"রেজাকার অখলরে গুল্লি কইরা মারা দরকার, তারার আবার বিচার কিয়ের (কিসের)। তারা যুদ্ধের সময় মানুষ মারছে ইতা তো সবউ জানে।" কথাগুলো বলেন যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আছদ্দর আলী আনসার।
‘৭১-এ পাক বাহিনীর হাত থেকে দেশ মুক্ত করতে পারলেও নিজে আজ বন্দি অভাবের শৃঙ্খলে। স্বাধীন দেশকে পাহাড়া দিয়ে সংসার চলছে আনসার আলীর। নিজের হাতে স্বাধীন করা দেশে বেঁচে থাকার জন্য ৫২ বছর বয়সের শ্রীমঙ্গল শহরের সিন্দুরখাঁন রোডের বাসিন্দা আনসার আলী রাত জেগে শহরের মৌলভীবাজার সড়কের এহেসান মার্কেটে পাহাড়া দিয়ে যা পান তা দিয়েই সংসার চলছে। মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে অভাবের আগ্রাসী থাবার সাথে স্বাধীনতরা ৩৬ বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে তিনি আজ কান্ত। জমি-জমা বলতে কিছুই নেই। তাই ভাড়া বাসাতেই দিন কাটছে। নিত্য অভাবের সংসারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ উঁকি দেয়নি কখনো। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসারের দু’মুঠো খাবার যোগাতে রাত জেগে পাহাড় দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘সবউ (সব) আমার কপালের লেখন, না অইলে স্বাধীন দেশও অত কষ্ট কইরা থাকা লাগবো ইতা কোনদিনই ভাবছিলাম না।
"৭১-এ যুদ্ধের সূচনাকালে পৈতৃক বাড়ি জুড়ী থানার বড় ধামাই গ্রামে শিলুয়া জুনিয়র হাই স্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে পাক-হানাদারদের নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, লুন্ঠন আর জ্বালাও পুড়াও দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেন নি। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে তার মনে। বাড়ির কাউকে না বলেই দেশ স্বাধীন করার জন্য ১৬ বছর বয়সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গ্রামের সালাম, আকমল আলী ও ফুরকান আলীর সঙ্গে চলে যান পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কাছার জেলার সোনাীরা প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে। সেখানে একমাস ট্রেনিং শেষে তাকে পাঠানো হলো লোহারবন্দ গেরিলা ক্যাম্পে। ট্রেনিং শেষে ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সিআর দত্তের অধীনে ফাইট লেঃ নুরুল কাদিরের নেতৃত্বে জুড়ী, ধলাই, বড়লেখা, বিয়ানীবাজার ও পরবর্তীতে লেঃ ওয়াকিজামাল এর নেতৃত্বে কুলাউড়া ও শমসেরনগর, কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকায় বিভিন্ন অপারেশনে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে তার সহযোদ্ধা আকমল আলী পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। বর্তমানে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে খুুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন আনসার আলী। ভাঙা ভাড়া বাসাতে রৌদ্র-তাপ, ঝড়-বৃষ্টি সবই মুখ বুজে সহ্য করতে পারলেও অভাবের তাড়নায় দিশেহারা। আর্থিক অনটনের কারণে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে এক ছেলের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আরেক ছেলের ভাগ্যত (ভাগ্যে) কিতা (কি) আছে ইতা (এটা) একমাত্র আল্লায় উ জানইন (জানেন)।’ বর্তমানে দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতির বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ৯শ’ টাকা দিয়ে সংসার চালাতে না পারায়, ৫২ বছর বয়সে রাতে পাহাড়াদারের কাজ নিয়েছেন।
ভাতা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আসদ্দর আলী আনসার (গেজেট নং ২২০৪৫৯) স্বাধীনতার ৩৬ বছরে অন্যকোন সরকারি বা বেসরকারি সহযোগীতা পাননি। তার স্ত্রী তাহেরা বেগম আপে করে বলেন, ‘আমার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা অইয়াও স্বাধীন দেশও আজকে পরাধীন অইয়া থাকরাম । এই দুঃখের কথা কইয়া কিতা হইবো । একটু মাথা গুজার জেগা পাইলে বাসা ভাড়ার টেকা দিয়া পোলা পাইন্তরে পেঠ ভরাইয়া খাওয়াইতাম পারতাম ।
"মুক্তিযোদ্ধা আসদ্দর আলী আনসার দুঃখ করে বলেন, অসুস্থ শরীর লইয়া উ রাইত জাইগা পারা দেই, আর বাঁচি থাকতে সম্মান না পাইলে মরলে পরে রাষ্ট্রের সম্মান পাইয়া লাভ কিতা (কি)?
বাঁচি থাকতে চাই - মরলে পরে রাষ্ট্রের সম্মান পাইয়া লাভ কিতা!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(
আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।
ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন