somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্প: কাগজের পৃষ্ঠা

০২ রা অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
.
বারান্দায় সূর্যের আলো মুখমন্ডলে পড়তেই এক প্রফুল্লতা বিরাজ করে আমার। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে উড়ন্ত পাখির সাথে তুলনা করতে কোন কমতি নেই আমার। প্রভাতের রোদ মাখা আলোয় চোখ বন্ধ করে এক প্রশান্তির নিশ্বাস নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে অনুধাবন করি দীর্ঘ চলে যাওয়া দিন সময় গুলোকে নিয়ে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি মাত্র। রঙ্গিন মলাট খুলে উপস্থাপনের সহিত নিজেকে তৈরি করার দরজায় পা বাড়াই। ক্যাম্পাসে সবাই যখন আড্ডাতে ব্যস্ত তখন আমি একটু দুর থেকেই খেয়াল করলাম জাহেদের কবিতা…
.
“নিষ্পেষিত দেহে রাত্রির নির্জনে আলোর রেখায়
তোমার নীল চোখের আঁকা যে ছবির সাক্ষাত পেয়েছি
অন্তহীন নিশ্বাসের ভিড়ে ততবার হয়েছে আমার নিশ্চুপ অবসান”
.
কবিতাটা শুনেই জাহেদের দিকে একটু ভালো করেই তাকালাম। প্রথম প্রথম ছেলেটাকে কেমন যেন ভ্যাবলা টাইপের মত মনে হতো। সব সময় জিন্স প্যান্টের সহিত পাঞ্জাবী পড়ে থাকে। কবিতা লিখে, আবৃত্তি করে। আমার জানালার রোদমাখা আলোর মত আমাকে ভাবান্তরিত করতে একটা নতুন অধ্যায় সামনে হাজির হয়। যার সান্নিধ্যতে অনেক দুর পথ অতিক্রম করা যায় বা অলস ছায়া আকর্ষিত বা গ্রাস করতে সাহস পায় না। আর যদি করেও সেই শত রং এর কবিতা দিয়ে অলসতাকে বন্দি করা যায়। এই কবিতার রেশ ধরেই জাহেদকে নিয়ে জানার আগ্রহ জাগতেই জানতে পারি সে আমার একমাসের ছোট। কেমন যেন একটা শূন্যতা ভর করে আমার রোদমাখা আলোর মাঝে। জীবন অতিক্রম হওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে আবিষ্কার করে, সন্নিকটে হাজির হওয়া চ্যাপ্টারটা ক্লোজ করে দেই। বন্দ করে দিতেই স্ব চেহারায় এক ধুসর আভা ফুটে উঠে। দিন অতিক্রম হতে থাকে। দিন দিন এই কবিতা যখন আমার শ্রবনে প্রবেশ করে তখন আবার বন্দ করে দেওয়া চ্যাপ্টারটা খুলে দেই। তার কবিতার অনুভুতিতে হারাই। হোক না সে একমাসের ছোট।
.
ক্লাসে চুপ করে বই পড়ছিলাম তখন জাহেদ আমার কাছে এসে এহেম করে কাশি দিয়ে জানায়…
“আমি গতকাল আসি নি। জেনিয়া তোমার কাছে গতকালকের নোটগুলো হবে?
আমি বই থেকে মুখ তুলে জাহেদের দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকি। তারপর একটু রাগান্তি সুরে বললাম..
“প্রথম কারো সাথে কথা বললে আপনি করে বলতে হয়।
জাহেদ কি বলবে বুঝতে পারে না। একটু অবাক হয়েই বললো…
“আমরা একি ক্লাসের সেই হিসেবে তো বলতেই পারি।
আমি বসা থেকে উঠে তার দিকে ফিরে বললাম…
“তুমি আমার একমাসের ছোট। তাই আমাকে আপনি করে বলবে। কথা কানে গেছে?
“তাই? আপনি দেখছি আমাকে নিয়ে অলরেডি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছেন। হা হা হা।
.
