সময়টা ছিল ১১শতকের শেষভাগ। বৈশ্বিক ক্ষমতার মঞ্চে বিশাল পট পরিবর্তন হচ্ছে একে একে। একসময়ের সুবিশাল রোমান বায়জেন্টাইন সাম্রাজ্য তখন ক্ষমতা হারিয়ে ধুঁকছে; রাজধানী কন্সটান্টিনোপলে শেষ অস্তিত্বটুকু ধরে রেখেছে সম্রাট অ্যালেক্সিওস। ৪০০বছর আরব শাসনের পর মুসলিম বিশ্বের কর্তৃত্ব তখন সেলজুক তুর্কিদের হাতে, প্রায়ই বায়জেন্টাইন সাম্রাজ্যের সীমানায় হানা দেয় তারা।
অপরদিকে ইউরোপ তখন সমস্যায় জর্জর এক অভিশপ্ত এলাকা। প্লেগ, শীত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুই ছিল খ্রিস্টান অধ্যুষিত ইউরোপের অধিবাসীদের জন্য অবধারিত। ইউরোপ হতে ৩ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পবিত্র ভূমি জেরুজালেম এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শক্তি সম্পর্কে তারা একেবারেই ছিল উদাসীন। প্রায় ৪০০ বছর আগে ৬৩৪খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে এই পবিত্র ভূমি ছিনিয়ে নেয় মুসলমানেরা। এই বিজয়ের ফলে ৫বছর পূর্বে বিতাড়িত ইহুদীরা আবারো জেরুজালেমে ফিরে আসার সুযোগ পায়। এমনকি স্থানীয় খ্রিস্টানদেরও তাদের পবিত্র স্থানগুলোতে উপাসনা করার সুযোগ বহাল রাখা হয়। এভাবেই পরবর্তী ৪০০ বছর এই পবিত্রভূমি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।
ইউরোপ হতে কনস্টান্টিনোপল হয়ে জেরুজালেম
এরই মাঝে ১০৮৮খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথোলিকদের নতুন পোপ নির্বাচিত হন আরবান II । তিনি শুধু ধর্মগুরুই ছিলেন না, রাজনৈতিকভাবে এই পোপ ছিলেন অসাধারণ দূরদর্শিতার অধিকারী। প্রথমেই তিনি ভাবলেন, ইউরোপের ক্ষমতা পোপের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে হবে; কিন্তু পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত জাতিগুলোকে এক করার উপযুক্ত কোন মওকা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যেহেতু জেরুজালেমে কোন গোলযোগ নেই, তাই সেখানে মাথা ঘামানোরও কোন দরকার নেই; এই ছিল ইউরোপের রাজাদের ধারণা।
এমন সময়ে হঠাৎ করেই পোপের হাতে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিলেন বায়জেন্টাইন সম্রাট অ্যালেক্সিওস। সীমান্তে তুর্কিদের প্রতিহত করার জন্য কিছু নাইট পাঠানোর আবেদন জানার পোপের কাছে। এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন পোপ আরবান। সাথে সাথে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের ভয়াবহ বিপদের কথা উল্লেখ করে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানালেন পোপ আরবান। পোপের আহ্বানটা ছিল অনেকটা এরকম-
‘আমাদের ভাগ্যের দোলনা, মহান প্রভুর পবিত্র ভূমি এবং প্রায়শ্চিত্যের পথ; সবই আজ অধার্মিক দখলদারদের করায়ত্ত্ব। যেখানে আমাদের মহান পিতা যিশু শুয়ে আছেন সেখানে আজ অপবিত্র কর্মকাণ্ডে কলুষিত। যাজকদের হত্যা করা হয়েছে, কুমারীদেরকে বেছে নিতে বলা হয়েছে মৃত্যু অথবা পতিতাবৃত্তি।'
এরকম ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে ফ্রান্সের ক্লে’মন্তের সভায় ইউরোপের রাজা, নাইট এবং নেতারা যোগ দিলেন পোপের সাথে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার জনতা শরীক হোল পবিত্র ধর্মযুদ্ধে।
