somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলিংগেন, জার্মানী থেকে ফিরে (৩)

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জলিংগেন, জার্মানী থেকে ফিরে (৩)

পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার কয়েকদিন আগের কথা; আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম “আকল কুয়ায়” যাব। “আকল” আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে মেধা কিংবা বুদ্ধি, সম্ভবতঃ আমাদের মধ্যে কেউ পরীক্ষার আগে বুদ্ধি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই প্রস্তাব করেছিল। তখন আমাদের জন্য আকল কুয়া ছিল অনেক দূরের পথ তাই আমরা আমাদের বড় চাচাকে অনূরোধ করে উনার উইলিস জীপে চেপে সেখানে গিয়েছিলাম। কথিত আছে যে, হজরত শাহজালাল (রঃ আঃ) যখন গৌড়ের রাজা গৌরগোবিন্দের সাথে যুদ্ধ জয় করে সিলেটে আসেন তখন এই স্থানেই হয় তার প্রথম অবস্থান। এখানে একটি কুয়া, কয়েকটি মাজার, একটি মসজিদ আর পাশাপাশি জনবসতি গড়ে উঠে তাই আজো জনগণের নিকট এই স্থান একটি বিশেষ মর্য্যাদা পেয়ে থাকে। অনেকের বিশ্বাস আকল কুয়ার পানি পান করলে বুদ্ধি বাড়ে, তাইত এই কুয়ার নাম আকল কুয়া।

সিলেটের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার বেশ ভিন্নধর্মী। ইসলামের সুফি তত্ত্বের বাহক হজরত শাহজালাল (রঃ আঃ) ইয়ামনী তার ৩৬০ জন অনুগামী নিয়ে মক্কা থেকে দিল্লী হয়ে সিলেট আগমন করেন ও গৌড়ের রাজার সাথে যুদ্ধ করে সিলেট বিজয় করেন ১৩০৩ সালে। কথিত আছে তিনি সুরমা নদী পার হতে গিয়ে জায়নামাজ ব্যাবহার করেছিলেন, বড় পাথরের বাধা অতিক্রম করতে গিয়ে পাথরকে আদেশ করেছিলেন “সিল হট যাও” বলে আর সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম সিলেট হয়, তারপর এক সাথীর আজানের ফলে গৌড়গোবিন্দের ৭ তলা অট্টালিকা একে একে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এগুলো সবই রূপকথা।
ঐতিহাসিকদের মতে দিল্লীর সুলতান সিকান্দার শাহ গাজীকে সহায়তা করতেই হজরত শাহজালাল তার ৩৬০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে সিলেট বিজয় করেন। এর পর এই সুফি প্রতিভার ধর্মীয় আচার আর আচরণে মুগ্ধ হয়ে অত্র অঞ্চলের প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে ধর্মান্তরিত হন। চির কুমার হজরত শাজালাল ১৩৫০ সালে মৃত্যুবরণ করলে বর্তমান দরগাহে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সিলেটের সকল কর্মকান্ড আজো এই দরগাহকে ঘিরেই আবর্তিত। সাকীর আব্বা জনাব শফিকুল হক সাহেব এই দরগাহের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। আমাদের নানী দরগাহের মুফতি পরিবারের অন্তর্গত। আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেক কর্মকান্ড এই দরগাহকে নিয়ে জড়িত। আমাদের শৈশবে শবে বরাত ছিল সবচেয়ে আলোকিত ও আনন্দের সময়। ঐদিন ঘরে ঘরে মোমবাতি আর আগরবাতি জ্বালান হত, রান্না হত চালের রুটি, হালুয়া আর আখনি বিরিয়ানি। ঘরে ঘরে বিতরণ করা হত শিরনি, রুটি আর হালুয়া। সন্ধ্যার পর আমরা সবাই দল বেধে যেতাম দরগাহ জিয়ারতে। শাহজালাল সাহেবের দরগাহের পর শাহ পরানের দরগাহ জিয়ারত ছিল আমাদের নৈমিত্তিক কাজ। প্রতি বছর দরগাহে ওরস অনুষ্ঠিত হত। ঐ সময় আমি আর সাকী শাহজালাল সাহেবের ব্যাবহৃত দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর দায়িত্ব নিতাম। প্রদর্শিত হত তাঁর ব্যাবহৃত খড়ম, জায়নামাজ আর তলোয়ার। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে দরগাহ এলাকা উজ্জীবিত হয়ে উঠত। এখন সিলেটে মাজার জড়িত ধর্মীয় আচরণে বেশ পরিবর্তন এসেছে তবে দরগাহের অনুষ্ঠানাদি আরও ব্যাপ্তি লাভ করেছে বলেই আমি মনে করি।

