মানুষ হত্যা কিংবা জাতিকে হত্যা করার জন্যে আমি বিপ্লবে যোগ দেই নি। আমার দিকে তাকাও। আমাকে কি হিংস্র দেখায়?
- পল পট, খেমাররুজ নেতা ও কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী
খেমার রুজ নেতা পল পট কম্বোডিয়ার প্রধান মন্ত্রী ছিলেন ১৯৭৫-১৯৭৯ পর্যন্ত। সেসময়টায় খেমাররুজদের গৃহীত নীতির ফলে প্রায় দুই মিলিয়ন কম্বোডিয়ান মারা যায়। খেমাররুজ গেরিলারা প্রকৃতপক্ষে ছিল সমাজবাদী এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব কামপুচিয়ার সদস্য। কম্বোডিয়ার শাসনভার নেয়ার সময়ে খেমাররুজ গেরিলারা এই দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখে "ডেমোক্রেটিক কাম্পুচিয়া"।
সমাজবাদের গোড়ার কথা:
১৮ শতকে শুরু হয় পশ্চিমে শুরু হয় শিল্প বিল্পব। সাথে সাথে চ্যালেন্জ্ঞ হয়ে দাড়ায় শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরী, তাদের কাজের পরিবেশ ইত্যাদি। এই চ্যালেন্জ্ঞ থেকে জনপ্রিয় হতে থাকে সমাজবাদ, যারা মনে করে শ্রমজীবী মানুষের সমস্যার সমাধান তাদের হাতেই নিহিত। কার্ল মার্কসের মতে সমাজ একটি একক সত্ত্বা এবং সমাজের নীতি-উৎপাদন হবে সমাজের সামগ্রিক কল্যানের সাথে সামন্জ্ঞস্যপূর্ন। সমাজকে হবে শ্রেনীহীন এবং সমাজের রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রতিটি মানুষের মতামত সমানভাবে গুরুত্ব পাবে। যার ফলে ব্যক্তি মালিকানা নয়, সম্পদের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজের সামষ্টিক মালিকানা। কার্ল মার্কস সমাজবাদের একটি তাত্ত্বিক রূপরেখা দেন মাত্র, এর কোন বিস্তারিত প্রয়োগ দেখান নি। কার্ল মার্কসের দেয়া সমাজবাদের মূলনীতির মধ্যে রয়েছে উৎপাদনের হাতিয়ারের উপরে সমাজের সামগ্রিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে নিরূৎসাহিত করা ইত্যাদি। সমাজের শ্রমজীবী মানুষ বা প্রলেটারিয়েত কর্তৃক শাসকশ্রেনী বুর্জোয়াদের উৎখাতের মাধ্যমেই এই সমাজ গঠন সম্ভব। কমিউনিজম এবং সোশালিজমের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে - কমিউনিজমের সাথে বিপ্লব বা রেভোলিউশন জড়িত। অন্যদিকে সোশালিজমের মাধ্যম হচ্ছে ইভোলিউশন বা বিবর্তন। কমিউনিজমের এই ধারনা বহু পুরোনো - গ্রিক বিজ্ঞানী প্লেটোর বিখ্যাত বই "রিপাবলিক" উল্লেখ করেছে যার প্রকৃতিকে।
একটু অপ্রাসংগিক ভাবেই আমার একটি পর্যবেক্ষন টেনে আনছি। আজকের বাংলাদেশেও কিছুদিন আগে পোশাক শিল্পে এক ধরনের অরাজকতা পরিলক্ষিত হল ন্যুনতম মজুরী নিয়ে। এই আমেরিকাতে এই বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা হয়ে থাকে। যারা ন্যুনতম মজুরী বাড়ানোর বিপক্ষে , তাদের কথা হচ্ছে, এটি এন্ট্রি লেভেল জবকে নিরুৎসাহিত করে থাকে। আমি নিজেও কিন্তু এরকম চিন্তাধারাকে যৌক্তিক মনে করি। ন্যুনতম মজুরী নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে বরং শ্রমিকেরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য মজুরী পাচ্ছে কিনা, কিংবা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কিনা - সেটা নিশ্চিত করা জরূরী। আরেকটি দিক যেমন, কাজের পরিবেশ। এ বিষয়ে মুক্তবিশ্বের অবস্থান মোটামুটি অনড় এবং এমপ্লয়ীদের সার্বিক নিরাপদ কাজের পরিবেশ দিতে মালিকপক্ষ বাধ্য। এদিকে বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় গার্মেন্টস এ আগুন লেগে প্রচুর শ্রমিক মারা যায়। এক্ষেত্রে কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি যে উপেক্ষিত হচ্ছে - তা বলাই বাহুল্য। কিছুটা সতর্ক হলে এবং সঠিকভাবে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করলে এসব দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।
