সমুদ্রের তীর ঘেঁষে হাঁটছে তারা দু’জন।
পৃথিবীতে আর কেউ নেই তাদের। কেবল তারা দু’জনই আছে পরষ্পরের।
মা আর মেয়ে।
বিকেল পড়ে এসেছে। সমুদ্রে এখন ভাঁটার টান। মিষ্টি একটা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে থেকে থেকে। তার মধ্যেই সমুদ্রের বিশাল বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছিলো তারা।
- আচ্ছা মা, তোমাকে কোনও ছেলে কখনো প্রোপোজ করেনি? (ফিচকে হাসি)
- কি সব বলিস নীপু! সেরকম দিনকাল ছিলো নাকি আমাদের?
- ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বাবাই তো তোমাকে প্রোপোজ করেছিলো। কিন্তু বাবা না, অন্য কেউ কখনও... ইউ নো হোয়াট আই মিন... করেনি?
- থাক আর প্যাঁচাল পাড়তে হবে না। চুপ কর তো!
- বাবা প্রোপোজ করার সময় কি বলেছিলো তোমাকে? বলোই না... এখন তো আর ছোট্ট খুকিটি নেই আমি!
- আচ্ছা নীপু তুই হাঁটতে হাঁটতে পানির এত ভেতরে চলে যাচ্ছিস কেন? একটু ধার দিয়ে হাঁট।
- আরে ধুর, সমুদ্র দেখতে আসবো আর গা ভেজাবো না তাই কি হয় নাকি? ওটাই তো মজা।
- তাও এত পানির মধ্যে দিয়ে যাস না মা। তুই তো সাঁতার জানিস না, বড় ভয় করে আমার। কত সাধ ছিলো তোকে সাঁতার শেখানোর, তা তো আর হলো না।
- হিহি! মা আমার হাতটা একটু ধরো তো দেখি!
মা সভয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে মাকে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে আসে বুক সমান গভীর জলের মধ্যে।
ওরে দস্যি মেয়ে! মা কপট রাগে চেঁচিয়ে ওঠে।
কিন্তু বাইরে বাইরে চিৎকার করলেও মায়ের ভালো লাগে মনে মনে। কতবছর পর আজ আবার সমুদ্র দর্শনের সুযোগ হলো। একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনে এটুকুই তো কত বড় পাওয়া। মেয়েটা খুব পাগলামি করলো বলেই আসা হলো এভাবে। একটা সময় ছিলো যখন প্রতিবছর নিয়ম করে আসা হতো। কত ভালো লাগতো সমুদ্রের গম্ভীর গর্জন আর বিশালতার আলিঙ্গনের মাঝে হারিয়ে যেতে। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না...
মায়ের সংবিত ফেরে মেয়েটির আকাশ কাঁপানো ভয়াবহ চিৎকারে।
মাআআআআআআআআআআআ..............................
আমি......... ডুবে যাচ্ছিইইইইইইইই.....................
বাঁচাআআআআআআআআও...............
মাআআআআআআ..........
জলের আলোড়নে হারিয়ে যায় মেয়েটির কন্ঠস্বর।
সাঁতার জানা হতচকিত মা প্রাণপনে টেনে তোলার চেষ্টা করে সাঁতার না জানা মেয়েটিকে। কিন্তু প্রবল জলের তোড় আর ভাটার টান তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের আরও গভীরে।
তখন আর দিগবিদিক জ্ঞান নেই। মা পাগলের মত হাঁচড়ে পাঁচড়ে জলের গহবর থেকে তুলে আনে মেয়েকে। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হয় না, আবার তারা পরষ্পরকে হারিয়ে ফেলে । একবার, দু'বার, বারবার। কত অগাধ জল চারিদিকে, বেঁচে ফেরে সাধ্যি কার! ক্রমাগত ডুবন্ত আর ভাসন্ত দু’টি অস্তিত্ব তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকে ডাঙায় এসে ভেড়ার।
ও নীপু, নীপু... ধর আমাকে শক্ত করে। আমি তোকে তীরে টেনে নিয়ে যাবো। ... কই দেখি, তোর হাত দু'টো দে আমার কাঁধে!
হ্যাঁ, এই তো হয়েছে! ভালো করে ধরে থাক।
এই তো, আর একটুখানি! আর একটুখানি এগোতে পারলেই পাড়ে যাওয়া যাবে।
এ কি, তুই এভাবে পানির তলায় ঠেলে দিচ্ছিস কেন আমাকে!
ও নীপু, ছাড়! ছাড়! ডুবে যাচ্ছি তো আমি!
জলের তীব্র ঘুর্ণিতে হাবুডুবু খেতে থাকে মানুষ দু'টি।
মেয়ে প্রাণপণে ধরে থাকে তার মাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। ছাড়তে চায় না। কিছুতেই না। জীবনের শেষবিন্দু দিয়ে সে ক্রমাগত চেষ্টা করে যায় একটু বাতাসের সংস্পর্শ পাওয়ার। কিন্তু তার নাকে মুখে স্রোতের মত ঢুকতে থাকে বেনোজল। জলের অতলে মায়ের শরীর প্রচন্ড শক্তিতে আঁকড়ে ধরে সে নেমে যেতে থাকে আরও অতলের দিকে। প্রাণের তীব্র তাড়নায় সে শক্ত করে ধরে রাখে মাকে...ভাবে মাকে ধরে রাখলেই সে বেঁচে যাবে! হ্যাঁ, যাবেই তো! মা-ই তো তাকে টেনে নিয়ে যাবে তীরে! মায়ের মত এমন ত্রাতা আর কে আছে এ জগতে?
কিন্তু এ যে আরও গভীর জল! ... ঠাঁই নেই কোথাও।...
শুধু জল... আর জল...
শরীরে প্রবল চাপ নিয়ে মা সর্বশক্তি দিয়ে ছটফটিয়ে উঠে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে মেয়েকে। কিন্তু পারে না। মেয়ে যে তার সমস্ত ওজন নিয়ে মাকে আঁকড়ে রেখেছে! তাকেও তো বাঁচতে হবে! ...
প্রবল জলের ধাক্কা আর মেয়ের টান সরাতে আকূল মায়ের দু’হাত, বেঁচে থাকার আদিম তাড়নায় সাঁড়াশির মত প্রাণপণে টিপে ধরে মেয়ের গলা!
আহ... এই তো একমুঠো বাতাস!
শান্তি।
............................
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৪৪