somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।। গল্পঃ কবি

২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নুসাবা সিগারেট ধরালো । বেডসাইড টেবিল থেকে আসা ল্যাম্পশেডের ম্লান হলুদ আলোর সঙ্গে ধোঁয়ার দল নীরব নম্রতায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে । এই আধফোটা আলোতেও নুসাবার চোখদুটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । কেমন ক্লান্ত, বিষন্ন ! মন্দাক্রান্তা শেষ বিকেলের রোদের মতন । যা মন খারাপ করিয়ে দেয় ঠিকই, তবু দেখতে বড় ভাল লাগে । হেলাল আড়চোখে নুসাবার দিকে তাকালো । কেমন পরীর মতন একটা মেয়ে ! অথচ তাকালেই তার ভেরোনিকা ফুলের মত শাদা মুখ, গলা মোমের মত নরম শরীরের নীচ থেকে কোথাও এক দুঃখের মহাসমুদ্রের গর্জন শোনা যায় । কত রকম দুঃখই না আছে মানুষের । সবটা কেউ সবাইকে বলতে পারে না । হেলাল নরম ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমাকে কেমন অচেনা লাগছে যেন ।’
‘তাই বুঝি ? কেমন সেটা ?’
‘বুঝে উঠতে পারছি না । তবে মনে হচ্ছে বিদেশিনী কোন ব্লন্ডি রূপবতী । ল্যাম্পের আলোর জন্যেও হতে পারে । তোমার চেহারায় ক্যাথলিন টার্নারের একটা ছাপ আছে, এর আগে বলেছে তোমাকে কেউ ?’
‘না, বলেনি । আমায় নগ্ন দেখেছো বলেই এমনটা মনে হচ্ছে তোমার কাছে ।’

এমন কথা অবলীলায় বলেই নুসাবা এক বুক নিকোটিনের বিষ দীর্ঘ সময় ধরে ভেতরে টেনে নিল । তারপর কি মনে করে যেন ক্যাথলিন টার্নারের ভঙ্গীতে হেসে তার বিখ্যাত সিনেমাটির সংলাপ নকল করে বলল, ‘আইম আ ম্যারিড ওমেন’ । ফ্যানের বাতাসে তার চুলও উড়ছে ছায়াছবির মত করেই । হেলাল হেসে বলল, ‘মিনিং হোয়াট ?’

‘আইম নট লুকিং ফর কোম্পানি...’, বলেই নুসাবা আবার বিষন্ন হয়ে পড়ল । কোনায় পড়ে থাকা টেলিভিশন বকবক করে চলেছে নিজের মত । হেলাল উঠে গিয়ে শার্ট গায়ে চড়িয়ে বোতাম বাঁধতে শুরু করল । নুসাবা বলল, ‘ক্রিপারের ওখানটায় দেখো । ঘূর্নিবিচির বনসাইটার নিচে তোমার পেমেন্ট খামে ভরে রেখেছি ।’ হেলাল খামটা তুলে নিয়ে না খুলেই পকেটে ফেলে রাখল । নুসাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বেখেয়ালে বলল, ‘আমার কাছে এই মুহূর্তে আর কোন টাকা নেই । থাকলে তোমাকে সারা রাত এখানে রেখে দিতাম । ভাল কথা, এক রাতের জন্য আমার কাছ থেকে তুমি কত নিতে ? মানে, পুরোনো খদ্দেরের জন্য চার্জ তো কম হওয়ার কথা ।’

হেলাল নুসাবার পাশে গিয়ে বসল । সে এখনো আগের মতই বসে আছে । এতোটুকুও নড়ছে না । কাপড় পড়ে নি । ছড়ানো জামা কাপড় মেঝেতে পড়ে আছে । হাতের সিগারেট ফুরিয়েছে সেটাও বোধহয় খেয়াল নেই । পোড়া ফিল্টার এখনো তার দু’আঙুলের ভাঁজে আটকে আছে । নুসাবার মোমের মত ফর্সা নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে হেলাল গভীর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল । কি নেই এই নারীটির মধ্যে ? মিশরী মেয়ের মত টানা চোখ, টানা ভ্রূ, নাসপাতি ঠোঁট, করুণ শঙ্খের মত স্তন, মোমশাদা দেহ আর মায়াকাড়া দৃষ্টি । সবটা মিলিয়ে নুসাবাকে ফ্রান্সোই গেরার্দের পেইন্টিং করা সাইকির মত লাগছে, অপূর্ব রূপবতী- হাত বাড়ালেই হারিয়ে যাবে এমন । যে কোন দেবতাও যাকে দেখে আসক্ত হবে নিশ্চিত । ছুঁয়ে দিতে চাইবে- আদর করতে চাইবে- চাইবে একান্ত নিজের করে নিতে । হেলাল হালকা গলায় বলল, ‘আজ তোমার কি হয়েছে বলতো ?’
নুসাবা জবাব না দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, হেলাল, তুমি কি কখনো কাউকে ভালবেসেছো ?’
‘হ্যাঁ, বেসেছি ।’
‘আমাকে নিশ্চয়ই নয় ?’

