somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলচ্চিত্র চালচিত্র: :মনপুরা'তে মন পুড়লো কি?

০৭ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ করেই আজ বলাকা সিনেমা হলে পৌছে গেলাম সন্ধ্যার দিকে গুটিকয়েক বন্ধুবেষ্টিত হয়ে, উদ্দেশ্য হালের ফেনোমেনন চলচ্চিত্র "মনপুরা" দর্শন। টিকিটের লাইন দেখে রীতিমত স্তম্ভিত হয়েছিলাম, বাংলা সিনেমা এখনো এত দর্শক টানতে সক্ষম! আমার ইচ্ছা করছিল সর্বনিম্ন মূল্যের টিকিটে সিনেমা দেখে একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করি, কিন্তু সঙ্গীদের গণতন্ত্রের চর্চায় অভিজ্ঞতাটা আর হলনা। এরপর, ভীড় ঠেলে হলের ভিতরে প্রবেশ।
সাধারণত বহুল আলোচিত বাংলা-হিন্দি চলচ্চিত্রগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি, কেননা অতীত অভিজ্ঞতা বলে ' barking dog seldom bites'. তবুও এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটল, আর তারই ফলশ্রুতিতে মনপুরা'র তানপুরা বাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমি মনে করি, 'মনপুরা' নিয়ে ব্যাপক দর্শক আগ্রহের কারণ এ সিনেমার চমৎকার গানগুলো, এবং সিনেমা দেখে আসার পরও সেই মনে হওয়াটা অক্ষুণ্ন আছে। এর সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যোগ হয়েছে "ক্যামেরার কাজ"। আমার ধারণা, বাংলা চলচ্চিত্র ক্যামেরার এমন অসাধারণ ব্যবহার ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি, তাই এটি আগামী দিনের চলচ্ছিত্রগুলোর জন্য একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। নদী-আকাশ-প্রকৃতি-গাছপালা-এমনকি মানুষের হাটাচলাগুলোও এমনভাবে ধারণ করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র ক্যামেরার ব্যবহার উপভোগের জন্য হলেও এই সিনেমাটি পুনরায় দেখতে রাজী আছি।
ক্যামেরার মুগ্ধতার কথা বললে আরও একটি বিষয় আড়ালে চলে যায়: চঞ্চল চৌধুরীর অনবদ্য অভিনয়। চঞ্চল চৌধুরী ঘুরেফিরে সেই একটি নির্দিষ্ট ঘরানারই অভিনয় করে বলে অধিকাংশ সময় তাকে ভাল লাগেনা, তবুও এক্ষেত্রে সেই একই ঘরানাতেই সে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন, এ চরিত্রটি অন্য কাউকে কোনভাবেই মানাত না, বিশেষ করে সিনেমায় একটি দৃশ্য আছে দৌড়ে ছাগল ধরার; এই দৃশ্যটির বাস্তবতা অনেকদিন স্মৃতিতে ঢু মারবে।তার চিরায়ত বাচনভঙ্গিটাও এ সিনেমার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।পাগলের চরিত্রে মডেল শিমুলের অভিনয়ও পরিপক্কতার সাক্ষর রেখেছে; একটি দৃশ্য আছে যে, তাকে চিকিৎসা করার জন্য এক পীরবাবা আসেন, সেসময় সে পীরের অনুকরণটি যেভাবে করল, তা দেখে হলে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।