somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (চতুর্থ পর্বঃ “ রয়েল বেঙ্গল টাইগার”)

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সুন্দরবনের বাঘ বিশ্বব্যাপী রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে পরিচিত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার হলো সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা টাইগ্রিস। বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবনই হলো বাঘের শেষ আবাসস্থল।

১। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (প্রথম পর্বঃ সুন্দরবন নামকরণ ও ইতিহাস)
২। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (দ্বিতীয় পর্বঃ ভৌগলিক অবস্থা ও ভূ-প্রকৃতি)
৩। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (৩য় পর্ব: জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রানী)

এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু। এর গায়ে লালচে বর্নের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে। এছাড়া এই বাঘের রয়েছে রাজকীয় চলন ও ক্ষিপ্রগতি। সুন্দরবনের প্রায় সব জায়গাতে এর পদচারনা লক্ষ করা যায়। কখনো সে গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকে বা নদী-খালের পাড়ে হেতাল বা গোলপাতা গাছের নীচে আয়েশী ভঙ্গিমায় বিশ্রাম নেয় অথবা ঘাসের উপর শুয়ে থাকে। কখনও বা সে সাঁতার কেটে খাল বা নদী পারাপার হয় বা সমুদ্র সৈকতের পাড় দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে চলে। বেঙ্গল টাইগারের এই অবাধ বিচরণের কারণে অবৈধ শিকারীরা বনের সম্পদ নষ্ট করতে ভয় পায়। তাই বাঘকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রক্ষকও বলা হয়।



বাঘের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৮ ফিটের মত হয় কিন্তু একটি পূর্ণবয়স্ক রয়েল বেঙ্গল টাইগার দৈর্ঘ্যে ৯ ফিটের কাছাকাছি হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার শিকারকে নিয়ে অনায়াসে এক মাইল ছুটতে পারে। এমনকি সে তার নিজের চাইতেও ভারী প্রাণীকে শিকার করে নাস্তানাবুদ করে ফেলতে পারে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার খুব অলস প্রজাতির প্রাণী। শিকার করা ছাড়া এরা খুব বেশি একটা চলাফেরা করে না। কিন্তু শিকার করবার সময় এলে তারা তাদের সীমানা নির্ধারণ করে নেয় এবং এই সীমানার পরিমাণ প্রায় ২০০ স্কয়ার মাইল দীর্ঘ হয় । খুর বিশিষ্ট জন্তু শিকারের ক্ষেত্রে বাঘ হ’ল বিশেষজ্ঞ। কোন জন্তু কে মরণ কামড়ে হত্যা করতে বাঘের তিক্ষ্ণ স্ব-দন্ত বিশেষ নকশায় তৈরী। অন্য দাতগুলির কাজ হ’ল শক্ত ভাবে ধরে রাখা এবং মাংস কেটে ফেলা। এর নখগুলি শিকার কে ধরা ও নিয়ন্ত্রনে রাখার কাজ করে। বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ একে বনের মাঝে সহজে লুকাতে সাহায্য করে। এর শক্তিশালী পা ও শরীর অল্প দূরত্বে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবিত হতে পারদর্শী। সুন্দরবনের বাঘের প্রধান শিকার হ’ল হরিণ ও বন্য শুকর। তবে সুযোগ পেলে এরা সব ধরনের মাছই খেয়ে থাকে।



এই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজকীয় চলন, ক্ষিপ্রগতি এবং তার বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশ হতে প্রচুর সংখ্যক পর্যটক প্রতি বছর সুন্দরবন ভ্রমন করে থাকে। বাঘকে সুন্দরবনের রাজা বলে গন্য করা হয়।