হেলাল হাসল । নুসাবা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করে বলে যেতে লাগল, ‘কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা ভরা চাঁদের মত রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসে । রূপবতী মাত্রই নিজেকে রাজকন্যা ভাবে, ভাবাটাই স্বাভাবিক । তারা নিজেদের জন্য পারফেক্ট প্রিন্স চার্মিং-কে খুঁজে বেড়ায়- তাকে নিয়ে স্বপ্ন তৈরী করে । তাদের আশেপাশে এত এত রাজপুত্র ঘুরে বেড়ায়, যে আসল প্রিন্স চার্মিং-কে এদের ভেতর থেকে খুঁজে বের করাটা কঠিন হয়ে পড়ে । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই রাজকন্যার দল নিজের লালন করা ভালবাসাটুকু ভুল রাজকুমারকে দিয়ে বসে । শেষ পর্যন্ত যাকে দেয়া হয় দেখা যায় যে কেবল রূপটুকু শুষে নেয়ার জন্যেই কাছে এসেছিল, ভালবাসা পাওয়ার কোন ইচ্ছা তার ছিল না । রাজকন্যাদের সবচে বড় কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের রূপ, যে রূপের কারনে একদিন অনেক রাজপুত্র তার দুয়ারে হাত পেতে বসেছিল । হেলাল, তুমি তো তোমার এই পেশায় অনেক বয়েসের অনেক ধরনের নারীকে সঙ্গ দিয়েছো । আমাকে সত্যি করে বলতো আমার মত রূপবতী কাউকে কি কখনও তুমি এত কাছ থেকে দেখেছো ?’
‘না, নুসাবা ।’
‘তবুও তুমি আমায় ভালবাসতে পারো নি । নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য তোমাকে আমার ভাড়া করে আনতে হয়েছে । এমন কি হতে পারতো না, তুমি একবার দেখেই আমায় ভালবেসেছো, বারবার নিজের ইচ্ছেতে এখানে এসেছো ? তা কিন্তু হয় নি ।’
‘আমার ব্যাপারটা ভিন্ন । আমি আমার ভালবাসাগুলি কৈশোরের এক প্রান্তে রেখে এসেছি । নতুন করে ভালবাসার মত তৃষ্ণা আমার ভেতরে আর আসবে না ।’
‘আমার মতন রূপবতী কাউকে পেলেও নয় ? আচ্ছা, তোমার কৈশোরের প্রেমিকা কি আমার চেয়ে সুন্দর ছিল ?’
‘না নুসাবা, আমি আগেই বলেছি তোমার মত রূপবতী কাউকে এত কাছ থেকে আমি কখনো দেখিনি । প্রথমবার তোমাকে দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম । তোমার মত একটি মেয়ের পুরুষসঙ্গী ভাড়া করতে হবে, এটা বেশ অবিশ্বাস্য । বারবার টাকার জন্য আমার এখানে আসতে হয়েছে । কখনো জানতে চাওয়ার সাহস হয় নি, কেন এমন ।’

নুসাবা একটা মুখভঙ্গি করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল । মেঝে থেকে পুরোনো কাপড় না তুলে ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার টানল । সেখান থেকে একটা একটা করে ড্রেস তুলে নিয়ে মেঝেতে ফেলছে । কোনটিই পছন্দ হচ্ছে না তার । তারপর হালকা নীল রঙের একটা নাইটি বেছে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে সাজতে শুরু করল সে । আই লাইনার দিয়ে চোখে দীর্ঘ কাজল টানার চেষ্টা করল, হল না । তার হাত কাঁপছে প্রচন্ডভাবে । কাজল এলোমেলোভাবে বসে গিয়ে চোখে কলংক লেপে দিল যেন । নুসাবা তার আই লাইনারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল । হেলাল খুব অবাক হল । নুসাবা অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করছে । এমনটা আগে কখনো হয় নি । কি হয়েছে ওর ?
নুসাবা ঘরের এক কোণে মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল । তার গাল বেয়ে কাজল অশ্রুর সাথে নেমে গেছে । সমস্ত মুখ মেখে গেছে কালিতে । হেলাল বলল, ‘তুমি বরং ঘুমাও ।’
‘তুমি চলে যেতে চাচ্ছ ?’
‘না, আমি আছি । তুমি ঘুমাও ।’
‘রাতে থাকতে কত টাকা চাও ?’
‘টাকা দিতে হবে না । তুমি ঘুমাও ।’
‘সত্যি করে বলতো, তুমি কি আবার আমার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেছো নাকি ?’
‘না, এমন কিছু না ।’
‘তাহলেই ভাল । আর কোন পুরুষের ভালবাসা-বাসি টাইপ ন্যাকামি সহ্য করার মত শক্তি এখন আর নেই ।’

