somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হযরত আলী কার্‌রামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক

০৯ ই মে, ২০১২ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরিচিতি

নাম আলী, উপনাম আবূল হাসান (হাসানের পিতা) ও আবূ তুরাব (মাটির পিতা)। পিতার নাম আবূ তালিব, মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। বিশেষ উপাধি আসাদুল্লাহ (আল্লাহ পাক-উনার সিংহ), হায়দার (বাঘ), মুরতাদ্বা (সন্তষ্টি-প্রাপ্ত)। তিনি আব্দুল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ। তিনি রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার চাচাত ভাই। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখায় জন্ম। পিতৃকূল ও মাতৃকূল উভয় দিক থেকে তিনি হাশেমী বংশদ্ভূত।

বিলাদত শরীফ:

রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নুবুওয়াত লাভের দশ বছর পূর্বে বিলাদত লাভ করেন। জন্মের সময় পিতা আবূ তালিব অত্যন্ত অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় পিতৃব্যের আর্থিক সঙ্কট লাঘবের উদ্দেশ্যে বালক আলীকে নিজে প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অপর পুত্র জাফরকে পিতৃব্য হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অভিভাবকত্বে সোপর্দ করেন। (তাবারী)

ইসলাম গ্রহণ:

একদা রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত খাদীজা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে নামায পড়তে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি করছেন? উত্তরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা আল্লাহ পাক-উনার দ্বীন। হযরত খাদীজা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, তোমাকেও আমরা সেই দায়িত্ব দিচ্ছি। তখনই তিনি ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে কালিমা শরীফ পাঠ করেন। ইসলাম গ্রহণকালে উনার বয়স মুবারক দশ বছর ছিল। তিনি হলেন সর্বসম্মতিক্রমে বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী।

কিশোর ও যৌবন কাল:

হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর চৌদ্দ কিংবা পনের বৎসর বয়সকালে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকট-আত্মীয়দিগকে ইসলামের দিকে আহবান করার জন্য নির্দেশ পান। এতদুদ্দেশ্যে তিনি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সকলকে একত্র করবার ব্যবস্থাপনার নির্দেশ দেন; হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বেশ উক্তমরূপে এর ব্যবস্থা করেন। দস্তরখানে খাসীর পায়া এবং দুগ্ধ রাখা হয়েছিল। উপসি'ত মেহমানদের সংখ্যা ছিল ৪০ জন। আহার সমাপনের পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানান। এই সমাবেশে কেবল হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুই তাঁকে সর্বাত্মক সমর্থন জানান এবং ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন । (তাবারী)

মক্কা শরীফে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সঙ্কট ও অগ্নি পরীক্ষার তেরটি কঠিন বৎসর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাহচর্যে অতিবাহিত করেন। এর মধ্যে আবূ তালিব গিরি সঙ্কটে তিন বৎসরের নির্বাসিত জীবন ছিল সর্বাপেক্ষা সঙ্কটপূর্ণ। সে সময় উনার ভ্রাতা হযরত জাফর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার স্ত্রী সহ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। কিন' হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এরূপ কঠিন মুহূর্তেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে মক্কা শরীফে অবস্থান করেন, যতদিন না তিনি মক্কা শরীফ হতে মদীনা শরীফ হিজরত করার অনুমতি পেলেন।

মক্কা শরীফের মুশরিকদের যে সব সম্পদ আমানত হিসেবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট রক্ষিত ছিল, এমতাবস্থায়ও শত্রুর গচ্ছিত সম্পদ মালিকদের নিকট প্রত্যার্পনের কথা তিনি ভূলেননি। তিনি সেই সব গচ্ছিত সম্পদ প্রত্যার্পনের দায়িত্ব হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে অর্পন করেন এবং বলেন যে, তিন দিন পর এই সব গচ্ছিত সম্পদ এর মালিকদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে মদীনা শরীফে আসবে। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিন দিনের মধ্যেই সেইগুলি প্রাপক ব্যক্তিদেরকে পৌঁছিয়ে দিয়ে পরে কুবাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে মিলিত হন। (ইবনে কাছির)

জিহাদের ময়দানে বীরত্ব:

দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমাদ্বান বদরের জিহাদে মুসলমান ও মুশরিক উভয় বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি হয়। তৎকালীন যুদ্ধরীতি অনুযায়ী মক্কা শরীফের মুশরিকদের পক্ষ হতে উতবা, শায়বা এবং ওলিদ নামক তিন জন সদর্পে ময়দানে অবতরণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিকে যুদ্ধে আহবান জানালে তাদের মোকাবেলায় হযরত হামজা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উবায়দা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠানো হয়। হযরত হামজা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে তাঁদের স্ব স্ব প্রতিদ্বন্দ্বি নিহত হয়। কিন' বার্ধক্য জনিত কারণে হজরত উবায়দা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন সফল না হওয়ায় হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার সাহায্যার্থে অগ্রসর হন এবং প্রতিপক্ষ শায়বা নিহত হয়। অতঃপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। (তাবারী)

হিজরী তৃতীয় সালে সংঘটিত উহুদের জিহাদে মুশরিকগণ মুসলমানদেরকে আক্রমণ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন' হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাদের সকল অভিসন্ধিই ব্যর্থ করে দেন। মুশরিক বাহিনীর পতাকাবাহী আবূ সা’দ ইবনে আবি তালহা তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহবান জানালে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক আঘাতেই তাকে ধরাশায়ী করেন; কিন' তার অসহায়তা ও হতবিহ্বলতা দেখে তিনি তাকে হত্যা করেন নি। (ইবনে হিশাম)

হিজরী ৭ম সনে খাইবারের জিহাদ সংঘটিত হয়। এই জিহাদে খাইবরের সর্বাধিক সূদৃঢ় দুর্গ ‘‘কামুস্থ’ এর অধিকর্তা মারহাব নামক এক বিখ্যাত ইয়াহুদী বীরকে হত্যা করে তিনি অতুলনীয় বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দান করেন। অত:পর কয়েকদিন অবরোধের পর তিনি দুর্গ অধিকারে সক্ষম হন। এই জিহাদে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সূদৃঢ় দুর্গ ‘‘কাছরে মারহাব’’ জয় করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন । (ইবনে হিশাম)

রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্ক :

একদিকে তিনি রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার চাচাতো ভাই। অপরদিকে রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর স্বামী। দ্বিতীয় হিজরীতে তাঁদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

খিলাফত লাভ:

খিলাফত লাভের পূর্বে তিনি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফত আমলে পরামর্শদাতা ছিলেন। হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শাহাদতের পর হিজরী ৩৫ সনে খিলাফতের মসনদে সমাসীন হন। প্রায় চার বছর সাড়ে আট মাস যাবত এ দায়িত্ব যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করেন।

হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফত আমলে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পারস্পরিক যুদ্ধ:

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা, হযরত ত্বলহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত যুবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ ছাহাবা হযরত উছমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার দাবী জানান। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন: এই মূহূর্তে বিদ্রোহীগণ বিপুল শক্তির অধিকারী। এখন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে অনেকেই ভাবলেন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইচ্ছা করে গড়িমসি করছেন। নাঊযুবিল্লাহ। পরবর্তীতে উভয় পক্ষ সালিসের মাধ্যমে নিস্পত্তি হয়ে যায়। এইদিকে মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে সাবা এবং তার দল দেখল-সর্বনাশ! এইবার তাদের আর রেহাই নেই। রাত্র হলে তারা বিপরিত পক্ষের ছাউনির তরফ হতে এসে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিদ্রিত সৈন্যের উপর আক্রমণ চালান। এতে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মনে করলেন হযরত ত্বলহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত যুবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সৈন্যরা বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। যুদ্ধ শুরু হল। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু- হযরত ত্বলহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত যুবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট শান্তির পয়গাম পাঠালেন। এই পয়গাম পেয়ে তাঁরা এতটা প্রভাবিত হন যে, তাঁরা যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেন। ইহুদী আবদুল্লাহ ইবনে সাবার দলের লোকেরা কোন কোন মতে খারিজী ফিরক্বার লোকেরা পথিমধ্যেই তাঁদের উভয়কে শহীদ করে। তাঁরা শহীদ হয়ে গেলে বিরোধী দল দুর্বল হয়ে পরে। হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আন্‌হা একটি উষ্ট্রে আরোহণ করে আপোষ করার জন্য এই যুদ্ধে উপসি'ত হন। এই জন্য একে ‘‘উষ্ট্রের যুদ্ধ’’ বলা হয়। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৩৬ হিজরী সনের জুমাদাল উখরা মাসে। (তারিখুল খুলাফা)