বাঘের সৌন্দর্য, চেহারা মাধুর্য, শক্তি, নির্দয়তা সুপার প্রাকুতিক গুনাবলীর জন্য মানুষ বাঘকে মান্য করে, ভয় পায় এবং সম্মান করে। বাঘের থাবাগুলো এমনভাবে সৃষ্ট যাতে দুরন্ত শিকারকে আঘাত ও ধরতে পারে। কেনিন দাত এমনভাবে সাজানো যাতে শিকারকে কামড়াতে ও মারতে মারে।বাঘের শক্তিশালী চোয়াল আছে যা ক্ষমতাশালী মাংসপিন্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পায়ের তালু বেশ নরম। ফলে নিঃশব্দে দৌড়াতে পারে। বাঘের শব্দ শোনার ক্ষমতা, কোন কিছু দেখা এবং কোন প্রাণীর গন্ধ বুঝার ক্ষমতা খুবই উচ্চ ও প্রখর। বাঘ শব্দ শুনলে বা গন্ধ পেলে কোন বন্য প্রাণীর অবস্থান বা বন্য প্রাণী কি করছে তা বুঝতে পারে। বাঘ নিজকে একটি ছোট ঝোপ ঝাড়ে বা গাছের পেছনে বেশ ভালভাবে আড়াল করে রাখতে পারে। তা’ ছাড়া কোন শব্দ ছাড়া শিকার ধরার জন্য একনিষ্ঠভাবে অবস্থান করে। অতি সন্নিকটে হরিণ, বানর থাকলেও অনেক সময় এরা বাঘের উপস্থিতি বুঝতে পারে না। নিজের সুবিধা মত দুরত্বে এক লাফে হরিণ, বানর, ইত্যাদি ঘাড়ে থাবা দিয়ে মেরে ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে ভক্ষন করে। হরিণ, বানর, শুকর ইত্যাদি তৃনভোজী প্রাণী বাঘের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য নুতন পদ্ধতি বের করলেও বাঘও শিকার ধরার জন্য সেভাবে নুতন পদ্ধতি বের করে। যার ফলে বাঘ মাংসভোজী প্রাণীর মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।



বাঘ নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সীমানায় (territory) বা নিজস্ব রাজত্বে বসবাসকারী নিঃসঙ্গ প্রাণী। মানুষের শংস্রবে আসতে এরা অপছন্দ করে। পরিণত বাঘ শিকার করে এবং একাকী বাস করে। একমাত্র যৌন মিলন অথবা লড়াইয়ের সময় অন্যের সাক্ষাতে আসে। বাঘ তার নিজস্ব সীমানা রক্ষা করতেই অধিকাংশ সময় ও শ্রম ব্যয় করে, কারণ এটা তাদের টিকে থাকার লড়াই। বাঘিনী জঙ্গলের বিশেষ কোন এলাকার দখল নেয়, যেখানে টিকে থাকার জন্য প্রচুর শিকার পাওয়া যায়। একটি বাঘ এমন একটি এলাকা পছন্দ করে তার বসবাসের জন্য যে এলাকার মধ্যে একাধিক বাঘিনী বাস করে। পুরুষ বাঘ তার এলাকার মধ্যে বসবাসরত বাঘিনীদের উপর প্রজননের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং তার এলাকার মধ্যে অন্য পুরুষ বাঘদের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে নিয়মিত টহলদারী অব্যহত রাখে। একটি পুরুষ বাঘের এলাকার মধ্যে দুই থেকে চারটি প্রজননক্ষম বাঘিনী বাস করে। বাঘ এবং বাঘিনী উভয়ই চিহ্ন দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দেয় যাতে অন্য বাঘ সাবধান হয় এবং তার এলাকায় অনধিকার প্রবেশ না করে। একটি বাঘের বন এলাকায় অন্য বাঘ আসলে মারামারি লেগে যায়। তাই সবাই সবার আবাসিক এলাকা সংরক্ষন করে রাখে। প্রজনন ঋতুতে বাঘ ও বাঘিনী একত্রে চলাফেরা করে। শরৎকাল বাঘের প্রজনন সময়। প্রজনন ঋতু শেষ হলে বাঘ ও বাঘিনী আলাদা হয়ে যার যার আবাস এলাকায় চলে যায়।



