রেজিস্ট্রেশন করার পর প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল, অথচ এখনও কমেন্ট করারই অনুমতি পেলাম না। অনেকদিনের আশা ছিল সামুতে লিখব, কিন্তু সামনেই একটা সিরিয়াস পরীক্ষা, তাই লিখতে পারছি না। মাঝেমধ্যে দুই একটা ব্লগ পড়ি, কিন্তু কখনও কমেন্ট করি নি। রেজিস্ট্রেশন করে ভেবেছিলাম কমেন্ট করা শুরু করব, কিন্তু একটা লেখা পোস্ট না করা পর্যন্ত সে উপায় নেই। যাইহোক, কোনরকমে একটা অখাদ্য রচনা করেছি, এতে করে যদি একটা ছাড়পত্র মেলে।
জৈবিক বিবর্তন বিষয়ে যারা জানতে আগ্রহী, বিভিন্ন লেখায় তাদেরকে প্রায় সময়ই 'এলিল ফ্রিকোয়েন্সি' (allele frequency) জাতীয় একটা বিদ্ঘুটে শব্দগুচ্ছের মুখোমুখি হয়ে থাকতে হতে পারে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের উপরে যাদের বায়োলজিতে একাডেমিক জ্ঞান নেই, স্বাভাবিকভাবেই তারা এর সাথে পরিচিত নন। কিন্তু বিবর্তন বুঝতে হলে কিংবা বিবর্তন বিষয়ক বিভিন্ন লেখার 'দুর্বোধ্য অর্থ' উদ্ধার করতে গেলে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কী জিনিস, সেটা জানা প্রয়োজন। আর এটি জানানোই এই পোস্টের একমাত্র উদ্দেশ্য।
Allele Frequency
এলিল ফ্রিকোয়েন্সি বোঝার আগে এলিল কি, তা জানা দরকার।
DNA-এর একটি নির্দিষ্ট অংশ যা জীবের একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী, তাকে বলা হয় জিন। DNA আবার থাকে ক্রোমোসোমের মধ্যে। একটা ডিপ্লয়েড দেহকোষে ক্রোমোসোমগুলো নির্দিষ্ট জোড় বেধে থাকে। এই ক্রোমোসোম জোড়ের একটি ক্রোমোসোম আসে বাবার কাছ থেকে, আরেকটি আসে মায়ের কাছ থেকে। এই ক্রোমোসোম জোড়াকে বলা হয় হোমোলগাস ক্রোমোসোম (homologous chromosome)। একটি DNA থাকে একটি ক্রোমোসোমের মধ্যে। অর্থাৎ দুটি হোমোলগাস ক্রোমোসোমের মধ্যে থাকে মোট দুটি DNA। একটি জিনের আবার দুটি অংশ, এগুলোকে বলে এলিল (allele)। এই এলিল দুটি একটি ক্রোমোসোম-জোড়ার দুটি ক্রোমোসোমের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। যে স্থানে এরা থাকে তাকে বলা হয় লোকাস। যাইহোক, এলিল আবার দুপ্রকারঃ- প্রকট আর প্রচ্ছন্ন। একটি জিনে যদি দুটিই প্রকট বা দুটিই প্রচ্ছন্ন এলিল হয়ে থাকে, তাহলে একে হোমোজাইগাস (homozygous) বলে। আর যদি একটি এলিল প্রকট এবং আরেকটি প্রচ্ছন্ন থাকে, তাহলে তাকে বলে হেটেরোজাইগাস (heterozygous)। এবিষয়ে আরও কথা আছে, সেগুলো পরে বলছি।
জীবের একটি দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ফিনোটাইপ (phenotype)। যেমনঃ- আকার, আকৃতি, উচ্চতা, গায়ের রঙ, চুলের রঙ ইত্যাদি যেকোন বৈশিষ্ট্য। একটা ফিনোটাইপের জন্য দায়ী থাকে এক বা একাধিক জিন, আর সেই জিনের বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় জিনোটাইপ (genotype)। জীবের একটা নির্দিষ্ট ফিনোটাইপের জন্য দায়ী একটি নির্দিষ্ট জিনোটাইপ। যেমনঃ- একটা কালো রঙের ইঁদুরের কালো রংকে যদি ফিনোটাইপ বলি, তাহলে তার জিনোটাইপ হবে AA বা Aa। এখানে A এবং a হচ্ছে দুটি এলিল। A এলিলটি প্রকট, আর a এলিলটি প্রচ্ছন্ন। এক্ষেত্রে AA হচ্ছে হোমোজাইগাস, আর Aa হচ্ছে হেটেরোজাইগাস।
একটি জিন কি বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী, তা নির্ভর করে এলিলের উপরে। মূলত এলিলগুলিই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্যই দায়ী। একটি জিন কী বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী হবে, তা নির্ভর করে ঐ জিনের গঠনে বিভিন্ন এলিলের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির উপর। এখানে AA হচ্ছে কালো ফিনোটাইপের জিনোটাইপ। আবার A এলিলটি হচ্ছে প্রকট। তাই এক্ষেত্রে A এলিলটির জন্যই মূলত কালো রঙের বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যদি ইঁদুরটির জিনোটাইপ aa হত, তাহলে a এলিলটি যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, সে বৈশিষ্ট্যটিই ঐ ইঁদুরটিতে প্রকাশ পেত। a যদি বাদামী রঙের জন্য দায়ী হত, তাহলে aa জিনোটাইপ উপস্থিত থাকলে ইঁদুরটি কালো না হয়ে বাদামী হত। কিন্তু প্রকট এলিল A উপস্থিত আছে বলে Aa-এর ক্ষেত্রে শুধু A-এর বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পেয়েছে, অর্থাৎ ইঁদুরটি কালো রঙের হয়েছে।