আরও একটি দৃশ্য আছে এমন যে, তার স্ত্রীর বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধা এসে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলে সে ক্ষিপ্ত হয় উঠে। পবর্তীতে ভুল ভাঙ্গে এবং আনন্দে বৃদ্ধাকে সালাম করা শুরু করা দেয়, এরপর স্ত্রীকেও সালাম করে বসে! ফজলুর রহমান বাবু বরাবরের মতই তার মানদণ্ডের অভিনয় করে গেছে, বিশেষ করে "পাগল বরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করায় প্রতিবশী বুড়ি এর প্রতিবাদ করলে , তার প্রতিক্রিয়াটা অসম্ভব রকম বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে।" তবে অভিনয়ের প্রসঙ্গে বললে, নন্দিত অভিনেতা মামুনুর রশীদ হতাশ করেছেন। তার চরিত্রে আরো ইনোভেটিভ হওয়ার দাবীদার ছিল, তিনি সেটা পূরণে ব্যর্থই বলবো।।
ক্যামেরার ব্যবহার , আর কলাকুশলীদের অনুপম অভিনয়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিনেমার কাহিনী অংশই ঢাকা পড়ে গেছে। তার আগে, একটি সিনেমা থেকে ঠিক কী প্রত্যাশিত, সে সম্বন্ধে একটু বলা যেতে পারে। সিনেমাকে সিনেমা হিসেবেই দেখতে চাই, যদি সেটা ভাল লাগে, এবং দেখার পর ঘণ্টা তিনেক সময়কে অপচয়ের খাতায় না ফেলতে হয়।
সিনেমার কাহিনীটি অতি সরল, সচরাচর যা দেখি তেমনই। তবে, এর মধ্য দিয়েও উঠে এসেছে বিত্তবানদের স্বার্থপরতা-নির্লজ্জতা, দরিদ্রের হাহাকার- অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে পৌছানোর দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আর নির্মমতার চিত্র।
সিনেমার শুরু হয় অপ্রকৃতিস্থ শিমুলের একটি খুন করার মাধ্যমে, যার দায়ভার বাড়ির চাকর চঞ্চলের উপর অর্পণ করে তাকে নদীর ধারের এক নির্জন চরে পাচার করে দেয়া হয়। সেখানে, তার নিঃসঙ্গ জীবনের প্রতিমুহূর্তের বেদনার মাঝে ফিরে আসে "রবিনসন ক্রসো"। কথা বলার কাউকে না পেয়ে সে নদীতে চলাচলকারী মাঝিদের ডেকে কথা বলে, গর-ছাগল-ময়না পাখির সঙ্গে কথা বলে। এরপর ঘটনার ধারাবাহিকতায় তার জীবনে প্রেম আসে, যা তার মালিক মামুনুর রশিদের স্বার্থে আঘাত হানে। তাই সে নির্দোষ হয়েও হাজতবাস করে, আর নায়িকার ভাগ্যে জোটে পাগল স্বামী। একসময় চঞ্চল মুক্ত হয, কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা, এখানেও সেই স্বার্থপরতা : চঞ্চলকে যাতে নায়িকা ভুলে গিয়ে পাগল স্বামীকে মেনে নেয়, সেজন্য ইনিয়ে বিনিয়ে তার শ্বাশুড়ি তাকে জানায় যে শুক্রবার রাত বারোটায় চঞ্চলের ফাঁসি কার্যকর হবে। ব্যস, ঠিক ১২টা ১ মিনিটে নায়িকা বিষপান করে, চঞ্চলের স্মৃতিচারণ করতে করতে। এ অংশটুকুকে দৃষ্টিকটুভাবে হিন্দি চলচ্চিত্র গ্যাংস্টারের প্রভাবযুক্ত মনে হয়েছে। পরদিন ভোরে চঞ্চল ফিরে আসার পরবর্তী ঘটনাটা হিন্দি চলচ্চিত্র "তেরে নাম' এর প্রভাবযুক্ত। পরিচালক চাইলেই হয়ত, এই প্রভাবগুলো এড়িয়ে যেতে পারতেন। সিনেমার শেষদৃশ্যটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত: জীবনের প্রতি মোহশূন্য চঞ্চল নদীতে ডিঙ্গি নৌকা বাইতে বাইতে চলে যাচ্ছে, এরপর মাঝনদীতে এসে হঠাৎ করে বৈঠা ছুড়ে ফেলে গুটিসুটি হযে নৌকায বসে থাকে, নৌকা ঢেউয়ে দুলতে দুলতে এগুতে থাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে...এখানেও যথারীতি আরো একবার ক্যামেরার অসাধারণত্ব।
