somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯৭১ ট্রাজেডিঃ মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক দলিল....

০৭ ই মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৫:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সাল। গ্রেনেড ও বোমার স্ট্রাগল। স্বাধীনতার মাস। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের একটি লাল সবুজের পতাকা। সেই পতাকাটি উড়াতে সেদিন মুক্তির মাঠে ওরাও ছিল। বলছি বাংলাদেশের (তৎকালীন) সোয়া লাখ চা শ্রমিকের কথা। বৃটিশ শাসনের পালাবদল, পাকিস্তান ট্রাজেডি ও ১৯৭১ সালের মৃক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ চা শ্রমিকের প্রাণ সময়ের স্রোতে উৎসর্গীত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের আত্মহুতির প্রায় ৩ যুগে পদার্পণ। এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও চা শ্রমিকরা রয়ে গেছে সেকালেই। মহান এই স্বাধীনতার মাসে স্মরণ করছি সেই সব চা শ্রমিকবীরদের।

মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের কিছু দলিলনামা

এই যুদ্ধে চা শ্রমিকদের অনেক বধ্যভূমি রচিত হয়; লুণ্ঠিত হয় অনেক মা-বোনের ইজ্জত। চা শ্রমিকরা হারিয়েছিল চা সমাজের অসংখ্য সংগ্রামী ও যোগ্য নেতাকে।

১৯৭১ সালের ১ মে ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রবেশমুখে একটি ছড়ার পাড়ে একসঙ্গে ঝরে পড়ে ৫৭ জন চা শ্রমিকের তাজা প্রাণ। সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে পাকহানাদার বাহিনীর ১২টি এলএমজি একসঙ্গে গর্জে উঠেছিল সারিবব্দভাবে দাঁড়িয়ে থাকা চা শ্রমিকদের ওপর। সেদিন পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন বিশ্বময় হাজরা, গংগা বাড়ৈ, ভোমর চাঁদ, অমৃত হাজরা, রামচরণ গৌড়, গবিনা গৌড়, কৃষষ্ণচরণ হাজরা, রবিনা গৌড়, হক হাজরা, বংশী মৃধা, শিব মোড়া, মোংরা তুড়িয়াসহ নাম না জানা ৫৭ জন চা শ্রমিক। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সাতগাঁও (মাকরী ছড়া) চা বাগানে আপনা অলমিকসহ আরো ৬/৭ জন চা শ্রমিক পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজয়ই তাদের সুনিশ্চিত, তখন গোটা বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য শুরু হলো বুদিব্দজীবী হত্যা।

সেই নিস্পেষিত কালো থাবা থেকেও রেহাই পায়নি চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিক সমাজের অগ্রনায়ক, নিপীড়িত নির্যাতিত চা শ্রমিকদের জাগ্রত করায় যার ছিল অগ্রণী ভূমিকা, আপসকামী নেতৃত্ম্বের বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন বিদ্রোহী বীর, সেই পবন কুমার তাঁতিকেও পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। চারদিন বন্দি রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর।
কালীঘাট চা বাগানের শিববাড়ী বস্তির দাশিবাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে। চা শ্রমিকদের মধ্যে পবন কুমার তাঁতি ছিলেন প্রথম গ্রøাজুয়েট। ১৯৪১ খ্রিষ্টাবদ্ধে রাজঘাট চা বাগানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে বাগানে চলে আসেন তিনি। ১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে। শ্রীমঙ্গল শহরের ওয়াপদা (তৎকালীন) বর্তমান পল্লী বিদ্যুতের কাছে একটি ছড়ার মধ্যে পবনের লাশ ফেলে রেখে চলে যায় পাকবাহিনী। রাজঘাট চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি বসু তাঁতিকেও পাকবাহিনী ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে দেশের বীর বাঙালির সঙ্গে চা শ্রমিকরাও যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করলেও স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও চা শ্রমিকরা মুক্ত হতে পারেনি অত্যাচার, অবিচার, শাসন ও শোষণের জাঁতাকল থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হলেও সিন্দুরখান চা বাগানের সুধীর দাশ, রাজঘাট চা বাগানের পবন খড়িয়া ও কেজুরী ছড়া চা বাগানের চন্দ কাটারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিকরা জীবন যুদ্ধে আজ পরাজিত। আজ কেউই তাদের খোঁজ রাখছেন না। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সেদিন চা শ্রমিকদের রক্তও একই মোহনায় মিলিত হয়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। জাতি পেয়েছিল লাল সবুজের পতাকা।

শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী সমৃদিব্দশালী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চা শ্রমিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আজও চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ইতিহাসের অবসান হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের আত্মহুতির প্রায় ৩ যুগে পদার্পণ। এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও চা শ্রমিকরা রয়ে গেছে সেকালেই। আজও অত্যাচার ও শোষণের চাকায় পিষ্ট চা শ্রমিকদের জীবন। আজ মুক্তিযোদ্ধ চা শ্রমিক ও যুদ্ধাহত চা শ্রমিকদের জীবনযাপন দেখলে মনে হয়, হয়তো জন্মই তাদের আজন্ম পাপ।

তবুও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে এদেশের আপামর জনতার সঙ্গে চা শ্রমিকরা যে বীরত্বের ও প্রত্যয়ের দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন তা অবিস্বরনীয় হয়ে থাকবে আমাদের সবার মাঝে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:০৫
২৮টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×