
মন খারাপ করিয়ে দেয়ার মত এলিমেন্ট একটা মুভিতে অনেকরকম ভাবে আসতে পারে। অনেকরকম প্রসঙ্গে আসতে পারে। আমি এই পোস্টে শুধু সেই মুভিগুলোর কথা বলবো যেগুলো মূলতঃ খুব স্যাড ছবি। যেখানে দুঃখের ধাক্কাটা খুব বেশি। এমন অসংখ্য ছবি আছে যেগুলোর কন্টেন্ট অনেক দুঃখময় হলেও ফিনিশিংটা একটা ফিল গুড বা ভালো অনুভূতি এনে দেয়, কিন্তু এই মুভিগুলোর ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। ছবিগুলো মানের দিক থেকে খুবই অসাধারণ, একবার দেখলেও দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে ঠিকই কিন্তু দেখতে গিয়ে আবারও অবধারিতভাবে খুবই মন খারাপ হয়।
সব ভাষায়ই নিশ্চয়ই এরকম ছবি আছে অনেক। আজ আমি যে ছবিগুলোর কথা বলবো সেগুলো সবই ভারতীয় এবং হিন্দি ভাষার। হিন্দি চলচ্চিত্রের ব্যাপারে অনেকেই অনাগ্রহ পোষণ করলেও আমার মনে হয় এই পোস্টটি পড়লে তাঁদের ধারণা হয়তো একটু বদলাতেও পারে।
১. Mother India (1957)
একজন মায়ের সংগ্রামের কাহিনী। বড় ভয়াবহ সেই সংগ্রাম। প্রেমময় কৃষক স্বামী ও দু'টি সন্তান নিয়ে যার সুখেই সংসার করার কথা ছিলো, কিন্তু জমি চাষ করতে গিয়ে পাথর চাপা পড়ে তার স্বামীর দু'টি হাতই কাটা পড়ে। তারপর ঝড় জলোচ্ছাসে ভেসে যায় ঘরবাড়ি জমি জিরাত সবকিছু। নিজের ক্ষুধার জ্বালা হয়তো সহ্য করা যায় কিন্তু অবোধ শিশু দু'টির কান্না তো সহ্য করা যায় না। দু'টো পয়সার বিনিময়ে জিনিসপত্র গ্রামের জমিদারের কাছে বন্ধক দিতে গেলে তার কাছ থেকে পেতে হয় রক্ষিতা হবার কুপ্রস্তাব। অশেষ কষ্ট আর দুঃখ বহন করে ছেলে দু'টিকে বড় হয়। একসময় শুধুমাত্র ছেলের নৈতিক চরিত্র স্খলনের কারণে মা বাধ্য হয়ে নিজ হাতে হত্যা করে তার সবচেয়ে আদরের সন্তানটিকে। গ্রামবাসীরা মা'কে ভারতমাতা নামে ভূষিত করে, পুরষ্কারও দেয় কিন্তু মায়ের অন্তরের জ্বালা কি আর তাতে জুড়ায়?
এই ছবিটি সবার দেখা উচিত। এর কেবলমাত্র মেকিং ভালো যে তাই নয় এই ছবিতে ব্যবহৃত স্পেশাল ইফেক্টগুলোও অসাধারণ। এত বছর আগে তৈরী অথচ এটা আসলে সবসময়ের ছবি। সব দেশের ছবি। ছবিটিতে এমন অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো দেখলে একেবারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। শিশু চরিত্রে বিরজু'র অভিনয় আমি জীবনেও ভুলবো না। আর অভিনেত্রী নার্গিস তো নমস্য। পদ্মভূষণ উপাধি তো আর শুধু শুধু দেয়া হয়নি তাঁকে।
Download Mother India
Wikipedia of Mother India
২. Fiza (2000)

এত ভয়াবহ কষ্টের ছবি আমি খুব কম দেখেছি। দু'টি ভাইবোন আর তাদের মা, এই নিয়ে সংসার। সাধারণ আর দশটি ছেলের মতই
হতে পারত ছেলেটির জীবন, কিন্তু অবস্থার চাপে পড়ে, সিস্টেমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে হয়ে যায় টেরোরিস্ট। বাড়ি থেকে পালিয়ে টেরোরিস্ট