আশা করি জিন, এলিল আর এদের এক্সপ্রেশনের ফলে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্মন্ধে একটা ধারণা পেয়ে গেছেন। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে।
ন্যাচারাল সিলেকশন কাজ করে সবসময় জীবের ফিনোটাইপের উপরে। ফিনোটাইপের উপরে কাজ করলেও আল্টিমেটলি এর প্রভাব জিনোটাইপেও পড়ে। যে ফেনোটাইপটি প্রজন্মান্তরে বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলিলটিও কিন্তু সাথে সাথে বাড়তে থাকে। একটি এলিল প্রজন্মান্তরে বাড়ছে কি কমছে, তা হিসাব করা হয় এলিল ফ্রিকোয়েন্সির ভিত্তিতে।
এলিল ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে কয়েকটি জীবের পপুলেশনে ঐ জীবগুলোর জিনোটাইপে উপস্থিত একটি এলিলের হার। এটি ব্যাখ্যার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া আবশ্যক।
বাদামী আর কালো রঙের ১০টি ইঁদুরের একটা পপুলেশন বিবেচনা করি। বাদামী ইঁদুরের জিনোটাইপ হচ্ছে aa, আর কালো ইঁদুরের জিনোটাইপ হচ্ছে Aa এবং AA। পপুলেশনটাকে নিম্নোক্তভাবে দেখানো যায়।
AA, Aa, AA, aa, Aa, AA, AA, Aa, Aa এবং AA
দেখা যাচ্ছে কালো ইঁদুর (AA অথবা Aa) নয়টি আর বাদামী ইঁদুর (aa) একটি। এখন A ও a এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি যদি যথাক্রমে p ও q হয়, তাহলে,
p=(2+1+2+0+1+2+2+1+1+2)/20= 0.7
q=(0+1+0+2+1+0+0+1+1+0)/20= 0.3
এবং p+q=1
এটিকে নিম্নোক্তভাবেও প্রকাশ করা যায়,
p=(2n(AA) + n(Aa))/2n
এবং q=(2n(aa) + n(Aa)/2n, যেখানে,
n(AA) = AA জেনোটাইপবিশিষ্ট ইঁদুরের সংখ্যা = 5
n(aa) = aa জিনোটাইপবিশিষ্ট ইঁদুরের সংখ্যা = 1
n(Aa) = Aa জিনোটাইপবিশিষ্ট ইঁদুরের সংখ্যা = 4
n= ইঁদুরগুলোর মোট সংখ্যা = 10
এখন যেকোন কারনেই হোক, পরবর্তী প্রজন্মে যদি ১০টি ইঁদুরের মধ্যে ৮টি কালো, আর ২টি বাদামি ইঁদুর জন্মায়, তাহলে উপরের নিয়মানুযায়ী A এবং a-এর এলিল ফ্রিকোয়েন্সি হবে যথাক্রমে 0.65 এবং 0.35। এক্ষেত্রে A-এর এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাবে, আর অন্যদিকে a-এর ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাবে। প্রজন্মান্তরে কোন প্রজাতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী এলিলের ফ্রিকোয়েন্সির এই পরিবর্তনই হচ্ছে বিবর্তন। মানুষ সহ সব প্রাণীরই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী এলিলগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি প্রজন্মেই বাড়ে-কমে, আর এর থেকেই বোঝা যায় যে বিবর্তন হচ্ছে। এটি স্পষ্ট আর ভালোভাবে বোঝা যায় যদি পপুলেশন ছোট হয়। বিরাট পপুলেশনের জন্য ফ্রিকোয়েন্সির হ্রাস-বৃদ্ধি যেমন কম হয়, ঠিক একইভাবে তাদের বিবর্তনও হয় কিছুটা ধীরে। প্রজন্মান্তরে যদি কোন একসময় p=1 বা q=0 হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে পপুলেশনে a এলিলটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার q=1 বা p=0 হলে বুঝতে হবে A এলিলটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে একটি ভ্যারিয়েশন পুরোপুরি হারিয়ে যায়। একে বলা হয় ফিক্সেশন পয়েন্ট (fixation point)। এমতাবস্থায়, একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য (যেমন, কালো বা বাদামি রঙ) পপুলেশনের সব সদস্যের জিনোটাইপই একই রকম হয়। অর্থাৎ সবারই জিনোটাইপ হোমোজাইগাস হয় (যেমন, AA অথবা aa)। ঠিক একই কারনে সকল সদস্যই হয় বিশুদ্ধ কালো (AA), নাহয় বিশুদ্ধ বাদামী (aa) বর্ণের হয়ে থাকে।
Modern Evolutionary Synthesis-এ ডারউইনিয়ান বিবর্তন তত্ত্বের সাথে জেনেটিক্সের (genetics) সমন্বয় ঘটে। এক্ষেত্রে বিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যার জন্য ন্যাচারাল সিলেকশনের সাথে জেনেটিক্সও সমানভাবে সক্রিয়। আর Modern Evolutionary Synthesis-এর সাথে সরাসরিভাবে যুক্ত হচ্ছে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি। তাই এ সম্মন্ধে স্বচ্ছ ধারনা না থাকলে বিবর্তন বিষয়ক কোন লেখায় এলিল ফ্রিকোয়েন্সি বিষয়ক বক্তব্য থাকলে, সেটি বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



