somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় কবির ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে- কবির বৈচিত্রময় কান্ড কারখানা ও হাসিকান্নার ঘটনা নিয়ে দীর্ঘতম পোস্ট- অচেনা রূপে কাজী নজরুল

২৫ শে মে, ২০১২ রাত ২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাজী নজরুল ইসলাম দেখতে কেমন ছিলেন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কাজী নজরুল এলেন কলকাতায়। ১৯২০ সালের কথা। বিশ একুশ বছর বয়সী তরুণ নজরুল তখনও সৈনিক জীবনের মায়া ছাড়তে পারেন নি। অস্বীকারের উপায় নেই, তার এ সৈনিক জীবনে তিনি যতদিন করাচীতে ক্যাম্পে ছিলেন, সেখানেও তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এ সৈনিক জীবনে তিনি এক মৌলভীর কাছে ফার্সী ভাষাটা আরও ভালভাবে শিখে কবি হাফিজের বেশ কিছু কাব্য অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়।

এ ছাড়া তিনি কিছু লেখালেখি করতেন সেখানে বসে আর সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন কলকাতার মোসলেম ভারত ও অন্যান্য পত্রিকায়। কলকাতায় এসেও তিনি নামের আগে কাজী আর হাবিলদার খেতাব ব্যবহার করতেন, শুধু তাই নয়, খেয়ালী কবি কারো কথা তোয়াক্কা না করে তখনও বুট পরে কখনও সৈনিক পোষাক পড়ে বিভিন্ন সভায় হাজির হতেন, তার হো হো অট্টহাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো, এ আবার কোত্থেকে এল?

একুশের সেই নজরুলকে কেমন লাগতো দেখতে তখন? নজরুলকে নিয়ে তার তৎকালের বন্ধুরা সবাই প্রায় একই ভাষায় তার অবয়ব বর্ণনা করেছেন, এর সারাংশ হচ্ছে এই-

সবল শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো যেন পেয়ালা, আর সে পেয়ালা দুটো যেন কখনো খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদা ভরপুর, তার গলা সারসের মতো পাতলা নয়, বরং পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সরল বীর্য-ব্যঞ্জক, গলার স্বর ছিল ভারী, তার সেই মোটা গলার সুরে ছিল যাদু, ঢেউয়ের আঘাতের মতো তার গান আছড়ে পড়তো ঝড়ের ঝাপটা হয়ে শ্রোতার বুকে। প্রবল হতে সে ভয় পেতো না, নিজেকে মিঠে দেখানোর জন্য সে চেষ্টা করতো না। এ বর্ণনা করেছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নজরুল ছিল একাই একশো। চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড়ো বড়ো মদির তার চেজাখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবী এবং তার উপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি রঙীন জামা পরেন কেন? ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে চট করে চোখে পড়ে তাই’, বলে ভাঙা ভাঙা গলায় হো হো করে হেসে উঠেতেন তিনি। কথার চেয়ে বেশী তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশী তার গান। একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণ চা এবং অনেকগুলো পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘন্টা একনাগাড়ে গান করতে থাকতেন। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না। এ বর্ণনা কবির বন্ধূ বুদ্ধদেব বসুর।

আবুল মনসুর আহমদও এক লেখায় কবিকে ১৯২২ সালে প্রথম দেখার কথা বর্ণনা করেছিলেন এ ভাষায়, সভায় গিয়ে অন্যান্য সবার সাথে নজরুল ইসলামের সাথেও পরিচয় হলো। মিলিটারী ইউনিফর্ম পরা কাঠখোট্টা লোক, কবি বলে পছন্দ হলোনা, কিন্তু চোখ দুটো তার ভাসা ভাসা হরিণের মতো, দেখে আকৃষ্ট হলাম। আমার এক কথায় সভার সমবেত সবার হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে যে ছাদ ফাটানো গলা শুনতে পেলাম, সেটি নজরুলের আওয়াজ। সভা শেষে তিনি আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি তার গায়ের অসাধারণ শক্তিতে বিস্মিত হলাম।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল, নজরুল এলেন। সৈনিক বেশ, কাঠখোট্টা চেহারা, দাঁিড় গোফ নেই, খনখনে অট্টহাসিতে ঘর মুখরিত করে আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন।
প্রবোধ কুমার লিখেছেন, নজরুল যখন তার অনুরাগরঞ্জিত কবি জীবন নিয়ে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার রাজপথে, তখন তার একদল লক্ষীছাড়া বন্ধুভিন্ন অপর সহায় সম্বল বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এমন একটি প্রবল উজ্জ্বল প্রাণ, এমন একটি সরল উজ্জ্বল ও হাস্যোদ্দীপ্ত জীবন, যেটি সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত করে রাখতো তার বন্ধু সমাজকে। তার স্বভাবের দীপ্তি, তার প্রাণবন্যা এবং তার হাস্যমুখরতা- এদের আকর্ষণে একদা কলকাতার রাজপথে ভীড় জমে যেত।

আব্দুল হালিম লিখেছেন, কবির সুডৌল বলিষ্ঠ দেহ, বড় বড় বিস্ফরিত উজ্জ্বল চোখ, মাথায় রুক্ষ দোলায়মান লম্বা চুল, সহাস্য মুখ, দীর্ঘ পিরান, পীত শিরস্ত্রাণ, গৈরিক বেশ হাতে বেণূ কবিকে মহিমান্বিত করে তুলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে গান ও কবিতায়। শেষ হচ্ছে কাপের পর কাপ চা। নজরুলের মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটছে, কলহাস্যে মজলিস মুখরিত, আহার নেই, নিদ্রা নেই, কবি তার ছন্দ দোলায় গান ও কবিতা রচনা করে চলেছেন, শত কোলাহলের মধ্যেও তার লেখনী স্রোতের মতো বেগবান।

নজরুলকে যারা গভীর ভাবে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করেছেন, মৃত্যু অবধি কাজী নজরুলের দু চোখে যে অপূর্ব দীপ্তি ও তেজোদ্দীপ্ত চাহনী ছিল, তাতে সরাসরি কেউ তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না। তার শরীর ছিল নাদুস নুদুস, যে অসুখে ভুগে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন, এর আগে পুরো যৌবন ও তারুণ্যে কখনো তিনি কোন অসুখে পড়েন নি।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের লেখা বিজ্ঞাপন

তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক কিছুই হয়তো আমরা জানি না। মাত্র কয়েক বছরের কাব্যসাধনায় যে কবি বাংলা সাহিত্যে প্রাণের জোয়ার বইয়ে দিলেন, তার ব্যক্তিগত স্বভাব চরিত্র ও অনেক কিছুই ছিল ব্যতিক্রমী। কবিতায় তার যে সত্ত্বা আমরা দেখতে পাই, এর সাথে অনেক পার্থক্য ছিল তার খেয়াল খুশীর।

মোসলেম ভারত নামের একটি পত্রিকায় নজরুল লিখতেন। সেকালে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী কবি নজরুলের কাছে এসে বায়না ধরল একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে। কোম্পানিটির নাম ডোয়াকিন এন্ড সন্স। তাদের নির্মিত হারমোনিয়ামের জন্য কবি নজরুল তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে লিখে ফেললেন এই বিজ্ঞাপনটি-

কি চান? ভাল হারমোনী?? / কাজ কি গিয়ে- জার্মানী? / আসুন দেখুন এই খানে, / যেই সুর যেই গানে, / গান না কেন, দিব্যি তাই, / মিলবে আসুন এই হেথাই, / কিননি কিন, ডোয়ার কিন..

কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় আরেকটি কোম্পানী ছিল, বাহাদুর কোম্পানী। এটিও বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবসা করত। পত্রিকায় ডোয়াকিন কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে তারাও ছুটে এল কবি নজরুলের কাছে। তাদেরও দাবী, আমাদের জন্যও লিখে দিন এমন একটি বিজ্ঞাপন। কী আর করা? কবি আবারও লিখে ফেললেন,

মিষ্টি বাহা বাহা সুরে, চান তো কিনুন ‘বাহাদুর’/ দুদিন পর বলবেনা কেউ- ‘দূর দূর’, / যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর!! / করতে চান কি মনের প্রাণের আহা দূর? / একটি বার ভাই দেখুন তবে ‘বাহাদুর’,/ যেমন মোহন দেখতে তেমনি শিরীন ভরাট, / বাহা সুর, চিনুন, কিনুন বাহাদুর।

এরপর কয়েক মাস ধরে একই পত্রিকায় এ দুটো বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল এক সাথে। কোম্পানীও ব্যবসা করেছিল দেদারসে। পরে মাথার চুলের জন্যও তিনি লিখেছিলেন একটি সুন্দর বিজ্ঞাপন। খেয়ালী নজরুল থেকে এভাবে কতো ব্যক্তি ও কোম্পানী যে উপকৃত হয়েছে, তার হিসেব নেই।

কুইজঃ কাজী নজরুল তার আনন্দ প্রকাশ করার জন্য কোন কথাটি বলে সবাইকে চমকে দিতেন?
উত্তরঃ দে গরুর গা ধুইয়ে।

বাবাজী বেশে কাজী নজরুলের ঢাকা ভ্রমণ

ক্যালান্ডারের পাতায় তখন ১৯২৭ সাল। বাঙালী খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত মোহনবাগান ক্লাবের সাথে আজ আরডিসিএলআই দলের খেলা। এ দলটি বিদেশী ফুটবলারদের নিয়ে গড়া।

কাজেই খেলা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। হাসির আওয়াজে আসমান ফাটানো কাজী নজরুল এ খেলা দেখতে যাবেন না, তা কি করে হয়?

