somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ইহতিশাম আহমদ
একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে ক্যামেরাপারসন হিসাবে চাকুরীরত। ত্রিকোন চলচ্চিত্র শিক্ষালয় নামে একটি ফিল্ম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রশিক্ষক। গল্প, কবিতা লেখা ও অভিনয়ের অভ্যাস রয়েছে।

চলচিত্র র্নিমাণ টিপস-৬ মন্তাজ ১

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(আয়তনে বড় হওয়ায় রচনাটি ২টি পর্বে বিভক্ত)
চলচ্চিত্র র্নিমাণের ক্ষেত্রে মন্তাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত সবাই কম বেশী মন্তাজ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। কিন্তু কেন যেন “মন্তাজ” নামক বিষয়টিকে সব সময় খুবই জটিল, কঠিন ও অতি গভীর একটা বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করার রেওয়াজ আমাদের দেশে রয়েছে। আমি চেষ্টা করব বিষয়টা সহজ করে উপস্থাপন করতে।

মন্তাজ মূলতঃ সম্পাদনার একটি বিশেষ পদ্ধতি। আসেন, প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি সম্পাদনা বিষয়টা আদতে কি? আমি পেশায় ভিডিও বা চলচ্চিত্র সম্পাদক না হলেও আমার দীর্ঘ মিডিয়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একটি শটের সাথে আরেকটি শট জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে একটি কাহিনীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই হল চলচ্চিত্র সম্পাদনা। কাহিনীটি কি ভাবে আগাবে তা র্নিভর করে লেখক এবং পরিচালকের উপরে। সেই সাথে কিছুটা দায় ক্যমেরাম্যানেরও রয়েছে, কারণ তার চিত্র ধারনের পদ্ধতি কি, সেটাও সম্পাদনায় কম বেশী প্রভাব ফেলে। অপরদিকে শটের সাথে শটের জোড়াগুলোকে সাধ্যমত মসৃণ ও যুক্তিগ্রাহ করাই একজন সম্পাদকের কাজ।

এখন, কাহিনী শুধু সামনে এগিয়ে গেলেই তো হবে না। সেখানে যদি কিছু ইমোশন বা উত্তেজনা না দেয়া যায় তাহলে মানুষ কেন পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে আসবে? ঠিক এই জায়গাটাতে মন্তাজের আবির্ভাব। একটা সরল সোজা জিনিসকে একটু ঘুরিয়ে বললেই সেটা শিল্প হয়ে যায়। যেমন, “বাঁশ বাগানে আসলে দেখা হবে”- এই সাদামাঠা কথাটাকে যখন ঘুরিয়ে বলা- “আসো যদি বাঁশ বাগানে আবার হবে দেখা বন্ধু আবার হবে দেখা” তখন সেটা গানের লাইন হয়ে যায়।

ঠিক তেমনি, নায়ক নায়িকাকে ছেড়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ করে ঘুরে আবার নায়িকার দিকেই ছুটে গেল, এর মাঝে কাহিনীর পরিসমাপ্তি আছে কিন্তু কোন অনুভুতি বা উত্তেজনা নাই। কিন্তু নায়ক নায়িকাকে ছেড়ে যখন দূরে যাওয়ার জন্যে হাঁটছে তখন যদি অতীতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দৃশ্যকে পর পর রিপিট করা যায় এবং তারপরে নায়ককে ঘুরে নায়িকার দিকে ছুটে যেতে দেখানো হয় তবে এই ছুটে যাওয়ার মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই আলাদা একটা রিনরিনে অনুভুতি কাজ করে। আর এটাই হচ্ছে মন্তাজের মূলমন্ত্র।

মন্তাজের কাজ হচ্ছে মানুষের অনুভুতিতে নাড়া দেয়া। নাড়া দেয়ার ধরনের উপরে ভিত্তি করে মন্তাজকে মোট চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্লেইন (Plain) মন্তাজ, ডায়ালেকটিক (Dialectic) মন্তাজ, মেট্রিক্স (Matrix) মন্তাজ ও ইন্টেলেকচুয়াল (Intellectual) মন্তাজ।

প্লেইন মন্তাজ- একটু আগে যে উদাহরণ দিলাম নায়কের নায়িকার কাছে ফিরে যাওয়ার, এটাই প্লেইন মন্তাজ। বাংলা সিনেমায় এককালে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। ইদানিং কালের বাংলা সিনেমায় এর ব্যবহার একটু কম দেখতে পাই। তবে হলিউডি বা বলিউডি সিনেমায় এর ব্যাপক ব্যবহার এখনও রয়েছে। “পিকে” সিনেমায় আমির খান যখন আনুশকার হাত ধরে তার পুরনো প্রেমিকের বিষয় জেনে নিচ্ছিল তখন পরপর পূর্বে দেখানো শট রিপিট করা হয়েছে। ঐ দৃশ্যটা নিশ্চয় আপনাদের মনে নাড়া দিয়েছে। যদি ওভাবে না দেখানো হত তবে কি এই অনুভুতির সৃষ্টি হত?

