somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ এর ছোট গল্প "কঙ্কাল"- শেষ পর্ব

০৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“ কালক্রমে আরো দুই-চারিবার রোগ ও আরোগ্য হইবার পরে দেখিলাম আমার সেই সন্ধ্যাকালের মানস-সভায় পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষ-সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া ক্রমে একটিতে আসিয়া ঠেকিল , আমার পৃথিবী প্রায় জনশূন্য হইয়া আসিল । জগতে কেবল একটি ডাক্তার এবং একটি রোগী অবশিষ্ট রহিল । ”

“ আমি গোপনে সন্ধ্যাবেলায় একটি বাসন্তী রঙের কাপড় পরিতাম , ভালো করিয়া খোঁপা বাঁধিয়া মাথায় একগাছি বেলফুলের মালা জড়াইতাম , একটি আয়না হাতে লইয়া বাগানে গিয়া বসিতাম । ”

“ কেন । আপনাকে দেখিয়া কি আর পরিতৃপ্তি হয় না । বাস্তবিকই হয় না । কেননা, আমি তো আপনি আপনাকে দেখিতাম না । আমি তখন একলা বসিয়া দুইজন হইতাম । আমি তখন ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম , মুগ্ধ হইতাম এবং ভালোবাসিতাম এবং আদর করিতাম , অথচ প্রাণের ভিতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস সন্ধ্যাবাতাসের মতো হূ হূ করিয়া উঠিত । ”

“ সেই হইতে আমি আর একলা ছিলাম না; যখন চলিতাম নত নেত্রে চাহিয়া দেখিতাম পায়ের অঙ্গুলিগুলি পৃথিবীর উপরে কেমন করিয়া পড়িতেছে, এবং ভাবিতাম এই পদক্ষেপ আমাদের নূতন-পরীক্ষোত্তীর্ণ ডাক্তারের কেমন লাগে; মধ্যাহ্নে জানলার বাহিরে ঝাঁ ঝাঁ করিত , কোথাও সাড়াশব্দ নাই , মাঝে মাঝে এক-একটা চিল অতিদূর আকাশে শব্দ করিয়া উড়িয়া যাইত ; এবং আমাদের উদ্যানপ্রাচীরের বাহিরে খেলেনাওয়ালা সুর করিয়া ‘ চাই খেলেনা চাই, চুড়ি চাই ' করিয়া ডাকিয়া যাইত; আমি একখানি ধব্‌ধবে চাদর পাতিয়া নিজের হাতে বিছানা করিয়া শয়ন করিতাম ; একখানি অনাবৃত বাহু কোমল বিছানার উপর যেন অনাদরে মেলিয়া দিয়া ভাবিতাম , এই হাতখানি এমনি ভঙ্গিতে কে যেন দেখিতে পাইল , কে যেন দুইখানি হাত দিয়া তুলিয়া লইল , কে যেন ইহার আরক্ত করতলের উপর একটি চুম্বন রাখিয়া দিয়া আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া যাইতেছে। মনে করো এইখানেই গল্পটা যদি শেষ হয় তাহা হইলে কেমন হয় । ”

আমি বলিলাম , “ মন্দ হয় না । একটু অসম্পূর্ণ থাকে বটে , কিন্তু সেইটুকু আপন মনে পূরণ করিয়া লইতে বাকি রাতটুকু বেশ কাটিয়া যায় । ”

“ কিন্তু তাহা হইলে গল্পটা যে বড়ো গম্ভীর হইয়া পড়ে । ইহার উপহাসটুকু থাকে কোথায় । ইহার ভিতরকার কঙ্কালটা তাহার সমস্ত দাঁত ক ' টি মেলিয়া দেখা দেয় কই । ”

“ তার পরে শোনো । একটুখানি পসার হইতেই আমাদের বাড়ির একতলায় ডাক্তার তাঁহার ডাক্তারখানা খুলিলেন । তখন আমি তাঁহাকে মাঝে মাঝে হাসিতে হাসিতে ঔষধের কথা , বিষের কথা , কী করিলে মানুষ সহজে মরে , এই-সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতাম । ডাক্তারির কথায় ডাক্তারের মুখ খুলিয়া যাইত । শুনিয়া শুনিয়া মৃত্যু যেন পরিচিত ঘরের লোকের মতো হইয়া গেল । ভালোবাসা এবং মরণ কেবল এই দুটোকেই পৃথিবীময় দেখিলাম ।