অতঃপর সিফ্‌ফিনের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু চাজিলেন যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সুসংহত হলে পরে হযরত উসমান যিননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু- এর শহীদকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আর এই ব্যবস্থা নেয়াও এত সহজ ছিল না যেখানে লক্ষ লক্ষ বিদ্রোহী জড়িত ছিল। ফলে সিফ্‌ফিনের প্রান্তরে উভয় পক্ষ সৈন্য সমাবেশ করলেন। বিপরীত পক্ষ যখন পরাজয় অত্যাসন্ন দেখলেন, তখন তাঁরা সন্ধির প্রস্তাব করলেন। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও তা মেনে নিলেন। সন্ধির সর্ত সমূহও লিখা হল এবং সি'র হল দু’ জন সালিসের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তি হবে। কিন' শেষ পর্যন্ত সালিসের মাধ্যমে বিচার-নিষ্পত্তি বিভিন্ন কারণে হয়ে উঠেনি। পরে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সঙ্গে সন্ধি করেন।

ইতিমধ্যে খারিজীগণ যারা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দলে এক বিরাট শক্তির উৎস ছিল তারা এই বলে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর দল হতে বের হয়ে গেল যে আমরা এই সন্ধি ও সালিস মানিনা। এরা ছিল উগ্রপন্থী বেদুইন- যে কোন লোককে যে কোন কারণে হত্যা করা এরা সহজ মনে করত। শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অনিবার্য মনে করলেন। নাহারওয়ান নামক স্থানে তাদের সাথে এক তুমুল সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে খারিজীরা সমপূর্ণ পরাজিত ও বিধ্বস্থ হয়। এই যুদ্ধে পর্যূদস্ত হয়ে খারিজীরা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে শহীদ করার জন্য ফন্দী ফিকির শুরু করে।

ছাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক মতভেদ স্ব স্ব ক্ষেত্রে নির্ভূল ছিল, তবে এতটুকু বলা যাবে যে তাদের কেউ ছিলেন হক্বের উপর আর কেউ অধিকতর হক্বের উপর।

সুতরাং তাঁরা কেউই ভূল করেননি। তাঁদের সমালোচনা করলে ঈমান হারাতে হবে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: আমার বেছাল (ওফাত) শরীফের পরে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইখতিলাফ (মতবিরোধ) সম্পর্কে আমি আল্লাহ পাককে জিজ্ঞাসা করেছি। আল্লাহ পাক আমাকে বললেন: হে হাবীব, নিশ্চয়ই আপনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আমার নিকট তারকা সমতূল্য। কারো আলোর চেয়ে কারো আলো বেশী, তবে প্রত্যেকেরই আলো আছে। সুতরাং তাঁদের যে কোন ইখতিলাফকে যারা আঁকড়ে ধরবে, তারা হিদায়েত পেয়ে যাবে। কারণ তাঁদের ইখতিলাফগুলো আমার নিকট হিদায়েত হিসাবে গণ্য। অতঃপর রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ (প্রত্যেকেই) তারকা সদৃশ, তাঁদের যে কেউকে তোমরা অনুসরণ করবে, হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে।” অর্থাৎ তাঁদের যে কাউকে, যে কোন ব্যক্তি, যে কোন বিষয়ে অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি সে বিষয়েই হিদায়েত লাভ করবে বা হিদায়েতের উপর থাকবে।

শাহাদত বরণ

হিজরী ৪০ সনের ১৬ই রমাদ্বান শুত্রবার ফজর নামাযে গমনকালে আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম নামক খারিজী ঘাতকের তলোয়ারের আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১৭ই রমাদ্বান শনিবার শাহাদত বরণ করেন। উনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইয়্যিদে শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার জানাযার নামায পড়ান। কূফার নাজফে আশরাফে জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন মুবারক করা হয়। গ্রহণযোগ্য মতে শাহাদত কালে উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৬৩ বছর।

হযরত আলী কার্‌রামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ফযীলত ও মর্যাদা :

ইসলামে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অবদান অপরিসীম। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার যামানার সকল জিহাদে অনেক বেশী সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় তিনিই দেন। এ কারণে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ‘হায়দার’ লক্ববসহ ‘যুলফিকার’ নামক একখানা তরবারি দান করেন। একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া সকল জিহাদেই তিনি অংশ গ্রহণ করেন। বদরে উনার সাদা পশমী রুমালের জন্য তিনি ছিলেন চিহ্নিত। বদরসহ প্রতিটি জিহাদে তিনি ছিলেন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পতাকাবাহী।

রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘হযরত হারুন আলাইহিস সালাম যেমন ছিলেন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট তেমনি আপনি হচ্ছেন আমার নিকট। অর্থাৎ প্রতিনিধি। তবে আমার পরে কোন নবী নেই।’’

হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন নবী খান্দানের সদস্য। তিনি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষা লাভ করেন। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি জ্ঞানের নগরী, আর হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সেই নগরীর প্রবেশদ্বার।’’ তিনি ছিলেন, কুরআনে হাফিয, শ্রেষ্ঠ মুফাস্‌সির এবং হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী রাবী।

হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মর্যাদা-ফযীলত সমপর্কে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যত কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন ছাহাবী সম্পর্কে তা হয় নি। (কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড)

‘মিরআতুল আস্‌রার’ কিতাবে উল্লেখ আছে, হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘রওদ্বাতুশ শুহাদা’ গ্রনে' বর্ণনা করেন: হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে যে কোন এক ব্যক্তি থেকে আমাদের সময় পর্যন্ত এত ইল্‌ম পৌঁছেনি, যতটা হযরত আলী কার্‌রামাল্লাহু ওয়াজহাহু থেকে পৌঁছেছে।

তরীক্বতের ইমাম: আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তরীক্বত পন্থীদের ইমাম ছিলেন। তরীক্বতের অধিকাংশ সিলসিলা উনার মাধ্যমে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার রূহানী তালীম তথা আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রচার-প্রসারে যে সমস্ত ছাহাবা বিশেষ ভাবে অবদান রাখেন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁদের মধ্যে বিশিষ্টতম। আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অনেক সিলসিলা (যেমন ক্বাদেরিয়া, চিশ্‌তিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, ইত্যাদি) অদ্যবধি উনারই মাধ্যমে উম্মত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ফয়েজ হাছিলের সাধনা করে আসছে। ইসলামের প্রত্যেক খলিফাই একদিকে পার্থিব ক্ষমতার রজ্জু স্বহস্তে ধারণ করে সাধারণ মানুষের জাগতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, অপর দিকে রূহানী তথা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও তাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। খিলাফতের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হওয়ার পরই ইহা জাগতিক ও আধ্যাত্মিক খিলাফত নামে বিভক্ত হয়ে যায়। এ পর্যন্ত খুলাফায়ে রাশিদীন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে তরীক্বতের সিলসিলা অক্ষুন্ন আছে। এই ক্ষেত্রে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বিশেষ খ্যাতি বিদ্যমান। তাছাউফের অনেক গুলি সিলসিলা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। উনার ব্যক্তিত্ব আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত এবং বাতিল ফিরক্বা শিয়া উভয় মহলের নিকট মর্যাদার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত। হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উম্মতে মুহম্মদীকে যেসব নিয়ামত দান করা হয়েছে তন্মধ্যে একটি এই যে, তরীক্বতের বিভিন্ন সিলসিলার নিস্‌বত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে বিশুদ্ধ ও দৃঢ়ভাবে রয়েছে, খেরকা প্রদান ও বাইয়াত উভয়ই সুন্নত হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে।

প্রথম থেকে মাশায়েখে ছূফিয়া-এর নিয়ম এইভাবে চলে আসছে যে, নিজের খলীফাদের ও মুরীদদের খেরকা পরিয়ে দেয়া, টুপীর ছূরতে হউক, অথবা পাগড়ী, জামা, জুব্বা, চাদর, লুঙ্গী ইত্যাদির ছূরতেই হোক, অর্থাৎ যা-ই সহজলভ্য হয়, তার মাধ্যমে ইজাজত (অনুমতি) প্রদান করা। যদি মাশায়েখগণ কাউকে নিজের সিলসিলায় ইজাজত দিতে চান, তাকে নিজের প্রতিনিধি (খলীফা) নির্দ্দিষ্ট করতে চান যেন তিনি তরীক্বত-পন্থীদেরকে তালক্বীন ও তরবীয়ত প্রদান করেন এবং তাদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করবেন, তখন তাঁকেই খেরকা পরিয়ে থাকেন যেন তাঁকে এসব বিষয়ে জিম্মাদারী (দায়িত্ব) অর্পন করতে পারেন। (আল ইন্‌তিবাহ ফী সালাসিলে আওলিয়াইল্লাহ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি)
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×