বাঘেরা দিনে-রাতে সব সময়ই শিকার করে, তবে সাধারণত বাঘ দিনের বেলা বিশ্রাম করে এবং রাতে শিকারে বা টহলে বের হয়। তীক্ষ্ণ শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি ঘন জঙ্গলে তাদের শিকার চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এরা হামাগুড়ি দিয়ে শিকারের খুব নিকটে পৌঁছে যায় এবং চূড়ান্ত আক্রমণে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবিত হয়। শিকার প্রায়শই ফসকে যায়, কারণ শিকার এদের চলার শব্দ বা গায়ের গন্ধ পায় অথবা দেখতে পেয়ে পালায়।
নিজস্ব এলাকার দখল না পাওয়া পর্যন্ত কোন বাঘ প্রজনন কর্মে লিপ্ত হয় না। যদি কোন বাঘ অন্য বাঘের এলাকা দখল করে তবে আগের বাঘের পুরুষ সন্তানদের সে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। এটা তাকে যত দ্রুত সম্ভব যৌন মিলনের নিশ্চয়তা দেয় এবং নিজের সন্তানদের জন্মদান নিশ্চিত করে। প্রজনন ঋতুতে দু’টো বাঘ একটি বাঘিনীর কাছে আসলে দু, টো বাঘের মধ্যে মহাযুদ্ধ বেঁধে যায়। অনেক সময় বাঘিনী এ দৃশ্য পছন্দ করে না বলে অতি আস্তে আস্তে সে অন্য কোথাও চলে যায়। সাড়ে তিন বছর বয়সে বাঘিনীরা সন্তান প্রসবের উপযোগী হয়, কিন্তু একটি পুরুষ বাঘ পাঁচ বছর বয়সের আগে সাধারণত নিজস্ব এলাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় না।
১০০ দিন থেকে ১০৪ দিন গর্ভধারনের পর বাঘিনী দুই থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা খুব ছোট এবং অক্ষম থাকে। প্রথম ১০ দিন বাচ্চারা চোখ খুলতে পারে না। দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকে। প্রথম ছয় মাস এরা মায়ের দুধ পান করে। পরে শিকার ধরতে মায়ের কাছে ট্রেইনিং শুরু করে।



বাচ্চা প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসলে বাঘিনী বাঘকে ছেড়ে নিরিবিলি আশ্রয়ে চলে যায়। আর বাঘ বাঘিনীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। প্রজননের সময় বাঘ কোন মতেই কারও উপস্থিতি সহ্য করে না এবং কারো বিরক্তি পছন্দ করে না। তখন তারা বেশী হিংস্র হয়ে উঠে। বাঘিনী এক সাথে ২ – ৪ টি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা প্রসব করার পর বাঘিনী প্রথম দিকে বাঁচ্চাকে স্তন পান করায়। ধীরে ধীরে যখন বাঘের বাচ্চা বড় হতে শুর করে তখন তাকে শিকার করা শিখানো হয়। বাঁচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত বাঘিনী বাঁচ্চাকে সব সময়ই বাঘের আড়াল করে রাখে। কারণ বাঘ বাঘের বাঁচ্চা খেয়ে ফেলে। একটি বাঘিনী তার জীবদ্দশায় গড়ে ৬ বার বাচ্চা প্রসব করে। বাঘিনী ২ বছর পর পর বাচ্চা দেয়। হরিণ ও শুকর খেতে বাঘ বেশী পছন্দ করে। অনেক সময় বাঘকে কাকড়া ও মাছ খেতে দেখা যায়। যখন বাঘ বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং শিকার করতে অসুবিধা হয় তখন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছোট ছোট খালের মধ্যে দাখিয়ে কাকড়া ও মাছ ধরে খায়। অনেক সময় সুযোগ পেলে বাঘ জনপদে ঢুকে মানুষ , গরু, ছাগল, মহিষ শিকার করে খায়। রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে প্রথমে রক্ত খায়। তারপর একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে মাংস খেতে শুরু করে। পেট ভরে গেলে আহার ঢেকে রেখে কাছেই ঘুরাফেরা করে। আবার ক্ষুদা লাগলে খায়। এভারে খাবার শেষ হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। বাঘের পেট ভর্তি থাকলে কাছে হরিণ, শুকর থাকলেও শিকারের জন্য বাঘ ব্যস্ত হয় না।
প্রচুর সংখ্যক বাঘ বাচ্চা বয়সে মারা যায়। তার চেয়েও বেশী সংখ্যক বাঘ মারা যায় যখন তারা মায়ের সঙ্গ ও এলাকা ছেড়ে বসবাসের জন্য নিজস্ব এলাকা প্রতিষ্ঠার খোঁজে বের হয়। যদি কোন বাঘ আহত অথবা অন্য কোন কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিকার ধরতে অথবা নিজের এলাকা রক্ষা করতে অক্ষম হয়, তখন সে বাঘটি মারা যায়। টিকে থাকার জন্য একটি নিজস্ব এলাকা প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষায় বাঘ এতই ব্যস্ত থাকে যে সন্তান-সন্ততী উৎপাদনের জন্য তারা কমই সময় পায়। প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বাঘিনী বেঁচে থাকে ৮ থেকে ১৪ বছর সে ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বাঘ বাঁচে ৬ থেকে ১২ বছর।
২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। পৃথিবীতে যত বাঘ আছে, তার প্রায় অর্ধেক হচ্ছে বেঙ্গল টাইগার। আর আকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড় হচ্ছে সাইবেরিয়ান বাঘ। সাইবেরিয়ান বাঘ আকারে প্রায় ১০.৭৫ ফুট (৩.৩ মিটার) লম্বা হয়ে থাকে। এদের ওজন প্রায় ৩০০ কেজির মতো। অপরদিকে বেঙ্গল টাইগার আকারে প্রায় ৭-৯ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এদের ওজন হয় প্রায় ১৫০-২২৭ কেজি। বন্য অবস্থায় একটি বাঘ সাধারণত ৮ থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। ১৮ মাস বয়সের আগে সাধারণত বাঘ শিকার করতে পারে না। বাঘ সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য হলো- এদের গর্জন প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়।



