আজ ৮ ই মার্চ ২০১৪ সাল, বিশ্ব নারী দিবস! আজ থেকে পয়ত্রিশ বছর আগে যে সভ্যতার মানুষ চাঁদে গিয়েছিল হাওয়া খেতে, সেই সভ্যতায় বছরের তিনশত পয়ষট্টি দিনের একদিন আলাদা নারীর জন্য পালন করতে হচ্ছে, একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত! পুরুষ দিবস কবে? নারী একা আন্দোলন করলেই হবে? পাশে পুরুষ লাগবে না? পুরুষের যে মানুষ হওয়া দরকার আছে, এইটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য দিবসের দরকার নাই বুঝি? কিন্তু নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তো লাভ নেই, যেমন ঢেউ-স্রোত, তেমনই বৈঠা বাওয়া!
আমি স্বপ্ন দেখি সেই দিনের যখন আলাদা করে এই নারী দিবসের আর প্রয়োজন হবে না, নারী অধিকার, পুরুষ অধিকার কথাগুলো আমরা জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নারী-পুরুষ সবাই হয়ে উঠবো- মানুষ, কথা হবে তখন শুধু মানুষের অধিকারের।
সময় বিষম প্রতিকূল থাকলে এমন অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়, যা শুধু সময়ের প্রয়োজনেই, অপেক্ষা থাকে কবে আমরা সেই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রান পাব। ঠিক তেমনি বর্তমান সভ্যতায় নারীবাদী আন্দোলন থেকে শুরু করে জেন্ডারভিত্তিক যে সমস্ত উদ্যোগ বা কর্মসূচী, তা নিতান্তই সাময়িক হোক! কারন যখনই আমি আলাদা পরিচয় তৈরী করবো, তার সাথে আমি নতুন এক বৈষম্যের বীজ বুনবো, এটাই নিয়ম। কিছুদিন আগে নারী ব্লগারদের একটা লিস্ট করা নিয়ে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। বিষয়টা যে খুব আহামরি কোনো নারী অবমাননার বিষয় ছিল এইটা না। আমার আপত্তি ছিল যে ব্লগারের আলাদা করে কোনো জেন্ডার পরিচয় দরকার নেই, আলাদা পরিচয় মানেই আলাদা নতুন ভেদাভেদ- যেটা ফরাসী বিপ্লবের আগে জন্ম নেওয়া কুষ্টিয়ার অজগ্রামের এক পাগল ফকির এইটা খুব ভালো বুঝেছিলেন। তিনি যাওয়ার আগে তাঁর সকল পরিচয় মুছে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাই আমরা সে হিন্দু, না মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়েছেন, বলতে পারি না, জানার দরকারও নেই বলেই তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন- সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী জাতির কি বা বিধান? আমি ব্রাম্মন চিনি পৈতা প্রমান- বামনি চিনব কেমনে?
আমাদের বেঁচে থাকায় নারী-পুরুষ যে বিভাজন, সেটা নিতান্তই কৃত্তিম, জীবন আসলে সেভাবে চলেও না, বলেও না! কারন দেখেন, সবাই সে নারী হোক আর পুরুষ, তাকে কিছু রোল প্লে করতে হয়, এইটাই তার পরিচয়। সে দাঁড়িয়ে না বসে মুত্রত্যাগ করে, এইটা কোনো বিভাজন নয়। আমরা এক টেবিলে বসে একই খাবার একইসাথে খাই, নিষ্কাষন পদ্ধতির জৈবিক ভিন্নতা নিয়ে মানুষ যখন তেনা পেচায়, মানুষ হিসেবে মাথা নিচু হয়ে যায়। ভাদাইম্যা কত পুরুষেরে নারী পালছে, সেই নারীর মূল্যায়ন আমি কীভাবে করব? পরিবারের বধু হিসেবে, নাকি মূল উপার্জনকারী মানুষ হিসেবে? পড়াশোনা শেষ করে যে মেয়েটা চাকুরী করে বুড়ো বাবা-মার দায়িতব নিচ্ছে, ছোট ভাইবোনের মানুষ করবার ভার মাথা পেতে নিচ্ছে, তাকে আপনি কীভাবে শুধু একজন নারী হিসেবে নম্বর দেবেন? নারী পুরুষ যেই হোক, জীবন যার সামনে যে খেলার ছক কাটবে, তাকে সেই খেলাই খেলতে হবে, নারী না পুরুষ, এইটা দেখার টাইম তার নাই, কখনো ছিলোও না। এইজন্য আমার শহরেই আমি দেখি নারীকে ইজিবাইক চালাতে! আবার শহরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদে নারী- এই পদ পারিবারিক সূত্রে না, যোগ্যতায় অর্জন করে নেওয়া!