নুসাবা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল । দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে । টেলিভিশনটা এখনো সতেজ, কি একটা বিদেশী ফ্যান্টাসি সিরিজ চলছে । হেলাল উঠে গিয়ে ওটাকে বন্ধ করে দিল । বেডসাইড টেবিলের ওপরের দিকের লাগোয়া ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল । লাইটার খুঁজে পাচ্ছে না । সে লাইটার খুঁজতে নীচের ড্রয়ারগুলিও হাতড়ালো । লাইটার পেল না, তবে একেবারে নীচের ড্রয়ারটিতে অনেকগুলি ছবির অ্যালবামের নীচে একটি কালো রঙের ডায়েরী উঁকিঝুঁকি মারছে । অন্যের ডায়েরী পড়বার অভ্যেস হেলালের নেই । তবু কি মনে করে ডায়েরীটা বের করে খুলল সেঃ

“আমার লাংস ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে । কোন এক অদ্ভুত কারনে চিকিৎসা যতই এগুচ্ছে, আমি তত বেশী অসুস্থ্য হয়ে পড়ছি । আজ দুপুরে ডাক্তারের সাথে কথা হলো । তিনি কোন কিছুই লুকোলেন না । মৃত্যুর দিনক্ষণ রোগীকে জানানোর রিস্ক কোন ডাক্তারই নেয় না । তিনি অবশ্যি ফ্রাংকলি বলেছেন, ‘আপনি যদি আর কিছুদিন আগে আসতেন, তাহলে চান্স বেশী থাকতো...’ ইত্যাদি । থ্যাংকস ডাক্তার সাহেব । আপনার সাথে কথা বলবার কারনেই আজ অনেকদিন পর রাতে হয়তো আমার খুব ভাল ঘুম হবে । অনেক, অনেকদিন পর ।

অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু আর্থারাইটিজ জেঁকে বসেছে আমার ওপর । খুব কষ্ট হচ্ছে লিখতে । তবু লিখছি । অনেকসময় দৈহিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণার ট্রিটমেন্ট পাওয়াটা বেশী প্রধান হয়ে দাঁড়ায় । আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে । আমার ট্রিটমেন্ট আমার লেখালিখি । বেদনাগুলো মাথা থেকে বের করে ডায়েরীতে ছেড়ে দেয়া । জীবনে কি কি করতে পেরেছি আর কি পারিনি এর একটা হিসেব করাও তো দরকার ।

আমার বিবাহিত জীবন কেমন ছিল ? ইংরেজীতে ‘ইম্পসিবল্‌ মেরিড লাইফ’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে । আমারটা ছিল তারচে’ও খারাপ । হ্যাঁ, আমার স্বামী আমায় স্বাধীনতা দিয়েছিল । অবাধ স্বাধীনতা । প্রাইভেসীও দিয়েছিল । এতোটাই বিশাল পরিমানে দিয়েছিল যে আমি কি পছন্দ করি, কি অপছন্দ করি- সেসবেও বিন্দুমাত্র নাক গলাতো না সে ! আসলে নাক গলানোর মত আগ্রহই তার ছিল না । তার আগ্রহ ছিল মদে ।

মদ্যপ লোকটিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলাম । অত্যন্ত অহংবোধ ছিল তার চরিত্রে, একগুঁয়ে আর স্বার্থপর । সে ওমেনাইজার ভাবধারার মানুষ আর আমি ফেমিনিস্ট । কাজেই ও যখন আমাকে মারত, আমিও চুপ করে থাকতাম না । সে যুদ্ধের হুমকি দিলে আমি তার গায়ে বুলেট ছুঁড়ে দেয়ার মত ভুলটাই করতাম প্রতিনিয়ত । ঐ বুলেট ব্যবহার করেই সে গুলি করবার সুযোগ পেয়ে যেত । আমাদের যৌন জীবন ছিল এক কথায় ‘নন-এক্সিসটেন্ট’ । আর তার মধ্যেও যখন কখনো-সখনো গাঢ় অমাবস্যায় চাঁদ উঠতো তখন আমার কাছে তার সংজ্ঞা ছিল দু’অক্ষরের একটা কুৎসিত শব্দঃ রেপ ।

আমি ভেবেছিলাম ও ঠিক হয়ে যাবে । একটা বাচ্চা নিলেই হয়তো একটা ঘরোয়া পরিবেশ তৈরী হবে । কিন্তু আমার ভাবনা ভুল ছিল । খুব ভুল ছিল । কিছু কিছু মানুষের স্বপ্ন দেখাই উচিত না । আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি তেমন মানুষদের দলে । আমি প্রেগনেন্ট শুনে ও আমার মুখের ওপর মদের গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছিল । আমি এতোটাই অবাক হলাম যে...”