ক্রুসেডের নেতৃবৃন্দ
ক্রুসেডের উদ্দেশ্য
-পোপের উদ্দেশ্য, মুসলমান এবং ইহুদীদের হাত থেকে পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধার এবং হলি ক্রস উদ্ধার এবং ফলাফলে পোপ হয়ে যাবে সমস্ত ইউরোপের হর্তাকর্তা।
-সাধারণ জনগণ এবং ধর্মপ্রাণ রাজাদের উদ্দেশ্য, পবিত্র ধর্মযুদ্ধে অংশ নিয়ে সমস্ত পাপ স্খলন করে পরকালে স্বর্গ লাভ করা।
-এবং কারও কারও উদ্দেশ্য পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনকারী অর্থনৈতিক লাভজনক এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ।
অবশেষে ১০৯৫সালের ২৭শে নভেম্বর পোপের ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম ক্রুসেডের যাত্রা শুরু হোল। ক্রুসেডের প্রথম খড়গটাই নেমে আসল ইহুদীদের উপরে। ইউরোপের রাইন উপত্যকায় বসবাসরত ইহুদীদের উপর হামলা চালাল ক্রুসেডাররা। নারী-শিশু নির্বিশেষে হাজার হাজার ইহুদীকে হত্যা করা হোল, যা ইহুদীদের ইতিহাসের প্রথম হলোকাস্ট নামে পরিচিত।
১২৫০ এর ফ্রেঞ্চ বাইবেলে প্রাপ্ত ইহুদী হলোকাস্টের ছবি
প্রায় ৬০হাজার যোদ্ধার বিশাল ক্রুসেড বাহিনী ৩০০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ১০৯৬-৯৭ সালে উপস্থিত হোল বায়জেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে। এখান থেকেই শুরু হয় মুসলিম দখলদারদের হাত থেকে পবিত্রভূমি উদ্ধারের অভিযান। এরপর বহু যুদ্ধ, অবরোধ পেরিয়ে ১০৯৯ সালে জেরুজালেমের পতনের মাধ্যমে সমাপ্তি হয় প্রথম ক্রুসেড।
ক্রুসেড একটি বিশাল উপাখ্যান, প্রথমটি ছিল পরবর্তী হাজার বছরের যুদ্ধ, রক্তপাতের শুরু মাত্র। প্রথম ক্রুসেডের এই ৪বছর সময়কালে অসংখ্য যুদ্ধ, বীরত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংসতা এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। এই অসংখ্য ঘটনার মাঝে শুধু একটি ঘটনা এই পোষ্টে তুলে ধরব।
সময়কালঃ নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১০৯৮খ্রি.
স্থানঃ বর্তমান সিরিয়ার একটি শহর মা’আরাত আল নুমান
মা'আরাতের প্রাচীন দুর্গ-শহর
দখলের উদ্দেশ্যে ১০৯৮এর নভেম্বরের শেষের দিকে মা'আরাত শহরের বাহিরে অবরোধ শুরু করে ক্রুসেডার বাহিনী। ২০,০০০অধিবাসী অধ্যুষিত শহরে কোন সংগঠিত সেনাবাহিনী ছিলনা। স্বেচ্ছাসেবক মিলিশিয়াদের দিয়ে মুসলিম বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে। শহরের শক্ত দেওয়াল ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে ক্রুসেডাররা Siege Tower তৈরি করে আক্রমণ শুরু করে এবং এর সহায়তায় অবশেষে তারা প্রাচীরের উপর নামতে সক্ষম হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা পিছু হটতে হটতে শহরের ভিতরের কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