সিনেমার প্রতিটি ঘটনা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল, কাহিনীতেও খুব নাটকীয়তা নেই, তবুও দৃশ্য-ঘটনাপরম্পরার অপূর্ব সমণ্বয়ে এই পূর্বানুমানেও এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছিল। একটি দৃশ্য বাদ পড়ে গেছে: চঞ্চল ঘাসের উপর অনুভূমিকভাবে শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে, তার শরীরের উপর খেলা করছে একটি ছাগলছানা, সে ছানাটির সঙ্গে কথা বলছে....এই দৃশ্যটি এই সিনেমার একটি শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ বলে মনে হয়েছে।
এবার সিনেমার অপছন্দের দিকগুলো বলি। ভালোবাসার শুরুর ধরনটাই ভাল লাগেনি : হঠাৎ নৌকার উপর এক ঝলক দেখেই দুজনের ভাল লেগে যাওয়াটা রীতিমত টেলিপ‌্যাথির মত লেগেছে। এই বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে বাবার মাছ ধরতে আসাটাও অবিশ্বাস্য, মাছ ধরার দৃশ্যগুলোও ততটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বরং, নদীতে গোসল করাটা নদী তীরবর্তী মানুষদের জন্য খুবই স্বাভাবিক, আমি নিজেও এমন নজির অনেক দেখেছি। নায়ক-নায়িকার যোগাযোগসূত্রটাও এখান থেকে হলে ভাল লাগত।
মামুনুর রশিদের পরিবারের সদস্যদের ভাষার অসামঞ্জস্যটাও শ্রুতিকটু। তার নিজের-স্ত্রীর-শিমুল, তিনজনের ভাষা তিনরকম দেখানো হয়েছে, যেটা খাপছাড়া লাগে।
বিয়োগান্তক পরিণতির ক্ষেত্রে সেই চিরন্তন মৃত্যুর ধারণা থেকে এ সিনেমাটিও মুক্ত হতে পারেনি। নায়িকার একটি সংলাপ ছিল " নদী ছাড়া আমি বাঁচতে পারুমনা"....এই সংলাটির সার্থক প্রয়োগ ঘটতে পারত যদি নদীর পথ ধরেই সে হারিয়ে যেত কোথাও অজানার উদ্দেশ্য। নায়কসহ সবাই তার সন্ধান করত।।।
নায়িকা প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নায়িকা চরিত্রটি কিছুটা ভুল নির্বাচন ছিল; স্বত:স্ফূর্ত অভিনয়ের পরিবর্তে তাকে অধিকাংশ সময়ই মনে হয়েছে আড়ষ্ট, শিক্ষানবিস। পাশাপাশি, গ্রামীণ চেহারার সঙ্গেও তাকে মানাচ্ছিল না কোনক্রমেই, বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত। এ চরিত্রে অভিনেত্রী মমো হয়ত ভাল বিকল্প হতে পারত( ব্যক্তিগত অভিমত)
.............আজ সন্ধ্যায় আমার এক বড় বোনের বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু পরিস্থির কারণে না যেতে পারায় তাকে ফোন করলে সেই আপুর বক্তব্য ছিল: "তুমি একজনের মন পুড়িয়ে তো মনপুরা দেখতে পারনা"। দেখা শেষে এখন আপুর কথাটিই মনে পড়ছে : "মনপুরাতে আদৌ মন পুড়ল কি?"
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১:০৪
৪৮টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাইনারি চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি: পূর্ণাঙ্গ তুলনার ধারণা এবং এর গুরুত্ব

লিখেছেন মি. বিকেল, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩০



সাধারণত নির্দিষ্ট কোন বস্তু যা শুধুমাত্র পৃথিবীতে একটি বিদ্যমান তার তুলনা কারো সাথে করা যায় না। সেটিকে তুলনা করে বলা যায় না যে, এটা খারাপ বা ভালো। তুলনা তখন আসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×