা দুটি অভ্যাসেই শৈথিল্য দেখা যায়; তখন দাবার নেশা চেপে বসেছিল ভয়াবহরকম।তবে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠার পর পুরনো অভ্যাসের প্রত্যাবর্তন ঘটে। কলেজে অনীক নামে এক বন্ধু ছিল। সে আর একজন বইপাগল। তবে সে কেনার পরিবর্তে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার নিত। ওর সূত্রেই প্রথম জানতে পেরছিলাম যে নীলক্ষেতে অল্প দামে ভালো বই পাওয়া যায়।আমি থাকতাম মুগদাপাড়া আর ওর বাসা বকশিবাজার। প্রতিমাস শেষে ওকে টাকা আর লেখকের তালিকা দিতাম, "ও" সেই অনুযায়ী আমাকে বই কিনে এনে দিত। অবশ্য ওকে বইপ্রতি একটা করে বেনসন সিগারেট সার্ভিস চার্জ হিসেবে দিতে হত।
বুয়েটে আসার পর বইকেনার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন বই কিনি টিউশনির বেতনের ভিত্তিতে। প্রতিমাসে বেতনের ২০% খরচ হবে বইকেনা তহবিলে, এই শর্তে ফার্স্ট ইয়ারে বইকেনা ভালোভাবেই চলছিল।কিন্তু এরপর আমার টিউশনি ক্যারিয়ারে ভয়াবহ ধস দেখা দেয়, যে কারণে বই কেনাটাও চালাতে হচ্ছে বিভিন্ন খাতে খরচের খাত কমিয়ে।তন্মধ্যে "Golden Age" বইটি কেনার ঘটনাটি ইতিহাস হয়ে থাকবে আমার লাইব্রেরীর ভুবনে। এই বইটি কেনার আগে হঠাৎ মনে হল , ভিন্নকিছু করলে কেমন হয়! সেই সূত্রেই "আমারে দেবনা ভুলিতে প্রোজেক্ট।" এই প্রোজেক্টের তাৎপর্য হচ্ছে আমার প্রত্যেক সহপাঠীর উপস্থিতির স্মারক হয়ে আছে এই বইটি। ওদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০টাকা করে নিয়েই এই বইটি কিনেছিলাম। আর বইয়ের ফাকা জায়গাগুলোতে ওদের মন্তব্য লেখা। কেউ আমাকে "লম্পট" লিখে গালিগালাজ করেছে, কেউ লিখেছে "পাগল".....মানে দুষ্টুমির যত ভাষা হয় আর কি! এই ব্ইয়ের তাৎপর্য এখন বুঝতে পারছিনা, কিন্তু আমি জানি বুয়েট পাশ করার পর এই বইটি খুললেই মন খারাপ হয়ে যাবে, কাছের মানুষগুলোকে মিস করব। সেজন্যই "আমারে দেবনা ভুলিতে প্রোজেক্ট।"
একুশে বইমেলায় প্রথম আসি ২০০৪ সালে। এরপর কোনবছরই মিস করিনি। প্রতিবছরই বইমেলা উপলক্ষে জানুয়ারী মাস থেকেই আমরা তহবিল সংগ্রহ শুরু হয়। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত খরচ কর্তন করে সঞ্চয় চলতে থাকে, আর আব্বু-আম্মু-বড় আপা-দুলাভাই প্রত্যেকের জন্য একটি আলাদা বাজেট তৈরি করে রাখি। আমি বরাবরই অন্তর্মুখী স্বভাবের হওয়ায় দুলাভাইয়ের কাছ থেকে বড় বাজেট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়না।
গতবছর বইমেলা থেকে নতুন প্রোজেক্ট শুরু হয়েছে। এর নাম " 'ক্ষুদ্রঋণ' ও 'মুক্তহস্তে অনুদান' প্রোজেক্ট"।
ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে বলি। সেই প্রাইমারী স্কুল থেকে বুয়েট অদ্যাবধি যত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে সবার থেকে ১০০টাকা ঋণ নেই। ঋণের পরিমাণ নির্দিষ্ট ; কম-বেশি হওয়ার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি কাজ করে সেটি এমন: একজনের কাছে৫০০০ টাকা ঋণ চাইলে সে হয়ত অপ্রস্ত্তত হবে, কিন্তু একজনের কাছে ১০০ করে মোট ৫০জনের কাছে ঋণ পেলেই তো৫০০০ হয়। ১০০টাকা ঋণ দেয়াটা বোধহয় ততটা সমস্যা নয়। তাছাড়া আমিতো ৫০এর অধিক মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। এই একটি মাসে বইয়ের সূত্রে তাদের সাথে নাহয় আর একটু জানাশোনা হল! আমার লাইব্রেরীতে সবারই অবদান থাকুক। এরপর সারাবছর এই ক্ষুদ্রঋণ শোধ করে কেটে যায়।
