পেশা হিসেবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কেমন?
৫-৬ বছর আগে এই প্রশ্নের উত্তর ছিল খুবই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এখন এর উত্তর এককথায়-"আইছেন তো মরছেন!"
প্রথমেই যারা মনে করেন মেরি্নে ভর্তি হলেই টাকা, তাদের কিছুটা ধারনা দেওয়া প্রয়োজন।
ধাপ-১ঃ HSC পাশের পর ২ বছরের Pre-sea ট্রেইনিং করতে হবে একাডেমিতে,
ধাপ-২ঃ ১ বছর সমুদ্রগামী জাহাজে ক্যাডেট হিসেবে শিক্ষানবিশ থাকতে হবে,
ধাপ-৩ঃ Class-3 পরিক্ষা দিয়ে COC(Certificate of Competency) অর্জন করতে হবে;
এরপরেই আপনি জাহাজে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকুরি শুরু করতে পারবেন।
এবার আসি সেই ধাপগুলোর আলোচনায়ঃ-
"ধাপ-১", অর্থাৎ ২ বছরের Pre-sea ট্রেইনিং করতে আগে শুধুমাত্র "বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি" এবং "মেরিন ফিসারিজ একাডেমি", এই দুইটি প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু এখন মাশাআল্লাহ প্রাইভেট একাডেমিই ১৮ টি। আগে যেখানে একমাত্র সরকারি একাডেমি হতে সব মিলিয়ে প্রতি বছর ক্যাডেট তৈরি হত ১৫০-২০০ জন, গত ৩-৪ বছর ধরে বাংলাদেশ এখন সরকারি-প্রাইভেট মিলিয়ে প্রতি বছর ৮০০-১০০০ ক্যাডেট বের হয়। শুধুমাত্র মেরিন একাডেমি থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (বর্তমানে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অধীনে) "ধাপ-২" তে জাহাজের ১ বছরের প্রশিক্ষন শেষে ৩ বছর এর বিএসসি(পাশ) ডিগ্রী দেওয়া হয়, প্রাইভেট একাডেমিগুলো থেকে এ ধরনের কোন ডিগ্রী দেওয়া হয় না। প্রাইভেট একাডেমিগুলোতে ভর্তির বিষয়ে আলাপ করতে চাইলে, তারা কখনোই ফোনে আপনাকে কিছু বলবে না, তাদের ক্যাম্পাসে যেতে বলবে। আপনি তাদের ঝকঝকে ৫ স্টার মার্কা ক্যাম্পাস দেখে আবেগে আপ্লুত হবেন,তারা একটা অপ্রয়োজনীয় ব্রিটিশ ডিগ্রীর মুলা দেখাবে, আর তাদের একঝাক মিথ্যা আশ্বাস সহজেই বিশ্বাস করবেন। মনে রাখবেন,সকল প্রাইভেট মেরিন হল কতিপয় সিনিয়র মেরিনার আর এক্স-নেভির লোকজনের অতিমাত্রার লাভজনক রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান
"ধাপ-২", অর্থাৎ সমুদ্রগামি জাহাজে ১ বছরের শিক্ষানবিশকাল হাতের মোয়া না। আপনি অতিমাত্রায় মেধাবি হলে মেরিন একাডেমি থেকে জাহাজে স্কলারশিপ পেতে পারেন, এই সংখ্যা বর্তমানে ৩০০ জনে ৫ জন। এই ৫ জন বাদে আপনি চাকুরির বাজারে একজন ফ্রীল্যান্সার, অর্থাৎ আপনার চাকুরি আপনাকেই যোগাড় করতে হবে। আর ভিসা সমস্যা, জাল সনদের কারনে বাংলাদেশি নাবিকদের জাহাজে চাকুরি পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া এখন সমার্থক শব্দ, কারন দেশি জাহাজের সংখ্যাও ৭৫ থেকে কমতে কমতে এখন ৩৩ টি। আর প্রাইভেট একাডেমিগুলোর কথা বাদই দিলাম। নিয়ম অনুযায়ী এদের চাকুরি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ক্যাডেট পাশ করার পরে এদেরকে আর খুজে পাওয়া যায় না, কারন আপনাকে নিয়ে এদের ব্যবসা ঐ ২ বছর পর্যন্তই। এই ২ বছরে আপনার পকেট থেকে ১২-১৮ লাখ টাকা খসিয়ে পরবর্তিতে তারা আপনাকে চিনতে পারবে, এই কথা চিন্তা করাও বোকামি। পত্রপত্রিকার কল্যাণে এতদিনে আপনি অবশ্যই জেনে গেছেন দেশে এখন বেকার ক্যাডেটের সংখ্যা ৭০০ এর কিছু বেশি, যা আগামি বছর হবে ১৫০০, এর পরের বছর ২০০০, এভাবে বাড়তে থাকবে। ধাপ-২ এর নির্ধারিত জাহাজে ১ বছর শিক্ষানবিশ বা ক্যাডেট