somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্যরকম বাংলাদেশ: খাগড়াছড়ি-শেষ অংশ

১৮ ই জুন, ২০১৩ ভোর ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Part 3:
তৈদুছড়া
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝর্না দুটির নাম তৈদুছড়া ঝর্না। ত্রিপুরা ভাষায় “তৈদু” মানে হল “পানির দরজা” আর ছড়া মানে ঝর্না। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই ঝর্নাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
খাগড়াছড়িতে যে কয়টি দর্শনীয় স্থান রয়েছে তৈদুছড়া তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানে পাহাড় আর সবুজ বুনো জঙ্গেলর মাঝে আঁকা বাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে ঝর্নার জল। শীতল স্বচ্ছ টলমলে জলের কলকল করে ছুটে চলার শব্দে মুখিরত চারিপাশ। ৩০০ ফুট উচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পরছে পাথুরে ভূমিতে। অন্য সকল ঝর্নার মত এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পরছে না। পাহাড়ের গায়ে সিড়ির মত তৈরি হওয়া পাথুরে ধাপ গুলো অতিক্রম করে নিচে পরছে।
দীঘিনালা খাগড়াছড়ি জেলার একটি উপজেলা। ঢাকা কিংবা খাগড়াছড়ি হতে গাড়ী নিয়ে সরাসরি যাওয়া যায় দীঘিনালায়। তৈদুছড়া ভ্রমনের জন্য খাগড়াছড়িতে রাত্রি যাপন না করে দীঘনালায় থাকাই উত্তম। এখানে থাকার জন্য একটি ভাল মানের রেষ্টহাউজ আছে। যোগাযোগ করলে হয়তো আগে থেকেই এটি বুকিং করা সম্ভব, অথবা গিয়েও বুকিং করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুকিং পাওয়াটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে। আর একান্ত রেষ্টহাউজ না পেলে এখানকার স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে কোন না কোন একটি থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গাড়ী নিয়ে দীঘিনালা হতে সামনে এগিয়ে চাপ্পাপাড়া পর্যন্ত যাওয়া যায়। এর পর আর গাড়ী চলার কোন পথ না থাকায় বাকী পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে। দীঘিনালা হতে সব মিলিয়ে তৈদুছড়ি পর্যন্ত পৌছতে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে। নির্ভর করে হাঁটার গতির উপর। সুতরাং সকালে রওয়ানা দিলে অনায়েসেই সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসা সম্ভব। এই আসা যাওয়ার পথটি মোটেও বিরক্তিকর নয়। হাঁটতে হাঁটতে যতটা না ক্লান্তি আপনাকে গ্রাস করবে তার চাইতেও বেশী গ্রাস করবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশা। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে আপনি আসক্ত হবেনই। কেবল দীঘিনালা থেকে তৈদুছড়া নয়, খাগড়াছড়ি প্রবেশের পর হতে আপনার জন্য কেবল বিস্ময় অপেক্ষা করবে। যে দিকেই চোখ যাবে কেবল সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ আর সাদা কুয়াশার মত মেঘ আপনাকে মোহাবিষ্ট করে রাখবে।