শিকারি হিসেবে বাঘ একটি অসাধারণ প্রাণী। এরা নিশাচর এবং খুবই শক্তিশালী শিকারি। বাঘ সাধারণত ছদ্মবেশে শিকার করে। এদের চামড়ার রং এবং গঠন ছদ্মবেশ ধারনে যথেষ্ট সহায়ক। শিকারের সময় এরা যে প্রাণীটিকে তাদের শিকার বানাতে চায়, খুব সাবধানে এবং প্রায় নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যায়। পরে স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে শিকারের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। মোট কথা, এরা শিকারকে কোনো সুযোগই দেয় না। শিকারের জন্য বাঘ মাইলের পর মাইল বিচরণ করতে পারে। শিকার হিসেবে এরা প্রধানত হরিণ এবং বন্য শুয়োরকে প্রাধান্য দেয়। একটি ক্ষুধার্ত বাঘ এক রাতে প্রায় ৬০ পাউন্ড (২৭ কেজি) মাংস সাবাড় করে দিতে পারে। যদিও বাঘ সাধারণত একবারে খুব বেশি আহার করে না।

রাশমেলা উদযাপনে সুন্দরবন ভ্রমন আপনাকে দিবে নতুনত্বের স্বাদ

বাঘ (Panthera tigris) বিশাল বিড়াল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্যানথেরা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত চারটি বৃহৎ বিড়ালের মধ্যে এটি একটি। বাঘ বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় প্রাণী। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এলাকায় একে দেখা যায়। ‘অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট’ চ্যানেলের সমীক্ষা অনুযায়ী বাঘ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী।
একসময় পৃথিবীতে আট প্রজাতির বাঘের দেখা মিলত। কিন্তু, বিংশ শতাব্দিতে এসে মাত্র পাঁচ প্রজাতির বাঘ দেখা যায়। বাকি তিনটি প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। গত একশ বছরে চোরাশিকারি এবং আবাস ধ্বংসের কারণে বাঘের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ থেকে মাত্র ৩-৪ হাজারে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতি বাঘের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বাকি পাঁচটি প্রজাতিও আজ খুব বেশি সুখে নেই। বাঘের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হ’ল বন উজাড় হওয়া। প্রতিনিয়ত বন ধ্বংস করা হচ্ছে,ফলে কমে যাচ্ছে বাঘের আবাস ভূমি। চোরা শিকারি (?) বা বাঘ ডাকাতদের হাতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বহু বাঘ মারা পড়ছে। বাঘের মাথা ও চামড়া বিপুল অঙ্কের টাকায় কালোবাজারীদের কাছে বিক্রি হয়। বাঘের হাড়ও অনেক দামে বিক্রি হয়, কারণ পূর্ব-এশিয়ার অনেক দেশের মানুষ বাঘের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরী ঔষধ ব্যবহার করে।
বাঘ শুমারী, ২০০৪ হতে দেখা যায় সুন্দরবনে মোট ৪৪০ টি বাঘ আছে। যার মধ্যে ২১টি ব্যাঘ্র শাবক রয়েছে। গড়ে সুন্দরবনের প্রতিটি বাঘের জন্য ১৪.৪ বর্গ কিঃমিঃ ব্যাপী নিজস্ব আবাস স্থল রয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ি সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। অবশ্য এর আগের জরিপ (পায়ের ছাপ) পদ্ধতিতে গনণা করে পরিসংখ্যানে বাঘের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৪৫০টি। ম্যানগ্রোভ এই বনাঞ্চলে বাঘের সঠিক সংখ্যা জানতে ২০১৩ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। মাঝে বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালের নভেম্বরে আবার শুরু হয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে জরিপ শেষ হয়। এতে ক্যামেরার ফাঁদ পেতে বাঘের ছবি নেওয়া হচ্ছে। এই ছবি দেখে বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ চিহ্নিত করা হবে এবং ডোরাকাটা দাগের পার্থক্য বিচার করে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়।