কবির বন্ধুরা তাই সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে টিকেট খুঁজে হয়রান, কিন্তু কোথাও মিললনা। সবাই যখন একটু মন ভার করে কবির অফিসে এসে হাযির, কবি তাদেরকে দেখালেন, এ খেলার জন্য তিনি আগেই সবার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সবাই আনন্দে খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরী হল। এ সময় তিনি প্রায় প্রতিদিন কাজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে খেলার মাঠে যেতেন। ক্রীড়ামোদী হিসেবে তখন তার বেশ পরিচিতিও ছিল বন্ধুমহলে।

জীবনের শুরু ও শেষে নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটানো কবি নজরুল এ সময়টাতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। কাজ করতেন সওগাত পত্রিকার অফিসে। বেতন হিসেবে পেতেন কমপক্ষে তৎকালে দু শ টাকা। কবিতা গান গল্প আর রচনা লিখে আরও বেশ কিছূ কামাই হতো তার। এমন সুদিনে তিনি বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকতেন হৈ হুল্লোড়ে। তার খামখেয়ালীপনার কান্ড কারখানা দেখে আনন্দের বন্যায় ভেসে যেত বন্ধুদের সব দুঃখ বেদনা।

খেলা শুরু হল। কবির দু পাশে তার বন্ধুরা তাকে বেষ্টনী দিয়ে রেখেছেন প্রহরী হিসেবে। খেলা দেখার সময় সব ভুলে একেবারে অন্যমানুষ যেন ছোট শিশুর মত হয়ে যেতেন নজরুল। কখনো আনন্দে লাফ দিয়ে কারো গায়ে পড়ে যেতেন, নয়তো কাউকে বল ভেবে পদাঘাত করে বসতেন, গোল গোল বলে জ্ঞানশূন্য হয়ে কাঁিপয়ে তুলতেন চারদিক তুমুল চিৎকারে। মাঠভর্তি দর্শক হা করে তাকিয়ে দেখত বিদ্রোহী কবির শিশুসুলভ কান্ডকারবার।

বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হতো আশেপাশের মানুষ।
খেলা শেষ হলো। ছয় গোলে মোহনবাগান হারিয়েছে বিদেশী ফুটবলারদেরকে। নজরুলের আনন্দ তখন আর দেখে কে?

শুরু হল বন্ধুদের নিয়ে তার উল্লাস নৃত্য। সবাইকে নিয়ে নেচে খেলে ক্লান্ত হলেন কবি। তারপর ঢুকলেন পাশের খাবারের দোকানে। পেট ভরে সবাই তৃপ্ত হল। তবু মন ভরেনা দুরন্ত কবির। এই চল, চন্দননগন থেকে ঘুরে আসি। প্রাণখোলা নজরুলের মুখে এমন কথায় সবাই একলাফে রাজী। কারো বাড়ীতে কেউ জানালোনা, সবাই চলল চন্দননগর।

চন্দননগরে এসেও মন মানে না কবির। আরও দূরে যেতে চান তিনি। একটু আনন্দ আর প্রানখোলা হাসিতে জগত ভরিয়ে দিতে তার চঞ্চল মন তাকে শান্ত হতে দিচ্ছেনা যে। নাহ, চল, সবাই ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসি। যা হয় হোক। কবির এমন খেয়ালীপনা তার বন্ধুদের কাছে নতুন কিছু নয়। কোনো নিয়মের শেকল তাকে আটকাতে পারেনি, ছোটবেলা থেকে নির্বাক হওয়া অবধি।

কোথায় চন্দননগর আর কোথায় ঢাকা? কিন্তু যেখানে সাধ্যের চেয়ে সাধ বড়, সেখানে আর কে ঠেকায়? বাঁধনহারা নজরুলের ডাকে এক কাপড়ে সবাই ছুটল শিয়ালদা ষ্টেশনে। এবার টিকেট কাটতে গিয়ে হুঁশ এল সবার। এক নজরুলের পকেটে যে টাকা আছে, তা দিয়ে সবার ঢাকা ঘুরে আসা সম্ভব নয়, বাকী সবার পকেট শূন্য। তবে কি সবাই ফিরে যাবে কলকাতায়? নিছক টাকার জন্য ঢাকা যাত্রা বাতিল হচ্ছে?

যেখানে নজরুল, সেখানে সব হিসেব ভুল। সবাইকে হাঁক দিয়ে বললেন, এই তোরা দাঁড়া, চিন্তা করিসনে, ব্যবস্থা করে আসছি।

লম্বাচুলের বেশে বলিষ্ঠ দেহের সুপুরুষ তাগড়া জোয়ান নজরুলকে তখন অনেকেই চিনতো। তিনি ষ্টেশনের গেটে যাওয়া মাত্র তাকে দেখে দৌড়ে এলেন মাস্টার। নমস্কার জানিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানালেন লোকটি। নজরুলও তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এই যে শুনুন, আমরা কয়েকজন ঢাকা যাব, কিন্তু সবার যাওয়ার মত খরচ নেই, আমরা ভেন্ডার গাড়ীতে যেতে রাজী আছি।’ কবির কথায় কাজ হলো। দেশজুড়ে তামাম জনতা যার কবিতায় মত্ত হয়ে যায়, সামান্য মাস্টার সেখানে তেমন কি?

সবার যাওয়ার ব্যবস্থা হল। ইষ্ট বেঙ্গল মেলে চড়ে সবাই ছুটলো হাসি আনন্দ আর গান বাজনার মধ্য দিয়ে। সবাই এসে নামলো গোয়ালন্দ স্টেশনে। এখান থেকে বাকী পথ যেতে হবে জাহাজে। টাকা নেই, টিকেট নেই। এই এতদূরে ভিনদেশে কে চিনে নজরুলকে? এবার উপায়। নজরুল পড়লেন বিপদে, তার বন্ধুরা দুশ্চিন্তায়।

কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন কাজী নজরুল। যেখানে নজরুল সেখানে সব রীতি ভন্ডুল। নজরুল তাই সবাইকে চুপে চুপে কী যেন বলে নিজে একটি টিকেট আর একখানা মাদুর কিনলেন ঘাট থেকে। তারপর সোজা কোন তোয়াক্কা ছাড়া মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লেন জাহাজের ডেকে।

কোনদিকে না তাকিয়ে ভরাট গলায় টান দিলেন, প্রাণভোলানো সুরে শুরু করলেন গজল গাওয়া। চুপে চুপে বলে আসা বুদ্ধিমত তার বন্ধুরা ততক্ষণে তার চারপাশ ঘিরে বসে তালি বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ মাথা নাড়াচ্ছে, এ যেন আসমানী জলসা। কবি তখন গভীর ভাবের সাগরে ডুব দিয়ে একের পর এক গাইছেন ভুবন ভোলানো গজল। বন্ধুদের কারো কাছে টিকেট নেই, তাতে কী? সবাই তখন দেওয়ানা মাস্তানা নজরুলের দরাজ সুরের সাগরে।

দেখতে দেখতে জমে গেল ভীড়। ছুটে এল খোদ জাহাজের কর্মচারী ও কর্তারাও। কার সাধ্য, নজরুলের কথা ও সুরের যাদুকে ঠেলে দেয়, যেমনই তার কথা তেমনই তার সুর, যে শুনেনি, তাকে কে বুঝাবে তার যাদুকরী মনমোহনীর ক্ষমতা।

শ্রোতা দর্শকের ভীড়ে ও চাপে জাহাজ কাত হয়ে যাচ্ছে, এমন গুরুতর দশা দেখে উপর থেকে নীচে নেমে এলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। রাগের মাথায় নীচে নেমে তিনিও মজে গেলেন সবার সাথে। বিনয় শ্রদ্ধার সাথে নজরুল ও তার সাথীদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একেবারে জাহাজের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন কবিকে।

শুধূ কি তাই, টিকেট পরীক্ষকও সব ভুলে ডুবে থাকলেন নজরুলের মায়াবী হৃদয়দোলানো সুরের সাগরে। দৌড়ে গিয়ে নিজের রুম থেকে তবলা এনে হাতে তুলে দিলেন নজরুলের বন্ধুদের, বারবার জানতে চাচ্ছিলেন কোন সেবার কিংবা কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা?

এভাবে পুরো পথ পাড়ি দিয়ে রসিক নজরুল এসে পৌঁছলেন আমাদের ঢাকায়। কবি হিসেবে তার নাম ডাক তখনো তেমন ছড়ায়নি, এই ঢাকায় তাকে সমাদর করবে কে?

তাছাড়া এত বন্ধু বান্ধব মিলে তো আর একজনের বাড়ীতে উঠা যায়না, সবাই তখন বুদ্ধি করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যার যার স্বজন পরিজনদের বাসায় গিয়ে উঠলো। নজরুল থাকলেন বুদ্ধদেব বসুর দলে। আরও কয়েকজন সাথে নিয়ে এ দলের দায়িত্ব নিলো বুদ্ধদেব। তার এক আত্মীয় ঢাকায় উচ্চপদস্থ সরকারী কর্ত। সবাই মিলে সেখানে গিয়ে উঠার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো।

এবার আরেক বিপদ। এ দলের সবাই হিন্দু শুধু কবি নজরুল ছাড়া। বন্ধুরা বিপদে পড়লেন এ প্রাণের বন্ধুকে নিয়ে। তৎকালে ঢাকায় হিন্দুদের সমাজে ছিল জাতিভেদের প্রথা আর কৌলীন্যের বড়াই। তাই নজরুল নাম শুনলে তাকে কেউ ঘরে তুলবে না। তবে কী করা যায়?

