somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শোকাবহ আগস্ট: আমব্রিখটের চিঠি

১৮ ই আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম আলো
১৮ই আগস্ট, ২০০৯ (মূল পাতা)

শোকাবহ আগস্ট: আমব্রিখটের চিঠি:

জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ও সুইস কুটনীতিক ড. ভিক্টর এইচ আমব্রিখট ব্যাংককে মার্কিন দুতাবাসের মাধ্যমে ১৭ নভেম্বর এক মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠির উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি হোয়াইটহাউস পরদিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠান।

ড. ভিক্টর আমব্রিখট লিখেছিলেন, "৩ নভেম্বর আমি ঢাকা থেকে ফিরি। এর আগে রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান নিয়ে প্রচন্ডতম তর্ক-বিতর্ক ও মতবিরোধ রয়েছে। তাঁদের অনেকেই মুজিব, তাঁর পরিবার ও চার নেতাকে হত্যার বিষয়ে ঘাতক মেজর ও ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে নেই। তাঁরা ঘাতকদের ক্রিমিনাল হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। আমি ওই দেশটা থেকে একটি হেলিকপ্টারে প্রথমে কলকাতায়, সেখান থেকে ইউরোপে চলে আসি।"

জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ড. আমব্রিখট মুজিব সরকারের সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিবরণ দেন। তিনি লিখেছেন, "গত ১২ মাস ধরে দেশের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটেছিল। ভালো খাদ্য পরিস্িথতি, বৃহত্তর খাদ্য মজুদ, ব্যাপক রপ্তানি ও ঘাটতিবিহীন বাজেটও ছিল। ধর্মঘট ছিল না। ছিল ভালো জনকর্মসুচি, ভালো "কাজের বিনিময়ে খাদ্য" প্রকল্প, কম বেকারত্ব, অধিকতর দক্ষ জনপ্রশাসন (যদিও এখনো দুর্দশা কাটেনি) প্রভৃতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তম অংশটিকে কেন নির্মুল করা হলো, তা বিচার করা দুরূহ। আমাদের তা দেখা ও বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।"


এ পর্যায়ে মার্কিন সরকারকে যেন কিছুতেই মেজরদের আশ্রয় না দেয়, সে আবেদন জানিয়ে ড. ভিকটর বলেন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছ থেকে আমি জেনেছি, এই সামরিক ব্যক্তিরা মস্ত বড় দুর্বৃত্ত। তাঁরা কেবল শেখকেই হত্যা করেননি, তাঁরা তাঁর স্ত্রীকে ছুরি দিয়ে খুন করেন। তাঁরা হত্যা করেন শেখের দুই বিবাহিত পুত্রকে। সঙ্গে তাঁদের তরুণী স্ত্রীদেরও (একজনের বিয়ের বয়স হয়েছিল ১৫ মাস, অন্যজনের তিন সপ্তাহ)। তাঁরা শেখের ১১ বছরের কনিষ্ঠতম ছেলেটাকে বাগানে ধাওয়া করেন এবং গুলি করে হত্যা করেন। ড. আমব্রিখট লেখেন, "এই চরম নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার সব বিবরণ দানের ভাষা নেই। এই দুর্বৃত্তদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো উচিত এবং একটি সামরিক আদালতে তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। আমেরিকার ঔদার্য ও মহত্ত্বের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এই দুর্বৃত্তদের ঠাঁই যুক্তরাষ্ট্রে হতে পারে না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, স্টেট ডিপার্টমেন্টে আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে লিখব। পরে ভাবলাম তা যথাসময়ে পৌঁছে কি না। তাই আপনাকে লেখা।"

পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন এক সংবর্ধনায় ১৮ নভেম্বর রাতে বোস্টারকে জানান, "মেজরদের আশ্রয়ের ব্যাপারে আপাতত একটা উপায় হয়েছে।" লিবিয়ায় কীভাবে তাঁরা আশ্রয় পেয়েছিলেন, সে বিষয়ে জানা যায়নি। তবে লিবিয়ার পত্রিকায় ছাপা এ বিষয়ক একটি খবরের বরাতে ওই দেশের মার্কিন দুতাবাসের একটি তারবার্তা এখনো গোপন রাখা হয়েছে। ২৪ নভেম্বরে ফারুকেরা যখন ব্যাংকক ত্যাগ করেন, তখন তাঁদের সেখানে বিদায় জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত সালেহউদ্দিন কায়সার। এ বিষয়ে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির কোনো মন্তব্য কখনো জানা যায়নি। পঁচাত্তরের মে মাসে গাদ্দাফি ঢাকায় দুতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ফারুক-রশীদ চক্রের ভিসা ঢাকার দুতাবাস থেকেই দেওয়া হয়।

