ইনডিয়ান মুভি ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মুভির নাম যদি বলা হয় তাহলে নিন্দেহে সবার চোখের সামনে যে নামটি ভেসে উঠবে তা হলো মুঘল-ই-আজম। যারা অনেক আগে থেকেই মুভি দেখেন তারা মুভির কথা উঠলেই এখনও মুঘল-ই-আজম মুভির নাম তুলতে সুখানুভব করেন। মুভিটি নাম নেওয়ার কারন হলো মুভিটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শককে টানা বসিয়ে রাখতে সফল হবে।
এ মুভি এতো জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে কারনও আছে অনেক। মুভিটি তৈরি করতে লেগেছে অনেক সময়, অর্থ এবং তার সাথে ধৈর্য। কারন ধৈর্য না থাকলে কোন ভালো কাজই হয় না। দেখা যায় বিগ বাজেটের অনেক মুভিও সফলতা অর্জন করতে পারেনা। এর পিছনে কারন হলো মুভির প্রতি সময় না দেওয়া, মুভির ভিতরে ঢুকতে না পারা। আবার কাহীনি ভালো কিন্তু মুভিটি সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেনা। এর সব কারনই হলো একটি কাজের প্রতি আন্তরিকাতা আর নিষ্টার অভাব।
সে যাই হোক, এই মাস্টার পিস মুভিটি তৈরি করেছেন কে. আসিফ ১৯৬০ সালে। তখন তিনি মুভিটি তৈরি করতে দীর্ঘ নয় বছর সময় নিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে কালার মুভি তৈরি করার জ্বর শুরু হয়েছিলো। কিন্তু প্রডিউসারদের অনিহার কারনে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। পরে শুধু একটি গান এবং ৩০ মিনিটের কিছু ক্লাইমেক্স শট কালারে ধারন করা হয়েছিলো। মুভিটির কাহীনি এর পূর্বে লাভস অফ অ্যা মুঘল প্রিন্স(১৯২৮) এবং আনারকলি(১৯৫৩)-তে এসেছিলো। সম্রাট আকবরের ছেলে মুঘল প্রিন্স সেলিমের কাহীনির উপর নির্ভর করেই মুভিটি তৈরি করা হয়েছে। প্রিন্স সেলিম নর্তকি আনারকলিকে ভালোবাসে। এবং ভালোবাসার পরিনতিসরুপ সেলিম তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্ত এতে রাজি নয় সম্রাট আকবর। এর ফল সরুপ আনারকলিকে বন্দি করা হয়। এদিকে সেলিম তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু পরাজিত হন। এর ফলে সেলিমের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এভাবেই মুভির প্রেম কাহীনি বা বিরহ কাহীনি চলতে থাকে। সেলিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলিপ কুমার, আনারকলি চরিত্রে মধুবালা, আকবর চরিত্রে পৃথিরাজ কাপুর। প্রত্যেকের পারফর্মেন্সই চমৎকার হয়েছে। না হওহায় কোন কারনও নেই। কারন সবাই তার অভিনয়ের প্রতি ছিলেন অনেস্ট। যেমন পৃথীরাজ কাপুর প্রতিটি শট দেওয়ার পূর্বে নিজেকে আয়নায় দেখে নিতেন। ডিরেক্টর যখন তাকে এর কারন জিগ্ঞেস করলেন তখন তিনি বলেন, আমি চরিত্রের গভীরে ঢুকতে চাই।
মুভিটি রিলিজ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি আয় করতে সফল হয়েছে ১৯৭৫ সালে শোলে মুভি রিলিজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। তবে ২০০৪ সালে যখন মুভিটি আবার কালার হয়ে রি-রিলিজ হয় তখন তা আবার সবার উপরে উঠে আসতে সক্ষম হয়। কালার ভার্সনে রি-রিলিজ পাওয়া মুভির মধ্যে এটই হলো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। কারন এখন পর্যন্ত কোন কালার ভার্সনে রি-রিলিজ হয়নি। হলিউডে যা হয়েছে তা কেবল হোম বিডিওর ক্ষেত্রে হয়েছে। এখন মুভিটিকে কালার ফর্মাটে নিয়ে আসতে ও অনেক সময় এবং অর্থ ব্যায় করতে হয়েছে। এই টাইমলেস ক্লাসিক মুভিটি কালার ফর্মাটে আনতে কাজ করেছে দি ইনডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড অ্যানিমেশন। ৫০ জন ইনডিয়ান টেকনিসিয়ান কাজ করেছেন এর জন্য এবং খরচ করেছেন প্রায় তিন কোটি রুপি। শেষ পর্যন্ত কে.আসিফের ইচ্ছা সফল হলো। যদি ও তিনি এখন তা আর দেখতে পেলেন না।
মুভিটি এখনও এতো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুর কারন কেন? এর উত্তর খুজতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে এর পিছনের ইতিহাস জানার জন্য। যে কোন একটি কাজের কিছু বিষয় চিরদিন মানুষ মনে রাখে। এখন মুঘল-ই-আজম মুভিটির কোন সিকোয়েন্সটি মানুষ মনে রাখবে তা যদি বলা হয় তা হলে অবশ্যই শীষ মহলে আনারকলির গানটির কথা বলবেন। এটা আসলে ভুলার মতো বিষয়ও নয়। তবে এই গানটির পিছনে রয়েছে অনেক চেষ্ঠা, অর্থ এবং সাধনা। গানটির গীতিকার শাকিল বিদওয়ানকে ১০৫ বার এই গানটির লিরিক লেখতে হয়েছিলো। ১০৫ বারের মাথায় মিউজিক ডিরেক্টর গানটির অনুমোদন দেন। এই গানটি ধারন করতে ব্যায় হয়েছে তখনকার ১০ মিলিয়ন রুপি। তখন একটি মুভির পেছনেই খরচ হতো না ১ মিলিয়ন রুপি। লাহোর ফোর্টে যেখানে গানটি ধারন করা হয়েছিলো সেখানকার প্রতিটি আয়নায় তা রিফ্লেক্ট হয়েছে। এতো চমৎকার কাজ মনে না রাখার কোন কারন অবশ্য নেই। মুভিটিতে মিউজিক ডিরেক্টরের কাজ করেছেন নওশাদ। এটাকে বলা হয় ইনডিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভালো সাউন্ডট্রেক।
মুভিটিতে যে কস্টিউম ব্যবহার করা হয়েছে তাতে কাজ করার জন্য দিল্লী থেকে আনা হয়েছে টেইলর, এম্বয়ডারির কাজ করার জন্য সুরাট-খম্বাট থেকে আনা হয়েছিলো কিছু স্পেশালিস্ট, হায়দারাবাদের স্বর্ণাকররা তৈরি করেছেন জুয়েলারী, অস্র এসেছে রাজস্থান থেকে। মুভিটিকে যতোটুকু সম্ভব বাস্তবধর্মী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এতো কিছু বাস্তবে রূপদিতে প্রডিউসারকে খরচ করতে হয়েছে দেড় কোটি রুপি এখন যা ৩৮.২৯ কোটি রুপির সমান।
মুভিটি দীর্ঘ হলেও সময় যে কখন চলে যাবে তা টেরও পাওয়া যাবেনা এটা নিশ্চিত। ড্রামা, অয়ার, রোমান্স নির্ভর মুভিটি তিনটি পুরস্কার এবং পাচটি নমিনেশন পেয়েছে।
মুঘল-ই-আজম: ইনডিয়ান মুভি ইতিহাসের অন্যতম সফল মুভি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৫টি মন্তব্য ৭টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।