আমি আর কিছু বলার সাহস পাই না। আমতা আমতা করে চুপ থেকে লজ্জার সহিত চুল কানে গুজে জাহেদকে নোট দিয়ে দেই। সেদিনের কথোপকথনের পর থেকেই সে আমাকে “আপনি আর আপু” বলে সম্মেধন করে। জাহেদ যেদিন ভার্সিটিতে আসতে পারে না তার পরদিনই আমার কাছ থেকে নোট নেয়। আমিও তেমন কিছু বলি না। কিছু বলতে গিয়েও যেন আটকে যাই। জীবনের আলো আর আঁধার সংমিশ্রত পথে এই অধ্যায়টা ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে…
.
দুই
.
দুর্বার গতিতে সময় এগিয়ে রাতের শহরের আবছায়া ছড়িয়ে পড়ে। নিস্তব্দ রাতে অনুভুতিরা হাজার গুন বেড়ে গিয়ে মানুষের অন্তরে ঘুরপাক খায়। সেই নিস্তবদ্ধের অনুভুতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে খানিকের আবেগে একে অপরের ভালো লাগা জানায়। মানুষ সেই অনুভুতির রং এ নিজেকে লাল নীল হলুদের মাঝে ভাসাতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে নীল রং গুলো বিষাদের রুপ নেয়। নীল এমনিতে বিষাদরেখা। যে অনুভুতিতে বিষাদ রেখা বিরাজ করে সে সম্পর্ক গুলো বেশি দুর পর্যন্ত যেতে পারে না। মাঝ পথেই যেন চাকার পাম ফুরিয়ে যায়। আমি অনুধাবন করে আমার ফেইসবুক আইডিতে আফরিন নামের এক অজানা ছায়ার বার্তা দেখি…
.
”আমি কি আপনার কবিতার পাঠক হতে পারি?
মনের অবচেতন কাটিয়ে নিশ্ব ছেলের মত রিপ্লে দিলাম..
“একটু ভাবতে হবে।
.
ঘন্টাখানেক বাদে আফরিন রাগের ইমো সেন্ড করে রিপ্লে দেয়…
”ভাবনার সমাপ্তি হয়েছে আপনার?
আমি হাসতে লাগলাম। রাগের ইমো দেখে মনে হচ্ছে সে রেগে আছে। নিশ্চয় সে নিজে নিজে বক বক করছে…ছেলের ভাব দেখো। নিজে থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছি আর বলে একটু ভাবতে হবে… নিশ্চয় সে এখন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ক্যান্সেল করে দিবে। আমি রিপ্লে দিলাম…
“আলোর স্পন্দন ভাঙ্গা জানালায় উকি দিয়েছে। আমার অখাদ্য কবিতা পড়ার আগ্রহটা জানতে পারি?
.
আফরিন কি উত্তর দিবে হয়তো তা ভাবছে। সে টাইপ করতে থাকে যা আমি মেসেঞ্জারে বুঝতে পারছিলাম। সে হয়তো এখন লিখবে… আপনার অনেক ভাব নাহ? ইন্টারভিউ নিচ্ছেন নাকি? আরে বাবা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করলে করেন, না করলে ক্যান্সেল করে দেন। এতো ভাব নেওয়ার কি আছে?... কিন্ত এই গুলা সেন্ড না করে আফরিন রিপ্লে দেয়…
“আপনি কি সব সময় কাব্যিক ভাষায় কথা বলেন জনাব জাহেদ সাহেব?
আমি মনে মনে হাসলাম। তারপর রিপ্লে দিলাম।
“যাক বাবা অন্যকিছু বলেন নি।
“মানে বুঝি নি।
“না মানে আমি ভাবছিলাম আপনি আমার ভাব টাব নিয়ে কথা বলবেন। অনেকে বলে তো তাই।
“একটা সত্যি কথা বলি?