ওরা খুনি: ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ বোস্টার এক তারবার্তায় লেখেন, জার্মান রাষ্ট্রদুত রিটার গত রাতে আমাদের জানিয়ে দেন যে মেজররা তাঁর দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। কিন্তু ৬ নভেম্বরে বনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন, "ওরা খুনি, ওদের যেন আশ্রয় না দেওয়া হয়।" রিটার বলেন, "আমিও তাদের আশ্রয় না দিতে সুপারিশ করেছি।" উল্লেখ্য, ওই সময়ে জার্মানিতে রাষ্ট্রদুত ছিলেন প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।

ত্রিপোলিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদুত স্টেইন ২৫ নভেম্বর জানান, "লে. কর্নেল ফারুক ও তাঁর দল ২৪ নভেম্বর বেনগাজিতে পৌঁছান।" বিমানবন্দরে তিনি এক টিভি সাক্ষাৎকারে ভারতের নাম না নিয়ে বলেন, তার সরকার ও জনগণ যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, বাংলাদেশ এখন সেসব শত্রুবেষ্টিত। এই সংগ্রামে পাশে দাঁড়াতে তিনি "মুসলিম ভাই"দের আহ্বান জানান।

খুঁটিনাটি: ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্যাংকক থেকে হোয়াইটহাউস যা লিখেছেন তাতেও মেজরদের নিয়ে কিসিঞ্জারের উদ্বেগ স্পষ্ট। "পররাষ্ট্র দপ্তরের রেফারেন্স টেলিগ্রামের (নম্বর ২৬১৭৮৭) ভিত্তিতে জানাচ্ছি যে ৪ নভেম্বর বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের যাঁরা ব্যাংককে পৌঁছেছেন, তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে সব ধরনের খুঁটিনাটি জানতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এবং তা জানার সঙ্গে সঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ হোক না-হোক, পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানিয়ে দিচ্ছি। ব্যাংককের পাকিস্তান দুতাবাস বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বিষয়ে দারুণ আগ্রহ দেখাচ্ছে। ৪ নভেম্বর তাঁরা পৌঁছানোর পর তাঁদের বিমানবন্দর ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তাঁরা এখন ভিক্টোরিয়া হোটেলে অবস্থান করছেন। পাকিস্তান দুতাবাস জানিয়েছে, বাংলাদেশ দুতাবাসই থাই ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের মাধ্যমে দলটিকে ক্লিয়ারেন্স করিয়েছে।

পাকিস্তানের ঝুঁকি: ৫ নভেম্বর রয়টার্সের ব্যাংকক সংবাদদাতা জন রজার্স পাকিস্তান দুতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি খালিদ নিজামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি কর্নেল ফারুকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নিজামী তাঁকে বলেছেন, "এই দলটি বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে এসেছে বর্তমান ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী সেনা কর্মকর্তাদের সম্মতিক্রমেই। খালিদ নিজামী আমাদের জানিয়েছেন, ওই গ্রুপের অন্যান্য কর্মকর্তা যাঁদের মধ্যে লে. কর্নেল খন্দকার আ. রশীদ ও লে. কর্নেল শরিফুল হক (মেজর ডালিম) রয়েছেন।"

খালিদ নিজামী বলেছেন, এ মুহুর্তে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তানের জন্য ঢাকার পরিস্িথতি এতটাই অনিশ্চিত যে তাদের পক্ষে ওই কর্মকর্তাদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব না। কারণ, বর্তমানে যাঁরাই ক্ষমতায় থাকুন, তাঁদের তা অননুমোদনের ঝুঁকি রয়েছে।
জিয়ার পরামর্শ: ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৫ চেসল ঢাকা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে টেলিগ্রাম পাঠান যে আজ সকালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলার গুজব নাকচ করেন। যে ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, আমি এর একটি দৃষ্টান্ত দিলাম। বললাম, বেনগাজি থেকে এক অথবা একাধিক কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছে কি না। জবাবে তিনি (জিয়া) বলেন, সামরিক বাহিনীতে সবকিছু শান্ত রয়েছে। যে ধরনের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গে না নিতে তিনি অনুরোধ জানান। নির্বাসিত কর্মকর্তাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জিয়াউর রহমান বলেন, তাঁরা (ফারুক-রশীদ) ঢাকার সমস্যা সম্পর্কে জানেন, যা কিনা তাঁরা ফিরে এলে আরও প্রকট হবে। সুতরাং তাঁদের আরও অপেক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৪:৪৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×