রাশমেলা উদযাপনে সুন্দরবন ভ্রমন আপনাকে দিবে নতুনত্বের স্বাদ

বাংলাদেশের সুন্দরবনে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত কালপরিধিতে অর্ধাশতাধিকের বেশি বাঘ মানুষের হাতে মারা গেছে। স্থানীয় লোকজন ও সরকারীভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাঘের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। সুন্দরবনে নিরাপদ বিচরণের জন্য প্রার্থণা করাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি। বাঘ যেহেতু সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে সেহেতু জেলে এবং কাঠুরেরা মাথার পেছনে মুখোশ পরে। এ ব্যবস্থা স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও পরে বাঘ এ কৌশল বুঝে ফেলে এবং আবারও আক্রমণ হতে থাকে।
বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বাঘ বাঁচাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সুন্দরবনে বাঘ নিধন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ৩৫ বছরে (১৯৮০ থেকে ২০১৫) সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় শিকারিদের হানা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৮৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। প্রজনন বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে বাঘ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে সুন্দরবনে ৫২টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজন পিটিয়ে ২৪টি এবং চোরাশিকারিরা কৌশলে ১৭টি বাঘ হত্যা করে। ১১টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।



বাঘ আমাদের দেশের একটি অমূল্য সম্পদ। কিন্তু, আজ এই সম্পদ ধীরে ধীরে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেলে সুন্দরবন তার একটি মূল্যবান অলংকার হারাবে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত হবে। বাঘ রক্ষার জন্য, তথা সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকেও সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে চোরাচালান রোধে এবং বাঘের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে বাঘ বলতে আমরা প্রধানত সুন্দরবনের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’কেই বুঝি। আর এই বাঘ দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে বাঘ কিংবা বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাঘ বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিলেও সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে।

রাশমেলা উদযাপনে সুন্দরবন ভ্রমন আপনাকে দিবে নতুনত্বের স্বাদ

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত। সুন্দরবন শুধু নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বন অভ্যন্তরে রয়েছে গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, সরীসৃপসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। নির্বিচারে বন উজাড়ের ফলে বাঘের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে বাঘের বংশবৃদ্ধি ঘটছে না। অপরদিকে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও চোরাশিকারিদের হাতে পাচার ও নিধনের ফলে ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে এ প্রাণী।বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান করলেও ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাশিকারিদের বন্যপ্রাণী হত্যা। মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সিমান্তের আন্তর্জাতিক চোর বাজার ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে’ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরাশিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ।

১। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (প্রথম পর্বঃ সুন্দরবন নামকরণ ও ইতিহাস)
২। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (দ্বিতীয় পর্বঃ ভৌগলিক অবস্থা ও ভূ-প্রকৃতি)
৩। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য (৩য় পর্ব: জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রানী)

ভিজিট সুন্দরবন- সুন্দরবনের স্বর্গ রাজ্যে আপনাদের স্বাগতম

বিস্তারিত চলবে, জানতে-পড়তে আমাদের সাথে থাকুন। ধন্যবাদ।

লেখকঃ আবু মুহাম্মাদ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×