সবাই মিলে নজরুলের নাম আপাতত বদলে দিল। তার নাম স্বামী রামানন্দ। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের বিশাল বপুর অধিকারী নজরুলের সাথে নামটা একেবারে মিলে গেল। তার চোখ মুখের অপূর্ব দীপ্তি আর ভরাট গলা শুনলে তাকে বাউল সন্যাসী না ভেবে উপায় নেই।

বুদ্ধদেব বাবু তার এ দল নিয়ে হাজির হল তার আত্মীয়ের বাসায়। বাবরী চুলের নজরুলকে দেখে পরিচয় জানতে চাইল ঘরের লোকজন। ইনি বেলুড়মাঠের রামানন্দ বাবাজী’ বলে সবাইকে জানিয়ে দিলো দলনেতা। মুহূর্তে সাড়া পড়ে গেল সারা বাড়ীজুড়ে। কাছে গিয়েও যার পদধুলি পায়না মানুষ, তিনি এসেছেন এ বাড়ীতে অতিথি হয়ে, সাধক পুরুষের পদধুলিতে ধন্য হবে সবাই, নিজেদেরকে বড্ড সৌভাগ্যবান ভাবতে লাগলেন বাড়ীর কর্তারা।

শুধু কি কবি? নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার ভান্ডার। কখনো তিনি হাতের রেখা বলে ভবিষ্যত বলে দিতেন। বেদ বেদান্তদ, উপনিষেদ, রামায়ণ আর মহাভারতসহ হিন্দু ধর্মের নানা গ্রন্থে তার জানাশোনা ছিল প্রচুর। হিন্দুয়ানী ধর্মের তত্ত্বকথাতো বটেই, তাদের শ্যামাসঙ্গীতেও তিনি ছিলেন পটু। আর তাই বাবাজী বেশধারী নজরুল এ কয়টা দিন ধর্মের গুরুগম্ভীর আলোচনা, কখনো শ্যামাসঙ্গীতের উজাড় করা সুরে ভরিয়ে দিতেন সবার মন।

এমন সাধক বাবার সুনাম শুনে পাড়া পড়শীরা ছুটে আসতে লাগলো ফলমূল আর মিষ্টান্ন মিঠাই নিয়ে। ভক্ত অনুরক্তের আগমনে ভরে গেল কর্তার ঘর আঙিনা। একটু প্রনাম জানাতে নানা পদের আহারাদী নিয়ে ছোট বড়রা আসতে লাগল যে কদিন নজরুল ওখানে ছিলেন। আত্মভোলা নজরুলের বেশ ভালোই লাগছিল এ বাবাজী জীবন। আড়ালে মুখ টিপে তখন হাসছিল তার বন্ধুরা। এই না হলে কি আর তাদের প্রাণবন্ধু নজরুল।

এক প্রফেসরের গলায় গান ধরালেন কবি

কবি নজরুল তখন খুব ব্যস্ত। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লিখেন, সুর করেন, গান শিখিয়ে দেন। বেশীর ভাগ গান গাইছে কে মল্লিক। একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এল। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস। এসে ধরল মল্লিক কে-

দেখুন মল্লিক বাবু, আপনার বাড়ী কালনা, আমার বাড়ী কাটোয়া, বলা চলে একই দেশের লোক। আমাকে কি আপনি একটু উঠতে দিবেন?
আরে, দেশের লোক উঠতে পারলে তো আমারই খুশী। তো কী চান বলুন।
আমি গান গাইতে চাই, নেবেন আমাকে?
কিন্তু গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের কোম্পানীতে।
জ্বী আমি রাজী।

পরীক্ষা নেয়া হল প্রফেসরের। ফলাফল একেবারে অচল। গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই সান্তনা দেন, বেচারা ততই দ্বিগুণ কাঁেদন। আওয়াজ শুনে এলেন কোম্পানীর বড়বাবু। তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, আপনার গলা এখনও ঠিক হয়নি। সুর তাল লয় ঠিক থাকছেনা, কদিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়।

প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন যারা তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভাল হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে। প্রফেসরের কান্না আর থামছে না।
এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।

আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল।
আরে মল্লিক, আমারা বাঙালীরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে। এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো, তুমি কাল এস, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নিব।

কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভাল করেই জানেন। কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন।
পরদিন কবি এসে দেখেন, প্রফেসর জি দাস অনেক আগেই এসে হাজির। কবি তাকে দেথে বললেন, যাও মল্লিককে ডেকে আনো।

আবার মল্লিকের নাম শুনে মন খারাপ হয়ে এল বেচারার। কাজীদা, ঐ লোকটি এলে আমার গান খারাপ করে দেব’ বলে অভিযোগ করলেন মল্লিকের বিরুদ্ধে। কবি তাকে সন্তনা দিয়ে বললেন, আরে না, মল্লিক খুব ভালো লোক, তোমার সাথে কেমন সুন্দর হারমোনিয়াম বাজায়, তুমি দেখো।
খবর পেয়ে মল্লিক সাহেব এলেন। কাজী নজরুল তাকে দেখে বললেন, আরে আসুন আসুন, প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তবলাওয়ালাকে ডাকো, তারপর দরজায় খিল এঁটে দাও।

রিহার্সাল রুমে তখন চারজন। কাজী নজরুলের কান্ড দেখার জন্য মল্লিক সাহেব চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন। তবলাওয়ালাও ভাবছে, এই পাগলকে দিয়ে কী গাওয়াবেন কাজী সাহেব, কে জানে?

কবি এবার তৈরী হয়ে প্রফেসরকে বললেন, শোনো, তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কী গাইবে, কিছুই বলবেনা তখন। খুব সাবধান, বাজারে রেকর্ড এলে যেন সবাই শুনে। তার আগে যেন কেউ টের না পায়। বেচারা প্রফেসর মাথা নেড়ে সুবোধ বালকের মত সায় দিল। হেসে হেসে বলল, না , না, কাউকে শোনাবো না।

আচ্ছা, এবার গান ধরো, বলে কাজী নজরুল তাকে বলতে বললেন,
কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়/ ছ্যাকরা গাড়ী যায় খচাং খচ/ ই্িচং বিচিং জামাই চিচিং/ কুলকুচি দেয় করে ফচ।।

অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকী দুজন ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেকা জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন আরেক গান-

মরি হায় হায় হায়. কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো।/ তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা/ উপুড় করলে হয় সাঁকো।/ হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁেটা, মরি হায় হায় হায়//

এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেলনা। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে থাকল। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলনা, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে? চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হল, তারপর বাজারে ছাড়া হল।

বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো?
বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, কাজী দা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গানদুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ী যায় ভষড় ভষড়.....
কোম্পনীর ম্যানেজার তো দারুণ খুশী। বড়বাবুকে ডেকে বললেন, তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরো দু একটা নাও না ওর গলায়..
মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে। বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

এই ছিল তার রসিক কান্ড, খেয়াল খুশীতে তিনি পাগলকে দিয়েও বাজার মাত করে ফেললেন, অবাক হয়ে পুরো কোম্পানী তার প্রতিভার কাছে তাই মাথা নুইয়ে থাকতো।

কবি নজরুলের বুলবুলপ্রীতি

কবি নজরুলের প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। কবি তার এই ছেলেটিকে খুব ভালবাসতেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বাবা হিসেবে মনের মত করে তিনি তাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার জীবন ও যৌবন সাজাতে চেয়েছিলেন। বুলবুল এর গলাও ছিল অসাধারণ মিষ্টি।

কবির সাথে যারা আড্ডা দিতে আসতেন, তারাও তাকে আদর করতেন, তার মুখের কথা শুরে অবাক হতেন। শুধু কি তাই, কবি যখন হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে কোন সুর বাজাতেন, ছোট্ট ছেলে বুলবুল সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে দিত, আব্বু এখন এই গানটি করবেন, এ বাজনা এ গানেরই। তার গলায় গান শুনে অবাক হয়েছিলেন তৎকালে কবির বন্ধুবান্ধবরা।

কবি যেখানে যেতেন, এই ছোট খোকাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বুলবুলকে নিয়ে কেটে যেত তার হাসি আনন্দে ভরা উচ্ছল সময়গুলো। বাধা বন্ধনহীন কবির ছন্নছাড়া জীবন ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল হয়ে উঠছিল বুলবুলকে ঘিরে।
জন্মের পর থেকে দুঃখ যার নিত্য সঙ্গী, সেই দুখুমিয়া কবি নজরুলের কপালে এ সুখ আনন্দ বেশীদিন সইলো না। অল্প বয়সে কবির ছেলেটি অসুখে ভুগে চলে গেল পরপারে। আদরের প্রথম সন্তান ছোট খোকা বুলবুলের এ মৃত্যু কবিকে ভেঙে চুরমার করে দিল।

জীবনের প্রথম স্বপ্নসৌধ অবেলায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল সদা হাস্যপ্রাণ কবি নজরুলের। মাত্র কয়েক লাইন লিখে কবির দুঃখ বেদনা আর মুষড়ে পড়ার কথা এখানে বুঝানো অসম্ভব।

কাঁদতে কাঁদতে কবির চোখদুটো ফুলে গিয়েছিল, নাওয়া খাওয়া ভুলে এমন ”ঞ্চল কাজী নজরুল একেবারে নীরব হয়ে গেলেন, কতখানি শোকে বিদ্রোহী কবি পাথর হয়ে চুপচাপ হয়ে যেতে পারেন, তা অনুমান করা হয়তো কিছুটা সম্ভব।

বুলবুলের সব খেলনা, জামা কাপড় কবি পরম আদরে সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাকে সান্তনা জানিয়ে তার বন্ধুরা যেসব চিঠিপত্র পাঠাতেন, সেসব পড়ে কবি জোরে জোরে কেঁদে বুক ভাসাতেন নয়নের জলে। বুলবুলের চিকিৎসায় তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছিল, কাজেই মৃত্যুশোকের সাথে এবার যোগ হল অর্থকষ্ট। ভরাক্রান্ত কবির কাছে এ দিনগুলো ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল।

তার জীবনীকারদের কেউ কেউ লিখেছেন, প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে কবির জীবনে একটি ভাবান্তর আসে, কবি তখন সবার অলক্ষ্যে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে আসক্ত হয়ে পড়েন, তার রচনা ও লেখার স্রোত ধীর হয়ে আসে, এভাবে চলতে থাকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত, এরপর তো তিনি চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝে তার সাথে গল্প করেন। একবার কবির বাসায় তল্লাশীর হুকুম এল উপর থেকে। এ বেচারাকে দায়িত্ব দেয়া হল সে দলে থাকার। গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবির ঘরের। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন এবং সঙ্গত কারণে এই তরুণ অফিসার এবং কবি দুজনই পরস্পরকে না চেনার ভান করে রইলেন।


গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল্লাশী চালাচ্ছে, কবিও তাদেরকে যথাসম্ভব বাক্স খুলে খূলে দেখাচ্ছেন। হঠাৎ ঘরের কোনে পরম যতেœ উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর পড়ল তাদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইল। কবি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দিবেন না যেন।

কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ তীব্র হল। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছূ খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী। এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দু চোখ পানিতে ভরে গেল। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনে। এমন সুকঠিন মুখখানা তার ব্যাথায় ও দুঃখে কালো হয়ে এল। এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের সন্তান এই ছোট বুলবুলের।

তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি সান্তনা খূঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের গালে। এ অফিসার তার এক লেখায় নিজেকে অত্যন্ত ব্যর্থ ও লজ্জিত উল্লেখ করে লিখেছেন, এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি, কিন্তু সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি।