“বলুন।
“আমি কিন্তু সত্যি সত্যি শালা বলে বকা দিয়ে টাইপ করেছি। লিখেছিলাম… শালা তোর এতো ভাব কেন? কবিতা লিখিস বলে নিজেকে অনেক কিছু মনে করিস? লাগবে না তোর ফ্রেন্ড রিকু একস্পেট করা। মেসেজ সেন্ড করে আপনাকে ব্লক দিয়ে দিতাম। হি হি হি। কিন্তু ব্যাকস্পেস চেপে মুছে ফেলেছি। যাই হোক আপনার কবিতা গুলো কিন্তু পড়তে মন্দ লাগে না। সব সময় কি কবিতা নিয়েই পড়ে থাকেন? এতো কবিতা মাথায় আসে কি করে?
.
আফরিনের রিপ্লে দেখে আমি হাসির ইমো সেন্ড করে লিখলাম…
“আমি রঙিন মলাট নই। রোদ মাখা কাব্য আমার ঝুলিতে নেই।
“হি হি হি। রোদ মাখা কাব্য এটা আবার কেমন?
“যে কাব্য নগরীর বুকে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে যায়।
.
তারপর থেকেই কথার ঝুলিতে আবদ্ধ হয়ে সময়ের রঙ পরিবর্তনের কথায় ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকি। বন্ধুত্তের কাতারে এসে আপনি থেকে তুমিতে আসতে বেশি সময় লাগেনি আমাদের। কল্পনার চ্যাটে নির্জন রাতে তারা জ্বলিত রাত দেখা, হলুদ ল্যাম্পোষ্টের আলোতে হাটা, আফরিন চা বানিয়ে তার পিক পাঠিয়ে বলে খাবে চা? সব পূর্ণতার গল্প আশির্বাদ হয়ে আমাদের চ্যাটে আবদ্ধ হয়। কিন্তু আমাদের মাঝে কখনো দেখা হয়না। ছবিহীন প্রোফাইল আফরিনের। মেসেঞ্জারেও কেউ কাউকে কল দেই না। একটা ইগো কাজ করে আমার। ফোন করলে সে অন্য কিছু মনে করতে পারে। ফেইসবুকের বার্তাতেই আমাদের আঁকা ছবি গুলো সীমাবদ্ধ থাকে। নিস্তব্দের রাতের অনুভুতির ভুতরা আমাদের ভর করে…
.
তিন
.
বাসটা থামলে জাহেদ উঠেই আমাকে দেখতে পায়। পরক্ষনেই জাহেদ চোখ সরিয়ে অন্যদিকে মুখ করে ফেলে। আমি ব্যাপারটা দেখে বললাম…
“নিজেকে লুকানো হচ্ছে তাই না? না দেখার ভান করছো?
কথা শুনে জাহেদ আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন এক্ষনি দেখেছে একটা ভাব। বাসে দাড়িঁয়ে একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে..
“আরে আপনি জেনিয়া আপু?
.
আপু ডাকটার প্রতি এলার্জি না থাকলেও জাহেদের কাছ থেকে যখন এই শব্দটা প্রকাশ পায় আমি বিষয়টা মেনে নিতে পারি না। সব কথার শেষে আপু শব্দটা জুরে দিবে। নিজেই নিজেকে শান্ত করে চুপ করে থাকি। আড়াল চোখে জাহেদের দিকে তাকিয়ে দেখি এই শৈত্য প্রবাহের মাঝেও একটা পাঞ্জাবী, জিন্স প্যান্টের সহিত পড়াহিত অবস্থায় ভার্সিটিতে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত হয়ে আমি বললাম…
“এই ছেলে তোমার শীত লাগে না?
“শীত আমাকে পছন্দ করে না আপু। না হলে স্পর্শ করতো, আপু”
.
আমি খুব শান্ত ভাবেই তাকে ছাগল বলে সম্মেধন করি। জাহেদ হাসতে থাকে। হাসি দেখে আমার রাগের অনুভুতি তীব্র ভাবে বাড়তে থাকে। কিন্তু বাসের ভিতর এতো গুলো লোকের মাঝে এই রাগের অনুভুতি প্রকাশ করতে চাই না। তবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাসির উত্তর দিয়ে বললাম…
“রোদের পর একটা সময় কিন্তু ছায়া আসে জানো তো?
