somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্প: জলশব্দ

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইবনাতের সাথে আমার প্রেমটা হয়ে উঠে না। এই না হওয়ার কারনটা হচ্ছে ওর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। আমি প্রায় ভাবি ওর প্রেমে কি আমি পড়ে গিয়েছি? ভালোবাসার মধ্যে একটা ভয়াবহ আকর্ষন আছে যা মানুষকে অদ্ভুত ভাবে কাছে টানে। অন্ধ কবির মত আমার ভিতরে এই চমৎকার মানবীর প্রতি ভালোবাসার আকর্ষনটা কখন জন্ম নিল আমি তা কখনো বুঝে উঠতে পারি না।ভার্সিটির একদম উত্তর দিকের জায়গাটা আমার খুব পছন্দের।ভয়ংকর ব্যাপার এই জায়গাটায় আসলে আমার কেন যেন খুব শান্তি লাগে।এই জায়গাটায় বসে ইবনাতকে একদিন খুব গভীর হয়ে ইতস্ততার সহিত বলেছিলাম “অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো তোমার ছোট ছোট চোখ গুলার মাঝে আমি যখন তাকাই একটা শুভ্রতার ছোয়া আমার মাঝে বিরাজ করে।” সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে থেকে বললো “তোমার মাথা ঠিক নেই। তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো জাহেদ। আমাকে এমন করে কেন বলো তুমি? আর এমন করে বলো না কেমন?” আমি অনুতপ্ত হয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হাসছিলাম কিন্তু আমার ভিতরে এই মানবীর জন্য যে কাব্য তৈরি হয়েছিল সেটা কি সে বুঝতে পেরেছিল?

মানুষ বৃষ্টির মাঝে ভিজে কি অনুভূতি উপলব্দি করে আমি ভেবে পাই না। গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি কাশি বানিয়ে কি একটা অবস্থা হয়েছে আমার।সারা রাত ধরে এই সর্দি কাশির জন্য আমার একটুও ঘুম হয়নি। আমি অনুধাবন করি কি আছে বৃষ্টির মাঝে যা মানুষকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে পারে? মাঝে মাঝে ইবনাত টুকটাক খাবার এনে আমাকে খেতে দেয়। এতে ওর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার কেন যেন মনে হয় ওর প্রেমে পড়ার মাঝে এই খাবার হচ্ছে একটা কারন। গতপর্শু ক্যান্টিনে বসে রুটি আর আলু ভাজি খাওয়ার সময় বললাম “এমন করে কেউ রান্না করে?” সে ইতস্ততা করে বললো “কেন ভালো হয়নি?” আমি রুটি আর আলু ভাজি মুখে দিয়ে বললাম “খাবারের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।” সে বললো “খাবারের প্রেমে পড়লে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ভুলে আমার প্রেমে পড়ো না ঠিকাছে?” আমি তখন চুপ করে খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।আমি ওর মুখে তেমন হাসি দেখতাম না কখনো। আর এই হাসিমাখাহীন মেয়েটার নাকি বৃষ্টি পছন্দ। বৃষ্টির মাঝে নাকি একটা আলাদা অনুভূতি আছে। যারা বৃষ্টিকে অনুভব করতে পারে তাদের মনটা নরম হয়। তারা এই বৃষ্টির ছোয়ায় ভিতরের ধুসর ছায়াকে মুছে ভালোবাসার এক নতুন আকাশকে নিজ হাতে ছুয়ে দিতে পারে। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় আমি যখন বৃষ্টিতে ভিজলাম আমার এমনটা একদমি মনে হয়নি।আমার মনে হয়েছে আমার ভিতরটা অনেক কঠিন অনেক।