নজরুল লিখলেন তার বুলবুলকে নিয়ে, আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছে, যে দেশে গেছ তুমি- সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও বেশী সুন্দর।’

আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমি যখন আমার পথ খুঁজছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখিয়ে আমার হাত পিছলে মৃত্যুর সাগরে হারিয়ে গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমার কাছে ধর্মযাজকরূপে দেখা দিল, সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ফিরতে লাগল...ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখিয়ে হেসে চলে গেলেন।’
এ সময় কবি প্রায়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন, নীরব হয়ে দিন কাটাতেন, এমনকি এ দুরন্ত কবি তার বন্ধুদেরকে, যাদেরকে নিয়ে দিনরাত ভুলে হাসি আড্ডায় মেতে থাকতেন, তাদেরকে একবার বলে ফেললেন, আমি এ ভারতের সর্বসেরা ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি।

কবির জীবনে বুলবুলের মৃত্যুতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা তিনি নির্বাক হওয়ার আগ পর্যন্ত আর ভুলতে পারেন নি। কবিতার আগুনে জ্বালাময়ী লেখায় আর ভরাট গলার টানে যে কবি পুরো বাংলাকে যাদুগ্রস্ত করে মোহময় করে রাখতেন, এমন বিদ্রোহী আর অশান্ত কবি নজরুলের মমতাময় মনের এমন প্রকাশ দেখে তার বন্ধুরাও নিশ্চুপ হয়ে থাকতেন।

কাজী নজরুল যেভাবে ছড়া ও গান কবিতা লিখতেন

কাজী নজরুল এসেছেন কুমিল্লায়। উঠেছেন শ্রী ইন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়ীতে। একদিন তার কানে একটি শিশুর আওয়াজ ভেসে আসল। তিনি কান পাতলেন, চোখ মেলে তাকালেন, দেখেন, সেই বাড়ীরই ছোট মেয়েটি একটি পেয়ারাডালে বসা কাঠবেড়ালীর সাথে ভাব জমাচ্ছে। এই ভয় দেখায়, আবার আদর করে, কখনো নিজেই রাগ করে, আবার অভিমান ভুলে যায়, কখনো মেয়েটি কাঠবেড়ালটিকে বলছে, তোমার সাথে আমার আড়ি, যাও।

কবি নজরুল এ দেখে নিজেও যেন শিশুর জগতে মিশে গেলেন। তিনি তন্ময় হয় ছোট্ট মেয়েটির ভাব জমানো দেখছিলেন, মেয়েটি রাগ হয়ে বলছিল, হেই ভগবান, একটি পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে।’ শিশুমনা নজরুল দারুণ মজা পেলেন তার এ দুষ্টুমী দেখে। তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে ফেললেন এবং হাসতে হাসতে লিখে ফেললেন তার সেই ছড়াটি, অজস্র শিশুর প্রথম পাঠ্য বইয়ে আজো সেই ছড়াটি বিদ্যমান।


গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজী নজরুল তখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন। চারিদিকে তখন শিল্পীদের ভীড়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম, সুর করে শিখিয়ে দিচ্ছেন বিরামহীনভাবে। রিহার্সাল ঘরে তুমুল হৈ হুল্লোড়ে বসে কবি সবার সাথে মিসে যেতেন আনন্দে।

হঠাৎ দেখা যেত, কবি চুপ হয়ে আছেন। যেন ভাবান্তর ঘটেছে তার মনে। আনন্দে ব্যস্ত রুমভর্তি মানুষদের কেউ তার এ আচমকা নীরবতা টের পেলনা। এত গোলমাল আর হট্টগোলের মধ্যে তিনি মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে আধ ঘন্টার কম সময়ে লিখে ফেলতেন দশ বারোটি গান। তারপর হাতে হাতে তা বিলি করে দিতেন। যেন মাথায় তৈরী করা ছিল, শুধু কাগজে তুলে দিলেন।

একদিন এলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন। এসে কবিকে বললেন, এই যে কাজীদা, দেখুন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দু কাওয়ালী গানের রিহার্সাল দিচ্ছে। বাজারে সেসব গান খুব চলছে। আপনি বাংলায় এমন কিছু গান লিখে দেন না কেন? কোম্পানীর বাঙালী সাহেব বলে উঠলেন, না না, ওসব চলবে না বাজারে।

এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। কী ভেবে এবার কর্তা রাজী হলেন। আব্বাসউদ্দীন ছুটে গিয়ে কবিকে বললেন, কাজীদা, কর্তা রাজী হয়েছেন।
এ খবর শুনে নজরুল একটি আলাদা রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আব্বাসকে বললেন, কিছু পান নিয়ে এসো। তিনি পান নিয়ে এলেন ঠোঙা ভর্তি করে।

কবি নজরুল তখন বললেন, দরজাটা বন্ধ করে এবার চুপচাপ বসে থাক।
পনেরো থেকে বিশ মিনিট। কবি মাথা তুলে তাকিয়ে বললেন, এই যে এসো, নাও, ধরো, সুর শিখে নাও। শিল্পী আব্বাস উদ্দীন অবাক। এই ক মিনিটে তার কাজীদা লিখে ফেলেছেন, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো...। শুধু কি লিখলেন, সুরও ধরিয়ে দিলেন সাথে সাথে। আর বললেন, কাল এসো আবার। রেকর্ডের অপর পৃষ্ঠার জন্য আরেকটি লিখে দিব।

পরদিন তিনি এলেন এবং কবি তার জন্য লিখে দিলেন, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর। চারদিন পর গজল দুটো রেকর্ড হল এবং বাজার মাত হয়ে গেল। এভাবে শুরু হল তার গজল লেখা। কোম্পানীও দেদারসে মুনাফা করল এসব বিক্রি করে। মাত্র কয়েক মিনিটে জন্ম নেওয়া সেসব গানগজল এর মহিমা ডিঙাতে পারেনি আজও কোন কবি কিংবা শিল্পীর গান।

কুইজঃ কাজী নজরুলের কি কোন গানের ওস্তাদ ছিল?
উত্তরঃ গ্রামোফোন কোম্পানীতে নিমন্ত্রণ পাওয়ার পর কবি ভাবলেন, গানের বিদ্যাটা একটু ভালো করে শিখে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। সেসময় ১৯২৯ সালে তিনি ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খানের কাছে কিছু তালিম নিয়েছিলেন, যাতে ওস্তাদী করতে তার কাজে লাগে। এর প্রমাণ মিলে ১৯৩২ সালে সেপ্টেম্বরে তার গানের বই ‘বনগীতি’ উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত কলাবিদ আমার গানের ওস্তাদ জমীরউদ্দীন খান সাহেব এর দস্ত মোবারকে।’

কাজী নজরুল ইসলামের হাস্যরস ও রসিক কারবার

কাজী নজরুল এসেছেন সিরাজগঞ্জে। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর প্রতি কবির ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও বিনয়মিশ্রিত ভালোবাসা। সিরাজীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবি কাঁদলেন, খোদার কাছে মাগফেরাত চাইলেন।

বেদনাবিধুর কণ্ঠে তিনি উপস্থিত লোকদেরকে শোনালেন, সিরাজী সাহেব আমাকে যে আদর করেছিলেন, তা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এমন আদর আমাকে এই বাংলার আর কেউ করে নাই। এই সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি আমার জন্য মানি অর্ডার করে সেকালে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন, একটি কলম কিনে নিও. আমার কাছে এর বেশী এখন নেই, থাকলে তোমায় পাঠিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।’ কথাগুলো বলার সময় বিদ্রোহী কবির চোখে অশ্র“ ছলছল করছিল।

সফরের তৃতীয় দিন কবি খেতে বসেছেন আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে। সবার পাত্রে ইলিশ ভাজা পরিবেশন করছেন তিনি। কবির পাত্রেও একখানা দিয়েছিলেন, কবি সেটি খেয়ে কেবল শেষ করছিলেন, তখনই একজন আরও কিছু ইলিশভাজা তার প্লেটে দিতে যাচ্ছিলেন, রসিক কবি নজরুল তাকে বাধা দিয়ে হো হো করে বলে উঠলেন, আরে আরে করছ কী? শেষকালে আমাকে বিড়াল কামড়াবে তো?

উপস্থিত সবাই কবির কথাটা বুঝতে পারল না। গিয়াসুদ্দীন নামে একজন জিজ্ঞেস করলেন, মানে?

কবি বলতে লাগলেন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, আরে বুঝলেন না! ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়, বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে, বেশী খেলে কি আর রক্ষে আছে, সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।

এমন ব্যাখ্যা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

খাওয়া দাওয়া শেষ। আয়োজকরা কবির পাতে দই ঢেলে দিচ্ছেন। একটু দই মুখে দিয়ে কবি অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখ কপালে তুলে আসাদউদ্দৌলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি হে! তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি? সবাই আবারও হাসতে হাসতে কাত হয়ে গেল। টক দইয়ের জন্য মেজবানকে এভাবে শাসানো কবি নজরুল ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল?

দই খাওয়া শেষ। পান জর্দা মুখে দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে শুয়ে আছিন কবি নজরুল। এমন সময় এক লোক এল কবিকে সালাম করতে। দরজায় দাড়িঁয়ে সে বেশ জোরে আসসালামু আলাইকুম বলল। কবি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আরে, দুর্গা দাসবাবুর মুখে আসসালামু আলাইকুম যে!,

উপস্থিত সবাই কবির এমন আজব কথা শুনে আগন্তুকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে, লোকটি সত্যিই বাংলা নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত নট দুর্গা দাসের মতো সুদর্শন। আগত লোকটি বিনীত ভাবে বললেন, আমি বন্দোপধ্যায় নই, সৈয়দ। এই তো রায়পুরায় আমার বাড়ী। একজন অচেনা মানুষকে এমন ভড়কে দিতে কবির আকস্মিক মন্তব্যে আবার হো হো করে হেসে গড়াল ঘরশুদ্ধ সব মানুষ।

বন্ধু শৈলেনের কাছে এসে তার কাছে কবি চা চাইলেন এই বলে, তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।

শৈলেন জিজ্ঞেস করে, দু পেয়ালা কেন?
কবি বলে চলেছেন, আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেরে চারাক হয় না। লাখ পেয়ালা হতেক আমার এখনও দু পেয়ালা বাকী আছে। বন্ধুর কাছে থেকে চা আদায় করে নিতে এমন অদ্ভুত মন্তব্য ছিল কবির নিত্য অভ্যাস।
কবি নজরুলের পত্রিকা ধুমকেতুর অফিসে সারাক্ষণ চলত হাসি আনন্দের বন্যা। সেখানে সবাইকে চা দেয়া হতো মাটির ভাঁেড়। এর কারণ কী?

