বৃষ্টি এবং তাহার বন্ধুরা
লিখা ও প্রকাশঃ ১৭-০৭-২০১৫
পলিথিনের ছোট্ট পুটলির মধ্যে সম্ভবত ২২ টাকা পেঁচিয়ে পকেটে ভরলাম। অনেকদিন থেকে পড়ে থাকা প্ল্যাস্টিকের স্যান্ডেল জোড়া খাটের নীচ থেকে বাহির করে নিয়ে আসলাম। বাসা পরিবর্তন করার পরে সম্ভবত এগুলো আর বাহির করা হয়নি। পলিথিন আবৃত থাকায় স্যান্ডেল জোড়ায় কোন ময়লা জমেনি। একদম নতুনের মত অবস্থা।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। আর দেরী না করে বেড়িয়ে পড়লাম। নিজেকে এত ঝরঝরে লাগছিল যে, বুঝাতে পারব না। পাতলা কাপড়ের একটা প্যান্ট আর গায়ে একটা কাল টি-শার্ট পড়েছি। আমাদের ছেলেদের জীবনে মোবাইল এবং ওয়ালেট ছাড়া কেউ কখনো বাহিরে বের হয়েছে কিনা সেটা হাতে গুণে বলে দেয়া যাবে। প্রাসঙ্গিক-ভাবে আজ ওগুলো ছাড়াই বের হলাম। কেন জানি আমার মনে হয়, বছরের যে ২/৩ টা দিন আমি এগুলো ছাড়া বের হই, সে ২/৩ টা দিন যেন নিজেকে পৃথিবীর সবচে হাল্কা-তম বস্তু হিসেবে মনে হয়।
বাসার গেট দিয়ে বের হয়ে সরাসরি বৃষ্টিতে নেমে পড়লাম। পকেটে শুধু প্ল্যাস্টিক মোড়ানো সেই ২২ টাকা। টাকাটা অবশ্য হিসেব করে নিয়েছি। আমার বৃষ্টি ভেজার মধ্যবর্তী বিরতিতে, পথে ১৫ টাকা দিয়ে এক কাপ কফি কিনবো, তার সাথে ৭ টাকা দিয়ে একটা বিস্কুট কিনবো এবং বিস্কুটটা কফিতে চুবায়ে খাব।
পথে দেখলাম বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ছোট ছোট দোকানগুলোতে অনেকগুলো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে । আমার অনেকটা লজ্জাই লাগছিল। আমি জানি দোকানে আশ্রয় নেয়া অনেকগুলো মানুষের চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসিও দিচ্ছে। কারণ বড় ছেলে আর বড় মেয়েদের ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করতে হয় না, তারা হঠাৎ করে গলা ছেড়ে গান গাইতে মানা, তারা রাস্তার মধ্যে মনের আনন্দে নেচে উঠতে মানা, তারা টুপ করে বৃষ্টিতে মেনে পড়তে মানা, ইত্যাদি ইত্যাদি । এসব কথা চিন্তা করে কেন জানি আমার এই মুহূর্তে কিছুটা লজ্জা লাগছে। কিন্তু আমি জানি, কিছুক্ষণ পরে আমার এ লজ্জাটা কেটে যাবে। তখন চারপাশে কে আমাকে লক্ষ্য করছে, এ ব্যাপারটাই আমি ভুলেই যাব।
আমার সামনে দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে এক যুবক-যুবতি যুগল হাঁটছিল। কিন্তু দু’জন দু’জনের বেশ পার্থক্য রেখে হাঁটছিল। এই ব্যাপারটাই আমার সব সময় ভাল লাগে। কারণ ভালবাসা প্রকাশের জায়গাটা কোন পাবলিক প্লেস না হওয়াই সমীচীন এবং এটা রীতিমত জঘন্য।
আমার সামনে দিয়ে হাঁটা মেয়েটার উচ্চতা ৫.৩ হতে পারে আর ছেলেটা ৫.৮ এর কম হবে না। এর একটু পরে তারা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমি প্রায় ২৫ মিনিট ধরে হাঁটছিলাম। আজকের বৃষ্টিটা তার কাব্যিক ছন্দ ধরে রেখেছে। একই ধারায় বৃষ্টিটা পড়ছে, কোথাও কম, কোথাও বেশী না।
একটু পরে আমি আবার সেই যুগলকে পেয়ে গেলাম। তারা সম্ভবত একটু আগেই পার্কটাতে ঢুকেছে, পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে।
আরে!!! এই ছেলেটাকে তো আমি মুখ দেখা-দেখি চিনি। মাঝে মাঝে আমার কলোনিতেই তার সাথে দেখা হয়। কিন্তু কথা হয় না। গত বছর বৃষ্টিতেও তার সাথে এভাবে আমার দেখা হয়েছে। সব ঠিক আছে কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, "এটা তো আগের সে মেয়েটি না, অন্য মেয়ে!!!
