সাধারণত বহুল আলোচিত বাংলা-হিন্দি চলচ্চিত্রগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি, কেননা অতীত অভিজ্ঞতা বলে ' barking dog seldom bites'. তবুও এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটল, আর তারই ফলশ্রুতিতে মনপুরা'র তানপুরা বাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমি মনে করি, 'মনপুরা' নিয়ে ব্যাপক দর্শক আগ্রহের কারণ এ সিনেমার চমৎকার গানগুলো, এবং সিনেমা দেখে আসার পরও সেই মনে হওয়াটা অক্ষুণ্ন আছে। এর সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যোগ হয়েছে "ক্যামেরার কাজ"। আমার ধারণা, বাংলা চলচ্চিত্র ক্যামেরার এমন অসাধারণ ব্যবহার ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি, তাই এটি আগামী দিনের চলচ্ছিত্রগুলোর জন্য একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। নদী-আকাশ-প্রকৃতি-গাছপালা-এমনকি মানুষের হাটাচলাগুলোও এমনভাবে ধারণ করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র ক্যামেরার ব্যবহার উপভোগের জন্য হলেও এই সিনেমাটি পুনরায় দেখতে রাজী আছি।
ক্যামেরার মুগ্ধতার কথা বললে আরও একটি বিষয় আড়ালে চলে যায়: চঞ্চল চৌধুরীর অনবদ্য অভিনয়। চঞ্চল চৌধুরী ঘুরেফিরে সেই একটি নির্দিষ্ট ঘরানারই অভিনয় করে বলে অধিকাংশ সময় তাকে ভাল লাগেনা, তবুও এক্ষেত্রে সেই একই ঘরানাতেই সে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন, এ চরিত্রটি অন্য কাউকে কোনভাবেই মানাত না, বিশেষ করে সিনেমায় একটি দৃশ্য আছে দৌড়ে ছাগল ধরার; এই দৃশ্যটির বাস্তবতা অনেকদিন স্মৃতিতে ঢু মারবে।তার চিরায়ত বাচনভঙ্গিটাও এ সিনেমার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।পাগলের চরিত্রে মডেল শিমুলের অভিনয়ও পরিপক্কতার সাক্ষর রেখেছে; একটি দৃশ্য আছে যে, তাকে চিকিৎসা করার জন্য এক পীরবাবা আসেন, সেসময় সে পীরের অনুকরণটি যেভাবে করল, তা দেখে হলে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।আরও একটি দৃশ্য আছে এমন যে, তার স্ত্রীর বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধা এসে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলে সে ক্ষিপ্ত হয় উঠে। পবর্তীতে ভুল ভাঙ্গে এবং আনন্দে বৃদ্ধাকে সালাম করা শুরু করা দেয়, এরপর স্ত্রীকেও সালাম করে বসে! ফজলুর রহমান বাবু বরাবরের মতই তার মানদণ্ডের অভিনয় করে গেছে, বিশেষ করে "পাগল বরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করায় প্রতিবশী বুড়ি এর প্রতিবাদ করলে , তার প্রতিক্রিয়াটা অসম্ভব রকম বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে।" তবে অভিনয়ের প্রসঙ্গে বললে, নন্দিত অভিনেতা মামুনুর রশীদ হতাশ করেছেন। তার চরিত্রে আরো ইনোভেটিভ হওয়ার দাবীদার ছিল, তিনি সেটা পূরণে ব্যর্থই বলবো।।
ক্যামেরার ব্যবহার , আর কলাকুশলীদের অনুপম অভিনয়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিনেমার কাহিনী অংশই ঢাকা পড়ে গেছে। তার আগে, একটি সিনেমা থেকে ঠিক কী প্রত্যাশিত, সে সম্বন্ধে একটু বলা যেতে পারে। সিনেমাকে সিনেমা হিসেবেই দেখতে চাই, যদি সেটা ভাল লাগে, এবং দেখার পর ঘণ্টা তিনেক সময়কে অপচয়ের খাতায় না ফেলতে হয়।
সিনেমার কাহিনীটি অতি সরল, সচরাচর যা দেখি তেমনই। তবে, এর মধ্য দিয়েও উঠে এসেছে বিত্তবানদের স্বার্থপরতা-নির্লজ্জতা, দরিদ্রের হাহাকার- অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে পৌছানোর দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আর নির্মমতার চিত্র।
