somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ের সাথে অভিমান করে জীবন কাটিয়ে দিলেন আমাদের কবি কাজী নজরুল

০৭ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাকে এভাবে অবহলো করেছিলেন বলেই কি আজ আমাদের প্রাণের কবি হয়েও তিনি অবহেলিত আমাদের জাতীয় মনন ও সমাজের চেতনায়?

বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময় প্রতিভা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমরা জানি, তার সারাটা জীবন ছিল বন্ধনহীন। এলোমেলো আর খামখেয়ালীতে ভরা। হুট করে বিয়ে থেকে নিয়ে নির্বাক হওয়া পর্যন্ত তিনি কত কিছুই না করেছেন। এসব কারণে কতো আঘাত পেয়েছেন তিনি, তবু সহ্য করেছেন বারবার। সে আঘাত ছিল নানা দিক থেকে তির্যক আর কটুক্তিতে ভরা। তৎকালের হিন্দু মুসলমানের আঘাত, সাহিত্যিকদের আঘাত, দুঃখ দারিদ্রের আঘাত, দায় দেনার লজ্জা, এই এত কিছুর পরও তার সৃষ্টি ও সাহিত্য আমাদেরকে শুধু অবাক নয়, হতবাক করে দেয়।

তবু তার জীবনের কিছু দিক আছে যা আজো অজানা। অনেকে নান চেষ্টা করেও এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি কেউ। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অজানা হচ্ছে মায়ের সাথে তার অভিমান।

যেখানেতে দেখি যাহা/ মা- এর মতন আহা
একটি কথা এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
ছিনু খোকা এতটুকু, / একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন/ আরাম-বিরামহীন
দোলা দিয়ে শুধাতেন, কি হলো খোকন?’
আয় তবে ভাইবোন/ আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধুলি শিরে লয়ে মা’র
মা’র বড় কেউ নাই/ কেউ নাই কেউ নাই।
নতি করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’

মাকে নিয়ে ছোটদের জন্য এমন ছড়া লিখেছেন যে কবি নজরুল, তিনি কীভাবে মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারেন, ভেবে আজো অনেকে বিস্মিত হন।

কাজী নজরুল ইসলাম সিয়ারসোল স্কুলে থাকাকালে ১৯১৭ সালে লাহোর হয়ে নৌশেরাতে চলে যান বাঙালীর পল্টনে সৈনিকরূপে।
১৯১৯ সালের শেষের দিকে পল্টন ভেঙে দেওয়ার কয়েক মাস আগে সাত দিনের ছুটি পেয়ে তিনি তার গ্রাম চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন। ১৯২০ সালে পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর তিনি কলকাতায় কয়েকদিন থেকে আবার চুরুলিয়ায় যান। গ্রামে গিয়ে তিনি নিজের বাড়ীতে সাত আট দিন ছিলেন। ঠিক এ সময়ে মায়ের সাথে কোন এক ব্যাপারে অভিমান করে বসেন কবি নজরুল ইসলাম।

এর পরপরই তিনি চুরুলিয়া ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন।
এই যে এলেন, আর কোনদিন তিনি তার গ্রামে যাননি, যাননি মায়ের কাছে।
এমনকি মায়ের মৃত্যুর পরও না।

হুগলী জেলে বন্দী থাকাকালে যখন তিনি অনশন শুরু করেন, তখন তার অনশন এর খবর পেয়ে তার মা ছুটে আসেন চুরুলিয়া থেকে। ছেলের অনশন ভাঙাতে মায়ের আকুলতা স্পর্শ করা তো দূরের কথা, মায়ের সাথে তিনি দেখাও করলেন না। এক বুক দুঃখ নিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন নজরুলের দুর্ভাগা জননী।

কবির অন্যতম বন্ধু মুজাফফর আহমদের ভাষায়, ১৯২১ সালে কবি যখন আমার সাথে তালতলার একটি বাসায় থাকতেন, তখন একদিন তার বড় ভাই কাজী সাহেবজান ও তার চাচা প্রখ্যাত কাজী বজলে করীম সেই বাড়ীতে এলেন।
তারা দুজন মিলে নজরুলকে তার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত অনুনয় আর সাধাসাধি করলেন, কিন্তু অভিমানী নজরুল তখনও গেলেন না নিজের গ্রামে।

কিন্তু কি রহস্য ছিল এর পেছনে?