জাহেদ একটু ভেবে মাথা চুলকিয়ে বললো…
“দেয়ালে আবদ্ধ অন্ধকার ঘরে রোদ আর ছায়া দুটোই ভেদ করতে পারে না জেনিয়া আপু।
.
আমি আর কিছু বলি না। সব বাক্যের শেষে আপু ডাকটা শুনতে চাই না আর। কি ভাবে নিজেকে এই ছেলে? নিশ্চুপ হয়ে বাসের জানালায় তাকিয়ে শহরের ভোরটা উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই শহরের সকালের ঠান্ডা বাতাস চলতে থাকা সময়কে কিছুটা হলেও থমকিয়ে দেয়। একটু পরেই পাশে বসে থাকা লোকটা নেমে গেলে জাহেদ আমার পাশে বসে। কিছুক্ষন বাদে জাহেদ সামনের সিটের নিচ থেকে একটা ডায়েরী পেয়ে পাতা উল্টিয়ে পড়তে থাকে। একটা পর্যায়ে জাহেদ কনট্রাকটারকে বলে গাড়ি থামিয়ে আমার ভাড়াটাও দিয়ে নেমে যায়। আমি কিছু বুঝতে পারি না হঠাৎ নেমে যাচ্ছে কেন?। কি মনে করে আমিও তার পিছন নেমে যাই। কেন নেমেছে জিজ্ঞেস করলে জাহেদ বলে একটা অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে যাচ্ছি। আপনি নেমেছেন কেন? ভার্সিটিতে চলে যান। তার কথার প্রতুত্তর না দেয়াতে ডায়রীটা আমার ব্যাগে রাখতে দেয়। তারপর একটা রিক্সা নিয়ে মিনিট বিশেক পর একটা দুতলা বাড়িতে যাই। দুতলা বাড়িতে যাওয়ার আগে আমি রিক্সায় বসে ডায়েরীটা পড়তে থাকি। দরজা নক করার পরবর্তীতে এক ভদ্রলোক দরজা খুলতেই জাহেদ বলে…
“আপনি মুরাদ সাহেব?
লোকটা হ্যাঁ সূচক ইশারা দিতেই জাহেদ আবার বললো…
“ভিতরে গিয়ে একটু কথা বলা যাবে?
অবাক বিষ্ময়ে ভিতরে যাবার আমন্ত্রন জানায় মুরাদ সাহেব। বিয়ের মাস খানেক পর ঝগড়া করে মুরাদ সাহেব তার বাবা মা থেকে আলাদা থাকে। একটা সময়ে উপলব্দি করে তাদের ভালোবাসা। কিন্তু লজ্জায় তাদের সামনে যেতে পারে না। এ সব কিছু ডায়েরীর পৃষ্টায় লিখে রাখে আর অযোগ্য সন্তান মনে করে নিজেকে। জাহেদ আমার দিকে তাকিয়ে মুরাদ সাহেবকে বললো…
.