দের সাথে যোগ দেয়। মা আশায় আশায় থাকে কবে ছেলেটি ফিরে আসবে, সাতটি বছর পেরিয়ে যায় কিন্তু ছেলেটি আর আসে না। অনেক সময় পরে যদিওবা ফিরে আসে, স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করে কিন্তু দেখে তার জন্য কোনও পথ খোলা নেই, সে বদলে গেছে। প্রচলিত সিস্টেমের প্রতি তো তার আর কোনও বোধ অবশিষ্ট নেই, কি করবে সে এই তথাকথিত 'স্বাভাবিক' জীবন নিয়ে? তখন সে আবারও ফেরারী হয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের মত এই ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মা করে আত্মহত্যা। বড় বোনটি অসম্ভব তেজস্বী একটি মেয়ে, সে তখন খুঁজতে বেরোয় তার ভাইটিকে... এবং সবশেষে পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকেই নিজের হাতে ভাইটিকে হত্যা করতে হয় ।
এই ছবিটির মূল উপজীব্য হিসেবে বলা যায়, চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরূদ্ধে একটি সুতীব্র চিৎকার। বেশ কিছু দৃশ্য রয়েছে যেগুলো দেখলে
বোঝা যায় যে আমরা সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা অসহায় এর কাছে। এই ছবিতে একটা দৃশ্য আছে, মা মারা যাবার পর দাফন কাফন হয়ে গেছে, মিলাদও শেষ, সব মানুষ ফিরে যাচ্ছে যার যার ঘরে। মেয়েটি তখন একা ঘরে এসে মায়ের কোরআন শরীফটি হাতে নেয়। তখন তার মনে পড়ে, মা
যে মরে গেছে, সে তো একবারও কাঁদতে পারেনি। সেই ভয়াবহ আর্তনাদ করে কান্নার দৃশ্যটি মনের ওপর খুব ছাপ ফেলে গিয়েছিলো।
Wikipedia of Fiza
৩. Fashion (2008)

ছবির পোস্টার দেখে মনে হতে পারে যে এই ছবি আবার দুঃখের কিভাবে হয়? খুব স্বাভাবিক, আমি নিজেও মুভিটা দেখার আগে বুঝিনি এতটা। শোবিজ জগতের একেবারে নোংরা রূপটা তুলে আনা হয়েছে এখানে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে মেয়েটি মডেলিং করতে আসে, সাফল্যের
একেবারে স্বর্ণচূড়ায় উঠে সে হঠাৎই বুঝতে পারে যে কি অসম্ভব স্বার্থপর একটা জায়গায় সে বাস করে! যখন দেখে তার পূর্বসুরী মেয়েটিও তার মতই সুখে ছিলো কিন্তু কর্পোরেট পরিপার্শ্বের কাছে মানসিকভাবে ধর্ষিত হয়ে এখন সে ড্রাগের নেশায় মাতাল। আজ তোমার রূপ আছে ভালো কানেকশন আছে আজ তুমি রাজা, কিন্তু কাল খুব সামান্য কারণে তোমাকে উচ্ছিষ্টের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে, তুমি টেরও পাবে না। এই জগতটা দিতে পারে অনেক কিন্তু কেড়ে নিতে পারে তারচেয়েও অনেক বেশি... আজ যারা তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, কাল সব হারিয়ে তুমি ভিক্ষুকের মত কেঁদে ফিরলেও কেউ আর তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, খেল খতম পয়সা হজম!