“ আমার গল্প প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে- আর বড়ো বাকি নাই । ”

আমি মৃদুস্বরে বলিলাম , “ রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল । ”

কিছুদিন হইতে দেখিলাম ডাক্তারবাবু বড়ো অন্যমনস্ক এবং আমার কাছে যেন ভারি অপ্রতিভ । একদিন দেখিলাম তিনি কিছু বেশিরকম সাজসজ্জা করিয়া দাদার কাছে তাঁহার জুড়ি ধার লইলেন , রাত্রে কোথায় যাইবেন । ”

আমি আর থাকিতে পারিলাম না । দাদার কাছে গিয়া নানা কথার পর জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ হাঁ দাদা , ডাক্তারবাবু আজ জুড়ি লইয়া কোথায় যাইতেছেন । '

সংক্ষেপে দাদা বলিলেন , ‘ মরিতে । '

আমি বলিলাম , ‘ না , সত্য করিয়া বলো-না । '

তিনি পূর্বাপেক্ষা কিঞ্চিৎ খোলসা করিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ করিতে । '

আমি বলিলাম ‘ সত্য নাকি । '— বলিয়া অনেক হাসিতে লাগিলাম । অল্পে অল্পে শুনিলাম, এই বিবাহে ডাক্তার বারো হাজার টাকা পাইবেন ।

কিন্তু আমার কাছে এ সংবাদ গোপন করিয়া আমাকে অপমান করিবার তাৎপর্য কী । আমি কি তাঁহার পায়ে ধরিয়া বলিয়াছিলাম যে , এমন কাজ করিলে আমি বুক ফাটিয়া মরিব । পুরুষদের বিশ্বাস করিবার জো নাই । পৃথিবীতে আমি একটিমাত্র পুরুষ দেখিয়াছি এবং এক মুহূর্তে সমস্ত জ্ঞান লাভ করিয়াছি ।

ডাক্তার রোগী দেখিয়া সন্ধ্যার পূর্বে ঘরে আসিলে আমি প্রচুর পরিমাণে হাসিতে হাসিতে বলিলাম , ‘ কী ডাক্তার- মহাশয়, আজ নাকি আপনার বিবাহ। '

আমার প্রফুল্লতা দেখিয়া ডাক্তার যে কেবল অপ্রতিভ হইলেন তাহা নহে , ভারি বিমর্ষ হইয়া গেলেন ।

জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ বাজনা-বাদ্য কিছু নাই যে। '

শুনিয়া তিনি ঈষৎ একটু নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ ব্যাপারটা কি এতই আনন্দের । '

শুনিয়া আমি হাসিয়া অস্থির হইয়া গেলাম । এমন কথাও তো কখনো শুনি নাই । আমি বলিলাম , ‘ সে হইবে না , বাজনা চাই , আলো চাই । '

দাদাকে এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিলাম যে, দাদা তখনই রীতিমত উৎসবের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন ।

আমি কেবলই গল্প করিতে লাগিলাম বধূ ঘরে আসিলে কী হইবে , কী করিব । জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ আচ্ছা ডাক্তার- মহাশয় , তখনো কি আপনি রোগীর নাড়ী টিপিয়া বেড়াইবেন । ' হি হি! হি হি! যদিও মানুষের বিশেষত পুরুষের মনটা দৃষ্টিগোচর নয় , তবু আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, কথাগুলি ডাক্তারের বুকে শেলের মতো বাজিতেছিল ।

অনেক রাত্রে লগ্ন । সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার ছাতের উপর বসিয়া দাদার সহিত দুই-এক পাত্র মদ খাইতেছিলেন । দুইজনেরই এই অভ্যাসটুকু ছিল । ক্রমে আকাশে চাঁদ উঠিল ।