চাপ্পাপাড়া কিংবা পোমাংপাড়া হতে দুর্গম পথ, অনেক গুলো ঝিরি, উচু নিচু পাহাড়, কোথাও হাটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি আর বুনো জঙ্গল পাড়ি দিয়ে অবশেষে প্রায় ৩ ঘন্টা হাঁটার পর আপনি পৌছবেন ১ম ঝর্নাটিতে। এটি প্রায় ৬০ ফুট উচু। ঝর্নামুখ হতে পানি পাহাড়ের গাঁয়ে পরে তা পাহাড় বেয়ে নিচে এসে ছোট একটি হ্রদের মিলিত হয়েছে। অসাধারন সেই দৃশ্য।
প্রথম ঝর্ণার ডানপাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠলে খুব কাছাকাছি পেয়ে যাবেন ২য় ঝর্নাটি। এখানে প্রায় ৮০-৮৫ ডিগ্রী এঙ্গেলের ঢাল বেয়ে বানরের মত প্রায় ১০০ ফুট উপরে উঠতে হবে। উপরে উঠলে প্রথমেই চোখে পড়বে ঝর্না মুখ যেখান হতে ১ম ঝর্নার পানি পড়ছে। ২য় ঝর্না হতে ঝিরি পথে পানি আসছে এখানে। ঝিরি পথ ধরে প্রায় ঘন্টা খানেক হাটলে পরে পৌছানো যায় ২য় ঝর্নাটিতে। এই চলার পথটি যেমন কষ্টকর তেমনি রোমাঞ্চকর আর আহামরি সুন্দর। উপর থেকে প্রচন্ড বেগে পানি নেমে আসতেছে। এই বেগ ঠেলে পানি বরাবরই হাঁটতে হয়। ডানে বায়ে যেখানে পানির স্রোত কম সেখানে শ্যাওলা জমেছে। একটুতেই পা পিছলে যায়। মাঝে মাঝে এখানে পানির স্রোত খুব বেশী যে ধাক্কা দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে চায়। তাই এখানে পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে হাঁটতে হবে। একবার পিছলে গেলে কয়েকশ হাত দূরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। এখান হতে আরো উপরে উঠতে হবে। চলার পথে পারি দিতে হবে বড় বড় পাথর আর কোমর সমান পানি। অতপর পেয়ে যাবেন দ্বিতীয় তৈদু ঝর্ণা।
অপূর্ব অসাধারন আর নয়নাভিরাম সে ঝর্না। এটি এতই দৃষ্টিনন্দন আর ব্যতিক্রম যে কারো আর তড় সইবে না। ঝর্নার নিচে ঝাপিয়ে পরতে মন চাইবে। ঝর্ণাটি প্রায় ৮০ ফুট উচু। ঝর্নার পানি এসে সরাসরি যেখানে পড়ছে সেখানে সিড়ির মত অনেকগুলো পাথুরে ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ধাপগুলোতে দাড়িয়ে অনায়েসেই গোসলের কাজটি সেরে নেয়া যায়। দীর্ঘ ক্লান্তিকর হাটার কষ্ট মুহুর্তেই ধুয়ে যাবে ঝর্নার জলে। ঝর্নার জলের শীতল পরশ আপনাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে আবার কতটা পথ আবার হাটতে হবে ফেরান জন্য। ওখানে ঝরণা আছে তিনটা কিন্তু আমরা দুটির বেশি দেখতে পারিনি কারণ তিন নম্বর ঝরণাটা আবার অন্য জায়গায়।
