somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতাঃ কবি-হত্যার বিচার

২১ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাননীয় আদালত !
যখন কোন সরস্বতী পূজোর মন্ডপে দাঁড়িয়ে কিশোর ছেলেটি
গাঢ় স্বরে আবৃত্তি করে যায় জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা
‘১৩৩৩’ :
‘আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;
তোমার শরীর ছানি
মিটায় পিপাসা
কে সে আজ !- তোমার রক্তের ভালবাসা
দিয়েছ কাহারে !
কে বা সেই- ...’
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, “না-----,
এ কবিতা জীবনানন্দের নয়, এটি আমার কবিতা !
এ কবিতা আমার লেখার কথা ছিল,
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়ঃ জীবনানন্দ দাশ !
আপনি জানেন না-, আপনি একজন তরুন কবির নির্মম হত্যাকারী ।

শুধু তিনি নন মাননীয় আদালত !
এমন অসংখ্য-অসংখ্য কবিতা আমায় পীড়া দেয়,
আমি জীবনের গভীরতম বিষাদ ভরে লিখেছিলাম, ‘এই দ্যাখো !
আমার দুহাতে আগুন, এখন আমি সমুদ্র পোড়াতে যাবো’,
রুদ্র গোস্বামী পড়বার আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি
ও কবিতা আমি লিখলেও- ‘কবি’ রীতিমতো অন্য কেউ !
বিশ্বাস করুন মাননীয় আদালত,
আমি বুঝতেই পারিনি !
যখন, “জাম আর জামরুলের পাতায়
অজস্র জোনাকী পোকার দল ভালবাসা-
প্রেম ফেরি করে...”, লিখে তৃপ্তি নিয়ে লেপমুড়ি-ঘুমুতে গিয়েছি
গভীর রাতে ঘুম ভাঙিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন জারি করে
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “অমলকান্তি”:
“জাম-জামরুল পদ আমি লিখে গেছি ঢের আগে
ঢের ঢের আগে-
এই পদ নিয়ে তুমি লিখতে পারো না !”

আমার চোখে জল আসে মাননীয় আদালত ...
আমি এই ভরা কোর্টরুমে দাঁড়িয়ে কি করে বলি,
অমলকান্তিও একজন কবির হত্যাকারী
যে হয়তো একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল...
তবু সে আজ হত্যাকারী বটে !
আমি কি করে বলি,
“আজ আমি কাঁদতে আসিনি,
একজন কবি-হত্যার বিচার চাইতে এসেছি”
এই ক্ষুদ্র বাক্যটি বলতেও আমার ভয় হয়,
পাছে ওরা বলেঃ
আমি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতার পংক্তি চুরি করে এনেছি !

তবু আজ সাহস করে বলে ফেলছিঃ
“ধৈর্য ধরে থেকেছি বহুদিন...
আজ আর নয়, আর নয় !”
যদিও জানি আল মাহমুদের নাম করবেন আপনিও মাননীয় আদালত !
কিন্তু আপনাকে তার আগেই জানিয়ে রাখতে চাই,
এই কবিতাটিও আমারই লিখবার কথা ছিল !

মাননীয় আদালত !
আজ আমায় সত্যিই বাধ্য হয়ে এই বিচারসভায় দাঁড়াতে হয়েছে
কি করবো বলুন ?
যখন আমার প্রেমিকার একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী,
সেদিনকেও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
তাকে নিয়ে আমায় কোন কবিতা লিখতে দেয়নি !
তার পাশে শুয়ে হাত ছুঁয়ে বলতে দেয় নি বুদ্ধদেব বসুঃ
“শুয়ে শুয়ে মোরা দেখবো আকাশ, আকাশ মস্ত বড়ো
পৃথিবীর যত নীল রঙ সব সেখানে করেছে জড়ো...”
তার চোখে চোখ রেখে
নতুন করে বলবার সুযোগ রাখেন নি কবি কাজী নজরুলঃ
“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় ...”
শুধুমাত্র অমিয় চক্রবর্তীর কারনে
তাকে কখনো আমি ‘অতন্দ্রিলা’ বলে ডাকতে পারিনি !
কখনো তার উদ্দেশ্যে লিখতে পারিনি, “কথা আছে
ঢের কথা আছে...”
সেটি সম্ভবতঃ নীরার জন্যে লিখে গিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় !