‘ওটা রেখে দাও ।’, ঘুমভাঙা কন্ঠে নুসাবা বলল । সে বোধহয় ঘুমাতেও পারছে না ঠিকঠাক । সে যে ক্যান্সারে ভুগছে একথা হেলাল জানতো না । ওর স্বামীর সম্পর্কেও তেমন কিছু জানতো না সে । জানতো ব্যবসায়ী, কিসের ব্যবসা সেটি পর্যন্ত হেলালের মনে নেই । ‘জিগালোও’দের এত কিছু মনে রাখতে হয় না । এদের কাজ ধনী নারীদের দৈহিক চাহিদা মেটানো, কোন কোন ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদের সঙ্গ দেয়া, তার বিনিময়ে টাকা উপার্জন এবং খদ্দের নারীটিকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ভুলে যাওয়া । বিশ্বস্ত হওয়াটা এই পেশায় খুব জরুরী । তাই এই পেশার সাথে জড়িতদের বড় গুন হচ্ছে ‘স্মৃতিভ্রষ্টতা’ ।

হেলাল ডায়েরীটি আবার ড্রয়ারে রেখে দিল, যেভাবে ছিল ঠিক তেমনি করে । জিজ্ঞেস করবে না ভেবেও বলল, ‘তোমার ক্যান্সার ধরা পড়েছিল কবে ?’
‘কেন ? ক্যান্সার জানলে আমার সঙ্গে শুতে আসতে না ? ভয়ের কি আছে ? ক্যান্সার তো আর ছোঁয়াচে কিছু নয় ।’
‘আমি যদি জানতাম তোমার এইডস আছে তাহলেও হয়ত আমি তোমার সাথে শুতাম । আদম যেমন গন্ধম খেয়েছিলেন, তেমন ।’

নুসাবা অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল । ওর দিকে তাকিয়ে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল হেলালের । কতদিন পর কাউকে এভাবে কাঁদতে দেখছে সে । আহা ! মানুষ হয়ে জন্মানোয় এত কষ্ট কেন ? এত কান্না কেন ?

নুসাবা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ভাঙা গলায় বলল, ‘হেলাল, তুমি একবার বলেছিলে তোমার একটা কবিতার বই বের হবে । হয়েছিল নাকি ?’
হেলাল মিথ্যে করে বলল, ‘না ।’
‘ভালোই হয়েছে । না হওয়াই উচিত । কোন ‘মেল এস্কোর্ট’ কবিতা লিখছে ভাবলেই তো মানুষের কবিতা পড়ার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যাবে । তবে তুমি অন্যরকম । তোমার শেষ কথাটা শুনে আমি কান্না ধরে রাখতে পারিনি । কথাটাতে একটা কিছু ম্যাজিক ছিল । কবিদের ‘কথার ম্যাজিক’ জানতে হয় ।’
‘তোমার বেশীমাত্রায় মন খারাপ বলে কেঁদে ফেলেছো । ম্যাজিক-ফ্যাজিক কিছু নয় ।’
‘তাই বুঝি ? তোমাকে একটা মিলিয়ন ডলারের অফার দিচ্ছি । তুমি যদি আমাকে একটা কবিতা বলে মুগ্ধ করতে পারো, আমি তোমার কবিতার বই ছাপানোর খরচ বিয়ার করবো ।’

হেলাল তৎক্ষনাৎ বললঃ
“ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সয়ে যাও,
ভিতরে বিষের বালি
মুখ বুজে মুক্তা ফলাও ।”

নুসাবা অবাক হয়ে বলল, ‘এই কবিতা তোমার লেখা ?’
‘না । আবুল হাসানের । তুমি কিন্তু আমার লেখা কোন কবিতা শুনতে চাও নি ।’
‘আমি তোমার লেখা কবিতাই শুনতে চেয়েছিলাম । অন্যের কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তোমার কবিতার বই কেন ছাপিয়ে দেবো ?’
হেলাল গভীর কন্ঠে আবৃত্তি করলঃ
“আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার
দুঃখ তো আমার হাত- হাতের আঙুল- আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক ।”
‘এটা কি আসলেই তোমার কবিতা ?’
হেলাল মৃদু স্বরে বলল, ‘এটা আমার কবিতা না, এটা অবিখ্যাত এক কবি হেলাল হাফিজের কবিতা ।’