এখানে সারা বছরই পানি থাকে। শীতে জল প্রবাহ কমে যায়। আর বর্ষার হয়ে উঠে পূর্ণ যৌবনা। তবে শীতের আগে ও বর্ষার শেষে এখানে ঘুরতে যাওয়া উত্তম সিদ্ধান্ত। ঝর্নার আশে পাশে কেবল যেন সবুজেরই সমারোহ। পাশের পাহাড় গুলোতে চলে জুম চাষ। পাহাড়ের সবুজের মাঝে জুম ফসলের মাঠ যেন যোগ করেছে ভিন্ন এক সবুজের। মনে হবে যেন সবুজের মাঝে সবুজের আঁচর। শুধু তাই নয় এখানকার আদিবাসীদের আথিতেয়তা আপনাকে মুদ্ধ করবে। আদিবাসীদের সাথে পরিচয় ও আলাপচারিতা আর যাত্রা পথের দৃশ্যাবলী অবলোকন হতে বঞ্চিত হলে আপনার তৈদুছড়া ভ্রমনটি অপূর্নই থেকে যাবে। জলপ্রপাত, ঝিরি, পাহাড়ী জীবন, আকাশ আর পাহাড়ের মিতালী, শিবছড়ি পাহাড়ের পাথরের শিব মূর্তি, পাথরের হাতি ও পাথরের সাপ সব কিছু মিলিয় আপনার চোখ ভরে যাবে তৃপ্তিতে, আপনি তুলবেন প্রাপ্তির ঢেকুর।
যেভাবে যেতে হবে
• ঢাকা থেকে বাসে করে খাগড়াছড়ি। কলাবাগান ও কমলাপুর হতে শান্তি পরিবহন, সৌদিয়া, এস.আলম, শ্যামলী বা ষ্টার লাইন পরিবহন গুলো প্রতিদনিই ছেড়ে আসে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।
• খাগড়াছড়ি হতে বাসে করে আসতে হবে দীঘিনালায়। শহর থেকে ১৯ কিলো দূরে এই উপজেলায় যেতে সময় লাগবে ঘন্টা খানেক। চাদের গাড়ির ছাদে করে গেলেই বেশি মজা পাবেন। ভাড়া জনপ্রতি ৩৫ টাকা, এটা চাদের গাড়ির ভাড়া।
• দিঘীনালার বাসস্ট্যান্ডে নেমে জনপ্রতি ৫ টাকা অটোরিক্সা ভাড়ায় চলে যান দিঘীনালা বাজার। (তবে ভুলেও বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিক্সাদের ঝরণা যাবার কথা বলবেন না, এরা ৩৫০/৪০০ টাকা ভাড়া চেয়ে আপনাকে ঠকাতে চাইবে। আপনাকে হাটতে হবেই আর গাড়ি আপনাকে যেখানে নামিয়ে দেবে সেখানকার ভাড়া সবমিলিয়ে ১০০ টাকার বেশি নয়)।
• দীঘিনালায় রাত্রি যাপন, সাথে তৈদুছড়া আসার জন্য প্রশাসনের অনুমতি গ্রহন ও গাইড নির্বাচন (গাইড ভাড়া ৩০০-৪০০ হবে, এটা ফিরে এসেই দেবেন। দিঘীনালা বাজার থেকে স্থানীয় দোকানদার-ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করে তৈদুছড়া ঝরণা যাবার জন্য একজন গাইড ঠিক করে নিন)।
• পরেরদিন ভোরে দীঘিনালা হতে গাড়ীতে/মোটরসাইকেলে করে চাপ্পাপাড়া।
• চাপ্পাপাড়া হতে পায়ে হেঁটে তৈদুছড়া।
• ৩ ঘন্টা হাঁটার পর পৌছবেন ১ম ঝর্নায় এবং আরো ১ ঘন্টা পাহাড় ট্রেকিং ও ঝিরি পাড়ি দিয়ে পৌছতে হবে ২য় ঝর্নাতে।
কোথায় থাকবেন
যারা খাগড়াছড়ি থাকতে চান তারা এখানে থাকার জন্য অনেক ভাল মানের হোটেল পাবেন। তবে দীঘিনালায় থাকার জন্য ভাল ব্যবস্থা বলতে একটি। সেটি হল দীঘিনালা রেষ্ট হাউজ।
পরামর্শ
• দীঘিনালা হতে তৈদুছড়া যাবার পথে যথেষ্ট পরিমান খাদ্য ও পানীয় নিতে হব।
• ব্যাকপ্যাক হালকা নিতে হবে। না নিয়ে পারল উত্তম।
• গাইড নেয়া বাধ্যতামূলক
• সাথে কিছূ শুকনা কাপড় রাখতে পারেন।
• মোবাইল ও ক্যামেরার জন্য জলনিরোধ ব্যাগ নিতে হব
• স্যালাইন, গ্লুকোজ ও ফাষ্ট এইড নিয়ে যাবেন
• শর্ট / থ্রি কোয়র্টার প্যান্ট ও ভাল গ্রিপওয়ালা প্লাষ্টিকের স্যান্ডেল