“আমি কিছু কথা বলতে চাই একটু সময় দিবেন? আমার মা নেই। আমার মায়েরা দু বোন ছিল। মা ছিল ছোট। খালা বোবা ছিল বলে অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেও বাতিল হয়ে যেত। এই বিষয়টা একটা পর্যায়ে খালা আর নিতে পারে নি। আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। এই জীবনের বেড়াজালে একটা অপূর্ণতা খালাকে ভর করে। বছর খানেক পর আমার জন্ম হয়। আমার জন্মের পর আলোর প্রতিচ্ছবি চারপাশে ছড়িয়ে যায়। আমি আমার মায়ের গর্ভে জন্ম নিলেও আমার খালার কাছে আমি বড় হয়েছি। জন্মের কয়েক দিন পরই নাকি খালা আমাকে দেখতে এসেছিল। সারাদিন আমাকে তার কাছে রাখতো, আমাকে নিয়ে খেলতো। কয়েক মাস পর পর খালা আমাদের বাসায় আসতো শুধু আমার জন্য। আমার বয়স যখন নয় মাস একদিন খালা রাতের আধাঁরেই নাকি চুরি করে আমাকে নিয়ে যায়। আম্মা তো কান্নাকাটি। পরে খালার সাথে অনেক চিৎকার চেচামেচি করলে খালা আম্মাকে আকার ইঙ্গিতে হাউ মাউ করে বলেছিল… কয়েক মাস পর পর গিয়ে তোর ছেলেকে আমার বুকে জড়িয়ে রাখতে ভাল্লাগে না। তোর ছেলেকে আমি একেবারের জন্য নিয়ে আসছি। আমি ওরে আমার বুকের মাঝেই রেখে দিব। খালাকে অনেক বুঝানোর পরে আম্মার কাছে আমাকে দিয়ে দেয়। এর পর থেকেই নানা খালাকে আর আমাদের বাসায় আসতে দেয়নি। বছর পাঁচেক পর আমাদের ঘরে আরেকজন অতিথির আগমনের সময় আসে। সেই আগমনে আমরা তিন থেকে চার হওয়ার স্বপ্নটা বিধাতা কেন যেন পূর্ণতা করতে দেয়নি। আমাদের কল্পনার ঘরের আলোটা জানালা দিয়ে বিলিন হয়ে যায়। আমার মা আর আগমন হওয়া অতিথি একসাথেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে।
.
এইটুকু বলে জাহেদ কান্না করতে থাকে। আমি স্তব্দ হয়ে চুপ করে থাকি। মুরাদ সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগেই জাহেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জল মুছে আবার বলতে থাকে…
.
“আপনি হয়তো একটু অবাক হচ্ছেন কেন আমি আপনাকে এইগুলা বলছি। মা মারা যাওয়ার পরে খালা আমাকে তার কাছে নিয়ে যায়। এর পরে খালা আর কারো কথা শুনে নি। দরজা বন্ধ করে রাখতো আমাকে নিয়ে। বাবা আমাকে নিতে আসলে খালা ফিরিয়ে দেয়। তারপর থেকেই আমি খালার কাছে থেকে গেছি। ছোট ছিলাম তো তখন নাকি অনেক কান্নাকাটি করতাম। এ সব কিছু আমার নানা নানির কাছ থেকে শুনেছি। এতো কিছু মনে নেই। বাবা আমাকে মাঝে মাঝে দেখে যেত। মানুষ একাকীত্ব জীবন নিয়ে সময় পার করতে পারে না। সবাই এই ধৈর্যটা অর্জন করার ক্ষমতা রাখে না। আমার বাবা নতুন সংসার সাজায় নতুন কাউকে নিয়ে। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। তার নতুন সংসারের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। অন্তমিলের বিশাল শহরে আমার খালা আমাকে তার সন্তানের মতই বড় করে তোলে। কিন্তু জীবনে না পাওয়া কোন অব্যক্ত ব্যথা তাকে আকড়ে ধরে ছিল। লোক দেখানো ভালো থাকার অভিনয় করে এই শহরের মানুষের মাঝে বেঁচে ছিল। তার মনের ভিতরও একটা শূণ্যতা জায়গা দখল করে ছিল যা আমি বুঝতাম। গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এই শূন্যতার শোকে খালা ইন্তেকাল করে। যে শোক তার মনের ভিতর তিলে তিলে ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমার খালা আমাকে তার নিজের সন্তান বলেই সবার কাছে পরিচয় দিত। বাবা মায়ের কাছে সন্তান কখনো অযোগ্য হয় না। তাদের কখনো স্যরিও বলতে হয়না। শুধু কাছে গিয়ে কান্নাশিক্ত চোখ নিয়ে দাঁড়লেই তারা হয়তো বুঝতে পারবে তাদের সন্তান ভালো নেই। আপনাকে এইগুলা বলার একটাই কারণ, আলাদা হয়ে নিজে কষ্ট পাচ্ছেন আর তাদেরও কষ্ট দিচ্ছেন। আমার বিশ্বাস ডায়েরীতে কষ্ট গুলো তুলে না ধরে তাদের নিকট পেশ করবেন যে আপনি তাদের ছাড়া ভালো নেই।
.