নুসাবাদের গুলশানের ‘প্রাসাদ’ থেকে যখন হেলাল বের হল তখন রাত একটার বেশী বাজে । বিদ্যুত চমকাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর । ঝড় হবে নিশ্চয়ই । চৈত্রশেষের এই ঝড় যত গর্জে ততটা বর্ষে না । এটা একটা আশার কথা । এ রাতে ভিজে গা নিয়ে বাড়ি ফিরলে আর উপায় থাকবে না । যদিও তার কোন বাড়ি নেই । এও বড় অদ্ভুত ! সে কি কখনো ভেবেছিল সে এমন বোহেমিয়ান হবে ? ঘর-বাড়ি-নিকটাত্মীয় হারা একজন । যে জীবনে নারীর প্রেম নেই, পরিবারের মমতা নেই, আছে শুধু অভিযোগ-অভিমান-অবহেলা । আগে ফজলুল হক হলে থাকা যেতো । পরিচিত কিছু ছোট ভাই ছিল হলে । এখন হলে ঠাঁই দেবার মতন পরিচিত কেউও নেই । হল বুড়োদের থাকবার জায়গা নয়, ওটি যৌবনের প্রতীক । বয়েস বাড়ছে । চুল না পাকলেও বোঝা যাচ্ছে যৌবন ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত । তাকে থাকতে হচ্ছে হোটেলের কামরা ভাড়া করে ।

আবার বিদ্যুত চমকালো । গায়ে হেলিওগ্রাফের মত আলোর ঝলক পড়ছে । হেলাল দ্রুত পা চালালো । ভেজা যাবে না । এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর এসে যাবে নির্ঘাত । তাছাড়া সঙ্গে এতগুলো টাকা । টাকাগুলির দরকার খুব । অনেক ধারদেনায় ডুবে আছে সে । মাঝখানে জুয়া খেলে অনেকগুলি টাকা হাতে জমেছিল । তার হাইড্রোজেন খেলার ভাগ্য বেশ, জোকার-টোকার এসে এলাহী কান্ড হয় । অথচ সেই হাইড্রোজেন খেলেও গত মাসে কতগুলি টাকা হাত থেকে বেড়িয়ে গেল । সব জমানো টাকা ফুরিয়ে গেল চোখের পলকে । মাঝে এমনও হয়েছে দুদিন কিচ্ছু খায় নি । টাকার অভাবে, এই ভেবে নিজের কাছেই লজ্জা লেগেছে তার । একবার ভেবেছে নেত্রকোনা চলে যাবে কিনা । তারপর আবার ভেবেছে কি হবে গিয়ে, কে আছে ওখানে ? এরচে এই ভাল । নানা রঙের কষ্ট সম্বল করে কবিতার জন্ম দেয়া । কবিতা ছাড়া আর কিইবা আছে তার ? সে রাস্তার সোডিয়াম আলোর নীচে হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে উঁচু স্বরে আবৃত্তি করলোঃ

“লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ?

ঘরের কষ্ট, পরের কষ্ট, পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ?

প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমনী ভালবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজেনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ? ”

দু তিনটে কুকুর তার পিছু পিছু আসছে । কবিতা শুনে ওরা বোধহয় ভড়কে গেছে । ক্রমাগত ঘেউ-ঘেউ করছে । চাহনী সুবিধাজনক নয়, যেকোন সময় আক্রমন করে বসতে পারে । হেলাল কবিতা থামিয়ে দিল । হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছে । কারো সঙ্গে বসে গল্প করতে ইচ্ছে হচ্ছে । কষ্টের গল্প নয়, সুখের গল্প । আনন্দের গল্প । আচ্ছা কোথায় যাওয়া যায় ? রন্টিদের জুয়ার আড্ডায় কি যাবে ? সেখানে যাওয়া মানে হাতের পুরো টাকাটা রিস্কে ফেলে দেয়া । হয় টাকাটাকে তিন-চার গুন বাড়িয়ে ফিরতে হবে । নয়তো নিঃস্ব হয়ে । আচ্ছা একটা টস্‌ হোক । যদি রন্টিদের মেসে পৌঁছুনোর আগে বৃষ্টি নামে তাহলে সে মেসে ঢুকবে । বৃষ্টি না হলে সোজা হোটেলে ফিরে যাবে ।

কুকুরগুলি এখনও আসছে পেছন পেছন । তবে নীরবে, ধীরে ধীরে, তাদের পায়ের শব্দও শোনা যায় না । কে যেন খুব বিখ্যাত একজন বলেছিলেন, বাংলাদেশে সবচে বড় পাপ কবি হয়ে জন্ম নেয়া, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে বরং কুকুর হয়ে জন্ম নেয়া ভাল- কবি নয় । কার কথা এটি ? খুব সম্ভবতঃ কবি নজরুলের । হেলাল ভেবে দেখল কথাটি খুব মিথ্যে নয় । এদেশ কবির মূল্য বোঝে না, মূল্য দিতে জানে না ।

তৃতীয়বারের মত বিদ্যুৎ চমকালো এবং ঘন করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল । হেলালের গায়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে । সে কোনরকম তাড়াহুড়ো করল না । নির্বিকার ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগল । কেন যেন বৃষ্টিতে ভিজতে আজ তার বড় ভাল লাগছে । বৃষ্টির একটি বড় গুন আছে । এটি খুব সহজে মানুষকে নস্টালজিক করে দিতে পারে । টেনে নিয়ে যেতে পারে অতীতের অন্য কোন চমৎকার বর্ষাবেলায় । বর্ষার গন্ধ ছাড়া যেখানে পৌঁছুনোর অন্য কোন পথ নেই । সে দুহাতে ভেজা মুখের পানি সরাতে সরাতে চিৎকার করে বলতে লাগলঃ

