somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ল্যাপ অব দ্য গডস

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৃশ্যপট ১

জ্বর মুখে বা শারীরিক অসুস্থ্যতায় সিগারেট তোতো লাগে, মুখ বিস্বাদে ভরে যায়। এজন্য মাঝে মাঝে আমি শরীরটা সুস্থ্য আছে কী নেই তা পরীক্ষা করার জন্য ধুমপান করে থাকি। এই ধুমপানকে নেশা হিসেবে দেখার কোন সুযোগ নেই কারণ আমার উদ্দেশ্য রোগ নিরুপন, ধুমপান নয়। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবেতো বটেই সিগেরেটের প্যাকেটে "ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর" বা "ধুমপান ক্যান্সারের কারণ" এসকল সচেতনাতামূলক তথ্যের সাথে আমি পরিচিত। তবু মাঝে মাঝে জ্বর হলো কীনা তা পরীক্ষা করে দেখতে আমি ধুমপান করে থাকি; আর যখন করি তখন আয়েশ করেই তা করা হয়!

দেশের অবস্থা ভালো নয়। প্রতিদিন গাড়ি পুড়ছে, রাস্তায় আগুন জ্বলছে আর সেই আগুন মানুষের পোষাক ভেদ করে শরীর পোড়াচ্ছে। আগুন যখন পোড়ায় তখন কী পোড়াচ্ছে, কাকে পোড়াচ্ছে, ছেলে না মেয়ে, ছোট বাচ্চা না বয়স্ক বৃদ্ধ অথবা মানুষ না কুকুর-বেড়াল কিংবা রিকশা নাকি টয়োটা কার তা দেখার সুযোগ নেই। সামনে যা পায় তাই পোড়ায় বৈকি। এই আগুনে পোড়া বা ঝলসে যাওয়া আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে।

আসলে আমার ভাবার খুব একটা কারণ ছিলনা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এক মাসের ছুটি ঘোষণা করেছে। আমি চাইলেই বাসায় বসে শীতের কামড় থেকে বাঁচার জন্য আগুন পোহাতে পারি আমদের গ্যাসের চুলায়। কিন্তু দু'টো টিউশনি করতে আমাকে বাইরে যেতে হয়। যেহেতু যেতে হয় সেহেতু আমাকে ফিরেও আসতে হয়। আর এই যাওয়া আর ফিরে আসার মাঝে অনেকটা সময় রাস্তায় উলঙের মত ঘোরাঘুরি করতে হয়। এখানে "উলঙ" অবস্থাটি যতটুকু আক্ষরিক অর্থে তার চেয়ে বেশি প্রায়োগিক অর্থে। কারণ পেট্রোল বোমা যখন কেউ ছুড়ে মারে তখন নিশ্চয়ই পোষাক থাকা বা না থাকা কোন বিষয় নয়।

দৃশ্যপট ২

শাহরুখ আর আমির দুই ভাই। ওরা থাকে বাড্ডায় এক বস্তিতে। ওদের বাবার হিন্দি সিনেমা দেখার খুব শখ ছিল এবং তিনি তার ছেলেদের নাম রেখেছেন বলিউড সিনেমার নায়কদের নামে। ওদের আরেকটা ভাই থাকলে ভালো হত, তার নাম রাখা যেত সালমান। কিন্তু সালমানের জন্মের আগেই ওদের বাবা মারা যাওয়ায় বলিউডি সম্রাজ্য পূর্ণতা পায়নি।

দুই ভাইকে ওদের মা বড় করার চেষ্টা করেছেন। এখানে বড় করা মানে সাধারণ অর্থে লেখাপড়া করে বড় হওয়া নয়। এখানে বড় হওয়া মানে গায়ে গতরে বড় হওয়া। কিছুদিন স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে দুই ভাই, কিন্তু সংসারের টানাটানি ওদের স্কুলে যেতে দেয়নি। তবে ওরা স্কুলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছে- শাহরুখ একটা স্কুলের ভ্যান চালায় আর আমির ঐ স্কুলের সামনে চানাচুর বিক্রি করে।

কিন্তু এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় ওদের আয় উপার্জনে বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সমস্যা সমাধানের কোন উপায় বলিউডি দুই নামকাওয়াস্তা নায়ক খুঁজে পাচ্ছেনা।

কিন্তু সমস্যা যেখানে থাকে, সমাধানের উপয়াও সেখানেই থাকে। ওদের বস্তির বশীর মোল্লা আজ দুই ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছে তার ডেড়ায়। বশীর মোল্লা সিল্কের শার্ট পরে, কখনো কখনো পান্জাবী পায়জামা আবার মাঝে মাঝে পোলো টিশার্ট ফেড জিন্স। তাকে বস্তিতে ঠিক মানায় না। তবু কত বেমানান জিনিসইতো আমাদের চারপাশে ঘটে।

- শাহরুখ, তোরা ভাই তো তোর রেকর্ড ভাইঙা ফেলবোরে। ধুম থ্রী আইতেছে মার্কেটে।

মোল্লার কথা শুনে শাহরুখ একটু বিমর্ষ হয়। সে জানে বাস্তব জীবনে সে একজন ভ্যানগাড়ি চালক। আর তার ভাই সামান্য চানাচুরওয়ালা। তবু নামের মিল একদম ফেলে দেবার মত নয়। বলিউডি সিনেমার প্রতিযোগিতা যেমন দুই খানের মাঝে আছে তেমনি কী যেন একটা প্রতিযোগিতা দুই ভাইয়ের মাঝেও কাজ করে।

- হ! জানি। সিনেমার গপ করার লাইগা ডাকছেন?