শতায়ুবর্ষী বটগাছ
মাটিরাংগা উপজেলার খেদাছড়ার কাছাকাছি এলাকায় এ প্রাচীন বটবৃক্ষ শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয় এ যেন দর্শনীয় আশ্চর্যের কোন উপাদান। এ গাছের বয়স নিরূপনের চেষ্টা একেবারেই বৃথা। পাঁচ একরের অধিক জমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটকের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ঝুড়িমূল কালের পরিক্রমায় এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, ঝুড়িমূল থেকে সৃষ্ট প্রতিটি বটগাছ তার মূল গাছের সাথে সন্তানের মতো জড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষেরা এতটুকু শীতল ছায়ার খোঁজে এখানে জড়ো হয়। কথিত আছে, এ বটবৃক্ষের নীচে বসে শীতল বাতাস গায়ে লাগালে মানুষও শতবর্ষী হয়। শব্দের পংক্তি দিয়ে এ গাছের বিবরণ শেষ হওয়ার নয়। খাগড়াছড়ি কেউ যদি একবার আসেন তাহলে ভুলেও কেউ শতায়ু বর্ষী বটগাছ না দেখে ফিরে যান না।

পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র
খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র ৩ কি: মি: পূর্বেই কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। সবুজের অফুরন্ত সমারোহ আর স্বপ্নীল আবেশে যদি নিজেকে ভুলতে চান কৃষি গবেষণা কেন্দ্রই আদর্শ স্থান। পাহাড়ের বুক চিড়ে রাস্তার দু’পাশে ফলের বাগান, স্বচ্ছ-স্থির জলরাশি, টিয়া সহ নানান প্রজাতির পাখি দেখে আপনি নিজেকে নতুনভাবে আবিস্কার করবেন আরেকবার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি এ কেন্দ্রটি। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসে শুধু সবুজের স্নিগ্ধতা মন্থনের আশায়। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের অনিন্দ্য সুন্দর খামার যে কোন পর্যটককে মোহিত করার ক্ষমতা রাখে।

ভগবান টিলা
জেলার মাটিরাংগা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারত সীমান্তে অবস্থিত ভগবান টিলা। জেলা সদর থেকে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কি:মি: উত্তর-পশ্চিমে। ঘন সবুজের ভিতর আঁকা -বাঁকা রাস্তা দিয়ে যতই এগিয়ে যাবেন পাহাড়ের অপরূপ নৈসর্গে অপলক নেত্রে আপনি বিস্ময়-বিহবল হবেন। এ যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া পর্বত রূপসী। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলা সম্পর্কে কথিত আছে, এতো উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং ভগবানও ডাক শুনতে পাবেন। প্রাচীন লোকজন তাই এ টিলাকে ভগবান টিলা নামকরণ করেছিলেন। চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ভগবান টিলায় দাঁড়ালে সবুজের নৈসর্গ আর মাথার উপরের আকাশের নীলিমা দারুণ উপভোগ্য। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি আউট পোষ্টও আছে এখানে। সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে দাঁড়ালে মনে হয় আপন অস্তিত্ত্ব শূন্যের নি:সীমতায় হারিয়ে গেছে। ঘন সবুজ বাঁশের ঝোপ, নাম না জানা কোন পাখির ডাক, পাহাড়ের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্নার জীবন্ত শব্দ – সবকিছু মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য লীলাভূমি। গহীন অরণ্যের এই উঁচু টিলায় বিডিআর এর তৈরী রেষ্ট হাউজটি আপনাকে পৃথিবীর যে কোন সুন্দর জায়গাকেও ভুলিয়ে দেবে। কোন এক জ্যোৎস্না রাতে নি:সীম অরণ্যের মাঝে কোন সাহসী পর্যটক যদি প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চান তবে ভগবান টিলা তুলনাহীন।

দুই টিলা ও তিন টিলা (মারিস্যা ভ্যালী)
প্রকৃতির এক অপূর্ব বিস্ময় এই দুই টিলা ও তিন টিলা। জেলা সদর থেকে ৪২ কি:মি: দূরে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-মারিশ্যা রাস্তার কোল ঘেষে এই টিলায় দাঁড়ালে ভূগোলে বিধৃত গোলাকৃতি পৃথিবীর এক চমৎকার নমুনা উপভোগ করা যাবে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা এবং দীঘিনালা থেকে মারিশ্যার বাসে চড়ে আপনি অনায়াসেই যেতে পারেন এখানে। পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে যেদিকে চোখ যায় মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত সবুজের সমারোহ এখানেই সমষ্টি বেঁধেছে। পাহাড়ের বুক চিড়ে সর্পিল রাস্তা নি:সর্গের এক নতুন মাত্রা বলে মনে হবে। দুই টিলার অচেনা দৃশ্য আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে। মনে হবে এ যেন ক্যানভাসের উপর কোন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়। সারা মারিশ্যা ভ্যালী যেন পায়ের কাছে এসে জড়ো হয়েছে। যে কোন পর্যটকের কাছে এ দৃশ্যটি আকর্ষনীয়।

মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি
জেলার মানিকছড়ি উপজেলার মং সার্কেলের রাজার প্রাচীন রাজবাড়ি এবং রাজত্বকালীন স্থাপত্য খাগড়াছড়ি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এ রাজবাড়ি। যদিও সুষ্ঠু সংরক্ষণ, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। মং রাজার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা ও দেখার জন্য ঘুরে যেতে পারেন মং রাজবাড়ি।
শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মানিকছড়ি উপজেলায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মং রাজার বাড়ি। খাগড়াছড়ি মং রাজ পরিবারের যাত্রা শুরু হয় কংজয়ের আমল থেকে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সন্তুষ্টি লাভের পর কংজয় ত্রিপুরা রাজকন্যা চন্দ্রাকে বিয়ে করে ৫০০ ত্রিপুরা পরিবার সঙ্গে নিয়ে সীতাকু-ু থেকে মানিকছড়িতে এসে বসবাস শুরু করে। রাজা কংজয় মারা যায় ১৮২৬ সালে। কংজয় পুত্র কিওজা সেইন ১৮২৬ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। নাবালক কিওজা ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাকা লথানয্যার অভিভাবকত্বে থেকে রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৮৬১ সালে ইংরেজদের কুকি দমনে কিওজা সর্বাত্মক সহায়তা করেন। কিওজা সেইনের কাজে ইংরেজ সরকার সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মং সার্কেল প্রধান নিযুক্ত করেন। কিওজাই প্রথম মং সার্কেল চিফ এবং এই মানিকছড়ি রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা। এরপর নরপদি, কিওজা প্রু, নে প্রু সেইন, রানী নানুমা, রাজা মং প্রু সেইন, নিহার দেবী, প্রাইহলা প্রু চৌধুরী পর্যায়ক্রমে মং সার্কেল প্রধান হন।

ঝুলন্ত সেতু
রাজা নে প্রু সেইনের কোনো ছেলে সন্তান ছিল না রানী ছুতির কোলে জন্ম নেয় একমাত্র রাজকুমারী নানুমার। রাজা নে প্রু সেইন বার্ধক্যে উপনীত হলে ইংরেজ সরকার রাজকুমারী নানুমাকে সহকারী মং চিফ হিসেবে নিয়োগ দেন। রাজা শেষ বয়সে রানী ছুতির নামে মানিকছড়ির উপর একটি সেতু নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে বিলুপ্ত। কিন্তু সেখানেই তৈরি হয়েছে নতুন ঝুলন্ত সেতু।

বন ভান্তের প্রথম সাধনাস্থল
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মীয় মহাসাধক আর্য পুরুষ, আর্য শ্রাবক বুদ্ধ সাধনানন্দ মহাস্থবির বন ভান্তে। তাঁর জন্ম রাঙামাটি সদর উপজেলার ধনপাতা গ্রামে। সাধনাস্থল দীঘিনালা। বন ভান্তের প্রথম সাধনাস্থলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ২০ একর ভূমির ওপর দীঘিনালা বন বিহার। এ বিহারে রয়েছে ২৩ ফুট উচ্চতার ধ্যানমগ্ন গৌতমবুদ্ধের মূর্তি, ১৩ ফুট উচ্চতার শিবলি মূর্তি, উপগুপ্ত বুদ্ধ (জলবুদ্ধ)সহ বিহার কমপ্লেক্সের স্থাপনা ও প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য। এ সাধনাস্থলকে ঘিরে গড়ে ওঠা পানছড়ি অরণ্য কুটির, পেরাছড়া বন বিহার দেখলে যেকোনো পর্যটকের মন জুড়িয়ে যাবে।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে পানছড়ির উল্টোছড়ি ইউনিয়নে রয়েছে শান্তিপুর অরণ্য কুঠির। ১৯৯৯ সালে গুরু শাসনারক্ষী স্থবির নির্জন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যঘেরা এই স্থানে গড়ে তোলেন শান্তিপুর অরণ্য কুঠির। এখানে কুঠিরে ঢুকতেই প্রথমে রয়েছে একটি বাতিঘর। এখানে একটি আলো জ্বেলে আপনিও মহামতি বুদ্ধের কাছে আপনার মনের বাসনা জানাতে পারবেন। প্রতি বছর বৌদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা, আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে এখানে বৌদ্ধপূজা ও উৎসব হয়। তবে এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় উৎসব হলো কঠিন চিবর দান। এই উৎসবে এখানে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। এই মহা আয়োজনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তুলা থেকে কাপড় বোনার কাজে অংশ নেয় পাহাড়ি অঞ্চলের হাজার হাজার নারী পুরুষ।