মুক্তহস্তে অনুদানই মূলত আমার তহবিলের প্রাণ সঞ্চালক। সিনিয়রদের সাথে আমার বরাবরই সুসম্পর্ক থাকে। বুয়েটেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এই অনুদানটাও আসে এই সিনিয়রদের থেকেই। হলের পুরনো রুমমেট, ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, এলাকার কিছু সিনিয়রসহ অনুদানদাতার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এই অনুদানের কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। এটা সিনিয়রদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সেটা ১০০ হতে পারে, ১০০০ ও হতে পারে। অনুদানের টাকা অফেরতযোগ্য বলেই এর নাম "মুক্ত হস্তে অনুদান।
মধ্য জানুয়ারী চলছে। তাই ক্ষুদ্রঋণও আসতে শুরু করেছে। সামনে সপ্তাহ থেকে স্কুলের বন্ধুদের থেকেও আসা শুরু হবে ঋণ। ওরা বিভিন্ন ভার্সিটি-মেডিকেলে পড়ে, তবুও ফেব্রুয়ারী মাস আসলে মানি অর্ডার করতে ভুল হয়না ওদের একটুও। একটা সময় ভাবতাম আমি একজন নির্বান্ধব-নৈরাশ্যবাদী মানুষ। কিন্তু প্রতিবছর জানুয়ারীর ১৫ তারিখের পর থেকেই আমার ভাবনা পরিবর্তিত হতে থাকে; বন্ধুদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হই_ আমার লাইব্রেরী গড়ে তুলতে কী অকৃত্রিমভাবে ওরা সাহায্য করে যাচ্ছে।
আমি প্রতিটি বইয়ের মুখবন্ধে নিজজস্ব কিছু কোড আর বাক্যবিন্যাস লিখে তারিখ, স্থান লিখে রাখি। আর সেইসাথে আলাদা একটি ডায়েরীতে লেখা থাকে বইয়ের তহবিলের যোগানদান কারী বন্ধুদের নাম। হয়ত আজ থেকে ২০-৩০ বছর পরে আমার লাইব্রেরীটা দাঁড়িয়ে যাবে কয়েক হাজার বই নিয়ে, সেদিন এই বন্ধুরা যে যেখানেই থাকুক, বইয়ের মাঝে ঠিকই বেঁচে থাকবে। বই আর বন্ধুত্ব ভিন্ন অবয়বে অভিন্ন বিম্ব হয়ে থাকুক আমার মননে।
বইকেনা, বইমেলা, ক্ষুদ্রঋণ, অনুদান, এবং লাইব্রেরীসহ সেমি-অসংলগ্ন+সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমাদের জাতির কপালে শনি আছে

একাত্তরে যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে তারা বলেছে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না, সুতরাং ভারতের অধীন হওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের অধীন থাকা ভালো। তারা মনে করেছে অধীকাংশ নাগরিক তাদের দলে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?
হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?
জুলাই আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতা ছিলেন না , তাকে কেউ চিনতো না কয়েক মাস আগে ও ।
জুলাই জংগীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদি ভাই, ইনসাফ এবং একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প

ইদানিং একটা কথা খুব মনে পড়ে। হাদি ভাই।
মানুষটা নেই, কিন্তু তার কথাগুলো? ওগুলো যেন আগের চেয়েও বেশি করে কানে বাজে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি? ক্ষমতা? গদি? নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে
আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[
স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ৩০ দেশের দুষ্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদুত বদলায়ে দিচ্ছে!

আইয়ুব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার পর, বাংগালীদের লাথি খেয়ে সরেছে; জিয়া, কর্নেল তাহের ও জাসদের গণ বাহিনী আমাদের দেশকে নরক (১৯৭৫ সাল ) বানিয়ে নিজেরা নরকে গেছে। আমাদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।