- না, একটা কাম আছে। করবি? ভালো টেকা দিমু। দিনে ধর দুই ভাই চাইরশো টেকা পাবি।

আমির শাহরুখ একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। দিনে চারশো টাকা!!

- কী কাম?

আমিরের প্রশ্নে মোল্লা যে জবাব দেয় সেটা খুব সহজ। ওদের কিছু গাড়ি ভাঙচুর করতে হবে। রাস্তায় পিকেটিং করতে হবে। মিছিলে গলাবাজি করতে হবে। এমন সব ছোট ছোট সামান্য কাজ। এমন কাজে রাজি হওয়া যায়, যদিও পুলিশের তাঁড়া খাওয়ার ভয় আছে তবুও পুলিশের তাঁড়া খাওয়া ওদের কাছে নতুন কিছু নয়।

আমির আর শাহরুখ একজন আরেকজনের দিকে তাকায়, কথা হয় চোখে চোখে খুব কম সময়ে। আমিরই মুখপাত্রের ভূমিকায় জবাব দেয়-

- হ, করুম।

-ভালো। তাইলে আইজ রাইত আটটায় গলির সামনে যে বড় রাস্তাডা আছে ঐটার সামনে যে স্কুলটা পরে তার সামনে থাকবি।

দৃশ্যপট ৩

টিউশনি শেষ হয়েছে আজকের মত। আমার ছাত্রের মা আজ না খাইয়ে ছাড়লেন না। বাড্ডা থেকে বাসায় যেতে এখন অনেক সময় লাগবে। আর এদিকে খাওয়াটাও একটু বেশি হয়ে গেছে। শরীরটা কি একটু খারাপ লাগছে। জ্বর এলো নাকি!! না, আজ একটা সিগেরেট খাওয়া জরূরী হয়ে পরেছে দেখা যায়। আমি একটা বেনসন কিনতে ঢুকে পরি গলির মোড়ের দোকানে। রাত আটটা বাজে, কিন্তু চারদিক কেমন মন মরা, কেমন ধুসর! যেহেতু আমি নিয়মিত স্মোকার নই, সেহেতু ৯ টাকার বেনসন আমার গায়ে লাগেনা। আমি সিগেরেটে আগুন ধরিয়ে রিক্সা খুঁজতে থাকি...

দৃশ্যপট ৪

মোল্লা একটা পেপসির বোতলের মত কিছু ধরিয়ে দেয় শাহরুখের হাতে। আরেকটা একই জিনিস আমিরের হাতে। দুই ভাই একটু বিব্রত। কারণ ওরা ঠিক বুঝতে পারছেনা এই জিনিস দিয়ে কী করতে হবে।

- শোন, এই বোতলের মাথায় আগুন ধরাইয়া যে গাড়ি যাইতে দেখবি সেই গাড়িতে ছুইড়া মারবি। মাইরা দৌড় দিয়া পালাইয়া যাবি। অন্যটা এমনেই অন্য কোন জায়গায় মারবি। রাইতে বস্তিতে দেখা হইবো- টেকা নিয়া যাইস।

মোল্লা অপেক্ষা করেনা। হনহন করে কোন কথা বলতে না দিয়েই চলে যায়। একটু পর তার সিল্কের শার্ট আর দেখা যায়না। এদিকে আমির আর শাহরুখ কিছুটা বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। তারা রোবটের মত দাঁড়িয়ে আছে। অবচেতন মনে তারা কোন একটা গাড়ি আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু আজকে রাস্তাটা বড় শুনশান। কোন গাড়ি নেই এদিকে!

প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল। কিন্তু কোন গাড়ির দেখা মিলছেনা। এমন সময় একটা রিকশা এগিয়ে আসতে দেখে ওরা। দু'জন তাকায় দু'জনের দিকে। চোখে চোখে কথা হয়- খুব অল্প সময়ে। রিকশাটা এগিয়ে আসছে আর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ওদের পাশ কাটিয়ে যাবে। আমির পকেটে হাত ঢোকায় দেশলাইয়ের জন্য। কিন্তু না নেই। ওরা পেট্রোল বোমার বিষয়টা জানতোনা। ওদের কারো কাছেই দেশলাই নেই।

শেষ দৃশ্যপট

নাহ, সিগেরেট মোটেই তেতো লাগছেনা আজ। মনে হয় শরীরে কোন জ্বর নেই। সিগেরেট শেষ হয়ে এসেছে। আমি শেষবারের মত সিগেরেটে একটা টান দেই আর তারপর ওটার গোড়াটা প্যারাবোলিক পথে ছুড়ে মারি দূরে। রাস্তা একদম ফাঁকা, কিন্তু সিগেরেটের গোড়াটা যেখানে পরলো ওখানে দু'জন মানুষের ছায়া দেখলাম মনে হলো... ...!!
২৪টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×