যা হোক, এই সমাজবাদী ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে খেমাররুজদের আধিপত্য ও বিস্তার ঘটে থাকে ৭০ এর দশকে। সাথে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আমেরিকা ও ভিয়েতনামের আগ্রাসন। নীচে যার কিছুটা বর্ননা রয়েছে।
খেমাররুজদের উথ্থান/পতন:
কম্বোডিয়া ছিল ফরাসী কলোনি। ১৯৫৪ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে সেখানে ক্ষমতায় ছিলেন রাজা নরোদম সিহানুক। দমননীতির মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং ১৯৫৫তে বিতর্কিত নির্বাচনের দ্বারা তিনি বিরোধী বামদের মনে এই ধারনা গেথে দিতে সমর্থ হন যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আসলে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও দুর্বল হবার কারনে কম্বোডিয়ার সমাজবাদী দলগুলো তখন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন তীব্র আন্দোলন কিংবা বিপ্লব গড়ে তুলতে পারে নি।
সে সময়টাতে আরো অনেকের মত "স্যালথ সার" নামে এক কম্বোডিয়ান যুবকও স্বপ্ন দেখত শোষিতের মুক্তির। একটি শ্রেনীহীন সমাজের, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের। ফ্রান্সে উচ্চ শিক্ষারত সময়েই তার মনে দাগ কাটে এই সমাজবাদী ধ্যান ধারনা। ১৯৫৪ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে স্যালোথ তখন স্বীকৃত কমিউনিস্ট পার্টি এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টিদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।
সরকারের দমননীতি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৯৬২ সাল থেকে কমিউনিস্ট দলগুলো আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে পারে নি। ১৯৬৩তে স্যালোথকে চলে যেতে হয় আত্মগোপনে, কারন তার উপরে নেমে এসেছে সরকারের খড়গহস্ত। ১৯৬৩তেই তিনি পার্টি সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। সরকারের স্বৈরাচার এবং অপশাসনের ফলে দ্রুত বাড়তে থাকে খেমাররুজদের তৎপরতা। একসময় খেমাররুজরা দখল করতে শুরু করে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন অংশ। খেমাররুজ নেতা স্যালথ সার ওরফে পল পট পরিচিত হন "ব্রাদার নাম্বার ওয়ান" নামে।
১৯৭০ সালে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে জেনারেল লন নল উৎখাত করেন প্রিন্স সিহানুককে। যার ফলে সিহানুক এবং খেমাররুজদের মধ্য এক জাতীয় সমঝোতা তৈরী হয়। এদিকে আমেরিকার ক্রমাগত বোম্বিং এর ফলে প্রায় ১০০,০০০ কৃষক জীবন হারায়। লন নলের দমননীতি এবং তৎকালীন অস্থিতিশীলতার ফলে বাড়তে থাকে খেমাররুজ গেরিলাদের তৎপরতা। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে খেমাররুজ গেরিলারা দখল করে নেয় নমপেন এবং কম্বোডিয়া। [৫]
১৯৭২ সালে ক্ষমতা দখলের আগেই খেমাররুজ গেরিলারা সমাজ পরিবর্তনের দিকে জোর দেয়। খেমাররুজ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে তারা পোশাক এবং অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পল পট ভূমি সংস্কার বিষয়ে মনোযোগী হন। যার ভিত্তি ছিল সম আয়তনের ভূমির মালিকানা। এসময় তারা সমস্ত প্রাইভেট যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ১৯৭২ এ তাদের নীতি ছিল স্বাধীন এলাকাগুলোর দিকে মানুষ কমিয়ে দেয়া। এসব নীতি দরিদ্র কৃষকের জন্য সুবিধাজনক হলেও তা শহুরে রিফিউজিদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়ায়। ১৯৭৩ সালে পল পট ডিক্রি জারী করেন যাতে কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলোতে সমিতি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যক্তি মালিকানা নিষিদ্ধ হয়। [৬]