“প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্‌লি’ অতীত থেকে যায় ।
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না ।
কেউ ফিরে এসে কিছু পায়,
মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায় । ”

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে । ভিজে চুপচুপ হয়ে কুকুরগুলি ফিরে চলে যাচ্ছে । তারা সম্ভবতঃ হারানো মানুষের কাছ থেকে কিছু নিতে চায় না ।



‘আরে, হেলাল সাহেব যে ! আপনি তো ভাই বড় অদ্ভুত মানুষ । কোথায় ছিলেন এতদিন ? আমি আপনার খোঁজে পুরো ঢাকা শহর চষে ফেলেছি । আপনি উধাও । উধাও মানে উধাও । এক বছর হলো আপনার বই ছেপেছি, আর আপনি এর মধ্যে প্রকাশকদের সাথে একবার যোগাযোগ করতেও এলেন না । আজব মানুষ ভাই আপনি ।’, সেলিম সাহেব হড়বড় করে বলে গেলেন ।
‘কি ব্যাপারে খুঁজছিলেন ? বই ছাপতে চান নাকি আমার ?’, হেলাল উৎসুক ভঙ্গীতে জানতে চাইল ।
‘আগে বসুন । চা খান । নাকি ঠান্ডা কিছু খাবেন ?’
‘পেপসি আনান ।’
‘ঐ মতি, রফিকের দোকান থেকে একটা পেপসি আনাও, সিগারেট আনাও কবির জন্য । তারপর, হেলাল সাহেব, কবিতা লেখালিখি কেমন চলছে ?’
‘চলছে ভালই ।’
‘লিখুন । লিখুন । আপনার হচ্ছেন দেশের চোখ । আপনারা লেখা বন্ধ করা মানে দেশ চোখ বন্ধ করে থাকা, বুঝলেন না ? আপনার আর একটা কবিতার বই বের করার জন্য খান সাহেবের সাথে কথা বলেছি । উনি একটু ভেজাল করছেন । বোঝেনই তো, কবিতার বই’র কাটতি কম । ঘটনা না, আমি ম্যানেজ করে ফেলবো । আপনি লিখতে থাকুন ।’
‘কেন খুঁজছিলেন তা তো বললেন না ।’
‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ । আপনার একটা চিঠি আছে আমার কাছে । প্রথমে এক মহিলা দিয়ে গেলেন । খুব নাকি আর্জেন্ট । এরপর এলেন তার স্বামী, বেশ কয়েকবার । আমাকে বলে, ঠিকানা জেনেও কেন দিচ্ছেন না ? বলুন দেখি কি কারবার । আরে ভাই ঠিকানা জানলে দেবো না কেন ? দাঁড়ান দেখি । কোথায় যেন রেখেছিলাম ... ।’

হেলাল প্রকাশনার অফিসঘরে বসেই চিঠি খুলল । কি আশ্চর্য ! হেলেনের চিঠি ! হেলেন কোথা থেকে পেল এই ঠিকানা ? হেলাল খুব দ্রুত চোখ বোলালো চিঠিটায়ঃ

“কবি,
তোমায় কবি সম্বোধন করলাম শেষ পর্যন্ত । আমার চেনাজানা হেলাল এত বড় মাপের কবি, ভাবলে লজ্জা হয় । ভাবি এত কাছে থেকে তোমাকে চিনতে পারলাম না ? যে আমি তোমার কবিতা লেখা নিয়ে হাসাহাসি করতাম, সেই আমারই তোমার কবিতা পড়ে মাথা এলোমেলো হয়ে গেল । তুমি লিখলে, ‘দুঃখের অপর নাম হেলাল হাফিজ’ । আমি ভাবলাম, এত দুঃখ তোমায় দিয়েছি বলেই হয়ত আমি সুখে নেই । জানো তো, কাউকে দুঃখ দিলে তা সহস্রগুনে ফিরে আসে ? আমার বুঝি তাই হয়েছে ।

তোমার কবিতার বইটা বইমেলা থেকে কিনে এনেছিল আমার বর । বইয়ের ফ্ল্যাপে তোমার ছবি দেখে চিনেছি, এই হেলাল হাফিজ আমার হেলাল । তোমার বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি কতবার- কতবার জানিনা । আবার তোমার দেয়া পুরোনো উপহারগুলি খুঁজে খুঁজে বের করলাম । কৈশোরের প্রেমের এইটুকু যা কঙ্কাল । কতদিন পরে আবার পুরোনো খাতা ঘাঁটতে গিয়ে একটা চ্যাপ্টা গোলাপ খুঁজে পেলাম, তুমি দিয়েছিলে । গোলাপের সেই আগের রঙ আর নেই । কালচে হয়ে গেছে সব । তোমার আমার সম্পর্কের মত । আমার চোখের জলেও ঐ গোলাপ তাজা হল না ।