কবি যখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার কোন হাসির কথা মনে পড়ে যায় কিংবা কোন রসিক বন্ধুকে এই মাত্র অফিসে ঢুকতে দেখেন, অমনি দে গরুর গা ধুইয়ে বলে চায়ের পেয়ালা ছুড়ে মারতেন, মাটির পেয়ালা ভেঙে চা ছিটকে পড়তো কাগজে, মেঝেতে, মাদুরে, কারো গায়ে। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হতো কবির সঙ্গীরা, তবু থামতেন না কবি।

গোপীনাথ নামে একজন ধুমকেতুর অফিসে এসে এসব আজব কান্ড দেখে কবিকে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনাদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কবি আবারও বলে উঠেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, শোন, আনন্দ কোত্থেকে জাগে, তার উত্তর নেই, কিন্তু নিরানন্দ কেন হবে, তার উত্তর শুনতে চাই তোমার কাছে।
গোপীনাথ জবাব দেয়, দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কীভাবে? প্রতিটি ইংরেজ আমাদের শত্র“, তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর আমরা হাসব, গাইব?

ভরাট গলায় নজরুল তাকে বুঝালেন, প্রতিটি ইংরেজ নয়, সমগ্র ইংরেজ সমাজ আমাদের শত্র“, এ শত্র“দের ভাসিয়ে দিতে হলে চাই প্রাণবন্যা, এরই আবাদ করছি আমরা এখানে।’ গোপীনাথ চুপ হয়ে শুনে ভাবুক হয়ে যায় কবির জবাব শুনে।


কুইজ ঃ সর্বশেষ কবে কাজী নজরুল ইসলাম নামাজ পড়েছেন বলে কেউ দেখেছে?
উত্তর- ১৯৪০ সালে। এ সময় কবি একদিন তার বন্ধু জুলফিকার হায়দারের বাসায় গিয়ে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছিলেন। এরপর এমন আর কেউ বর্ণনা করেছেন বলে জানা যায়নি।

কবি নজরুলের চিঠি থেকে একটি ঘটনা

কাজী নজরুলের প্রিয় বন্ধুদের একজন ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তাকে লেখা অনেক চিঠি আজো সংরক্ষিত রয়েছে। সেসব চিঠিতে কবি বারবার তার প্রিয়তমার মতো সম্বোধন করে কারো কথা লিখেছেন। কখনো ..... দিয়ে দিয়ে তাকে বুঝিয়েছেন। কবির যৌবনের কে সেই তার প্রিয়তমা? আমি এখনও তা উদ্ধার করতে পারি নি। তবে একটি দুর্লভ চিঠি আমার কাছে এসেছে। কবি প্রথম যাকে বিয়ে করেছিলেন সেই নার্গিসকে লেখা কবির একটি চিঠি, যা তিনি বিচ্ছেদের পনের ষোলো বছর পর লিখেছিলেন।

কাজী মোতারহার ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদেরকে লেখা সেসব চিঠি কবিকে জানার এক বিরাট উৎস। কবি তার এসব চিঠিতে নিজের সুখ দুঃখ অবলীলায় লিখেছেন। তার দুরন্ত ও চঞ্চল মনের অপূর্ব পরিচয় পাওয়া যায় এসব পত্র পড়ে।

১০-০৩-২৮ তারিখে রাত ২ টায় লেখা কাজী মোতাহার এর কাছে চিঠিতে কবি তাকে জানাচ্ছেন, তিনি একজন হিন্দু ব্রাক্ষণের জন্য রক্ত দিবেন। সেজন্য ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় ঐ ব্রাক্ষণ তার জন্য রক্ত চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এ কথা লিখে কবি তাকে অনুরোধ জানাচ্ছেন, একটি আমার- তোমার বন্ধুর অনুরোধ, এ কথা কাউকে জানিয়ো না যেন। কাউকে মানে- তাঁকেও জানিয়ো না।’ এই ‘তাকে’ কে?

তার সবচিঠিতে এই অজানা প্রিয়তমার কথায় ভরা। চিঠির ভাবে মনে হয়, কবি তার কাছ থেকে বিচ্ছেদ পেয়েছেন, তবে এখনও তাকে ভুলতে পারছেন না।

পরের চিঠিতে কবি কাজী মোতাহারকে জানাচ্ছেন, তার রক্ত নেয়া হয়নি। কবির ভাষায়, ‘রক্তদান করিনি। ডাক্তার শালা বলে, হার্ট দুর্বল। শালার মাথা। মনে হচ্ছিল, একটি ঘুষি দিয়ে দেখিয়ে দিই কেমন হার্ট দুর্বল। ভিতরের কথা তা নয়। ব্রাক্ষণ ভদ্রলোক ‘মুসলমানে’র রক্ত নিতে রাজী হলেন না। হায়রে মানুষ, হায়রে তার ধর্ম। কিন্তু কোনো হিন্দু যুবক আজো রক্ত দিলেনা। লোকটা মরছে, তবুও নেবে না ‘নেড়ে’র রক্ত।’’

এমন অজানা অসংখ্য কান্ডকীর্তি বিবৃত রয়েছে কবির এসব চিঠিতে।


কাজী নজরুলের যে কষ্ট কেউ দেখেনি, কেউ বুঝেনি

কবি নজরুলের জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ কোনটি? তার জীবনী পড়লে দেখা যায়, এত তেজোদ্দীপ্ত ও বিদ্রোহী কবি কিন্তু তার পরিবারের কাছে নিতান্ত অসহায় ছিলেন।

একজন মুসলিম কবি হয়েও তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন হিন্দু নারীকে। যদিও তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল নার্গিস নামের এক তরুণীর সাথে। কবি তার এই হিন্দু স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর কাছে অসহায় ছিলেন। বাড়ীতে তিনি তাদের সামনে ভগবান ও জল বলতেন আর বাইরে এসে বলতেন পানি ও আল্লাহ। যদিও কবি হিন্দুদের জন্য শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, কিন্তু ইসলামের জন্য তিনি প্রচুর গজল ও লেখা রচনা করেছেন।

কিন্তু মুসলমান হয়ে তিনি ইসলামের জন্য হামদ নাত লিখবেন, এটা সহ্য হতো না তার শ্বশুরগোষ্ঠীর। ইসলামী লেখার জন্য তারা কবিকে নির্মম কথা শোনাতো, উপহাস করতো, কবির শ্বাশুড়ী এ বিষয়ে দারুণ ক্ষ্যাপাটে ছিলেন। তবু কবি নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লিখতেন আল্লাহ ও রাসুলের নামে।

এখানেই শেষ নয়, কবি তার দুই ছেলেকে খৎনা করার কথা বলারও সাহস পেতেন না তার পরিবারের কাছে। মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে’ এই অভিযোগে যারা কবির স্ত্রী ও শ্বশুর পরিবারকে দূর দূর বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল, কবির নাম যশ প্রচার হলে এরাই আবার দলে দলে এসে কবির বাড়ীতে দীর্ঘদিন ধরে থাকতো, খেতো, আমোদ ফূর্তিতে মত্ত থাকতো।

এমনও হয়েছে কবির শ্বাশুড়ী পরিবারকে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কবি নজরুল বাধ্য হয়ে ট্রেনের দু বগি রিজার্ভ করতেন, সেইসাথে সামানপত্র নেয়ার জন্য ওয়াগন ভাড়া করতেন। এসবের খরচ মেটাতে গিয়ে কবি যে কত মানুষের কাছে হাত পেতে ধার করেছেন, তার হিসেব নেই।

কবির খুব কাছের বন্ধুদের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, এজন্য কবি কয়েকবার নীরবে লাঞ্চিত অপমানিত হয়েছিলেন। এতো করেও কবির তার স্ত্রীর পরিবারের মন ভরাতে পারতেন না। মুন্সী জুলফিকারের কাছে একসময় কবি বলেই ফেললেন কথা প্রসঙ্গে, তুমি তো আমার শ্বাশুড়ীকে চেন না। ওরা হচ্ছেন যেন রাঘব বোয়াল, কিছুতেই আমি ওদের পেট ভরাতে পারলাম না।’’

জুলফিকার হায়দার তার প্রত্যক্ষ বর্ণনায় লিখেছেন, কবির শ্বাশুড়ী যেন তার প্রতি আরোপিত অপবাদ ও ঘৃণার জবাব দিতে তার বাড়ী থেকে আগত অতিথিদেরকে দু হাত ঢেলে আপ্যায়ন করতেন। কখনো কখনো দু একজনের খাবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তিনি কবির পকেট থেকে তৎকালের দশ বিশ নয়, একেবারে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত খরচ করাতেন।

নিজেদের আত্মঅহমিকা আর ভাব দেখানোর এতসব আয়োজনের সব দায় মেটাতে হতো একা কবি নজরুলের। ফলে অর্থ অভাব আর টানাটানি লেগেই থাকতো তার সংসারে। হিন্দু সাহিত্যিকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছিল যারা সর্বক্ষণ কবিকে নির্দয় ভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিত, গোঁড়া হিন্দু স¤প্রদায় তাকে পরিহাস করত।

এই ছিল একদিকের দৃশ্য। এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করায় তৎকালের মুসলিম সমাজও কবিকে তিরস্কৃত করত, এমনকি তারা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। সারাদেশের জাগরণে যার গান প্রেরণা যোগায়, সে নজরুল তাদের কাছে ছিলেন ঘৃণার পাত্র।

ফলে ঘরে ও সমাজে এমন বিপরীত ও অসহনীয় একটি পরিবেশে কবি থাকতেন চরম দুঃখে ও মানসিক বেদনায়। আর এসব ভুলে থাকার জন্য তিনি সবসময় ছাদফাটানো হাসি আর আড্ডার উপায় বেছে নিতেন। তবু আশ্চর্যের বিষয়, দুরন্ত মনের চঞ্চল কবি কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে তার জীবনের এ বৈপরীত্য মেনে দিন কাটাতেন, সুর সাগরে সাহিত্য ভান্ডারে প্রাণসঞ্চার করতেন?

কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে যে কতটা নিঃসঙ্গ ছিলেন, তার মনের অবস্থা কতো বেদনাময় ছিলো, এর প্রমাণ মিলে তার বিভিন্ন চিঠি থেকে। এজন্যই হয়তো তিনি ঘুরে বেড়াতেন নানা জায়গায়। কয়েকবার তিনি এসেছেন আমাদের এই ঢাকায়, এসেছেন কুমিল্লায়, ফরিদপুরে, যশোরে, খুলনায়, চট্টগ্রামে, সিরাজগঞ্জে, ঠাঁকুরগায়ে।

বেগম মাহমুদ নাহারকে লেখা চিঠির এক জায়গায় কবি লিখেছেন, তোমরা ভালবাস আমাকে নয়, আমার সুরকে, আমার কাব্যকে। তোমরা কবিকে জানতে চাও না নজরুল ইসলামকে জানতে চাও?”

কাজী মোতাহার হোসনকে লেখা এক চিঠিতে কবি নিতান্ত দুঃখের সাথে লিখেছেন, “বন্ধু আমি পেয়েছি- যার সংখ্যা আমি নিজেই করতে পারবো না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু। ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার চোখের জলের বাদলা রাতে এরা কেউ এসে হাত ধরেনি।”

এমনই অসংখ্য চিঠি থেকে কবির মনোবেদনার যে দুঃখময় চিত্র ফুটে ওঠে, তার পূর্ণ বিবরণ দিলে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল। কবির ব্যক্তিজীবন তাই সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। মায়া ও করুণার অপূর্ব অনুভুতিতে মন সিক্ত হয়ে আসে।

নির্বাচনে পদপ্রার্থী কবি নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকাহিনী যতই পড়ি ততই বিমুগ্ধ হতে হয়। নির্বাক হওয়ার আগে তিনি যে কবছর তার কর্ম ও সৃষ্টিতে তৎকালের সবাইকে হতবাক করে যাচ্ছিলেন, তার সেসময়গুলো ছিল বড্ড বিচিত্র। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বন্ধনহীন। কোন বাধা তাকে আটকাতে পারেনি। যখন যা চেয়েছেন, আপনমনের খেয়ালে তা-ই করেছেন। ঠিক কি বেঠিক, ভাল কি মন্দ- সব তিনি করেছেন পরমানন্দে।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আমাদের প্রিয়কবি নজরুল কিন্তু নির্বাচনেও দাঁিড়য়েছিলেন। অবাক হলেও কিছু করার নেই, কারণ তিনি ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করেননি।

১৯২৬ সাল। মাসের নাম নভেম্বর। পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে কবি নজরুল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতায় নেমেছিলেন। শুধু কি তাই, এ নির্বাচনী প্রচারের জন্য তিনি এসেছিলেন ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েক জায়গায়। কবির আশা ছিল, তার এ নির্বাচনে কংগ্রেস তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু কবি নজরুল তা পাননি। ফলে হয়ত তিনি নিশ্চিত ছিলেন পরাজয়ের ব্যাপারে। কাজেই ২৯ নভেম্বর ফলাফল প্রকাশের তারিখ হলেও তিনি ২৩ নভেম্বর ফিরে আসেন।

ব্রজবিহারী বর্মণকে লেখা এক চিঠিতে কবি তার এ পরাজয়ের জন্য কংগ্রেসের তরফ থেকে যথেষ্ট সাহায্য না পাওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই চাল চলনে ও আচার ব্যবহারে কাজী নজরুলের ঔদাসীন্য দেখে তার গ্রামের লোকজন তাকে ডাকত ‘তারা খ্যাপা’ বলে। কেউ কেউ এতিম নজরুলকে দেখে আদর করে ডাকত ‘নজর আলী’ বলে।
দারিদ্য ছিল তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী।

আয় রোজগারের জন্যই তিনি তার বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই মসজিদের দায়িত্ব পালন করতেন আজান দিয়ে, নামাজ পড়াতেন ইমামতি করে। সংসারের ভরণপোষণ আর সেইসাথে তার ভেতর যে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটছিল তার তাগিদে মাত্র বার তের বছর বয়সী নজরুল ফাঁকে ফাঁকে গান গজল কবিতা লিখতেন।

একটু নাম ডাক ছড়িয়ে যাওয়ায় এ বয়সেই তিনি তিনটি লেটোনাচের দল, যা ছিল তৎকালে পশ্চিমবঙ্গের আমোদ বিনোদনের মাধ্যম, নিমসা, চুরুলিয়া এবং রাখাখুড়া- এ তিনটি দলের নাটক রচনার ভার পেয়েছিলেন। এসব আয়োজনে কবির লড়াই নামে একটি অংশ থাকত।

এতে তখনকার কবিরা নিজেদের কবিতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতেন। যে কবি জিততো তাকে গোদাকবি আখ্যায়িত করা হতো। নজরুলের ছোটবেলায় তাদের গ্রামে যে গোদাকবি থাকতেন, তিনি নজরুলকে ডাকতেন আদর করে ‘ব্যাঙাচি’ বলে। প্রায়ই তিনি বলতেন, তোমরা দেখে রাখো, আমার এ ব্যাঙাচি একদিন বড় হয়ে সাপ হবে।’

গোদাকবির সে ধারণা যে মোটেও মিথ্যা ছিলনা, তার প্রমাণ এই এত বছর পরও আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময় প্রতিভা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আমরা জানি, তার সারাটা জীবন ছিল বন্ধনহীন। এলোমেলো আর খামখেয়ালীতে ভরা। হুট করে বিয়ে থেকে নিয়ে নির্বাক হওয়া পর্যন্ত তিনি কত কিছুই না করেছেন। এসব কারণে কতো আঘাত পেয়েছেন তিনি, তবু সহ্য করেছেন বারবার। সে আঘাত ছিল নানা দিক থেকে তির্যক আর কটুক্তিতে ভরা।

তৎকালের হিন্দু মুসলমানের আঘাত, সাহিত্যিকদের আঘাত, দুঃখ দারিদ্রের আঘাত, দায় দেনার লজ্জা, এই এত কিছুর পরও তার সৃষ্টি ও সাহিত্য আমাদেরকে শুধু অবাক নয়, হতবাক করে দেয়।
তবু তার জীবনের কিছু দিক আছে যা আজো অজানা। অনেকে নান চেষ্টা করেও এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি কেউ। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অজানা হচ্ছে মায়ের সাথে তার অভিমান।

যেখানেতে দেখি যাহা
মা- এর মতন আহা
একটি কথা এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
ছিনু খোকা এতটুকু,
একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন
আরাম-বিরামহীন
দোলা দিয়ে শুধাতেন, কি হলো খোকন?’
আয় তবে ভাইবোন
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধুলি শিরে লয়ে মা’র
মা’র বড় কেউ নাই
কেউ নাই কেউ নাই।
নতি করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’

মাকে নিয়ে ছোটদের জন্য এমন ছড়া লিখেছেন যে কবি নজরুল, তিনি কীভাবে মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারেন, ভেবে আজো অনেকে বিস্মিত হন।

কাজী নজরুল ইসলাম সিয়ারসোল স্কুলে থাকাকালে ১৯১৭ সালে লাহোর হয়ে নৌশেরাতে চলে যান বাঙালীর পল্টনে সৈনিকরূপে।
১৯১৯ সালের শেষের দিকে পল্টন ভেঙে দেওয়ার কয়েক মাস আগে সাত দিনের ছুটি পেয়ে তিনি তার গ্রাম চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন। ১৯২০ সালে পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর তিনি কলকাতায় কয়েকদিন থেকে আবার চুরুলিয়ায় যান। গ্রামে গিয়ে তিনি নিজের বাড়ীতে সাত আট দিন ছিলেন। ঠিক এ সময়ে মায়ের সাথে কোন এক ব্যাপারে অভিমান করে বসেন কবি নজরুল ইসলাম।
এর পরপরই তিনি চুরুলিয়া ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন।
এই যে এলেন, আর কোনদিন তিনি তার গ্রামে যাননি, যাননি মায়ের কাছে।

এমনকি মায়ের মৃত্যুর পরও না।

হুগলী জেলে বন্দী থাকাকালে যখন তিনি অনশন শুরু করেন, তখন তার অনশন এর খবর পেয়ে তার মা ছুটে আসেন চুরুলিয়া থেকে। ছেলের অনশন ভাঙাতে মায়ের আকুলতা স্পর্শ করা তো দূরের কথা, মায়ের সাথে তিনি দেখাও করলেন না। এক বুক দুঃখ নিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন নজরুলের দুর্ভাগা জননী।

কবির অন্যতম বন্ধু মুজাফফর আহমদের ভাষায়, ১৯২১ সালে কবি যখন আমার সাথে তালতলার একটি বাসায় থাকতেন, তখন একদিন তার বড় ভাই কাজী সাহেবজান ও তার চাচা প্রখ্যাত কাজী বজলে করীম সেই বাড়ীতে এলেন।
তারা দুজন মিলে নজরুলকে তার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত অনুনয় আর সাধাসাধি করলেন, কিন্তু অভিমানী নজরুল তখনও গেলেন না নিজের গ্রামে।

কিন্তু কি রহস্য ছিল এর পেছনে?