লাইফ আপনি টানা ১ বছরে শেষ করতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক নিয়মে ৬-৯ মাসের বেশি একটি জাহাজে চাকুরি করার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাহলে বোঝা গেল এই ১ বছর শেষ করতে আপনার কমপক্ষে ২ টি জাহাজে উঠতে হবে। যারা শিপিং ইন্ডাস্ট্রির সাথে পরিচিত, তারা সহজেই অনুমান করতে পারেন একজন ক্যাডেটের পক্ষে পর পর ২ টি জাহাজে চাকুরি জোগাড় করা কতটা দুঃসাধ্য, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব। ক্যাডেট লাইফে ১০০-১৫০ ডলারের চাকুরি যোগাড় করতে ২-৩ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয় এখন,এই কথা সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য; একটু খোজ নিলেই জানতে পারবেন। কিছু কিছু একাডেমির লোকজন ভর্তির সময় অভিভাবকদের বলবে, "কোন চিন্তা নাই, সব আমাদের উপর ছেড়ে দিন, আপনার ছেলেকে মেরিনে ভর্তি করালেন মানে একটা টাকার গাছ লাগালেন।" দূর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি যদি এদের কথা বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এসব প্রাইভেট একাডেমি থেকে কতজন পাশ করেছে, আর কতজন জাহাজে চাকুরি পেয়েছে তার কোন "সঠিক" হিসাব আপনি তাদের কাছে পাবেন না।
"ধাপ-৩", অর্থাৎ ১ বছরের ক্যাডেট লাইফ শেষে Class-3 পরিক্ষা দিতে আসলে বিভিন্ন কোর্স, left-hand money এগুলোর পিছনে সহজেই এক-দেড় লক্ষ টাকা চলে যাবে, ঢাকার ডিজি শিপিং অফিসে যাওয়া-আসা করতে করতে আপনার জুতার তলা আর থাকবে না। লিখিত, মৌখিক এইসব পরিক্ষায় দৈবক্রমে এক চান্সে পাশ করতেও কমপক্ষে ১ বছর লেগে যাবে। আর কোন কারনে আপনি যদি সিংগাপুর বা মালয়শিয়ায় পরিক্ষা দেওয়ার নিয়ত করেন, তবে আপনার বাবার ব্যঙ্ক-ব্যালান্স এক ধাক্কায় জনতার কাতারে চলে আসবে, যদি তা আগেই না গিয়ে থাকে
অর্থাৎ বিষয়টা এমন নয় যে আপনি প্রতিটি ধাপই নির্দিষ্ট সময়ে পার হয়ে যাবেন; HSC এর পরে কমপক্ষে ৪ বছর আর কপাল খারাপ থাকলে ৫-৭ বছর লাগবে Class-3 পাশ করতেই, এখন ৫-৭ বছর স্বাভাবিক ব্যাপার। এরপরে আল্লাহর অশেষ এবং বিশেষ রহমতে যদি জাহাজে নিয়মিত চাকুরি করতে পারেন তাহলে আরো ৮-৯ বছর ধরে Class-2, Class-1 নামক অতিমাত্রায় ব্যায়বহুল পরিক্ষাগুলো দেবার পরে আপনি দেখবেন আপনার কোটি টাকার স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেল।ডাংগায় চাকুরির বেতন বছর বছর বৃদ্ধি পেলেও, জাহাজের চাকুরিজীবিদের বেতন কমেছে গুনিতক হারে। উদাহরনস্বরুপ, আগে ক্যাডেটদের গড় বেতন ৩০০-৪০০ ডলার হলেও, এখন তা কোনক্রমেই ১২০-১৫০ এর বেশি নয়। একই অবস্থা জাহাজের অন্যান্য র্যাঙ্কেও(কিছু বিশেষ কোম্পানি বাদে)।
অনেকের মনেই একটা ধারণা বধ্যমূল যে, জাহাজের চাকুরি অনেক চ্যালেঞ্জিং, এডভেঞ্চারাস। আমি বলি "ছাই!"। মাসের পর মাস পরিবার থেকে দূরে, কোন সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া, ৪৫-৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দৈনিক ১২-১৬ ঘন্টা কাজ করাটা আর যাই হোক "এডভেঞ্চারাস" না।
তাই, স্বপ্নের(!) পেশা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার (প্রতারিত হবার) আগে আরেকবার ভাবুন।
লেখকঃ
Ex-cadet, Bangladesh Marine Academy,
Class-3 Marine Engineer,
& most importantly jobless for last 1-year !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