তুমি লিখেছো, ‘এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো, পত্র দিও’ । যদি বলি ‘ভাল নেই’, যদি ঠিকানা দিই, আসবে ? চিঠির পেছনে ঠিকানা লিখে দিলাম । অপেক্ষায় থাকল তোমার জীবন নেয়া হারামজাদী । তোমায় কষ্ট দেয়া এক মানবী ।

ইতি ।”


কত কথা স্মৃতির ওপর ভর করে- একটা চিঠি মুহূর্তে ব্রেনের প্রতিটি নিউরোনে সাড়া জাগায় । ফেলে আসা দত্ত হাইস্কুল, নেত্রকোণা, একাত্তর আর সবকিছু ছাপিয়ে তার কিশোর বয়েসের প্রথম প্লেটনিক প্রেম- সেই কিশোরী হেলেন । যে আজও মিশে আছে তার প্রত্যেকটি কবিতার পরতে পরতেঃ

“অথচ পালটে গেল কত কিছু, -রাজনীতি,
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ,
কিশোরী হেলেন ।”

হেলালের বুক ভার হয়ে আসে । চিঠিতে তারিখ ফেলা গত বছরের । হেলাল ব্যস্ত হয়ে সেলিম সাহেবকে বলল, ‘কবে দিয়ে গেছে এই চিঠি ?’
‘গত মার্চে ভাই । কি ব্যাপার ? খারাপ সংবাদ নাকি ?’

হেলাল আর কথা না বাড়িয়ে হেলেনের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে । মতির আনা সিগারেট আর পেপসির বোতল অযত্নে পড়ে থাকে সম্পাদকের আবলুশ কাঠের টেবিলের ওপর । রোদ ছড়িয়ে যেতে থাকে প্রেস ক্লাব অঞ্চল ছাড়িয়ে দূরে আরও দূরে । কাকের দল দিশেহারা, বৈশাখের চেনাজানা রোদে পুরো আকাশ খাঁ-খাঁ করছে । যে রোদ সবকিছু পুড়িয়ে দিতে পারে । কেবল মন পোড়াতে পারে না । আর সেই মন পোড়ানোর জন্যে একটি কাগজের চিঠিই যথেষ্ট । হেলাল অবাক হয়ে ভাবে, কি অদ্ভুত ! কি অদ্ভুত !



ঘরের বারান্দায় বসে আছে হেলাল । সামনে চায়ের কাপ, কিছু নোনতা বিস্কুট । অনেকদিন পরে সে নেত্রকোনায় । সেই পুরোনো মাটির গন্ধ । ঘাস-জল-বৃক্ষের নরম ঘ্রান । বাতাস নিঃশ্বাসে টেনে নিতেও শান্তি । কবে হুট করে মরে-টরে যাবে, দেহটাকে নেত্রকোনা নিয়ে আসার ব্যবস্থাও হয়ত কেউ করে দেবে না । এর আগেই যা দেখে নেয়া । ইদানীং মৃত্যুচিন্তা খুব ভাবায় হেলালকে । বিশেষ করে নুসাবার মৃত্যুর পর । মৃত্যুর আগে নুসাবার কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছিল । চিঠির সাথে বড় অংকের চেক । চেকের পেছনে লেখাঃ কবিতা ওড়াও ! চিঠি পড়ে হেলালের বারবার মনে হয়েছে মৃত্যুর ওপারের জগৎটা আসলেই কেমন ? খুব জানার ইচ্ছে হয়েছে তার ।
নেত্রকোনায় গরম পড়েছে খুব । হেলাল ঘেমে নেয়ে গেছে । কয়েকদিন যাবতই কড়া রোদ । আবার কবে বৃষ্টি হবে কে বলবে ?

‘কেমন আছো, বাবা ?’
হেলাল উঠে দাঁড়িয়ে সালামের ভঙ্গি করে । হেলেনের মা আগের মতই আছেন । রূপ এতোটুকু কমেনি তার, চেহারাতেও বয়েসের ছাপ আসেনি । হেলাল বলল, ‘আমি হেলেনের সাথে দেখা করতে এসেছি । ওর বরের কাছ থেকে শুনেছি সব আমি ।’

‘আমার মেয়েটার সাথেই এমন হবার ছিল বাবা ?’, হেলেনের মায়ের চোখ ঘোলা, গ্রাম্য টানে বলতে লাগলেন, ‘ভালই তো ঘরকন্না করছিল । তোমার কবিতার বইটা হাতে পেয়েই মেয়েটা...’ হেলাল কি বলবে ভেবে পেল না । হেলেন পাগল হয়ে গেছে একথা কেমন বিশ্বাস হয় না তার । হেলেনের কি এমন কষ্ট ? কত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে তার । কত সুখের গল্প হেলাল শুনেছে তার নামে । তবু ভয় হয় । নুসাবা নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে । কত রকম দুঃখই তো আছে মানুষের, সবটা কি কেউ সবাইকে বলতে পারে ?