সর্দি কাশি বাধিয়ে ভার্সিটিতে যখন আসলাম ইবনাত আমাকে দেখে বললো “কি হয়েছে? আজ শাল গায়ে দিয়ে আসছো?” আমি একটা হাঁচি দিয়ে নাকের পানি মুছে বললাম “তোমার বৃষ্টিকে বুঝতে গিয়ে এমনটা হয়েছে।খচ্চর মার্কা একটা বৃষ্টি।” সে আমার কথা শুনে হাসতে লাগলো। আমি নাকের পানি মুছতে মুছতে চুপ করে উদ্ভেগপূর্ণের মত ওর দিকে তাকিয়ে আছি।মাঝে মাঝে ও যখন হাসে আমার ভিতরে কি যেন একটা বয়ে যায়।এই হাসিটার জন্য আমি কেন যেন প্রায় অপেক্ষায় থাকি।তার হাসি যখন আমি দেখি তখন সকালের মিষ্টি রোদের মত মনে হয় যেন এই রোদের হাসিটা আমার শরীরে মাখিয়ে দেই। সে হাসতে হাসেত বললো “তোমাকে বুঝতে কে বলেছে শুনি? পাগল। চলো ক্যান্টিনে গরম গরম চা খাবে। তুমিও খাবে আমাকেও খাওয়াবে।” মহারানীর যাহা হুকুম বলে ওর সাথে গরম গরম চা খেতে যাই। আমি চেয়ারে বসতেই ও রাশেদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে কি যেন বললো। রাশেদ ভাই এই ক্যান্টিনের লোক। ইবনাত আমার জন্য রং চা আর ওর জন্য দুধ চা এনে চেয়ারে বসতে বসতে বললো “আমার মনটা গতকাল রাত থেকেই ছটফট করছে জানো? কতদিন গ্রামে যাইনা। সামনের শুক্রবারে গ্রামে যাবো। মায়ের কবরটা দুর থেকে দেখে জিয়ারত করে আবার চলে আসবো।” আমি চুপ করে থাকি। গ্রামের কথা আর ওর মায়ের কথা শুনে আমার ভিতরটা ধক করে উঠে। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার চুপ থাকা দেখে ও চায়ে চুমুক দিয়ে বললো “একটা ব্যাপার কি জানো, আজকাল প্রায় রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।আমি মাঝ রাতে উঠে নিভো আলোয় চুপ করে বসে থাকি। ঘুমের মাঝে মনে হয় বিশাল একটা পাথর আমার বুকের উপর চাপা দিয়ে আছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারি না।এমনটা কেন হয় জাহেদ? আমি মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবো না।” আমি একটা কাশি দিয়ে বললাম “খবরদার এমন কথা কখনো আর মুখে আনবে না। এমন কথা আর একবার যদি মুখে এনেছো আমি কষে তোমার গালে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিব তখন।” ও আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। আমি জানি ভার্সিটিতে যদি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কেউ হয়ে থাকে নির্গাত সেটা আমি। আর কিছু না ভেবে নাকের পানি মুছে চা খেতে থাকি।

ইবনাতের কথা একটু করে বলি। ও তখন অনেক ছোট। ওর মায়ের প্রায় বুকে ব্যথা হতো। ব্যথায় নড়তে পারতো না। না পারতো বসতে, না পারতো ঠিক মত উঠতে। এই ব্যথাটা দিন দিন বেড়েই চলছিল।কিন্তু একটা পর্যায়ে হার্টে ব্লক ধরা পড়ে।কিন্তু ওর বাবা তেমন একটা গুরুত্ব দিত না। ওর মা ওকে রাতে জড়িয়ে বলতো “আম্মা আমি যদি তোমার কাছ থেইকা হারাই যাই তুমি কি কাঁদবা আমার লাইগা? কষ্ট পাইবা? ইবনাত চুপ করে ওর মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেত। এই কথার ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারতো না।কিন্তু একদিন খুব ভোরে যখন সকালের রোদ্দুর আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়লো ঠিক তখন ওর মা হারিয়ে যায়।নিঃশব্দে কান্নায় ইবনাতের আকাশটা কেঁপে উঠেছিল।এই আকাশে সেদিন রুপালি চাঁদটা দেখা গিয়েছিল নাকি মেঘে ঢাকা ছিল ইবনাতের জানা নেই।