ঋতুপর্ণ একবার বলেছিল তার নিজের সম্পর্কে, “ সবাই জানেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, ছবি বানায় বড়দের জন্য । সে ছবিতে সবাই গম্ভীর চিন্তা করে , চোখা-চোখা কথায় ঝগড়া করে , কথায় কথায় কান্না কাটি করে , চীৎকার করে বা নীরবে কষ্ট পায় , বা কষ্ট দেয়...”।
একজন কা(পুরুষ) হয়েই বলছি আমার স্ত্রী যদি বেশ সুন্দরী, স্মার্ট ও শিক্ষিতা হয় এবং ঠিক সেই কারণেই যদি রাস্তার বখাটেরা দলবেঁধে আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করে এমনকি ধর্ষণ করে তবুও ঐ রাস্তার গুণ্ডাদের সাথে মারামারি করে আমি পেরে উঠবো না বরং আমি ওদের পরবর্তী মারের ভয়ে চুপ করে যাব এবং এই ঘটনার জন্য আমার স্ত্রীর স্মার্টনেস, কাপড়চোপড় ও কথায় কথায় ইংরেজি বলাকেই দোষ দিব ।
পরে এই ঘটনা নিয়ে যখন আমার অফিসের কলিগেরা আমারই সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ রস মিশিয়ে গল্প করবে তখন তাদেরও আমি উচিত জবাব দিতে পারব না ।
কারণ আমি কাপুরুষ ।
সমাজের তথাকথিত মান সম্মানের ভয়ে আমি আমার স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে পারব না ।
কত বড় ছোটলোক আমি তার আরো উদাহরণ আছে, সেদিন রাস্তায় আমার স্ত্রীর শ্লীলতাহানির জবাব দিতে গিয়ে যে মানুষটা আমার স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁকেও তার সম্মানটুকু আমি দিতে পারব না । সেই সাহায্যকারী যদি পুরুষ হয় তবে তাকে চরিত্রহীন বলে গালাগাল দিব আর সেই সাহায্যকারী যদি নারী হয় তাহলে তো কথাই নেই, একজন নারীর চরিত্র সম্পর্কে ঠিক কি কি উপায়ে এবং কতভাবে বাজে কথা বলা যায় তা আমার ভালোই জানা আছে ।
ভাবছেন আমি কেন এত ছোটলোক ! কেন আমি এত কাপুরুষ !
কেন আমি এর যথাযথা প্রতিবাদ করতে পারব না জানেন ? ভয়ে ! সমাজের ভয়ে ! অনেক ভয় আমার । এই বুঝি আমার মান ইজ্জত যা আছে সব ঠেলাগাড়ির চাকার হাওয়ার মত ফুঁস করে বেরিয়ে যায় এই ভয়ে । কত ভয় আমাদের ! এই সমাজ আমাকে এতটাই ভীতু ও বোকা বানিয়ে রেখেছে যে আমার স্ত্রীর পক্ষে তো আমি কথা বলতে সাহস পাবোই না উল্টো আমাকে ভাবাতে বাধ্য করা হবে যে আমার স্ত্রীর চরিত্র আসলেই হয়ত একটু রহস্যময় , হয়ত আমার সতী-সাবিত্রী স্ত্রী ঠিক আমার সামনে যতটা ভদ্র ও মার্জিত আমার বাইরে হয়ত একটু অশ্লীল ও বেপরোয়া।
এ তো গেল আমার কাপুরুষতার কথা । আমার স্ত্রীর কথা ? তার কি হবে ? সে কি তার বাকী জীবন এই কাপুরুষ স্বামীর সাথেই কাটিয়ে দিবে ? নাকি সে আলাদা হয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করবে ? তার কি সেই মানসিক শক্তি আছে ? নাকি নেই ?
যদি না থাকে তাহলে কেন সে তার পাওনা অধিকার আদায় করে নিতে পারছে না ?
আর যদি স্বামীর ঘর করেও যায় তাহলে কোন স্বামীর সাথে সে ঘর করছে ? যে তাকে দেনমোহর নামক টাকার বিনিময়ে বৈধ বেশ্যা রূপে ব্যবহার করছে তার সাথে ?
অথবা সেই প্রেমিকা যে তার রোম্যান্টিক হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়ে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হল এবং তার প্রেমিক পুরুষটি কিছুই বলতে পারল না শুধুমাত্র বখাটেদের হাতে থাপ্পড় খাবে বলে এবং পরে হয়ত বাসায় গিয়ে ফোনে মেয়েটির সিল্কের ওড়না ও টাইট টাইস কেই দোষ দিল!
সেই মেয়েটি কি তখনো ভালোবাসবে ঐ ছেলেটিকে ? সে কি বিয়ে করবে ঐ ছেলেটিকেই যে তার সম্মানের কোন মূল্যায়নই করতে পারল না !
এসব ঘটনা ঘটে চলে আমাদের দেশের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি পার্কে ।
কি করব আমরা ? সবাইকে বাদ দিয়ে একা একা চলা শুরু করব ? কাউকে বিশ্বাস করব না? কারো উপর আস্থা রাখব না ? সব সম্পর্কগুলো আমরা ভেঙে দিব ? চারপাশের সবকিছুই কি আমরা ভেঙে উড়িয়ে দিব? হোক সেটা অবৈধ স্থাপনা ভাঙা অথবা বৈধ হৃদয় ভাঙা। একা একা চলা শুরু করে দিব ? বস্তুত একটা সময়ের পর আমরা সবাই একা ।
এরকমই একটা কাহিনী নিয়ে তৈরী ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা দহন ।
১৯৯৭ সালের সিনেমা। অনেকেই অনেকবার দেখেছেন। আবারো দেখুন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পর্কে নতুন করে বলার আর কিছুই নেই।
ঋতুর জন্য রয়েছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
আফসোস কেবল মানুষটা আর নেই আমাদের মাঝে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১:৪৮