নজরুল সম্পর্কিত যত বই ও গবেষণাপত্র পড়েছি, এ থেকে অনুমান করা যায় যে, হয়ত মুসলমান সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহ, সৈনিক ক্যাম্পে যোগদান, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করাসহ এমন কিছু ব্যাপারে তার গ্রামবাসী তার পরিবারকে নানা ভাবে হেনস্তা করতো।
এসব লাঞ্চনা ও কটুক্তির কারণে তার মা হয়তো প্রকাশ্যে ছেলেকে তেমন সমর্থন ও স্নেহ করতে পারেননি।

তাছাড়া ছোটবেলায় নজরুলের দৌরাত্মে ও চঞ্চলতায় তার গ্রামবাসী অতিষ্ঠ থাকতো এবং পরবর্তীতে তার কৈশোরে নানা কর্মকান্ডে অনেকে বিরক্ত হতো। এ কারণেই কিন্তু নজরুল কাউকে কিছু না বলে একদিন গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং এরপর বর্ধমান জেলার মাথরুণ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।

এত বছর পর গ্রামে ফিরে স্বজনদের ব্যবহার আর মায়ের কোন এক কথা কিংবা ব্যবহার যা আজো অজানা- এসব হয়তো প্রচন্ড জেদী তরুণ নজরুলকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। মায়ের কাছে এমন ব্যবহার হয়তো তিনি পাননি, যা তিনি চেয়েছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম এর ছেলে কাজী সব্যসাচীর মৃত্যু হয় ১৯৭৯ সালের ২রা মার্চে। তাকে এর কয়েকদিন আগে মায়ের সাথে কবির অভিমান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কলকাতার ড. সুশীল কুমার গুপ্ত। কবির ছেলে তাকে বলেছিলেন, গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশ মূলত কবিকে গ্রাম ও স্বজন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।

প্রিয়কবি নজরুলের এমন আরও কিছু কার্যকলাপ রয়েছে যা সহজে এভাবে বুঝা যায় না।

তবে ১৯৪২ সালে কবি যে অজানা রোগে ভুগে নির্বাক হয়ে কাটিয়ে দিলেন তার বাকী জীবনটা, এ রোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেকগুলো কারণ আমি সংগ্রহ করছি। কিন্তু মায়ের সাথে কবির এমন অপ্রত্যাশিত আচরণের সাথেও যে তার ব্যাধির যোগসূত্র থাকতে পারে, তা নিয়ে কেউ ভাবেন নি।
কারণ মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার এমন এক অভিশাপ, যার প্রতিফল দুনিয়াতে ভোগ করতেই হয়। এ ছাড়া বাকী সব পাপের পরিণাম পরকালে শোধ করবেন স্রষ্টা।

কবির নির্বাক ব্যাধির পেছনে এ অভিমানের কার্যকারিতা কিন্তু তাই একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। সেইসাথে তার অমূল্য ও বিস্ময়কর প্রতিভা ও কর্মযজ্ঞও কিন্তু তুচ্ছ করা চলবে না। মানুষ হিসেবে কেউ কিন্তু ভুলের উর্ধ্বে নয়।

আমি তাই কখনো কখনো ভাবি, মাকে এভাবে অবহলো করেছিলেন বলেই কি আজ আমাদের প্রাণের কবি হয়েও কেমন যেন তিনি অবহেলিত আমাদের জাতীয় মনন ও সমাজের চেতনায়?

কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন থাকতেন মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। তার সাথে থাকতেন আফজাল উল হক, মুজাফফর আহমদ ও আকবর আলী খান। এই আকবর আলী খান কাজী নজরুল আসার আগে থেকেই এ অফিসে থাকতেন। তার কাজ ছিল পত্রিকার জন্য বিভিন্ন জেলার ছোট ছোট ভৌগলিক বিবরণ লিখে দেওয়া, তিনি প্রাথমিক শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য কিছু পাঠ্যবই লেখারও চেষ্টা করেছিলেন।

তার বইগুলোর জন্য কবি নজরুল লিচুচোরসহ বেশ কিছু ছোটদের কবিতাও লিখে দিয়েছিলেন। আকবর আলী খান কয়েকটি নাটকও লিখেছিলেন এবং এগুলোর মধ্যে ‘ভিশতি বাদশাহ’ ‘বাবর’ মোটামোটি ভাল হয়েছিল। তার বাড়ী ছিল তৎকালের ত্রিপুরা জেলাধীন আজকের কুমিল্লায়, দৌলতপুর গ্রাম্

আকবর আলী খানের স্বভাব চরিত্র নিয়ে সবাই নিন্দা করত। তিনি ছিলেন অসৎ, মিথ্যা বলতেন এবং সেইসাথে বেশ অহংকারীও। কবি নজরুলের প্রতিভা দেখে তিনিও ভিতরে ভিতরে ফন্দি আঁটছিলেন কীভাবে কবিকে বাগে আনা যায়। খেয়ালীমনা নজরুল কি আর অতশত বুঝতেন। অনাদরে লালিত নজরুল কেউ তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ দিলে তখনই তার সাথে রওয়ানা হতেন।

আকবর আলী খানও সুযোগ বুঝে একদিন কবিকে তাদের বাড়ীতে যেতে নিমন্ত্রণ করলেন, কবিও তখনই সম্মতি দিলেন। শুধু কি সম্মতি, সাথে সাথে রওয়ানাও হলেন তার সাথে। মুজাফফর আহমদ তাকে নিষেধ করছিলেন লোকটির সাথে যেতে, তবু তিনি গেলেন। কারো বারণ না শোনাই তো কবির স্বভাব।

আলী আকবর খানের এক বন্ধু সহপাঠীর নাম ছিল বীরেন্দ্রকুমার। তার বাবা ইন্দ্রকুমার ছিলেন কুমিল্লার কোর্ট সাব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। তারা থাকতেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। বীরেন্দ্রকুমারের মায়ের নাম ছিল বিরজাসুন্দরী দেবী। বীরেন্দ্রকুমারের জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীও তাদের সাথে ওখানে থাকতেন। গিরিবালা দেবী ছিলেন বিধবা, তার স্বামী বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যে নায়েবের কাজ করতেন এবং তার মৃত্যুর পরই গিরিবালা দেবী একমাত্র কন্যা প্রমীলাকে নিয়ে ভাইয়ের কাছে কুমিল্লায় চলে আসেন।

প্রমীলার ডাক নাম ছিল দুলি। তাদের আসল বাড়ী ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জে তেওতা গ্রামে। পুরো পরিবারটির আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ভালো না হলেও সাহিত্য, সঙ্গীতের একটি আবহাওয়া বিরাজ করতো তাদের পরিবেশে। মাত্র কিছু সময় অবস্থানকালে কাজী নজরুলও পরিবারটির সাথে মিশে যান এবং আলী আকবর খানের মতো তিনিও বিরজাসুন্দরী দেবীকে মা বলে ডাকা শুরু করলেন। আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্রকে তিনি ডাকতেন ‘রাঙাদা’ বলে। হাসি আর আনন্দে নজরুলও কয়েকদিন আকবর আলীর সাথে এ বাড়ীতে কাটিয়ে তারপর দৌলতপুরে আকবর খানের বাড়ীতে রওয়ানা হলেন।

নজরুলের তখন ভরা যৌবন, তার উপর তিনি কবি। যেনতেন কবি নয়, হাস্যরসে ভরপুর বিপুর প্রতিভার দাদাকবি। প্রমীলাকে কি তার তখন থেকেই একটু একটু ভালো লেগেছিল নাকি পিতৃহীন প্রমীলাকে বিধবা মায়ের সাথে আশ্রিতা দেখে করুণা হয়েছিল, নজরুল গবেষকরা এখানে একেবারে নীরব।

যাই হোক, কাজী নজরুল এখন এসেছেন আকবর আলী খানের বাড়ীতে। কুমিল্লার মুরাদনগরে দৌলতপুর গ্রামে। আকবরের মা ছিলেন সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। এমন উচ্ছৃ্খংল নজরুলকে তিনি মায়ের মতো করে আপ্যায়ন করলেন। আকবরদের বাড়ীর একটু দূরে থাকতেন তারই এক বোন। তার স্বামীও মৃত। বিধবা এই বোন নজরুলকে দেখতে প্রায়ই তাদের বাড়ীতে আসতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি জাহাজে চাকরী করে, আর মেয়েটির বয়স তখন বিয়েছোঁয়া। মায়ের সাথে এই মেয়েটিও নজরুলকে দেখতে আসতো। নাম- সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগম। চোখে চোখে তখন থেকেই প্রেমের বিনিময় শুরু হল। এক উদাস দুপুরে নজরুলের বাঁশীর সুর শুনে মেয়েটি গভীর প্রেমে ডুব দেয় নজরুলের। কবির প্রেমতরী খুব শিগগিরই ঘাটে ভিড়লো।

আকবর আলী খানের দৌড়াদৌড়িতে তাদের দুজনের বিয়ে স্থির হলো। হুট করে এভাবে বিয়ে করছে নজরুল, এমন সংবাদে তার বন্ধুরা মোটেও খুশী হলো না।
পবিত্র গঙ্গোপধ্যায় এ খবর পেয়ে একটি চিঠি পাঠালেন নজরুলকে। তিনি লিখেছিলেন, নজরুল, যখন আজ তোর এই চিঠিতে জানলুম যে তুই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে বরণ করে নিয়েছিস, তখন অবশ্য আমার কোনো দুঃখ নেই। তবে একটা কথা, তোর বয়স আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও। ফিলিংস এর দিকটা তোর অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়তো দুটি জীবনই ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে তুই যদি কনশাস, তাহলে অবশ্য কোন কথা নেই। যৌবনের চাঞ্চল্য আপাত মধূর হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়। তুই নিজে যদি সব দিক ভেবে চিন্তে বরণ করাই ঠিক করে থাকিস, তাহলে আমি সর্বান্তকরণে তোদের মিলন কামনা করছি।’’

এ প্রেম ও বিয়েকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল তখন ভাসছিলেন ভাব, উম্মাদনা ও বিচলতার সাগরে। বন্ধুদেরকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, যাকে পেয়েছি সে-ই আমার চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী। এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি যে, যা কখনো কোন নারীর কাছে হইনি।’’

এ বিয়েকে কেন্দ্র করে আরও কিছু কান্ড করেছিলেন খেয়ালী নজরুল যা তার কোন কোন বন্ধুদের কাছে শোভনীয় মনে হয়নি।
এ বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র তৈরী করেছিলেন কাজী নজরুল। এতে খানিকটা অহমিকার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন- এ নিমন্ত্রণপত্রে কাজী নজরুলকে পরিচয় দেয়া হয়েছিল ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ বলে আর তার পিতা মরহুম হাজী ফকীর আহমদকে পরিচয় দেয়া হয়েছিল ‘চুরুলিয়ার আয়ামাদার’ বলে।

