মনটা বেশ খারাপ করেই রাস্তার ধারে বসে ছিলাম। কেন মন খারাপ!! তারও কোন কারণ ছিল না। এতে মনের সাথে সাথে মেজাজও খারাপ হচ্ছিল। এই বড় হয়ে যাওয়াটাই খুব ঝামেলা। ছাইপাশ কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়ে যায়। ছোটবেলায় তো তাও কারণ থাকত যে খেলনা চাই, মা কিনে দিচ্ছে না। বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাবো, মা যেতে দেবে না। টিভিতে কার্টুন দেখব। দেখা যাবে না। তখন নিষেধের কোন অন্ত ছিল না। তাই মন খারাপেরও অন্ত ছিল না। কিন্তু এখন আমি বড়দের দলে। যা খুশী তাই করতে পারি। কিন্তু কিছু করেই মন ভালো করা যায় না। পেয়ে বসে খালি অবসন্নতা। এর থেকে যেন আর মুক্তি নেই। বসে বসে আরো অনেক জটিল হিসাব নিকাশ করছিলাম। কিসের হিসাব নিকাশ!! সে বড়দের দুনিয়ার খুবই জনপ্রিয় হিসাব নিকাশ। পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব নিকাশ। কে কবে আমাকে দুঃখ দিয়েছিল। দুঃখ দিয়েও সে কিভাবে এত ভালো আছে। আর আমি এত নির্দোষ নিষ্পাপ মানুষ হয়েও প্রকৃত দুঃখী না হয়েও দুঃখী দুঃখী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সব পেয়েও কেন আমার মনে দুঃখ। এইসব অতি প্যানপ্যানে আর প্যাচপ্যাচে ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। এমন সময় আমাকে কে যেন ডাকল, ‘ব্রাদার!! ম্যাচ আছে!!!’ চেহারাটা আমার এমনিতেই গম্ভীর। মন মেজাজ খারাপ থাকাতে আরও গম্ভীর হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। প্রথমেই যা চোখে পড়ল তা হচ্ছে লোকটার মুখে সিগারেট। গেল মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে। এই সিগারেট খাওয়া আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। আর আমার কাছেই কিনা তাঁর জন্য ম্যাচ চাচ্ছে!! ছাত্র থাকা অবস্থার মেজাজ থাকলে দিতাম কয়েক কথা শুনিয়ে। কিন্তু নেহাত আমি এখন বড়। তাই গম্ভীরভাবেই বললাম, ‘না’। লোকটার যেন আমার উত্তর পছন্দ হল না। সে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল, ‘হাফ লেডিস!!’ আমার মাথায় একটা সাউন্ড হল যেন। টং। আমি উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে বললাম, ‘কিছু বলসেন?’ লোকটা সিগারেট মুখেই আমার দিকে ফিরে বিটকেলে হাসি দিয়ে বলল, ‘নাতো!!’ কবে জানি এক বড়ভাই শিখিয়েছিলেন যে খুব রাগ উঠলে তা নিয়ন্ত্রন করতে বুড়ো আঙ্গুলের সাথে তর্জনী জোরে চাপ দিয়ে ধরতে। আমি তাই ধরে রইলাম কিছুক্ষণ। রাগ কমানোর সুরাও পড়লাম। আমার আঙ্গুল আর ঠোঁট রাগ নিয়ন্ত্রনের কৌশল বুঝলেও আমার চোখ তা বুঝল না। কখনোই বোঝে না। লোকটা মানে মানে সটকে পড়ল। হঠাৎ দেখি পেছন থেকে কে যেন বলছে, ‘রাগ তো আপনার মারাত্মক!!’ নারীকন্ঠ। পেছন ফিরে দেখি এক মহিলা কোনার দিকে বসে ফুক ফুক করে সিগারেট ফুকছে। আমার রাগ কমানোর যাবতীয় প্রক্রিয়া কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেল। আমি অবাক হয়ে মহিলার দিকে চেয়ে রইলাম। একে ঠিক মহিলা বলা যায় না। আমার বয়সীও হতে পারে। আমার চেয়ে ছোটও হতে পারে। পরনে জিন্স আর শার্ট। মাথার চুল ছেলেদের মত ছোট করে ছাঁটা। দেখার মতই বস্তু সে। দেখতে থাকলাম। হাইট খুব বেশী হবে না। আমাদের দেশের মেয়েদের যেরকম হয় আর কি। ৫ ফুটের একটু উপরে। বেশীক্ষণ নিজেকে ছাড়া অন্য কারো প্রতি মনোযোগ দেয়া ঠিক আমার চিরাচরিত অভ্যাসে পরে না। তাই মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হেঁটে বাসায় চলে এলাম।
এরপরেও কয়েকবার মেয়েটিকে আমি রাস্তায় দেখেছি। কিন্তু মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হয়নি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার এক জায়গায় তাঁর সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। সেটাও কোন এক গোলমালের সময়।
বলা হয়নি। আমি একজন শিক্ষক। যাচ্ছিলাম কলেজে বাসে করে। বাসে বেজায় ভিড়। একগাদা লোক একজন আরেকজনের পশ্চাৎদেশ ঘষে ঘষে যাচ্ছে। এরকম সময়ে যখন বাস এর কন্ডাক্টর এসে বলে, ‘ভিৎরে যান। গ্যাটের কাছে খারায় রইসেন ক্যা?’ তখন মেজাজের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমি দূর পাল্লার যাত্রী। তক্কে তক্কে আছি কে নেমে পরবে বস থেকে আর আমি টুপ করে বসে পরব। আর বাকি পথটা আরাম করে যাব। যেই একজন নামতে যাবে অমনি আমি ঐ সীটটা মোটামুটি বাগে নিয়ে আসলাম। কিন্তু আমার পাশের জন কিছুতেই আমাকে ঐ সীটে বসতে দেবে না। আমার পা আটকে রাখল। আমারো রোখ চেপে বসল। আমিও হাত দিয়ে তাঁকে আটকে রাখলাম। ব্যস!! লেগে গেল। বাসে যা হরহামেশাই হয়। ঝগড়া যখন প্রায় মিটে গেছে। আমিও একটা সীটে। সেই ভদ্রলোকও আরেকটা সীট পেয়েছেন। তখন আমার একটু লজ্জা হল। সামান্য একটা সীটের জন্য এভাবে ঝগড়া করলাম!! আমার কোন ছাত্র যদি বাসে থাকে তাহলে কি শিখবে!! আবার পেয়ে বসল উদাসীনতা!! জীবনে কিছুই নিয়ন্ত্রন করতে পারলাম না। ছোটবেলা থেকে গান গাইতে পারতাম, গল্প কবিতা সব বলতে পারতাম। ছাত্র অবস্থায় ছবি তুলেও অল্পবিস্তর নাম হয়েছে। হাল্কা লেখালেখির অভ্যাসও ছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কোন কিছুতেই বেশীদিন মন টিকে থাকে না। অকাজের কাজ হল এই ‘রাগ’। এর হাত থেকে আর কিছুতেই নিস্তার পেলাম না। এই বদখত গুণটার জন্যেই কারো সাথে মিশতেও পারলাম না। ভালো মানুষ না হলে কি আর ভালো শিক্ষক হওয়া যায়!!