‘বিদেশে নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে ডাক্তার দেখাতে । ওরাও কিছু করতে পারলেন না । জামাই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে । কে আর পাগল বউকে ঘাড়ে করে টানতে চায় ।’, হেলেনের মা চোখ মুছলেন । হেলালকে হেলেনের ঘরের সামনে নিয়ে এসে দরোজা ঠেলে দিলেন ।

ঘরটা অন্ধকার । কেমন গুমোট একটা ভাব ঘরের ভেতর । পঁচা পেচ্ছাবের গন্ধ আসছে মেঝে থেকে । তারই ভেতর হেলেন অপরিচিতা সেজে বসে আছে এক কোণে । চোখের দৃষ্টি উদ্‌ভ্রান্ত, এলোমেলো শুষ্ক চুল, গালে খামচির দাগ । সাক্ষাৎ উন্মাদিনী, এ কি সেই হেলেন ? হেলাল খুব কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলোঃ ‘হেলেন !’

হেলেন হেলালকে চিনতে পারল বলে মনে হল না । হাত নাচিয়ে নাচিয়ে সে শেকলের ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ তুলল । হি-হি করে খুব হাসছে সে, যেন মজার কিছু একটা দেখতে পেয়েছে । এই প্রথম হেলাল খেয়াল করল হেলেনের হাত পা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে । হেলাল টের পেল না কখন তার চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করেছে । মাথায় বিক্ষিপ্তভাবে দৌড়োচ্ছে কবিতার কয়েকটা লাইনঃ

“আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই ।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে কার কি তাতে ?
আমি নাহয় ভালবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি,কি আসে যায় ?
এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে ?”

হেলাল কাউকে আর কিছু না বলে বেড়িয়ে এল । ঢাকার ট্রেনে চড়ে বসলো সে । ট্রেনের হুইসেলের শব্দ হচ্ছে যখন, সে জানালার বাইরে মাথা গলালো । নুসাবার দেয়া চেকটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে মনে মনে বলল, আর কবিতা নয়, অনেক হয়েছে । এবার একটু বিশ্রাম চাই । এবার একটু নীরবতা চাই । বড় ক্লান্ত লাগে । এখন একটু নিঃসঙ্গতা চাই ।

পরিশিষ্টঃ

প্রেসক্লাবের বিপরীতে হোটেল কর্ণফুলীর ২০২ নং ঘরে এক তরুন দম্পতি কড়া নাড়লো । মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন । মেয়েটি বলল, ‘কবি হেলাল হাফিজ কত নম্বর ঘরে থাকেন ?’

গৌড়দর্শন লোকটি মৃদু হাসলেন । মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমিই হেলাল হাফিজ ।’ হেলাল হাফিজকে অবাক করে দিয়ে দুজনেই হাট করে পা ছুঁয়ে সালাম করল । উত্তেজনায় তাদের দুজনের মুখ জ্বলছে । ছেলেটি বলল, ‘আপনার লেখা প্রত্যেকটি কবিতা আমার মুখস্ত একথা কি আপনি বিশ্বাস করেন ?’ হেলাল হাফিজকে কোনরকম উত্তর দিতে না দিয়ে ছেলেটি গড়গড় করে একে একে আবৃত্তি করে যেতে লাগল তাঁর সব কবিতা অগ্নুৎসব, অনির্ণীত নারী, অন্যরকম সংসার, অমিমাংসিত সন্ধি... । কবি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার লেখা সব কবিতা মুখস্ত করে বসে আছেন কেন ?’

উত্তর দিল মেয়েটিঃ ‘আপনার কবিতা পড়ে আমাদের প্রেমের শুরু । আমাদের বাসর যাপন । আমাদের বিরহ-মিলন সবকিছুতে আপনার কবিতা মিশে আছে, আপনি মিশে আছেন । আপনি আমাদের কবি ।’ গভীর আবেগে মেয়েটির চোখ ছলছল করছে । সে হেলাল হাফিজের হাত ধরে নরম স্বরে বলল, ‘আপনি বিশ বছর লুকিয়ে থেকেছেন । পুরো জীবনে আপনার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ । সেই প্রথম-সেই শেষ । স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে একা একা আছেন এই হোটেলের কামরায় । আমাদের কবিকে তো আমরা এভাবে থাকতে দেবো না । কি কষ্ট আপনার ? দেন তো ! ছুঁয়ে দেখি আপনার মাল্টিকালার কষ্ট !’

কবি হাসলেন । যে হাসি কোন দুঃখী মানুষ হাসতে পারে না !

___________________________
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×