নজরুল সম্পর্কিত যত বই ও গবেষণাপত্র পড়েছি, এ থেকে অনুমান করা যায় যে, হয়ত মুসলমান সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহ, সৈনিক ক্যাম্পে যোগদান, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করাসহ এমন কিছু ব্যাপারে তার গ্রামবাসী তার পরিবারকে নানা ভাবে হেনস্তা করতো।
এসব লাঞ্চনা ও কটুক্তির কারণে তার মা হয়তো প্রকাশ্যে ছেলেকে তেমন সমর্থন ও স্নেহ করতে পারেননি।

তাছাড়া ছোটবেলায় নজরুলের দৌরাত্মে ও চঞ্চলতায় তার গ্রামবাসী অতিষ্ঠ থাকতো এবং পরবর্তীতে তার কৈশোরে নানা কর্মকান্ডে অনেকে বিরক্ত হতো। এ কারণেই কিন্তু নজরুল কাউকে কিছু না বলে একদিন গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং এরপর বর্ধমান জেলার মাথরুণ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।

এত বছর পর গ্রামে ফিরে স্বজনদের ব্যবহার আর মায়ের কোন এক কথা কিংবা ব্যবহার যা আজো অজানা- এসব হয়তো প্রচন্ড জেদী তরুণ নজরুলকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। মায়ের কাছে এমন ব্যবহার হয়তো তিনি পাননি, যা তিনি চেয়েছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম এর ছেলে কাজী সব্যসাচীর মৃত্যু হয় ১৯৭৯ সালের ২রা মার্চে। তাকে এর কয়েকদিন আগে মায়ের সাথে কবির অভিমান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কলকাতার ড. সুশীল কুমার গুপ্ত। কবির ছেলে তাকে বলেছিলেন, গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশ মূলত কবিকে গ্রাম ও স্বজন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।

প্রিয়কবি নজরুলের এমন আরও কিছু কার্যকলাপ রয়েছে যা সহজে এভাবে বুঝা যায় না।

তবে ১৯৪২ সালে কবি যে অজানা রোগে ভুগে নির্বাক হয়ে কাটিয়ে দিলেন তার বাকী জীবনটা, এ রোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেকগুলো কারণ আমি সংগ্রহ করছি। কিন্তু মায়ের সাথে কবির এমন অপ্রত্যাশিত আচরণের সাথেও যে তার ব্যাধির যোগসূত্র থাকতে পারে, তা নিয়ে কেউ ভাবেন নি।

কারণ মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার এমন এক অভিশাপ, যার প্রতিফল দুনিয়াতে ভোগ করতেই হয়। এ ছাড়া বাকী সব পাপের পরিণাম পরকালে শোধ করবেন স্রষ্টা। কবির নির্বাক ব্যাধির পেছনে এ অভিমানের কার্যকারিতা কিন্তু তাই একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। সেইসাথে তার অমূল্য ও বিস্ময়কর প্রতিভা ও কর্মযজ্ঞও কিন্তু তুচ্ছ করা চলবে না। মানুষ হিসেবে কেউ কিন্তু ভুলের উর্ধ্বে নয়।

আমি তাই কখনো কখনো ভাবি, মাকে এভাবে অবহলো করেছিলেন বলেই কি আজ আমাদের প্রাণের কবি হয়েও কেমন যেন তিনি অবহেলিত আমাদের জাতীয় মনন ও সমাজের চেতনায়?

প্রিয় পাঠক, প্রিয়কবি নজরুল ইসলামের আরেকটি এলোমেলো অধ্যায় হচ্ছে তার বিয়ের ঘটনাগুলো। আগামী পর্বটি সেসব নিয়ে সাজাবো। ততদিন সবাই ভালো থাকুন।

আগের আরও এমন অজানা ১১ টি পর্ব পড়–ন..
প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর অজানা অধ্যায়



সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১১:৪৪
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×