এই শোকটা কাটিয়ে না যেতেই ওর বাবা আবার বিয়ে করে। ওর সৎ মা ওকে দেখতে পারতো না। কিন্তু ইবনাত অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অন্তত দু বেলা নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার মত খাবার আর পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছে বলে। একটা সময় ও যখন ইন্টার পাশ করলো ওর সৎ মা ওকে বিয়ে দিয়ে দেয় ইবনাতের থেকে অনেক বয়সে বড় একটা লোকের সাথে।যার আগে আরও দুটো বিয়ে হয়েছিল। একটা বউও সেই লোকের সাথে আকাশের চাঁদ দেখার সুযোগ পায়নি। অত্যাচার করতো খুব।মাঝে মাঝে গায়েও হাত তুলতো। ব্যবসায়ী হলেও মাতাল, তবে গ্রামে তার দাপট ছিল বটে। ইবনাতের এই বিয়েতে মোটেও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তারপরও অন্ধচোখে আলো দেখার আশা নিয়ে সে রাজি হয়। ভাবতো জীনটা হয়তো এমোনি। বাসর রাতে ও যখন বিশাল ঘোমটা দিয়ে বসে ছিল তার স্বামী মদ পান করে ওর কাছে গিয়ে ঘোমটা খুলে বললো “বউ আজকে তোকে অনেক আনন্দ দিবরে।” ইবনাতের কথাটা কেন যেন মোটেও পছন্দ হয়নি। মদের গন্ধে ও নাকে হাত দিয়ে বললো “আপনি আমার থেকে দুরে থাকেন।” ইবনাতের হাতটা যখন ধরলো ইবনাত কি ভেবে যেন তার স্বামীর গালে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে উনাকে ধাক্কা মেরে ওর বাড়িতে চলে যায়। ওর বাবা আর মা ওকে দেখে অনেক গালাগাল করেছিল। ওর মা ওর গায়ে হাত তুললো। ওর বাবার কাছে গিয়ে পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে যখন বলছিল “বাবা আমাকে মারও, কাটো, যা ইচ্ছা করো ঐ লোকটার কাছে পাঠিও না। ইবনাতের বাবা চুপ করে নিজের পা সরিয়ে অন্য রুমে চলে যায়। ঠিক তখনি ইবনাত আর কিছু না ভেবে গ্রাম থেকে পালিয়ে এই শহরে চলে আসে।এই শহরে আসার পর রেল স্টেশনে আমাদের ভার্সিটির ফারহানা ম্যাডামের সাথে পরিচয় হয়।স্টেশনে বিয়ের শাড়ি পড়া অবস্থায় বসে বসে কাঁদতে দেখে ফারহানা ম্যাডাম ওর কাছে গিয়ে সব কিছু জানতে পারে। তারপরে ফারহানা ম্যাডামের বাসায় ওর আশ্রয় মিলে এবং একটা সময় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফারহানা ম্যাডামের সাথে আবার নিয়ে আসে। এরপর আমাদের ভার্সিটিতে ওকে ভর্তি করার জন্য ওকে সেই ভাবেই গড়ে তুলে। ওর জীবনের এই গল্প গুলো যখন আমায় বিষণ্ন মন নিয়ে বলেছিল আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে শুনছিলাম। আর কেন যেন ফারহানা ম্যাডামের প্রতি আমার সম্মানটা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় অনুধাবন করি এই শহরে এমন কিছু সংখ্যক মানুষ আছে বলেই বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা বেড়ে যায়। ম্যাডাম আপনাকে অনেক সালাম।

প্রায় রাতে আমি একা একা হাটি। আমার খুব ইচ্ছে করে এমন একটা রাতের আকাশের সাথে কথা বলতে। মাঝে মাঝে আমি আর বাবা প্রায় আকাশের তারার সাথে কথা বলি। আমার প্রশান্ত কল্পনায় রাতের জ্বল জ্বল তারা গুলো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আমি ছটফট করি খুঁজে বেড়াই এই অসংখ্য তারা গুলোর মধ্যে কোনটা আমার মা।