আমি হাসিতে হাসিতে আসিয়া বলিলাম , ‘ ডাক্তার-মশায় ভুলিয়া গেলেন নাকি । যাত্রার যে সময় হইয়াছে । '

এইখানে একটা সামান্য কথা বলা আবশ্যক । ইতিমধ্যে আমি গোপনে ডাক্তারখানায় গিয়া খানিকটা গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলাম এবং সেই গুঁড়ার কিয়ংদশ সুবিধামত অলক্ষিতে ডাক্তারের গ্লাসে মিশাইয়া দিয়াছিলাম । কোন্‌ গুঁড়া খাইলে মানুষ মরে ডাক্তারের কাছে শিখিয়াছিলাম ।

ডাক্তার এক চুমুকে গ্লাসটি শেষ করিয়া কিঞ্চিৎ আর্দ্র গদ্‌গদ কণ্ঠে আমার মুখের দিকে মর্মান্তিক দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন , ‘ তবে চলিলাম । '

বাঁশি বাজিতে লাগিল, আমি একটি বারাণসী শাড়ি পরিলাম; যতগুলি গহনা সিন্দুকে তোলা ছিল সবগুলি বাহির করিয়া পরিলাম- সিঁথিতে বড়ো করিয়া সিঁদুর দিলাম । আমার সেই বকুলতলায় বিছানা পাতিলাম ।

বড়ো সুন্দর রাত্রি । ফুট্ফুটে জ্যোৎস্না । সুপ্ত জগতের ক্লান্তি হরণ করিয়া দক্ষিনে বাতাস বহিতেছে । জুঁই আর বেল ফুলের গন্ধে সমস্ত বাগান আমোদ করিয়াছে ।

বাঁশির শব্দ যখন ক্রমে দূরে চলিয়া গেল , জ্যোৎস্না যখন অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল , এই তরুপল্লব এবং আকাশ এবং আজন্মকালের ঘরদুয়ার লইয়া পৃথিবী যখন আমার চারি দিক হইতে মায়ার মতো মিলাইয়া যাইতে লাগিল তখন আমি নেত্র নিমীলন করিয়া হাসিলাম ।

ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে । ইচ্ছা ছিল যখন আমার অনন্তরাত্রির বাসর-ঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিব তখন এই হাসিটুকু এখান হইতেই মুখে করিয়া লইয়া যাইব । কোথায় বাসর-ঘর। আমার সে বিবাহের বেশ কোথায় । নিজের ভিতর হইতে একটা খট্‌খট্‌ শব্দে জাগিয়া দেখিলাম , আমাকে লইয়া তিনটি বালক অস্থিবিদ্যা শিখিতেছে। বুকের যেখানে সুখদুঃখ ধুক্‌ধুক্‌ করিত এবং যৌবনের পাপড়ি প্রতিদিন একটি একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইত সেইখানে বেত্র নির্দেশ করিয়া কোন্‌ অস্থির কী নাম মাস্টার শিখাইতেছে । আর, সেই যে অন্তিম হাসিটুকু ওষ্ঠের কাছে ফুটাইয়া তুলিয়াছিলাম তাহার কোনো চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছিলে কি । ”

“ গল্পটা কেমন লাগিল । ”

আমি বলিলাম , “ গল্পটি বেশ প্রফুল্লকর । ”

এমন সময় প্রথম কাক ডাকিল । জিজ্ঞাসা করিলাম , “ এখনো আছ কি । ” কোনো উত্তর পাইলাম না ।

ঘরের মধ্যে ভোরের আলো প্রবেশ করিল ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=স্মৃতির মায়ায় জড়িয়ে আছে মন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০৯


ঘাস লতা পাতা আমার গাঁয়ের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত
জংলী গাছ জড়ানো লতাবতী - আহা নিউরণে পাই স্মৃতির সংকেত,
রান্নাবাটির খেলাঘরে ফুলের পাপড়িতে তরকারী রান্না
এখন স্মৃতিগুলো পড়লে মনে, বুক ফুঁড়ে বেরোয় কান্না।

ফিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×