প্রেমিকাকে গভীরভাবে জড়িয়ে যেবার বললেম,
“পাগলী ! তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাবো জীবন !”
সে চোখ পাল্টে বলেছিল মনে আছে, ‘জয় গোস্বামী ?’
কতটা কষ্টের শংখনীল কারাগারে আটকা পরেছিলাম সেদিন,
ভাবতে পারেন মাননীয় আদালত ?
পারেন না, পারবেন না...
কারন আপনার মাথায়ও গেঁথে আছে রফিক আজাদের মতন
সুবিখ্যাত কবির নাম !

আমার প্রেমিকা আমায় ছেড়ে চলে যায়
সেকথা কাওকে আমি জানতে দেই না...
এই যাহ !
আবার অরুন মিত্র চলে এলো,
নতুবা এই কবিতাটিও আমি লিখে ফেলতাম ও চলে যাবার পরপর
কোন একদিন; প্রেমেন্দ্র মিত্রের “তারপরও কথা থাকে” অথবা পুর্ণেন্দু পত্রীঃ
“একান্তে যার হাসির কথা হাসে নি
যে টেলিফোন আসার কথা আসে নি...”

মাননীয় আদালত ! ও আমায় ভুলে যায়,
আমি শুধুমাত্র শামসুর রহমানের কারনে লিখতে পারি নাঃ
“তুমি আমাকে ভুলে যাবে আমি ভাবতেই পারি না...”
অভিমান নিয়ে এতোটুকুও পর্যন্ত লিখতে পারি নিঃ
“আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই...
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কি তাতে ?
আমি নাহয় ভালবেসেই ভুল করেছি, ভুল করেছি
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায় ?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে ?
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে ?”
আমায় লিখতে দেন না হেলাল হাফিজ !

মাননীয় আদালত ! অপদার্থ কবি-মন এটুকুও লিখতে পারে নাঃ
‘আমি আজ সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দী হবো ...’
কারন আবুল হাসান
এতোটুকুও ছেড়ে যায় নি আমার জন্যে স্থান
বৃথাই সুকান্ত চিৎকার করেছিল,
‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান...’
কবি !
আপনি মিথ্যেবাদী -
আমার জন্যে আপনিও কোন কবিতার স্থান ফাঁকা রেখে যান নি
কারন, আমি জানি, কিছুমাত্র আগে জন্ম নিলে কবিদের মিছিলে
এই কবিতাটিও আমারই লিখবার কথা ছিল ...

মাননীয় আদালত !
সবথেকে কষ্ট হয় যখন “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ”
কবিতার বিকল্পও বাঁচে না, লিখে রেখে যান স্পষ্টবাদী হুমায়ূন আজাদঃ
‘আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে...’
তারপরও মহামান্য আদালত !
তারপরও প্রধান আসামী হিসেবে আমি রবীন্দ্রনাথকে কাঠগড়ায় চাইঃ
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ...’
‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি...’
‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো।
তোমার মনের মন্দিরে...’
আরও কত কত কবিতার নাম করবো !
আমি বিশ্বাস করি তিনি শুধু আমার নন,
ভূ-ভারতের আরও সহস্র কবির হত্যাকারী-
তিনি তার কবিতা উইথড্র করে নিলে
হয়তোবা কবি হতেন আরও সাড়ে সাত হাজার বাঙালি !

মাননীয় আদালত ! আমি অপটিমিস্ট; তাই-
শেষ পর্যন্তও আশা নিয়ে লিখতে বসেছিলাম এই শিরোনামে কবিতাঃ
‘রবীন্দ্রনাথ, তোমার কবিতা উইথড্র করো !’
কিন্তু হায় !
আজ দুপুরের লিটল ম্যাগাজিন খুলে দেখি
এক শিরোনামে একই কবিতা লিখে রেখে গেছেন
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ !

মাননীয় আদালত !
আমি কি এরপরও বিচার চাইতে আসতে পারি না ?
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×