somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রসময়ঃ জীবনযুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধা

২১ শে জুন, ২০০৭ বিকাল ৫:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘরে খাবার নেই। প্রায়ই অসুখে ভোগেন। চিকিৎসা করানোর মতো টাকাও নেই। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সবুজবাগ গ্রামের রসময় কর্মকার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

দেশের টানে সেই ১৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। শায়েস্তাগঞ্জের বুলো বাবুর ওয়ার্কশপে কাজ করতেন তিনি। তখনই যুদ্ধ শুরু। পাক হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় এসে পড়ে তখন তিনি মা-বোনদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। ভারতের খোয়াই গিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে এক রাত থাকার পর বাংলাদেশ থেকে আরো মানুষ সেখানে যায়। তাদের কাছে তিনি জানতে পারেন তার বাবাবে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করেছে। তখন তার মা-বোনের কান্না সহ্য করতে না পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার।

হবিগঞ্জের বৌলাগ্রামের ইউনুস চৌধুরী খোয়াইয়ের অমর কলোনিতে মুক্তিবাহিনী গঠনের লক্ষে একটি ক্যাম্প গঠন করেন। সেখানে রসময় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নাম লেখান। তার সঙ্গে ছিলেন কবীর, নিখিল পাল, সুনীল বাড়ৈ, গোবিন্দ, আনসার আলী, রামকৃষ্ণসহ ১২ জনের গ্রুপ। গ্রুপ কমান্ডার হবিগঞ্জের সৈয়দ জাহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে তারা সেখানে ১৫ দিন ট্রেনিং নেন। এরপর অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টারে মেজর জেনারেল সফিউল্লার নেতৃত্বে ৩নং সেক্টরের আলফা কোম্পানিতে দেড় মাসের ট্রেনিং শেষ করেন।

ট্রেনিং শেষে বাঘাই ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন এজাহারের নেতৃত্বে যুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। রেমা, কালেঙ্গা, তুঙ্গেশ্বর এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কোথাও গেরিলা, কোথাও সম্মুখযোদ্ধে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনী কতবার তার বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন তারা। বাড়ি ফেরেন রসময়। ঘর পুননির্মাণও করেন। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি তিনি। অভাবের কারণে ১৯৮৫ সালে পৈতৃক ভিটেমাটি বিক্রি করে দেন।

সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার জন্য চলে আসেন শ্রীমঙ্গলে। তারপর থেকে ভাসমানের মতো জীবনযাপন- সঙ্গে স্ত্রী ও বৃদ্ধা মা। এরই মধ্যে গ্রামের অবশিষ্ট জমিজমাসহ বিষয়-সম্পত্তি জাল দলিল করে গ্রাস করে নিয়েছে ভূমিখেকোরা।

শ্রীমঙ্গল এসে উপজেলার সবুজবাগ গ্রামে প্রত্যন্ত এলাকায় ঠাঁই নেন তিনি। জীবিকার জন্য ঘুরতে থাকেন শহরের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ঘুরে ঘুরে কান্ত হয়ে পড়েন, তবুও জীবিকার কোন সন্ধান হয়নি তার। তিনি বলেন, কত পাকিস্তানিদের গ্রেনেড ও মাইনের বিষ্ফোরণে কুপোকাত করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আমি নিজেই কুপোকাত।

অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা রসময় যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রটি কার্ড নং- ০৫০৩০১০০৫৫, যোদ্ধা নং- ১২৩১৪২ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দেখালে তিনি তাকে থানার প্রধান ফটকের পাশে একটি পান দোকান নিয়ে বসার জন্য জায়গা দেন। বেশ চলতে থাকে রসময়ের ছোট দোকানটি।

অভাবের সংসারে স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দু’মুঠো খেয়ে-পরে সংসার চলতে থাকে রসময়ের। কিন্তু সেটিও বেশিদুর এগোতে পারে নি। পুঁজির অভাব ও বাকির কারণে দোকানটি বন্ধ করে দিতে হয়। এক পর্যায়ে রসময় আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। জীবিকার জন্য পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন আবার।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় ১৯৫৩ সালে লেঞ্জাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রসময়। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে পত্রিকা বিক্রি করে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। টাকার অভাবে নিজের চিকিৎসা করতে পারছেন না। মুক্তিযোদ্ধা রসময় বলেন, ‘পেটে ভাত নেই, খুব দুঃখ লাগে। ইন্ডিয়ার শরনার্থী ক্যাম্পে যারা খাইছে আর ঘুমাইছে এরা অইছে সঠিক মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা যুদ্ধে অংশ নিয়া রাইফেল গ্রেনেড চালাইছে তারা আজ ভাত খাইতে পায়না।’ মুক্তিযোদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আক্ষেপের সুরে কথা বলার সময় তার চোখের জল টলমল করতে থাকে।

চোখ মুছতে মুছতে তিনি আরো বলেন, ‘যুদ্ধের সময় দেশরে লইয়া অনেক স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম কেমনে দেশ শত্রুমুক্ত অইব। কেমনে মা-বোনের ইজ্জত রা অইব। দেশ স্বাধীন হইলে আর কোনো দুঃখ দুর্দশা থাকত না। কিন্তু আজ মুক্তিযোদ্ধারা দল করেন। আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দল নেই।’ আমরা সবাই একসঙ্গে যুদ্ধ করে জাতিকে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা আইন্যা দিছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দল নাই। আমরা সবাই একদল।’

৫৫ বছর বয়সে পত্রিকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা রসময় কর্মকার অশ্রুসিক্ত নয়নে তার জীবন-কাহিনী বর্ণনা করেন এভাবেই।

৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×