আমি অনেকটা এগিয়ে এসে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাইয়া, ভাল আছেন?”
দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি তার চেহারা কালো করে ফেলেছে। আমি অবশ্য সাথে সাথে বুঝতে পারিনি। একটু পরে বুঝলাম, হয়তো ছেলেটির ভেবে নিয়েছে , এখনই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করব, “গত বছর যে আপুটাকে নিয়ে বের হয়েছিলেন, সে আপুটা কেমন আছে?” অথবা এই ধরণের কোন প্রশ্ন। তাহলে মোটামুটি তার এখানেই সব শেষ।
আমি তার বিব্রতভাবটা কাটানোর জন্য একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, “বৃষ্টিতে কেমন ভিজলেন?”
ছেলেটি এবার একটু হেসে বলল, “এই তো ভালই, আপনি?”
আমি বললাম, “আমারও অনেক ভাল লেগেছে”
আরও ২/১ টা কথা হল ছেলেটির সাথে। মোটামুটি আমি ইচ্ছে করেই কথাগুলো বললাম। কারণ আমি চাচ্ছিলাম, যেন ছেলেটি মনে করে, আমি বুঝতে পারিনি যে ‘গত বছরের যে মেয়েটি ছিল এই মেয়েটি সেই মেয়েটি’। আমি চাচ্ছিলাম, ছেলেটির বিব্রতভাবটা কেটে যাক।
সত্যি কথা বলতে কি, ছেলেটি বিব্রত হবে এই কথাটি সাথে সাথে বুঝতে পারলে, আমি তার সাথে এভাবে গিয়ে কথাই বলতাম না। কারণ মানুষের জীবনে এমন অনেক ব্যাপার থাকতে পারে, যা দূর থেকে দেখে আমাদের নেগেটিভ মনে হয়, আমরা খারাপ কিছু ভেবে বসে থাকি। আসলে কিন্তু তা না।
সেদিন মোটামুটি ১ ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরে আসলাম।
এর কিছুদিন পরে আমি আমার কলোনির একটা দোকানের বাহিরের টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলাম। তখনো বর্ষাকালটি শেষ হয়নি। একটু আগেও বৃষ্টি হচ্ছিল।
কে যেন পিছন থেকে জিজ্ঞাসা করল, “ভাইয়া, ভাল আছেন?”
আমি তাকিয়ে দেখলাম সেই ছেলেটি। সেখানে বসেই তার সাথে অনেকক্ষণ কথা হল। একসাথে চা খেলাম।
ছেলেটি বলল, “গত বছর আপনি যে মেয়েটিকে দেখেছেন তার সাথে আমার ব্রেক-আপ হয়ে গেছে গত বর্ষার ২ মাস পরেই। সে-ই চায়নি রিলেশনটা রাখতে। কারণ তার পারিবারিক-ভাবে অনেক সমস্যা ছিল”।
ছেলেটি আরও বলল, “আমিও বুঝতে পারছিলাম রিলেশনটা আর খুব বেশী নেয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন ভাইয়া, আমি কখনোই চাইনি রিলেশনটা ভেঙ্গে যাক। আমি অনেক চেষ্টাও করেছি। অনেক কষ্টও পেয়েছি”।
আমি মনে মনে বললাম, "সব ঠিকেই আছে। কারও জীবনের জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না"
আমি একটু মৃদু হেসে আবার বললাম, “দূর ওটা কোন ব্যাপার না। তো, আপনার নতুন মানুষটা কেমন আছে?”
ছেলেটি আমাকে হেসে বলল, “হুম, ভাল আছে। আপনার সাথে বৃষ্টিতে আমাদের যে দিন দেখা হয়েছিল, সেদিনই আমাদের 1st Date ছিল”। কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন আমরা নতুন ছিলাম?”
আমি বললাম, “কিভাবে বুঝলাম এই সহজ রহস্যটা থেকেই যাক। সব রহস্য ভাঙতে হয় না। হা হা”
আমি আবার মৃদু হেসে বললাম, “পরের বর্ষায় আপনারা যদি এবার বৃষ্টিতে ভিজতে বের হন, আমাকে একটু জানায়ে বের হোয়েন। আমিও বের হব। যেন আপনাদের সাথে আবার দেখা হয়ে যায়”।
ছেলেটি হেসে বলল, “আপনার সাথে তো তখন অন্য কেউ ও থাকতে পারে, তাই না ভাইয়া?”
আমি বললাম, “বলা যাচ্ছে না। কারণ ‘কিছু মানুষকে একা রেখেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করে”’।
এই বলে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
কিন্তু কেন জানি ছেলেটি হাসল না। আমি খেয়াল করলাম, সে অনেকটা না দেখার ভান করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে...
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:১৬