আজকেও আমি আর বাবা চুপ করে বসে আকাশের তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “বাবু তোর মাকে ডাক না। তুই ডাকলে তোর মা তাড়াতাড়ি আসবে।” আমি বাবার দিকে তাকাই। বাবা এখনো আমাকে তার ছোট্ট বেলার বাবু মনে করে। মা আমাকে বাবু বলে ডাকতো। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি “মা তুমি কি আসছো? দেখো না বাবার মন কেমন ছটফট করছে।” ঠিক তখনি বিশাল মেঘের ছায়াটা সরে যেতেই একটা বড় ঝকঝকে তারা দেখতে পাই। আমি জানি না এটা আামার মা কিনা। হবেও না। তবুও আমরা মনকে শান্তনা দেই। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে আকাশের তারাকে বলে “এই যে বাপ ছেলে কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি সেটা কি তুমি জানো? তুমি আজকাল আমাদের থেকে লুকিয়ে থাকো কেন রেহানা?” আমি বাবার কাধে মাথা রাখি। আমরা বাপ ছেলে মায়ের সাথে কথা বলি। আমি মাকে নালিশ দিয়ে বললাম “বাবাকে কত করে বলি সিগারেট খাবে না। তারপরও খায়। লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। আমি যখন ঘুমায় থাকবো তুমি বাবারে শাসন করে যেও তো ঠিকাছে?” বাবা আমার কথা শুনে মুখটা কেমন করে ফেললো তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “বেশি খাইনা তো। সকালে একটা, দুপুরে একটা, আর রাতে একটা।” আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি। বাবা আকাশের দিকে মায়ের সাথে কথা বলতে থাকে। মাঝে মাঝে বাবা হঠাৎ করে মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে এসে বলে “বাবু ভয় করে। তোর পাশে ঘুমাই? আমি মনে মনে চুপ করে কাঁদি। এই কান্না বাবাকে দেখাই না। সব কান্না দেখাতে হয় না। মনের ভিতর রেখে দিতে হয়। আমার মাকে বাবা খুব ভালোবাসতো। যদিও আমাদের পরিবারে টাকা পয়সা ছিল না তেমন তবে ভালোবাসায় ভরপুর ছিল। বাবা আর মা প্রেম করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু ওদের বিয়েটা দু পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি। যখন আমি পৃথিবীর মুখ দেখলাম আমার কথা ভেবেও তখন কেউ আমার মা বাবাকে মেনে নেয়নি। ভালোবাসাটা বাহির থেকে কত সুন্দর দেখায় কিন্তু এর ভিতরে যে কি পরিমাণ যন্ত্রনা আছে আমি ভেবে পাই না।আমি যখন বুঝতে শিখলাম প্রায় দেখতাম বাবার সাথে আমার নানা, আর মামারা ঝগড়া করতো। এই ঝগড়াটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে মামারা বাবার গায়ে হাত তুলে। আমার বাবা ছিল গরীব ঘরের। আর মা ছিল ঐ গ্রামের মেম্বরের মেয়ে।বাবার গায়ে যেদিন হাত তুললো মা কি যে কান্না। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলেছিল “ভালোবাসায় অনেক কষ্টরে বাবু। আজ আমার জন্য তোর বাবা মার খেয়েছে।আমার খুব লজ্জা লাগেরে।যে মানুষটাকে এতো এতো ভালোবাসি সে মানুষটার চোখে আজ পানি দেখেছি।” আমি কিছু বলি না। তখন এই কথার কি প্রত্যুত্তর দেওয়ার দরকার ছিল আমার ছোট্ট জীবনে জানার ছিল না। এরপর দিনই আমি মাকে খুঁজে পাইনা। আমি কাঁদি, সারাদিন কাঁদি। বাবা কাজ থেকে আসলে বাবাকে বলি “মা কই? মাকে পাই না।” বাবা আমার কান্না দেখে কোলে নিয়ে মাকে খুঁজতে থাকে আর আমাকে শান্তনা দিতে থাকে।সন্ধ্যার সময় মায়ের লাশ পাই বিলের পাশে।