পল পট মাওবাদী নীতি গ্রহন করেন যেখানে কৃষকরাই হচ্ছে সত্যিকার মেহনতী শ্রেনী। শহর থেকে আসা মানুষগুলোর অধিকার কমে যায়, কমে যায় তাদের রেশন। মার্চের ২০, ১৯৭৬ এর নির্বাচনে এরা ভোট দিতে পারেনি, যদিও কম্বোডিয়ার সংবিধান সবার অধিকার নিশ্চিত করেছিল। খেমাররুজ নিয়ন্ত্রিত রেডিও দাবী করত তাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের স্বপ্নপূরনের জন্য এক থেকে দুই মিলিয়ন মানুষই যথেষ্ট। বাকীদের জন্য তাদের মেসেজ ছিল, "তোমাদের রেখে কোন লাভ নেই, তোমাদের বিনাশে কোন ক্ষতি নেই।"
পল পট বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার পরিবর্তে বেছে নেন চীনকে। ভিয়েতনাম ছিল রাশিয়ার বলয়ভূক্ত। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে পট পট ভিয়েতনামকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করে। ভিয়েতনামের সাথে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের পরে ভিয়েতনামের কাছে খেমাররুজ গেরিলারা ক্ষমতা হারায় ১৯৭৯ সালে। কিন্তু আমেরিকা ভিয়েতনামের বিপক্ষে থাকায় খেমাররুজ গেরিলারা তখনও জাতিসংঘে কম্বোডিয়ানদের প্রতিনিধিত্ব করছিল। খেমাররুজ গেরিলারা এবং পল পট চলে যান আত্মগোপনে। ১৯৮৫ সালে তাদের এলাকাগুলোতে ভিয়েতনামের আক্রমন তীব্রতর হওয়ায় পল পট থাইল্যান্ডে পালাতে বাধ্য হন। ভিয়েতনাম ১৯৮৯ সালে কম্বোডিয়া থেকে যাবার পরে নূতন কম্বোডিয়ান সরকার খেমাররুজ গেরিলাদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে আগ্রহী হন। পল পট তাতে রাজী হন নি। অন্যদিকে সন্দেহ করতে থাকেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোন সেনকে সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্যে। তীব্র হয়ে যায় খেমাররুজদের অন্তর্কলহ। এরই এক পর্যায়ে সোন সেনকে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন পল পট। কিন্তু এর পরে আরেক খেমাররুজ নেতা টা মক পল পটকে গ্রেফতার করে নির্বাসন দেন। পল পট সম্পূর্নরূপে হারান খেমাররুজদের সমর্থন। ১৯৯৮ সালে এই হাউস এরেস্ট অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে। [৬]
খেমাররুজ শাসনামলে কেন এত হত্যা, এত রক্ত:
খেমাররুজ কর্তৃক কম্বোডিয়ানদের এই রক্ত তাদের আদর্শের রক্ত। পল পট এবং খেমাররুজ গেরিলারা কম্বোডিয়াতে "ইয়ার জিরো" নামে একটি নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে সভ্যতা আবার নূতন করে শুরু হবে। আগের সমাজের সমস্ত মূল্যবোধ এবং ট্রাডিশনকে ধ্বংস করে নূতন একটি সংস্কৃতি দিয়ে শুরু হবে কম্বোডিয়া। যার ফলে তাদের মূল টার্গেট হয়ে যায় বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষকরা। গ্রাম ও কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে খেমাররুজ বাহিনী শহর থেকে বহিষ্কার করে এর অধিবাসীদের, বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। [৩] ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে পল পট তার সময়কালের হত্যাকান্ডকে ভিয়েতনামী এজেন্টদের কাজ বলে দাবী করেন। তবে তিনি পরাজিত লন নল ও তাদের নেতাদের হত্যাকান্ডের দায় নেন। [৪]
খেমাররুজদের শাসনকালের জাতীয় সংগীতের কয়েকটি লাইনের ভাবানুবাদ নীচে দিলাম। পুরোটা পাওয়া যাবে এখানে:
Click This Link.
"উজ্জ্বল লাল রক্ত ছিটকে পড়েছে কাম্পুচিয়ার শহর এবং
সমভূমির উপরে, আমাদের মাতৃভূমি
আমাদের বিপ্লবী নারী ও পুরুষ যোদ্ধা, মজুর এবং কৃষকের রক্ত;
তাদের রক্ত দিয়েছে প্রচন্ড ক্ষোভ এবং সাহস
বীরত্বের সাথে লড়াই এর জন্য
এপ্রিলের ১৭, বিপ্লবের ব্যানারে, তাদের রক্ত
স্বাধীনতা দিয়েছে দাসত্বের রাষ্ট্র থেকে"
১।http://www.encyclopedia.com/topic/communism.aspx
২।http://news.bbc.co.uk/2/hi/asia-pacific/78988.stm
৩।http://www.dccam.org/Publication/Monographs/Monographs.htm
৪। Click This Link
৫। Click This Link
৬। http://en.wikipedia.org/wiki/Pol_Pot
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১০ ভোর ৫:৫৪