এসবই বসে বসে ভাবছিলাম। সামনে মহিলা সীটে দেখি একটা ছেলে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই ঝগড়া করে আমার মনটা খারাপ। তাঁর উপর এক ছেলে মহিলা সীটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!! বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর মিলন হল। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম সে মোটেই ছেলে নয়। এবং এই মেয়েকে আগে আমি দেখেছি।
জ্বি!! আপনারা ঠিকই ধরেছেন। ইনি হচ্ছেন সেই সিগারেট ফুঁকতে থাকা জিন্স আর শার্ট পড়া মেয়ে। এরকম একটা বেখাপ্পা অপ্রস্তুতকর মুহূর্তে পরিচিত কারো সামনে পড়তে কি ভালো লাগার কথা!! যদিও সেইভাবে তাঁকে পরিচিত বলা যায় না। তারপরেও। আমি আর ওইদিকে তাকালামই না। জানালা দিয়ে উদাস নয়নে বাইরে চেয়ে রইলাম। ঢাকার এই জ্যাম আর দুরত্ব মিলে আমাকে আরো ঘণ্টাখানেক এই বাসে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখি মেয়েটাও নামেনি। বয়স কম থাকলে এতক্ষনে এই মেয়েকে নিয়ে প্রেমের কল্পনা শেষ করে বিয়ে পর্যন্ত চলে যেতাম। কিন্তু এখন আর সে বয়স নেই। আর এই মেয়ে বুঝেই নিয়েছে আমি কেমন মানুষ। যেখানেই যাই। ঝগড়া করি। এরকম মানুষকে আগেও কেউ পছন্দ করেনি। সামনেও কেউ করবে না।
মেয়েটি আমার সাথেই নামল। আমি তাড়াতাড়ি করে রিক্সা খুঁজতে লাগলাম। এখান থেকে জলদি গেলেই ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হল আমরা আমাদের পুরো জীবনে সবচেয়ে বেশী ‘না’ এবং উদাসীনতা পাই রিক্সাওয়ালা আর সিএনজি ড্রাইভারদের কাছ থেকে। তো আমি রিক্সা খুঁজতেই থাকলাম। হঠাৎ দেখি মেয়েটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল- ‘আমিও আপনার ওদিকেই যাবো। চলুন একসাথেই যাওয়া যাক।‘ আমি আবারো অবাক হলাম। চিনি না, জানি না। কেন আমি এই মেয়ের সাথে যাব। পুরুষ পাঠকরা হয়তো বলবেন- ‘ধুর!!! এরকম চান্স কেউ মিস করে!! ধুর মিয়া!!! ধুর!!!’ আমার ভিতরের পুরুষ যে একটু একটু নেচে ওঠেনি তা কিন্তু না। উঠেছে। কিন্তু এ জীবনে নিজের দুর্বলতা কখনো আমি প্রকাশ করিনি। আর এই মেয়েটা যদি কোন ফাঁদে ফেলে আমাকে। আজকাল যে দিনকাল!! খুব স্বাভাবিক।
‘না’ বলতে পারাটা বরাবরই আমার কাছে খুব কঠিন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কেউ যদি আমাকে বিনয়ের সাথে বলে, ‘আমি আপনার গলাটা একটু কেটে দিব। দেই??’ আমিও হয়তো নিমরাজি হয়ে বলব- ‘দেবেন? আচ্ছা!! দেন।‘ তাই কিছুক্ষন পরের দৃশ্যপট হল আমি একটি অপরিচিত মেয়ের সাথে রিক্সায় করে যাচ্ছি। ভাগ্যিস!! আমার কোন প্রেমিকা নেই। নইলে ঝামেলা হত। এর মাঝে অবশ্য মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় হয়ে গেল।
মেয়েটা বলল- আমি রত্না কাজি। আপনি?
এ আবার কেমন নাম!!! এই মেয়ের দেখি সবই উল্টা পাল্টা।
আমি বললাম- আমার নাম সুমন চৌধুরী।
মেয়েটা বলল- কী করেন??
আমি বললাম- শিক্ষকতা।
মেয়েটা বলল- হুম!! ইন্টারেস্টিং।
আমি বললাম- কেন!! ইন্টারেস্টিং কেন?
মেয়েটা কি আমার বাসে ঝগড়া করা নিয়ে ব্যঙ্গ করছে!!! যে কেমন শিক্ষক যে যেখানে সেখানে ঝগড়া করে।
মেয়েটা উত্তরে বলল- না এমনি!!!
আমি বললাম- আপনি কী করেন!!
সে জবাব না দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলল- বামে একটু চেপে দাও। থামার দরকার নেই।
রিক্সা একটু স্লো হতেই সে একটা হাল্কা লাফ দিয়ে নেমে গেল। নেমে একটু চেঁচিয়ে বলল- প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।