বাবাকে আমি কেমন যেন হয়ে যেতে দেখলাম। একটা ভয় এসে আমার বুকে জমা হয়। বাবা আমাকে শক্ত করে ধরে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে কান্না করে বলেছিল “বাবুরে সব শেষ বাবু সব শেষ।” মায়ের দাফনের যাবতীয় সব কাজ শেষ করে রাতের মধ্যেই গ্রাম ছেড়ে বাবা কি মনে করে যেন আমাকে নিয়ে এই শহরে চলে আসে। মায়ের বিষয়টা নিয়ে বাবা কেন যেন মাথা ঘামায়নি।আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম বাবার মনে আমাকে নিয়ে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। মাঝে দুবার গ্রামে বাবা নিয়ে গিয়েছিল। মায়ের কবরটা নেই। জায়গা ভরাট করে নতুন কবর হয়েছে কত। আমি আর কখনো গ্রামে যাই না। গ্রামের কথা শুনলেই আমার ভিতরটা ধক করে উঠে।

কিছুটা পথ হেটে যেতেই ভার্সিটিতে ফারহানা ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে বললাম “কেমন আছেন ম্যাডাম?” ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে চশমাটা ঠিক করে বললো “আলহামদুল্লিাহ।তোমার কি খবর জাহেদ? তোমার বাবা ভালো আছেন?” আমি হাসিমাখা মুখ নিয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। এমন মানুষগুলা যখন চারপাশে থাকে, ভালোমন্দ খোঁজ খবর নেয় ভিতরে কেমন যেন একটা শান্তি শান্তি লাগে।আমি অন্য কিছু বলতে চাচ্ছিলাম ঠিক তখন ম্যাডাম অপ্রতাশ্যাকর একটা কথা বললো “ইবনাতকে তোমার ভালো লাগে?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ম্যাডাম আমার চুপ থাকা দেখে একটু হেসে বললো “লাজুক ছেলে। ইবনাত ঠিকি বলে তুমি কেমন যেন।তোমার কথা ওর মুখে মাঝে মাঝে শুনি।আমার মেয়েটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মত না ঠিকাছে? ও আগামীকাল দেশের বাড়িতে যাবে। আমার একটু ভয় ভয় লাগছে। একা যাবে তো তাই। তুমি চাইলে তো যেতে পারো। তোমাকে ও কিছু বলেনি?” আমি বললাম “বলেছে।” ম্যাডাম আর কিছু না বলে হুম জাতীয় একটা শব্দ করলো। আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।উনি একটা হাসি দিয়ে চলে যায়।

হঠাৎ করে ট্রেনে উঠাতে আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো। আমার কোথাও যাওয়া হয়না বলে এই অনুভূতিটা ঠিক মত উপলব্ধি করতে পারছি না। ট্রেনে উঠার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমি যখন শরটাকে দেখছি ইবনাত আমার পাশে এসে বললো “কি করো এখানে?” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি “অপেক্ষার সময় গুনি।সবুজে সতেজ গ্রাম দেখার অপেক্ষা।” সে কিছু বলে না। গতকাল ম্যাডামের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে আমার কেন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করছিল। ওর সাথে দেখা করে বলেছিলাম “তোমার শহরটা দেখবো সাথে নিবে? তোমার শহরের অনুভূতি গুলো শরীরে মিশেয়ে একটা রং ছড়াতে ইচ্ছে করছে।” আমি ওর দিকে তাকাই। কি মনে করে যেন ওর চুলের ক্লিপটা খুলে দেই আমি। সে অবাক হয়ে আমার শরীরে কয়েকটা চড় মেরে বললো “বদমাইশ একটা।ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব এখন।” আমি হাসতে হাসতে বললাম “ধাক্কা তো আমি কবেই খেয়েছি। এই ধাক্কায় পড়ে গিয়ে আমি আর উঠতে পারছি না। হাত ধরে সাহায্য করো উঠার। ধরবে?” সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। বাতাসে ওর চুল উড়তে থাকে। আমি উড়ন্ত চুলের দিকে মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকি। ইবনাত চুল কানে গুজে লজ্জা লজ্জা ভাব অনুভ করে সিটে চলে যায় আর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেলান দিয়ে শহর দেখি, শহরের খেটে খাওয়া মানুষের ক্লান্ত চেহারাটা দেখি। এই শহরটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে।

গ্রামে পা রেখে একটা নিশ্বাস নিতেই আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠলো।গ্রামের মাঠ,ঘাট, পুকুর, গ্রামের বাতাস সব গুলো একত্র করে আমার মহাশূন্যে একটা কাব্য তৈরি হয়। এমন কাব্যে সবসময় আমার জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে এমন কাব্যকে। আমি নিশ্বাস নিয়ে আকাশে তাকাই, ঝকঝকে নীল আকাশ। এই বিশাল আকাশের মাঝে মেঘ বয়ে যায়। ইবনাতকে বলি “চলো মেঘ ধরি। ধরবে?” সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “ তুমি কি জানো তুমি একটা ছাগল।ছাগলের মত কথা বলো কেন হ্যাঁ?” আমি কিছু না বলে মাথা চুলকিয়ে হাসি। ইবনাতের মায়ের কবর জিয়ারত করার পর ওর বাবার সাথে একবার দেখা করে আবার শহরের দিকে রওনা দেই। আমরা তেমন একটা সময় কাটাইনি।ইবনাতের থাকার ইচ্ছা ছিল না।

শহরে যখন পৌছালাম তখন ঠিক সন্ধ্যা। রিকশা করে আমি ওকে বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য ওর সাথে করে যাই। আর একটু পথ অতিক্রম করলেই ফারহানা ম্যাডামের বাসা। জায়গাটা কেমন নিরব। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ইবনাত রিকশার হুড উঠিয়ে দিতে বলে রিকশা চালক ভাইকে। টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ে। এই বৃষ্টির শব্দটা আমার ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। ল্যাম্পোস্টের আলো আর ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টির ছায়া শহরটাকে কেমন রঙ্গিন করে তুলে। এই বর্ষনমুখর সন্ধ্যায় কি মনে করে যেন আমি রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ি। ইবনাত বলে “এই উঠো বলছি। কয়েক দিন আগেই বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি কাশি বাধিয়েছো মনে নেই?” বৃষ্টির জলে আমার সারা শরীর ভিজে যায়। আমি চুল গুলা নাড়া দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নামাই। ও “কি করছো এই কি করছো” এটা বলতে থাকে। ও নামলেই আমি ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি। আমার এমন তাকানো দেখে ওর চোখ দুটো কেমন যেন আমার চোখের মাঝে আচ্ছন্ন হতে লাগলো। পরিবেশ থমথমে রুপ ধারন করে। রিকশা চালক ভাই আমাদের এমন কান্ড দেখে কি মনে করছে আমি জানি না। বৃষ্টির জল ওর মুখ বেয়ে পড়তে থাকে। আমি কাপা কাপা হাতে ওর দু গাল আলতো করে ছুয়ে দেই। আমার ছোয়া পেয়ে ও কেমন যেন কেপে উঠলো। কিছুক্ষন আচ্ছন্ন করা চোখে তাকিয়ে ঝট করে নিজেকে ছাড়িয়ে রিকশায় উঠে চলে যেতে লাগলো। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ভিতরে কি রকম অনুভূতি হচ্ছিল আমি জানি না। কিন্তু একবার মনে হলো এই রকম একটা কাজ করা আমার কি ঠিক হয়েছে?