আরেকটা বিষয় বুঝতেই পারি না, নারী-পুরুষের মাঝে সমান-অসমান-উঁচু-নিচু হিসেব আসে কোত্থেকে? কীভাবে? যেমন গণিত শাস্ত্রের কথায় আসি- মানুষের বৌদ্ধিক অর্জনের সুচারু শাখা। এখানে ইফতি নামের ছেলে থেকে ভালো অঙ্ক জানে শাবনূর নামের কন্যা, শাবনূর থেকে আবার অঙ্কে বেশী মার্কস পায় আরেক পোলা সাকিব খান! আবার দেখা যায় সাকিব খানের থেকেও বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছে আরেক কন্যা পপি, এভাবেই দেখা যায় ফার্স্ট হল রাজ্জাক বা শাবানা! এখন যদি রাজ্জাক নামের কেউ প্রথম হয়, তাহলে কি এটা প্রমান হয় পুরুষেরা অঙ্ক ভালো জানে? না হয় না, কারন সাকিব খান, মফিজ ইফতি থেকেও কিন্তু ভালো অঙ্ক জানে শাবানা! সমান-অসমানের হিসেব হয় সম গোত্রের বস্তুর মধ্যে, যেখানে একটা বাদ দিয়ে আরেকটায় কাজ চলে, তখন আমরা হিসেব করতে বসি কে বড়। কিন্তু নারী পুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে আমরা একজন আরেকজন ছাড়া বাঁচি না, একজন নারী পৃথিবীতে আছে বলেই না আমি পুরুষ! পুরুষ এক মানুষ পাশে এসে দাঁড়ায় বলেই না নারীমানুষটা অপেক্ষায় থাকে, এই সম্পর্কে কীভাবে একে অন্যের সাথে তুলনা হইতে পারে আমাকে কেউ বোঝাবেন?
আমাদের এখনো নারী দিবসের খুব প্রয়োজন আছে, প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই সেটা বোঝা যায় হাড়ে হাড়ে, এখনো আমাদের সমাজে একজন পুরুষের শুধু মানুষ হতে অনেক বাকি। তাই হয়তো এখনো বাসে আপুদের হাতে আলপিন লুকিয়ে উঠতে হয়, একটা মুখোশধারী পুরুষ তার দিকে কামুক নোংরা হাত বাড়ালে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। এখনো যদি বইমেলা সন্ধ্যার পরে হুট করে অন্ধকার হয়ে যায়, আমরা কিছু পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়বো লালা ঝরিয়ে, তাই এই সমাজে, এই সময়ে এখনো খুব নারী দিবস পালন করতে হয়। নারীকে ঐতিহাসিকভাবে পরাজিত করতে পুরুষের কতটুকু সংগ্রাম করতে হয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু নারীকে করতে হচ্ছে অনেক বেশী, তুমুল সংগ্রাম করেই ফিনিক্সের মত নারীকে উঠে আসতে হবে! স্বপ্ন না থাকলে তো আসে না কিছু, আমরা সেই সময়ের স্বপ্ন এখন থেকেই যদি না দেখি, কেউ এসে আমাদের দিয়ে যাবে না। তাই আমি স্বপ্ন দেখি কবে সেই দিন আসবে যেদিন নাম দেখে নারী পুরুষ বোঝা যাবে না, ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া কেউ জানতেও চাইবে না কে নারী আর কে পুরুষ, আমরা জানবো সবাই মানুষ, সমাজে সে কী ভুমিকা পালন করে, সেইটার উপরই শুধু নির্ভর করবে তার সম্মান! কেউ নারী বলেই আমি তাকে বাসের সিট ছাড়তে চাই না, কেউ পুরুষ বলেই আমি তাকে সালাম দিতে চাই না!
আর পুরুষতন্ত্র কিন্তু বড় সুচতুর, সে তার চেহারা বদলায়ে নানা রূপে নানা ছলে রাজতব করতেই থাকে। এই যে দেখেন এত ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন, যে কোনো পণ্যের পাশে কাম জাগানিয়া নারীর সুড়সুড়ি- তো এই সমাজে যখন একটা কিশোর কোনো কিশোরিকে ‘মাল’ হিসেবে টিজ করে- সেই দোষ তার একার নয়, আমরাই তাকে প্ররোচিত করি নানা ইঙ্গিতে। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সুন্দরী হও, চামড়ার যত্ন নাও, কন্ডিশনার মাখ, পেপে না খেয়ে মুখে মারো, এই সবই পুরুষতন্ত্রের সুচতুর ছল! আচ্ছা বলেন তো- নারী এতো মোহনীয়, গুলাপী, লেবেঞ্চুসের মত হইলে কার লাভ? হরিনের মাংসে যতই টেস্ট থাকুক, সেইটা কিন্তু হরিনের সম্পদ নয়, বাঘের সম্পদ! তেমনি নারীর মোহনীয় রূপের সমীকরনও কাছাকাছি, পুরুষ নারীকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে পেতে চায়, তাই সে সাজাচ্ছে বিলবোর্ডে বিলবোর্ডে কামিনীদের