কথাটা শুনেই মুরাদ সাহেব কি বলবে বুঝতে পারে না। একবার জাহেদের দিকে তাকায় আর একবার আমার দিকে তাকায়। জাহেদকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে। আমি মুখ ফিরিয়ে চোখের কোনের জল মুছে জাহেদকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই। হঠাৎ করেই ছেলেটার প্রতি একটা ভালো লাগা ছুয়ে যায় আমার। এই ভালো লাগার কারণ আমি বুঝতে পারি না। ডায়েরীটা দিয়ে দুজনেই বের হয়ে পড়ি…
.
চার
.
রাতের শীতল বাতাস খোলা জানালায় প্রবেশ করতেই ক্ষিপ্ত মনোভাবে জানালাটা বন্দ করে দিলাম। অনাবিল আকাশে নিস্তব্দ রাতের শহরে যান্ত্রিকতার শব্দ থেকে কিছুটা হলে রেহাই পাওয়া যায়। চারপাশ কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে যায়। মনে হয় মানুষের সাথে সাথে পৃথিবীও ঘুমিয়ে গেছে। এই ঘুমিয়ে থাকা পৃথিবীতে মানুষের কত স্বপ্ন আশা অপেক্ষায় ঝুলে থাকে। কারো কারো অপেক্ষাটা পরিপূর্ণতা লাভ করে শূন্য পথের আশির্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। সারাদিনের ক্লাস, আড্ডা, কবিতা লিখার অবসান কাটিয়ে আফরিনকে নেটে দেখে আমি টেক্সট দেই…“কি করা হচ্ছে?” মেসেজের টুং করা শব্দ শুনে আফরিন রিপ্লে দেয়…
“ঠান্ডা বাতাস থেকে বাচার চেষ্টা। তুমি কি করো?
“ভাবছি।
“কি ভাবো শুনি।
“তোমার সাথে দেখা করার কথা।
“আমি তো অদেখা জনাব। দেখলে ভয় পাবা।
“আমি না হয় ভয়কে জয় কের নেব। শুক্রবার দেখা করা যাবে?
“না।
.
আমি পুনারায় অনুরোধ করলে আফরিন রাজি হয়। মুখ ঢাকা অবস্থায় চট্টগ্রামের ডিসি হিলে আফরিন দেখা করে। কেমন আছো? আসতে অসুবিধা হয়নি তো এ সব জিজ্ঞেস করলে আফরিন মাথা নেড়ে উত্তর জানায়। আমি কি বলবো কথা খুঁজে পাই না। “চুপ কেন? চ্যাটে তো অনেক কথা বলো” এসব উক্তি শুনেও আফরিন কিছু বলে না। চুপ থাকা দেখে আমি বললাম… “আচ্ছা যে আমার কবিতা পড়ে, সে আসলে কেমন? কেমন করে হাসে? কেমন করে আমার কবিতা গুলো পড়ে? তাকে না দেখেই বাসায় ফিরতে হবে” আফরিন কিছুক্ষন চুপ করে থাকে একপর্যায়ে তার চেহারাটা দেখায়। আমি অবাক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকি। প্রশান্ত পথে যে নির্ভুল গল্পের তৈরি হয়েছিলে নিমেষেই যেন তা অসমাপ্ত হয়ে অপ্রাপ্তির খাতায় জায়গায় দখল করে। বসা থেকে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বললাম “জেনিয়া আপনি?” জেনিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত হয়ে বলে “আমার পুরো নাম উম্মে জেনিয়া আফরিন। আমি জানি এমনটা করা উচিৎ হয়নি জাহেদ। আমি কি করবো? তোমার কবিতাগুলোতে একটা পাগলাটে সৌরভ ছিলো যা আমাকে নিত্যদিন শিহরতি করেছে। ভাবান্তরিত করেছে।” আমি কি বলেবো কিছু বুঝতে পারি না। অভিমান আর রাগে একটা তীব্র ঘৃনা নিয়ে আমি চলে যাই…
.