নজরুলের অনুরোধে তার বিয়ের খবর ছাপা হয়েছিল মোহাম্মদী পত্রিকায়। ফলে সবার মাঝে তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আরেকটি পত্রিকা ‘বাঙালী’ তেও ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র’ নামে এটি ছাপা হয়েছিল। কবির বন্ধু মুজাফফর আহমদ এসব কান্ড দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন নজরুলকে নিয়ে। ১৯২১ সালের ২৬ জুন প্রেরিত অত্যন্ত গোপনীয় এক চিঠিতে তিনি কাজী নজরুলকে লিখেছিলেন, নিমন্ত্রণ পত্রের ভাষা দু এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু কেমন যেন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়ে অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয়নাই। আমার ভয় হয়, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও আবার না দাম্ভিক হইয়া যান।”
বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ৩রা আষাঢ় ১৩২৮ সাল বাংলা।
কলকাতা থেকে তখন ট্রেন ও লঞ্চের ধর্মঘট চলছিল, কাজেই কলকাতা থেকে তার কোন বন্ধু বান্ধব এ বিয়েতে আসতে পারেনি।

বিয়ের দাওয়াত পেয়ে কুমিল্লা থেকে বীরেন্দ্রকুমারের পরিবার থেকে তার মা বিরজাসুন্দরী দেবীসহ দশজন অতিথি এসে পৌঁছান ২রা আষাঢ়।
কিন্তু এদিকে বিয়ে যতই ঘনিয়ে আসছে, আকবর আলী খান ও নার্গিসের ব্যবহারে কেমন যেন অহংকারী মনোভাব স্পষ্ট হতে লাগল। তাদের কোন কোন ব্যবহারে নজরুল বেশ অপমানিত হলেন ঘরে। আলী আকবর খাঁ চাচ্ছিলেন যে কোনোভাবেই কবিকে করায়ত্ব করতে। তাই মনে মনে ফন্দি এঁটেছিলেন দরিদ্র ভগ্নির সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কবিকে বিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো তাকে হাত করতে। এ কাজে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত খেলে যেমন বদ হজম হয়, বেশি চিপলে লেবু যেমন তেতো হয়, তেমনি অল্পতেই সম্পর্কটা খুবই তেতো করে ফেলেন।

কবির জীবনে কোনো লাম্পট্য ছিল না। প্রেম-ভালোবাসায় তিনি ছিলেন ভরপুর। মাস খানেকের মধ্যে কবির সঙ্গে সৈয়দা খাতুনের (কবির দেয়া নাম নার্গিস) বিয়ে স্থির হয়। কবি তখনকার দিনে সাহিত্যের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আর নার্গিস গ্রামের একেবারে লেখাপড়া না জানা সাধারণ মেয়ে। তাই অতি চালাক আলী আকবর খাঁ কবিকে তার পছন্দের মেয়ে নার্গিসকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই তাকে কবির জন্য উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে তৈরি করতে রাত-দিন তালিম দিতে থাকেন। লেখাপড়া, ভালো করে সাজগোছ করা, গানবাজনা এসব আর কী।

আলী আকবর খাঁর ভাগ্নীকে অত যোগ্য বানাবার চেষ্টায় কবি কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনি জীবনে কখনো কোনো মেকি বা কৃত্রিমতা পছন্দ করতেন না। গ্রামের মেয়ে হিসেবে নার্গিস যা ছিলেন তাতেই তিনি খুশী। কিন্তু প্রকাশক অতিরিক্ত ঘষা-মাজা করতে গিয়ে কবির ভাবীবধূর ছাল-বাকল তুলে ফেলেন। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়েছিল ৩ আষাঢ় ১৩২৮, ১৮ জুন ১৯২১ ইং। বিয়ের সব দাওয়াতপত্র বিলি করা হয়েছিল।
বিয়ের কাবিননামা লেখতে গিয়ে চতুর পুস্তক প্রকাশক মারাত্মক খামখেয়ালি করে বসেন।

তিনি কাবিননামায় শর্ত জুড়ে দেন, কবি সৈয়দা খাতুন বা নার্গিসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুরাদনগরের দৌলতপুরে বসবাস করবেন। তিনি অন্যত্র গেলেও নার্গিসকে স্ত্রী হিসেবে দৌলতপুরের বাইরে নিতে পারবেন না। এমনিতেই কবি ছিলেন বিপ্লবী স্বাধীনচেতা মানুষ। বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে ঘরজামাইয়ের মতো দৌলতপুরে বসবাস করতে হবে, তিনি বাইরে গেলেও স্ত্রীকে কোথাও নিতে পারবেন না এমন পূর্বশর্ত দেখে তিনি বিগড়ে যান। প্রকাশকের ফন্দি ছিল তাকে নিজের করায়ত্বে রাখা। আর কবি ছিলেন মুক্ত বিহঙ্গ। সেখানেই বিবাদের সূত্রপাত।’’

বিয়ের অতিথি হয়ে আসা বিরজাসুন্দরী দেবীকে তিনি সব খুলে বললেন। এসব শুনে বিরজাসুন্দরী তাকে এ বিয়ে করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু বিয়ের তারিখ তো আগামীকাল। অতিথিরাও চলে আসছেন।
এখন কী করা? বাধ্য হয়ে কবি বিয়ের আকদ মজলিসে গেলেন। যথারীতি আক্দ হল। কিন্তু তারপর এল বাসর রাত। অপমানিত নজরুল অভিমানী নজরুল কী করলেন সে রাতে?


এর পরের ঘটনা সবার জানা....


এতক্ষণ হয়তো ভাবছেন, এসব কীভাবে লিখলাম, তাই সর্বশেষে কিছূ কথা

আমি এখনও একজন ছাত্র। আমার অধ্যয়নের বিষয়ের সাথে কবি নজরুলের কোন সম্পর্ক নেই। তবু ছোটবেলা থেকে কবি নজরুলের প্রতি আমার প্রচন্ড কৌতুহল। তার কাব্য কবিতা যতই পড়েছি, ততই তাকে জানতে ব্যাকুল হয়েছি। যত বই কিনেছি, পড়েছি- সবগুলোতে প্রায় একই তথ্য দিয়ে ঠাসা। তার জীবনের একটি পূর্ণ চিত্র আমি কোথাও পাইনি।

নজরুল গবেষকরা সবাই তাকে নিয়ে লিখেছেন এবং ওসব লেখায় তার ব্যক্তিত্বের চেয়ে তার কাব্য ও প্রতিভার আলোচনাই বেশী। কেউ তাকে নিয়ে লিখতে বসে নিজেদের গুণ গরিমা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। একই কথা প্রযোজ্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রবন্ধ ও রচনার বেলায়।

কাজী নজরুলের জীবন সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে বেশ কিছূ দুর্লভ ও পুরনো বই সংগ্রহ করি ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ও পুরনো লাইব্রেরী থেকে। মুন্সী জুলফিকার হায়দারের লেখা- নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় (বাংলা একাডেমী সংস্করণ-১৯৬৪), বিশ্বনাথ দে সংকলিত নজরুল স্মৃতি (সংস্করণ-১৯৭১), আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল রচনা সম্ভার (সংস্করণ-১৯৬৯) সহ বেশ কিছু বই আমার কাছে রয়েছে।

এ বইগুলো বারবার পড়ে একই ঘটনা বিভিন্ন বইয়ে মিলিয়ে যাচাই করে আমি এ তঘ্যগুলো সংকলন করছি। এ ধারাবাহিকের লেখাগুলো একটি বৃহৎ উপন্যাসের খসড়া হিসেবে সংকলিত হচ্ছে। আগামী দু তিন বছর পর হয়তো কবির জীবনের নিরেট তথ্যচিত্রের এ খসড়াগুলোর সাহায্যে একটি উপন্যাস লেখার কল্পনা ইচ্ছায় রূপান্তরিত হতে পারে।

কবির জীবন ছিল রহস্যময়। কবির জীবনছিল দুঃখঘেরা। নির্মম তিরস্কার আর কটুবাক্য কবির পেছনে লেগেছিল জীবনভর। কবির জীবনের কিছূদিক এমনও রয়েছে যা মেনে নেয়া কঠিন। একজন মানুষ হিসেবে এ ভুল তার জীবনে খুবই স্বাভাবিক।

যারা কবিকে একদম সাধু দেবতা করে হাজির করতে চান, তারা এক্ষেত্রে লুকোচুরি কিংবা মিথ্যার আশ্রয় নেন। একথা অনস্বীকার্য সত্য যে, কবি নজরুল ইসলামের প্রতিভা তার এ সবগুলো ভুল ও খামখেয়ালী ছাপিয়ে সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে। বিদ্রোহী কবিতার উৎসমুখ আমাদের কবি নজরুলের এসব দিক তাই আমার কাছে বিস্ময়ের।

আমি শুধূ কবি নজরুলকে ভালোবাসি না, ভালবাসি তার ব্যক্তিত্বকেও। শুধূ কাব্য প্রশংসা করে তাকে নিয়ে মেতে থাকলে কেমন যেস স্বার্থপর স্বার্থপর মনে হয়। কবি তার ব্যক্তিগত জীবনেও এসব পছন্দ করতেন না। তার প্রিয় এক বন্ধূকে তাই বারণ করেছিলেন তার মৃত্যুর পর যারা তার গীত গেয়ে বক্তৃতার বুলি আওড়াবে- সেসব অনুষ্ঠানে যেন তিনি না যান।

কবির জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে হিন্দু মুসলিম প্রসঙ্গ একেবারে স্বাভাবিক। তার সাথে এ দু জাতির ব্যবহার সম্পূর্ণ প্রশংসনীয় ছিল না। অসাম্প্রদায়িক ভাবে লিখতে গেলেও এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমি তাই একজন দর্শকের ভূমিকায়।

নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সেকালের কবির চারপাশের মুসলিম ও হিন্দুদের আচরণগুলো উল্লেখ করতে চাই এ সংশ্লিষ্ট পর্বে। মনে রাখতে হবে, এত বছর পর আজকের এখন এই সময়ে এসে সেসব নিয়ে আহত কিংবা হুজুগে হওয়ার কোন অবকাশ নেই। এখানে আমরা নির্বাক দর্শক। কবিকে নিয়ে ব্যবসা করার মতো লোকেরও অভাব হয়নি, কবির জীবদ্দশায় এবং কবির মৃত্যুর পরও। কাজেই নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলেও সত্যকে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়।

জাতীয় কবিকে নিয়ে লেখা যেমনি গৌরবের, তেমনি ভয়ের। কাজেই আস্থা ও নিরপেক্ষতা এখানে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সেজন্যই এ কয়েকটি কথা লেখা।


সংকলন- তামীম রায়হান

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১২ রাত ২:৫৪
১১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×