মাঝরাতে শরীর কেপে আমার আবার জ্বর উঠে। আমি জ্বরের ঘোরে মাকে ডাকি “মা, ও মা আমি তোমার কাছে আসি? কিন্তু বাবাকে দেখবে কে? আমি ছাড়া যে বাবার আর কেউ নেই।” আমি ঘোরের মাঝে থাকলেও বুঝতে পারছি বাবা আমার মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে কাঁদছে, ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে।

তিন দিন পর যখন জ্বর ভাবটা শরীর থেকে বিদায় নিল আমি শহরটাকে দেখি। কেমন যেন হয়ে গেছে শহরটা। সুস্থ হওয়ার পরও আমি ভার্সিটিতে যাই না। নিজের প্রতি কেমন যেন একটা ঘৃনা বাসা বেধেছে। ইবনাতের সাথে এমনটা করা আমার একদমি উচিৎ হয়নি। মেয়েটা কি ভাবছে আমাকে নিয়ে। দিন যায় রাত যায় দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ পার হয়। আমার বার বার মনে হচ্ছিল ইবনাত বিষয়টা ভালো ভাবে নেয়নি। সাতদিন পর মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি নিয়ে লজ্জিত মুখটা সহ ওর সামনে যখন দাঁড়ালাম ও তেমন একটা পাত্তাই দিল না। আমাকে দেখে এমন একটা আচরণ করলো যেন কোন ব্যাপারই না। আমার সামনে থেকে হাটা দিলো। একবার জিজ্ঞেসাও করলো না “ঠিক আছো?” আমারও কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না।আসলে এই বলার সাহস টুকু আমি রাখি না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা পথ যখন হাটলাম পিছন থেকে কে যেন আমার হাতটা ধরে আমাকে ঘুরালো। আমি তাকিয়ে দেখি ইবনাত। সে আমার দিকে ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে।এই তাকানোর অর্থ আমি বুঝি না।আমি লজ্জিত মুখ নিয়ে বললাম “কিছু বলবে?” এই কথা বলার পরই সে কিছুক্ষন সময় নিয়ে আমার গালে একটা চড় মেরে কান্নার সুরে বললো “এই সাতটা দিন আমি নিজ হাতে রেঁধে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসি একজন খাবে বলে।আমি সামনে বসে থেকে চুপ করে তার খাওয়া দেখবো।কিন্তু এমনটা হয়না।আমার খাবার আমার ব্যাগেই রয়ে যায়।সে আসে না। কিভাবে আসবে?সে কি আমার কথা শুনে?বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে।বৃষ্টিতে ভিজার এতো সখ কেন তার?” আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠে।চোখের কোনোয় জল জমা হয়।আমার এই জলম্রিশ্রিত মুগ্ধ চোখে আমি গালে হাত দিয়ে চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। সে আমার হাতটা ধরে গভীর হয়ে বললো “আমাকে কষ্ট দিও না। আমার এই ছোট্ট জীবনে এতো কষ্ট সহ্য হয় না।” আমি কিছু বলি না। বলার প্রয়োজনবোধ করিনা। আমি শুধু শক্ত করে তার হাতটা ধরলাম। তার এই কথায় আমি ভালোবাসার একটা নতুন গল্পকে অনুভব করি। যে ভালোবাসায় বৃষ্টির জলশব্দরা খেলা করবে। এই জলশব্দের মাঝে আমি তাকে নিয়ে আমার ভালোবাসার গল্প সাঁজাবো। একটা নতুন ভালোবাসার জলশব্দের গল্প…
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২৮
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×