পরিশিষ্ট
.
আকাশের কালো মেঘ উড়ে যায়। দিন বদলায়। অনুভুতির গভীরে যন্ত্রনার সুরে জাহেদের মনে প্রতিহিংসা জন্মায়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে যান্ত্রিক শব্দের মাঝে নিজেকে তুচ্ছ মনে করে। এই শহরের অনুভুতিগুলো মানুষের মনের ভিতর বাস করে। সেই অনুভুতির মাঝে কত কিছু লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে থাকা অনুভুতি বেওয়ারিশ হয়ে ঘুরে বেড়ায় একেক জনের ভিতর বিভিন্ন রুপ ধরে। জাহেদ ভার্সিটিতে গেলে জেনিয়ার সাথে কথা বলে না। যেদিন ভার্সিটিতে অনুপস্থিত থাকে তার পরের দিন জেনিয়ার নিকট থেকে আগের মত নোট নেয় না। এই সব দৃশ্য জেনিয়ার মনে একটা অপরাধ কাজ করে। জেনিয়া কথা বলতে চাইলে জাহেদ এড়িয়ে চলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জেনিয়ার অনুশোচনায় চোখে জল চলে আসে। দশদিন অতিক্রম হয়। জাহেদ ছাদে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে করো প্রতি ভালো লাগা কাজ না করলে এমন পাগলামো কেউ করে না, এই রকম অনুভুতি প্রকাশ করে না। মানুষের অনুভুতি প্রকাশ করা সব এক রকম নয়। অনুভুতি গুলো বিভিন্ন ভাবে একে অপরের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এইগুলা ভাবতেই জাহেদ এই শহরের অসমাপ্ত গল্পকে একটা পরিপূর্ণতা দিতে পা বাড়ায়। জেনিয়ার বাড়ির গেইটের কাছে গিয়ে কিছুক্ষন পায়চারি করে। একটু পর জেনিয়াকে টেক্সট দেয় “একটু নিচে আসবে? অপেক্ষা করছি।” পনেরো বিশ মিনিট পর জেনিয়া নেট অন করলেই টুং করা মেসেজের শব্দতেই বার্তা পড়ে বারান্দায় একবার দেখে শাল গায়ে দিয়ে নিচে যায়। দুজনে চুপ করে থাকে। নিরবতা ভেঙ্গে জেনিয়া বলে “অনেক্ষন অপেক্ষা করছো, ফোন করলেই পারতে।” জাহেদ খুব শান্ত ভাবেই বললো “নাম্বার নেই” তারপর দুজনেই আবার চুপ হয়ে যায়। জেনিয়া যেই বলতে যাবে “আমি স্যরি, বিষয়টা এই রকম পর্যায়ে চলে আসবে বুঝতে পারিনি।” কিন্তু তার আগেই জাহেদ ইতস্ততার সহিত বললো… “তুমি কি আমার কাগজের পৃষ্ঠা হবে? আমার অখাদ্য কবিতাগুলো সেই পৃষ্ঠায় লিখবো।” জেনিয়া কি বলবে বুঝতে পারে না। চোখে জল আসে। একটা কান্নার গোংরানী দিতেই জাহেদ সাহস করে কাপা কাপা হাতে চোখের জল মুছে দেয়। জেনিয়া চুপ করে জাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহেদ ও তাকিয়ে থাকে। এই শহরের রাতের আলোয় রাত্রির নিরবতায় জাহেদ আবার পুনরাবৃত্তি করে বলে… “হবে আমার কাগজের পৃষ্ঠা ?”জেনিয়া শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেয়। জেনিয়ার হ্যাঁ সূচক ইশারাতেই এই শহরের বুকে আরেক নতুন কাছে আসার গল্পের অধ্যায় শুরু হয়। যে অধ্যায়ের নাম কাগজের পৃষ্ঠা…
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:২২
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×