রামগড় লেক ও চা বাগান
সীমান্ত শহর রামগড় উপজেলা সদরে নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত কৃত্রিম লেক নান্দনিক দিক থেকে অসাধারন একিটি পর্যটন স্থল যা পর্যটকদের পিপাষু দৃষ্টিতে মোলায়েম পরশ বুলিয়ে দেয়।
রামগড় সদরের খুব কাছেই বাগান বাজার এলাকায় পাহাড়ী পরিবেশে চা-বাগান ও পিকনিক স্পট। এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আদিবাসী সাওঁতালরা। আগ্রহ করে জানা যাবে তাদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে। চা-বাগানের অভ্যনত্মরে রয়েছে শাপলা ফোটা বিশাল প্রাকৃতিক লেক। কিছুদিন পর এ লেকে আসবে শীতের নানান জাতের অতিথি পাখি।
রামগড়ে পর্যটকদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে কৃত্রিম পর্যটন লেক, ঝুলন্ত সেতু, বনবীথি মৎস্য লেক ও বাগান। এছাড়াও খাগড়াছড়ির শেষ প্রান্তে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ঘেঁষে ডলু চা বাগান ও রামগড় চা বাগান পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান।
১০ নম্বর থেকে একটু দূরে তবলছড়ি পার হলেই হাতের ডানে আছে একটি চমৎকার প্রাকৃতিক লেক। মাটিরাঙা থেকে ৩৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ৮২ টিলা পাহাড়ের পাদদেশে প্রাকৃতিক এই লেকের এখনও কোনো নাম দেয়া হয়নি।

ভাইবাছড়া ঝরনা
এটি রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট বাজার থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে। ঝরনাটি রাঙামাটি জেলায় হলেও যোগাযোগব্যবস্থা খাগড়াছড়ি জেলা থেকেই সহজ। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়কের ভাইবাছড়ায় (বাঘাইহাট বাজারে যেতে এক-দেড় কিলোমিটার আগে) নামতে হবে। এরপর রাস্তা থেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে এ ঝরনার অবস্থান। উচ্চতা ৭০ থেকে ৮০ ফুট হবে। এ ঝরনাটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। অন্য ঝরনায় যেখানে পানি পড়ে সাধারণত সে জায়গায় গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটি ব্যতিক্রম। এখানে কোনো গভীর গর্ত নেই। তাই নিরাপদে গোসল সারা যায়।

দিঘীনালা মানিক্যারদিঘী
খাগড়াছড়ি থেকে ২১ কিঃমিঃ দক্ষিণে অবস্থিত রাজা মানিক্যারদিঘী। মানিক্য রাজার দীঘি থেকে দীঘিনালা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে।

দীঘিনালা শিবছড়ি পাহাড়
দীঘিনালা শীবছড়ি পাহাড়ে ৬০ ফুট চওড়া ২টি স্বর্প আকৃতির কৃষ্ণের শিলা আসন ও ২টি কৃষ্ণের গরম্নর বাহন রয়েছে।

লোগাং ধুদুকছড়া
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কালের সাক্ষী পার্বত্য শান্তি চুক্তির একাধিক সংলাপের ইতিহাসসমৃদ্ধ ও পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র জমাদানের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজরিত লোগাং ধুদুকছড়া। যার মনোরম দৃশ্য দেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ধুদুকছড়াকে পর্যটন স্পট হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং দ্রম্নত আধুনিক মানসম্পন্ন আনত্মর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রম্নতি দেয়।

অন্যরকম বাংলাদেশ: খাগড়াছড়ি - Click This Link
অন্যরকম বাংলাদেশ: খাগড়াছড়ি-২ - Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×