গত কয়েকদিন ধরিয়া ‘ক্ষ’- ব্যান্ডের গাওয়া একটি ভিডিও ‘ আমার সোনার বাংলা’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলিতেছে। সামুতেও একটি ব্লগে খুব চমৎকার আলোচনা হইয়াছে। এক পক্ষের খুব শক্তিশালী অভিযোগ হচ্ছে এই ভিডিওতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করা হইয়াছে, জাতীয় সঙ্গীত গাইবার কিছু নিয়ম- কানুন ও প্রোটোকল আছে, সেইগুলা ঠিকঠাক মানা হইনাই। এই সমস্ত অভিযোগ মেনে নিয়েই আমি কিছু কথা বলিতে চাই।
প্রত্যেকটি দেশেই তাদের সংস্কৃতির নানা কিছুকে প্রতিকীকরন বা জাতীয়করন করিয়া থাকে, যেমন আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল, বৃক্ষ হল আম, ফুল শাপলা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং আরও অনেক কিছু। বেশিরভাগ জাতীয় বস্তু সামগ্রী নিয়ে তেমন কোন অসুবিধা নাই, মানে খুব বেশী নিয়ম কানুন নাই। কাঁঠাল গাছ থেকে নামানোর সময় স্যালুট করাটা জরুরী না, শুইয়া বসিয়া যে কোনভাবেই খাওয়া চলে। তারপরেন ধরেন জাতীয় বৃক্ষ আম, উহা আপনার ইচ্ছে মত লাগান, কাটেন, উহার কাঠ দিয়া শয্যা বানান অথবা বেড়া দেন, আইনগত বিধি বিধান আছে কিনা জানিনা, তবে ইহা জানি যে থাকিলেও কেহ মাথা ঘামায়না। আর শাপলা আমাদের জাতীয় ‘ফুল’ হওয়া সত্ত্বেও দিনে দুপুরে বাজারে ইহা সবজি হিসেবে কেনা-বেচা হয়, মানুষ হরদম ইহা খাইয়া চলিতেছে। অথচ ‘জাতীয় ফুল’ খাইয়া ফেলার মত অবমাননায় এখনও পর্যন্ত কারও পেট খারাপ করিল বলে শুনি নাই। কিন্তু গোল বাঁধিবার দুইটি বিশেষ বস্তু হইতেসে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। একটি দেশ কে প্রতিনিধিত্ব করিবার দুইটি মোক্ষম বস্তু এই দুইটি, একইসাথে অনেক আবেগের, অনেক ভালবাসার। এবং যেহেতু দেশকে প্রতিনিধিত্ব করিবার মত আনুষ্ঠানিক বিষয় জড়িত, বেশ কিছু নিয়ম ও প্রোটোকল মানিবার আছে, যেগুলো ভাঙ্গা সাংবিধানিকভাবে অবমাননার শামিল।
আমরা আমাদের শ্রদ্ধার আর ভালবাসার জিনিসগুলোকে নানাভাবে সম্মান জানাইবার চেষ্টা করি। মজার বিষয় হইতেসে সম্মান জানানোর জন্য আমরা নানা কিছু আচার-আচরন তৈরি করার মাধ্যমে বস্তুটিকে দৈনন্দিন জীবন থেকে বিসর্জন দেই। যেমন কুরআন শরিফ- ঘরের সবথেকে উঁচু আলমারির উচু কোনে এর অবস্থান ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, কিতাব ধরার আগে অযু থেকে শুরু করে পবিত্রতা রক্ষার নানা নিয়ন কানুন এর সাথে আমার দূরত্বই তৈরী করেছে। সমস্ত নিয়ম কানুন মানিলে একই রকম দূরত্ব তৈরী হয় আমাদের পতাকা জাতীয় সঙ্গীতের সাথে।
শুধুই শ্রদ্ধার সম্পর্ক হইতেসে দূরের সম্পর্ক। আটপৌরে আর আপনার সম্পর্ক হইতেসে ভালবাসার। শ্রদ্ধার অনুভূতি ভঙ্গুর ও অস্থায়ী, তাই শ্রদ্ধা জানাইবার জন্য আমরা অনেক নিয়ম- কানুন বানাই ও তা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চেষ্টা করি। যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন হইল কিনা ইহা লইয়া ব্লগে- ফেবুতে বিতর্ক করি। ভালবাসার কিন্তু কোন প্রোটোকল বা শাস্ত্র নাই, উল্লেখ্য বাৎস্যায়নের ‘কামসুত্র’ ভালবাসিবার নিয়ম কানুন নহে, সহায়িকা মাত্র। যা আমাদের ভালবাসার ধন তা নিয়ে আমাদের আহ্লাদ না করিলে চলেনা।