মেলা, বলছে সবাই তোমরা ক্যাতরিনা হয়ে যাও, বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার তোমারে বিয়ে করে ধন্য করুক! মানুষ, বিশেষত নারী সাজবে, সহজাত সুন্দর সাজ, আমি কবি, সেই সাজের আমি পুজারী- কিন্তু নারীর সৌন্দর্যের যে কর্পোরেট মাগিবাজি ব্যবসা, তাতে বিবমিষা ছাড়া আর কিছু জাগে না, হ্যা অবশ্যই, স্যান্ডেলের বিজ্ঞাপনে যখন দেশের সেরা সুন্দরীটা বুক দুলিয়ে নাচতে থাকে, আমারো কাম জাগে, স্যান্ডেলটা কিনে এনে পায়ে না পড়ে বিছানায় তুলতে ইচ্ছে করে! আবার যখন কিছু কুমানুষ পুরুষকে এভাবে দেখায় যে পুরুষ একটা কামের মেশিন, নারীর চুল দর্শনেও তার মাথা নষ্ট হয়ে যায়, সে ঐ নারীকে ধর্ষন করে ফেলার একটা অধিকার পেয়ে যায়, তখন আমি একজন পুরুষ হিসেবে মাটিতে মিশে যাই, নিজের দিকে ভাবতে ইচ্ছে করে- পুরুষ তুমি কি এতই খারাপ? তাই যেমন বিলবোর্ডের সুরসুরি সুরোভিত- রুপসী- ঝলমলে- গোলাপী নারীও তার নিজের জায়গা নয়, আবার পুরুষ নামের কাম মেশিনের আক্রমন থেকে বাঁচবার অজুহাতে অবরোধবাসিনী কেরোসিনের বস্তাও নারীর আপন সহজাত স্থান নয়। এ সবই আরোপিত, চাপানো- কেউ জিজ্ঞেসও করলো না নারী তুমি কী চাও! সবাই বললো নারী তুমি এইটা হও! জীবন আমার, -সিদ্ধান্ত দেয় আরেকজন!
কবিয়াল নারীদের চোখে কাজল লাগে না,
পৃথিবীর নারীরা যদি জানতো!
নারী আর কারো নয়, সে শুধু নিজের-
পৃথিবীর নারীরা যদি জানতো!
নারীর যে প্রধান শত্রু পুরুষতন্ত্র, সেই পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক তো শুধু পুরুষ নয়! সমাজের প্রত্যেকটি চেতন অচেতন প্রত্যংগ এই কুতন্ত্র ধারন করে চলেছে, তাই লড়াই হতে হবে সর্বব্যাপী, সকল ফ্রন্টে, এবং সেটা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়, মানব অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই! যেমন আমি যদি কালো এক মেয়ে বিয়ে করি, আমার বাসায় ঘটনা কী ঘটবে? আমার মা-বোন –ভাবি সব ঘরের দোর দিয়ে কাঁদতে বসবে, পাশের বাড়ির বউঝিরা এসে মুখ বেঁকিয়ে বলবে,- পুলার চয়েস কী? আলকাতরা নিয়া আসছে ঘরে! সে বুঝতেও চাইবে না, তার ভাবার সময় নাই সেও একজন মেয়ে, আরেক মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে তাকে বিচার করা যে মানুষ হিসেবে মানুষের কত বড় অপমান, এই জিনিসটা তাকে বুঝতে দেয় না পুরুষতন্ত্র! কারন এখানেও সেই রোল প্লেয়িং, যে যার অবস্থানে থেকে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই আমাদের লড়াইটাও হতে হবে এই বিষয়টা মাথায় রেখে যে আমরা এমন একটা সমাজ গড়তে চাই, যেখানে আমাদের সন্তানেরা নারী বা পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে নিজেকে সহ সবাইকে ভাবতে শিখবে, যেখানে নারী ধর্ষন, এসিড ছোড়া নারী আদালতের বিষয় হবে না, মানবাধিকার লঙ্ঘনের আদালত হবে!
দুইটা পাতা একটি কুড়ি, এক নারী আর এক পুরুষ মিলে ফোটায় ফুল, যার সৌরভে মিশে থাকে মহাকালের মহত্তম আকাঙ্খা! কে নারী, কে পুরুষ চলুন আমরা ভুলে যাই, একবার যেষ্টা করে দেখি আমরা শুধুই মানুষ হয়ে উঠতে পারি কিনা!
** নারী বিষয়ক এরকম রসকষহীন লেখা দাঁড় করানো একজন কবির জন্য যন্ত্রণার, নারী অধিকার আমার বিষয় না, তারপরেও লিখে ফেললাম কেন জানি, ব্লগার কাল্পনিক_ভালোবাসার অনুরোধ-সাহস এর জন্য দায়ী! আমার লেখায় কোনো রেফারেন্স নাই, যে কেউ ইচ্ছেমত তার মতামত, সমালোচনা, বিশেষ অপছন্দ হইলে গালিও দিয়ে যেতে পারেন, তাইলে বুঝবো আমার লেখায় কিছু একটা ছিল!
শেষ করি কবি হিসেবেই-
হে বালিকাদল,
তোমরা আছ বলেই কবি কবিতা লেখে,
তোমরা ভালো থেক-
আমার কবিতারাও ভালো থাকবে!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৪ দুপুর ২:০১