আবার হলিউডের “প্রি-ডেসটেইনড” সিনেমাটি যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে সিনেমার শেষের দিকে যখন রহস্য খোলাসা করা হচ্ছে তখন বেশ কয়েক বারই আগের শটকে রিপিট করা হয়েছে। এটাও প্লেইন মন্তাজ। অনেকেই হয়ত বলবেন, এটা তো রোমান্টিক সিনেমা নয়, রহস্য বা থ্রিলার সিনেমা। তাহলে এখানে প্লেইন মন্তাজের বিষয়টা আসে কেমন করে?

আগেই বলেছি মন্তাজের মূল কাজ হচ্ছে অনুভুতিতে নাড়া নেয়া। সেই অনুভুতিটা যে শুধু রোমান্টিকই হবে তা আপনাদের কে বলল? প্লেইন মন্তাজে অনুভুতি সৃষ্টির জন্যে পূর্বে দেখানো কিছু শট রিপিট করা হয়। এখানেও পূর্বের শট রিপিট করে এক ধরনের অনুভুতির সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং এটা সর্ব অর্থেই প্লেইন মন্তাজ। অনেক সিনেমায় ভিলেনকে মারবার আগে নায়কের মনে পূর্বের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠতে দেখা যায়, এটাও প্লেইন মন্তাজ। আপনার দেখা যতগুলো সিনেমা আপনি মনে করতে পারেন তার মধ্যে যেখানেই পূর্বের দেখানো একাধিক শটকে পরপর জুড়ে দিয়ে আপানার মাঝে কোন অনুভুতি বা উত্তেজনার সৃষ্টি করা হয়েছে, সবগুলো প্লেইন মন্তাজ। কেউ কেউ হয়ত বিষয়গুলোকে কাঁচা ভাবে দেখিয়েছে, কেউ বা নিপুন ভাবে। কিন্তু বিষয়টি যে প্লেইন মন্তাজ, এতে কোন সন্দেহ নাই।

ডায়ালেকটিক মন্তাজ- ইংরেজি Dialectic শব্দটির অর্থ হচ্ছে দ্বান্দ্বিকতা। দুটি বিষয়কে পাশাপাশি প্যারালাল কাটিংএর মাধ্যেমে দেখিয়ে যদি কোন অনুভতির সৃষ্টি করা হয় তবে সেটাকে ডায়ালেকটিক মন্তাজ বলে। এই ক্ষেত্রে শটগুলোর দৈর্ঘ্য কখনওই খুব বেশী হয় না। সেই সাথে পুরো বিষয়টার মাঝে একটা শুরু ও শেষ বা পরিনতি থাকে।

“ব্যটেলশীপ পটেমকিন” সিনেমাটিতে এই মন্তাজের উৎকৃষ্ট ব্যবহার রয়েছে। সিনেমার এক জায়গায় দেখানো হয়- একটি নাবিকের লাশ ডক ইয়ার্ডে রাখা হয়েছে, কাট। কিছু মানুষ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাট। আবার লাশের শট, কাট। আবার ঘুরে বেড়ানো মানুষের দৃশ্য, তবে এবার তারা লাশের বিষয়ে সচেতন, কাট। আবার লাশের শট, দুই এক জন মানুষ কাছে এসেছে, কাট। একজন লাশ নিয়ে কিছু বলা শুরু করল, কাট। লাশের কাছে মানুষ এগিয়ে যেতে লাগল, কাট। তারপর একবার লাশের শট, আরেকবার মানুষের এগিয়ে আসার শট। লাশের শট, মানুষের শট, লাশের শট মানুষের শট- এভাবে চলতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে বিষয়টা একটা আন্দোলনে পরিনত হয়। এর পুরোটাই ডায়লেকটিক মন্তাজ। যদি শুধু লাশের ছবিটি টানা দেখানো হত যেখানে একটু একটু করে মানুষ জড় হচ্ছে তার পর সেটা আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে তবে কি সেই আন্দোলন আপনাদেরও আন্দোলিত করত?

আরেকটি উদাহরণ দেই। আলেকজেন্ডার পুদভকিন পরিচালিত “মাদার” সিনেমাটিতে প্রথম থেকে দেখানো হয় দেশের অবস্থা খুব খারাপ এবং সময়টা শীতকাল। চারদিকে জমাট বাধানো বরফ। এক সময় মানুষ জেগে উঠল অন্যয়ের বিরুদ্ধে। সে সময় পাশাপাশি শীতও চলে যেতে লাগল। বরফ গলতে লাগল। মানুষ জেগে উঠছে, বরফের চাংগর ভেঙ্গে পড়ছে। মানুষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, বরফ গলে পানিতে ভাসছে। মানুষ লড়াই করে জিতছে, তিরতির করে বরফ গলা পানি নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে। প্যারালাল কাটিংএর মাধমে দুটি বিষয়কে যখন পাশাপাশি দেখানো হয় তখন মনের মাঝে এক ধরনের অনুররণ জাগে।

চলবে......

২য় পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:০১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×