মুভিটা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো অনেক। এই ধরনের মুভি যাদের পছন্দ তারা Corporate ছবিটিও দেখতে পারেন, সেটিও
কর্পোরেট জগতের সুন্দর মুখোশ আর কদর্য মুখ নিয়ে তৈরী এবং মাশাআল্লাহ সেটাও অনেকই দুঃখের মুভি। ঐ ছবিটাও আমি দেখেছি কিন্তু রিভিউ লেখার মত অতটা মনে পড়ছে না তাই এখানে দিলাম না। কিন্তু অতি অবশ্যই ওটাও খুব ভালো মুভি, এবং সেখানেও চরিত্রগুলোর পরিণতি বড়ই করুণ।
Download Fashion
Wikipedia of Fashion
৪. Gangster (2006)
![]()
এই মুভিটা অনেকেই দেখেছেন কারণ এখানেই জেমসের সেই গানটি ছিলো (হিন্দি ছবিতে সেটাই তার প্রথম পারফরম্যান্স)। বেশ কিছু টুইস্ট অ্যান্ড টার্নস আছে কাহিনীতে, চমক জোগানোর মত তো বটেই। কিন্তু বেসিক্যালি এটা অনেক কষ্টের ছবি, পুরো ছবি জুড়ে শুধু স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর দুঃখজ্বালা। মেয়েটি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচানোর জন্য ভয়াবহ এক ফাঁদে পা দেয়, সে কল্পনাও করতে পারেনি কত ভয়াবহ দূর্দশা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। যখন দেখে যে সে নিজেই ছেলেটির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আত্মহত্যা ভিন্ন তার আর কোনও পথ খোলা থাকে না।
এই ছবিতেও একটি দৃশ্য আছে গগনবিদারী চিৎকার করে কান্নার। তাদের (ছেলেটির এবং মেয়েটির) একটি ফুটফুটে শিশু ছিলো, দত্তক নেয়া। ভাগ্যের ফেরে সেই শিশুটিকেও তাদের খুব অসময়ে চিরতরে হারাতে হয়েছিলো। ঐ কান্নার দৃশ্যটা এত শকিং যে আমি ঠিকমত দেখতেও পারি না। খুব চাপ পড়ে মনের ওপর।
Wikipedia of Gangster
এই ছবির গানগুলো ডাউনলোড করতে চাইলে
৫. Ankush (1986)

আরেকটি চরম কষ্টের ছবি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ধর্ষিত হওয়া একটি মেয়ে এবং তার জন্য ন্যায়বিচার চাইতে আসা বন্ধু ছেলেগুলোর তিলে তিলে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার কাহিনী। কয়েকটি ভালো মানুষের হেরে যাওয়ার গল্প। কি যে অসম্ভব যন্ত্রণা হয় ছবিটা দেখলে! তীব্র রাগে এবং দুঃখে কান্না পেয়ে যায় কিন্তু কিছু করার থাকে না।
Wikipedia of Ankush
৬. 1947 Earth (1998)

দীপা মেহতা প্রোডাকশন প্রায় সবগুলোই অনেক বেশি কষ্টের। খুব টিপিক্যাল ছবি তিনি তৈরী করেন না কখনও, সবসময়ই তার মুভিগুলো অনেক বেশি মাথা খাটিয়ে দেখার মত হয়। এই ছবিটা ওনার সেই বিখ্যাত ট্রায়োলজির (ফায়ার- আর্থ- ওয়াটার) একটা।
নাম শুনেই বোঝা যায় যে দেশবিভাগের সময়কার টানাপোড়েনের কাহিনী নিয়ে নির্মিত। দু'টি দেশ আর দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ আর তাদের রেষারেষি আর দ্বন্দ্বের সার্থক রূপায়ণ, প্রেমে ঈর্ষা আর তার ভয়াবহ নির্দয় প্রকাশের মাধ্যমে মুভির পরিসমাপ্তি। শেষের অংশটুকুকে আমি বলবো সিম্পলি শকিং, খুব বড় ধরণের ধাক্কা দেয়ার মত। পুরো ছবিটাই মনে হয় সব মিলিয়ে এত শকিং না শুধুমাত্র লাস্টের ১৫ মিনিট যে পরিমাণ শকিং! এত মন খারাপ হয় দেখলে যা বলার মত না।
এই ছবিতে একটা দৃশ্য আছে এরকম, পাকিস্তান থেকে একটা ট্রেন এসেছে, মুসলিমদেরকে বয়ে এনে। সেখানে নিজের আত্মীয়দের খুঁজতে গিয়ে আইস ক্যান্ডিওয়ালা (আমির খান) হতবাক হয়ে দেখে, একটা মানুষও জীবিত নেই, পুরো ট্রেন জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। আমির খান যে কত বড় শক্তিমান অভিনেতা তা ঐ দৃশ্যে আমির খানের এক্সপ্রেশন না দেখলে বোঝা যাবে না। হ্যাটস অফ টু হিম।
ছবিটি বাফার/স্ট্রিমিং করে দেখতে পারেন এখান থেকে
Wikipedia of 1947 Earth
আমি এই কয়টাই দিলাম, আপনারা আরও কিছু যোগ করুন। যে কোনও মুভি, যেকোনও ভাষার।
[ব্লগার ফাহাদ চৌধুরীকে অনেক ধন্যবাদ ছবিগুলোর ডাউনলোড লিঙ্ক দিয়ে সহায়তা করার জন্য।]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