এমনি পরিস্থিতিতে ক্রুসেডারদের সেনাপতি বোহেমন্ড এর সাথে মা’আরাত শহরের সেনাবাহিনীর সমাঝোতা হয়, অস্ত্র সমর্পণ করলে কারও কোন ক্ষতি করা হবেনা। আশ্বস্ত হয়ে শহরবাসীরা অস্ত্র জমা দেয়, কিন্তু তারা নিরস্ত্র হওয়া মাত্রই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রুসেডাররা। হত্যা করা হয় শহরের ২০০০০ হাজার অধিবাসীর প্রত্যেককে; নারী-পুরুষ, মুসলমান, ইহুদী, অগ্নি পূজারী কেউ রক্ষা পায়নি ক্রুসেডারদের তলোয়ারের হাত থেকে।
ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম বর্বরতার হয়তো অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে কিন্তু পরে যা হয়েছিল তার তুলনা কখনোই পাওয়া যাবেনা। দখলের পর ১মাস ৪দিন এই শহরে অবস্থান করে ক্রুসেডাররা, কিন্তু প্রত্যাশানুযায়ী লুটপাট করতে ব্যর্থ হয় তারা। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা, মনের জ্বালা মেটাতে বেছে নেয় হত্যা করা মৃতদেহগুলো। সেগুলো হতে মাংস কেটে রান্না করে খাওয়া শুরু করে তারা, বিশেষ করে বাচ্চাদের মাংস পুড়িয়ে গ্রিল করে খেয়েছিল তারা।
মা'আরাতের ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য
ক্রুসেডারদের বর্বরতার স্বীকার হয় এই অভিযান চলাকালীন দখল হওয়া প্রতিটি শহর। জেরুজালেম বিজয়ের পরেও অসংখ্য মুসলমান, ইহুদী হত্যার পাশাপাশি ক্যানিবালিজমের ঘটনা আবারো ঘটায় তারা। মহান ধর্মযুদ্ধ বিজয়ের গৌরবের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে এরকম অসংখ্য বর্বর, নৃশংস ঘটনা।
আজকে মুসলমানেরা অনেক পিছিয়ে আছে; আরব, পার্সিয়ান, তুর্কি জাতি এখনো ইসলামের নামে অনেক পশ্চাৎপদ প্রথা চালু রেখেছে স্বীকার করি। কিন্তু তীব্র আপত্তি জানাই, যখন বলা হয় ১৪০০ বছর পূর্বে আরব এবং মুসলমানেরা ছিল অসভ্য, বর্বর। রাগ উঠে যখন নাস্তিক হনুগুলো মহানবীর দেখানো পথকে অশান্তিময় বলে আখ্যা দেয়। মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় দু’এক জায়গায় বিশৃঙ্খলা, হত্যাযজ্ঞ হয়েছে কিন্তু তা কখনোই হনুদের পশ্চিমা প্রভুদের মতো এতো বর্বর ছিলনা। বরং সুযোগ্য মুসলিম শাসকেরাই সকল বিভেদ ভুলিয়ে সংঘাতময় স্থানকে সকলের জন্য শান্তিময় করে তুলেছে; যার প্রমাণ স্পেন, জেরুজালেম, ভারতবর্ষ।
মুসলমানেরা কখনো মৃতদের মাংস খায়নি, ইহুদীদেরও কোন হলোকাস্ট উপহার দেয়নি। ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের দ্বন্দ্ব সেই প্রথম ক্রুসেড পরবর্তী রোমান ক্যাথোলিকদের সুদীর্ঘ চক্রান্তের ফসল। আজকে খ্রিস্টান-ইহুদীরা একজোট হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর অজ্ঞতা এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে মুসলমানেরা সেই ফাঁদে পা দিয়ে ঘটাচ্ছে লিবিয়ার মত ঘটনা।
গত কয়দিনে হনুদের মনে হয় ঈদ লেগে গেছে, মুসলমানদের নামে দোষ দিতে গিয়ে অনেকে দেখছি ইতিহাস পর্যন্ত চরম বিকৃত করছে। এতো ভদ্র সুশীল হয়েও কিভাবে এরা মিথ্যা বলে!! নাস্তিক অনেক দেখেছি, বাহিরের বন্ধুদের মাঝে বেশীরভাগই নাস্তিক। এদের দেখে মনে হয় আমাদের দেশেরগুলা জীবনেও শুদ্ধ নাস্তিকও হতে পারবেনা, চুলকানিওলা হনুই থেকে যাবে সারাজীবন।
প্রথম ক্রুসেড
মা'আরাত অবরোধ
পোপ আরবান
জেরুজালেম
View this link
View this link
ইউটিউব লিঙ্ক