সিনেমার শুরু হয় অপ্রকৃতিস্থ শিমুলের একটি খুন করার মাধ্যমে, যার দায়ভার বাড়ির চাকর চঞ্চলের উপর অর্পণ করে তাকে নদীর ধারের এক নির্জন চরে পাচার করে দেয়া হয়। সেখানে, তার নিঃসঙ্গ জীবনের প্রতিমুহূর্তের বেদনার মাঝে ফিরে আসে "রবিনসন ক্রসো"। কথা বলার কাউকে না পেয়ে সে নদীতে চলাচলকারী মাঝিদের ডেকে কথা বলে, গর-ছাগল-ময়না পাখির সঙ্গে কথা বলে। এরপর ঘটনার ধারাবাহিকতায় তার জীবনে প্রেম আসে, যা তার মালিক মামুনুর রশিদের স্বার্থে আঘাত হানে। তাই সে নির্দোষ হয়েও হাজতবাস করে, আর নায়িকার ভাগ্যে জোটে পাগল স্বামী। একসময় চঞ্চল মুক্ত হয, কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা, এখানেও সেই স্বার্থপরতা : চঞ্চলকে যাতে নায়িকা ভুলে গিয়ে পাগল স্বামীকে মেনে নেয়, সেজন্য ইনিয়ে বিনিয়ে তার শ্বাশুড়ি তাকে জানায় যে শুক্রবার রাত বারোটায় চঞ্চলের ফাঁসি কার্যকর হবে। ব্যস, ঠিক ১২টা ১ মিনিটে নায়িকা বিষপান করে, চঞ্চলের স্মৃতিচারণ করতে করতে। এ অংশটুকুকে দৃষ্টিকটুভাবে হিন্দি চলচ্চিত্র গ্যাংস্টারের প্রভাবযুক্ত মনে হয়েছে। পরদিন ভোরে চঞ্চল ফিরে আসার পরবর্তী ঘটনাটা হিন্দি চলচ্চিত্র "তেরে নাম' এর প্রভাবযুক্ত। পরিচালক চাইলেই হয়ত, এই প্রভাবগুলো এড়িয়ে যেতে পারতেন। সিনেমার শেষদৃশ্যটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত: জীবনের প্রতি মোহশূন্য চঞ্চল নদীতে ডিঙ্গি নৌকা বাইতে বাইতে চলে যাচ্ছে, এরপর মাঝনদীতে এসে হঠাৎ করে বৈঠা ছুড়ে ফেলে গুটিসুটি হযে নৌকায বসে থাকে, নৌকা ঢেউয়ে দুলতে দুলতে এগুতে থাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে...এখানেও যথারীতি আরো একবার ক্যামেরার অসাধারণত্ব।
সিনেমার প্রতিটি ঘটনা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল, কাহিনীতেও খুব নাটকীয়তা নেই, তবুও দৃশ্য-ঘটনাপরম্পরার অপূর্ব সমণ্বয়ে এই পূর্বানুমানেও এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছিল। একটি দৃশ্য বাদ পড়ে গেছে: চঞ্চল ঘাসের উপর অনুভূমিকভাবে শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে, তার শরীরের উপর খেলা করছে একটি ছাগলছানা, সে ছানাটির সঙ্গে কথা বলছে....এই দৃশ্যটি এই সিনেমার একটি শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ বলে মনে হয়েছে।
এবার সিনেমার অপছন্দের দিকগুলো বলি। ভালোবাসার শুরুর ধরনটাই ভাল লাগেনি : হঠাৎ নৌকার উপর এক ঝলক দেখেই দুজনের ভাল লেগে যাওয়াটা রীতিমত টেলিপ্যাথির মত লেগেছে। এই বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে বাবার মাছ ধরতে আসাটাও অবিশ্বাস্য, মাছ ধরার দৃশ্যগুলোও ততটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বরং, নদীতে গোসল করাটা নদী তীরবর্তী মানুষদের জন্য খুবই স্বাভাবিক, আমি নিজেও এমন নজির অনেক দেখেছি। নায়ক-নায়িকার যোগাযোগসূত্রটাও এখান থেকে হলে ভাল লাগত।
মামুনুর রশিদের পরিবারের সদস্যদের ভাষার অসামঞ্জস্যটাও শ্রুতিকটু। তার নিজের-স্ত্রীর-শিমুল, তিনজনের ভাষা তিনরকম দেখানো হয়েছে, যেটা খাপছাড়া লাগে।
বিয়োগান্তক পরিণতির ক্ষেত্রে সেই চিরন্তন মৃত্যুর ধারণা থেকে এ সিনেমাটিও মুক্ত হতে পারেনি। নায়িকার একটি সংলাপ ছিল " নদী ছাড়া আমি বাঁচতে পারুমনা"....এই সংলাটির সার্থক প্রয়োগ ঘটতে পারত যদি নদীর পথ ধরেই সে হারিয়ে যেত কোথাও অজানার উদ্দেশ্য। নায়কসহ সবাই তার সন্ধান করত।।।
নায়িকা প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নায়িকা চরিত্রটি কিছুটা ভুল নির্বাচন ছিল; স্বত:স্ফূর্ত অভিনয়ের পরিবর্তে তাকে অধিকাংশ সময়ই মনে হয়েছে আড়ষ্ট, শিক্ষানবিস। পাশাপাশি, গ্রামীণ চেহারার সঙ্গেও তাকে মানাচ্ছিল না কোনক্রমেই, বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত। এ চরিত্রে অভিনেত্রী মমো হয়ত ভাল বিকল্প হতে পারত( ব্যক্তিগত অভিমত)
.............আজ সন্ধ্যায় আমার এক বড় বোনের বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু পরিস্থির কারণে না যেতে পারায় তাকে ফোন করলে সেই আপুর বক্তব্য ছিল: "তুমি একজনের মন পুড়িয়ে তো মনপুরা দেখতে পারনা"। দেখা শেষে এখন আপুর কথাটিই মনে পড়ছে : "মনপুরাতে আদৌ মন পুড়ল কি?"
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১:০৪