তাই খেয়াল করিবেন যে ক্রিকেট খেলার মাঠ থেকে বিজয় মিছিলে, এরকম কোথাও নানা আকৃতির, নানা ভঙ্গীমায়, নানাকিছুর সাথেই আমাদের জাতীয় পতাকার উপস্থিতি দেখি, এই উন্মাদনায় আমরা আপ্লুত হই। পতাকা নিয়ে তাঁর এই ভালোবাসা আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়। আইন মানিতে গেলে কিন্তু ধরা খাইবেন।
পতাকার নির্দিষ্ট মাপ আছে আমরা সবাই জানি, এই মাপ মানিয়াই কি পতাকার ডিজাইন নিয়া করা টি -শার্ট গায়ে দেই যে পতাকার অবমাননায় আমার গা চুলকোয়না? শাস্ত্রে আছে- ‘The ‘Flag’ shall not be dipped to any person or any inanimate object ’ . তাহলে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারীতে গালে কপালে পতাকা আঁকিয়া ফেসবুকে ছবি আপ্লোডাই উহার বেলা? বলিতে গেলে আরও বহু ধারা উপধারা হাজির করা যাইবে কিন্তু অনর্থক কথা বাড়িয়ে লাভ কি? আসল কথা হল প্রানের আবেগ নিয়মে বাঁধিয়া রাখা যায়না। রাখিতে যাওয়া মুর্খামি।
‘ক্ষ’ ব্যান্ডের সুরেলা সাবালিকা এবং কতিপয় অর্বাচীন বালক( দাঁড়াইলিনা কেন ?? দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চোনা ঢাললি!) ‘ আমার সোনার বাংলা’ শুনিয়া আমার মত কিছু মানুষ খুবই পছন্দ করিয়াছে, তাহা এদিক ওদিক চাহিয়া বেশ বোঝা যাইতেসে। শেয়ার লাইক এর ধুম দেখিয়া এই ভিডিওর বাজার পাইয়াছে বোঝা যায়। জাতীয় সঙ্গীতের দায় একইসাথে ‘ জাতি’ ও ‘ সঙ্গীত’ দুইটার প্রতি। জগতে আমার “ আমার সোনার বাংলা”-র অস্তিত্ব শুধু জাতীয় ‘প্রতীকী সঙ্গীত’এর দায়িত্ব পালন করা নয়, আলাদাভাবে সঙ্গীত হিসেবেও এর পরিচয় আছে। যার আবেদন আর্টের কাছে, সঙ্গীত বোধের কাছে। এই জায়াগাটাতে ‘ক্ষ’ ব্যান্ডের কাজ বড়ই মনোরম হইয়াছে, সাকিবের ছক্কায় গ্যালারীতে ভুল নিয়মের পতাকা দোলানো তরুনীকে দেখিয়া যেমন আপ্লুত হই, অনেকটা ওইরকম। অনেকবার শুনিয়াছি, আরও অনেকবার শুনিব, আরও অনেক শেয়ার করিব। কিন্তু ঐ খেলার আগে যদি আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘ক্ষ’ ব্যান্ডের “ আমার সোনার বাংলা” গাওয়ার কথা আসে তবে তাহা চলিবেনা না, অইখানে একদম ঠিক ঠাক জাতীয় সঙ্গীত “ আমার সোনার বাংলা” গাওয়া চাই, যেইখান থেকে শুরু ঠিক সেইখান থেকে, সবাই দাঁড়ায়ে, সুর প্রক্ষেপনে কোন কারিকুরি চলিবে না, ঠিক ওইসময় যে পতাকা টা উঠতে থাকবে ফ্ল্যাগ পোস্ট দিয়ে তাও একদম ঠিকঠাক মাপে, সঠিক রঙের হতে হবে, যদিও ঠিক তখন বুকে ভুল মাপে পতাকা আঁকিয়া ভুল সুরে চিৎকার করিয়া ‘আমার সোনার বাংলা ’ গাইতে থাকিবে কিছু সহজ মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