ঈদের দিনে আমরা যেতাম শাহী ঈদগাহে নামাজ পড়ার জন্য। ঐতিহাসিক এই ঈদগাহ ১৭ শতকে মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময়ে একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়। এখানে প্রায় এক লক্ষ লোক একসাথে নামাজ পড়ার ব্যাবস্থা আছে। প্রতি শুক্রবারে দরগাহ মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করা ছিল আবশ্যিক। আমি আমার দাদার সাথে নামাজে যেতাম। নামাজের পর আমরা মাজারের পাশে প্রথমে মিলাদ পড়তাম, সেই মিলাদে দাঁড়িয়ে সুর করে “ইয়া নবী সালামু আলাইকা” পড়া আমার খুব প্রিয় ছিল। এরপর মজার তোষা শিরনী (ময়দার হালুয়া) বিতরণ করা হলে আমরা মাজার জিয়ারত করতাম। মাজারে যেন কোন প্রকার বেয়াদবি না করা হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হত, বিশেষ করে বের হয়ে আসার সময় মাজারকে পিছন দিয়ে আসা ছিল বেআদবী, তাই উল্টো করে হেঁটে বের হতাম আমরা।

সে সময়ে সিলেট শহর ছিল অত্যন্ত ছিম ছাম। জনসংখ্যা ছিল খুব অল্প। শিশির ভেজা ভোরে ঘুম থেকে উঠে শেফালী ফুল কুড়ান আর তা দিয়ে মালা গেঁথে বিতরণ করা আমাদের প্রাত্যহিক কাজ ছিল। সিলেটের ঘর বাড়িতে বিশেষ ঐতিহ্য ছিল। টিনের চাল আর তর্জার বেড়ার উপর চূনামাটীর প্রলেপ দিয়ে “বাংলা ব্যাটন” বাড়ী। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত, টিনের চালে অনবরত বৃষ্টি পড়ার ছন্দবদ্ধ শব্দ আমাদের খুব প্রিয় ছিল। একবার আমার মনে আছে ১৭ দিন আর ১৭ রাত অবিরাম বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি আক্রান্ত সময়ে মাঝে মাঝেই ঘরে দুপুর বেলা খিচুড়ি আর ভুনা মাংস রান্না হত। গাড়ী ছিল হাতে গোনা, রিক্সাই ছিল প্রধান বাহন। দৈনন্দিন জীবন ছিল নিরাপদ, সুখ ও আনন্দের কিন্তু শ্লথ। প্রবাসীদের কল্যাণে তখনও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক ভালো। ধীরে ধীরে বদলে গেছে সিলেটের জীবন। জনসংখ্যা, গাড়িঘোড়া, দালান কোঠা, বাজার হাট সকল কিছুই বেড়েছে কিন্তু চরম অবহেলা আর পরিকল্পনাহীনতায় জীবনের সৌন্দর্য্য আজ বিতাড়িত হয়েছে। অপরিকল্পিত শহর সম্প্রসারণ জনজীবনে এনে দিয়েছে চঞ্চলতা। নিরাপত্তাহীনতা, দূর্ঘটনা আর সন্ত্রাস আমাদের ঘিরে ফেলেছে চারিদিকে। ইউরোপের জীবন দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আমরা ভাবছিলাম কবে আবার আমরা আধুনিক সভ্যতার চূড়া দেখব আর কবে আমরা আবার সুখ আর নিরাপত্তার বেষ্টনীতে মাখা জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করব। কবে সুরমা নদীর পানিতে স্বচ্ছতা আসবে আর সেই নদিতে নৌকা বিহার করে সারা বিশ্বের পর্য্যটকরা আলী আমজদের ঘড়ি আর চাদনীঘাটের সিঁড়ীর ইতিহাস বিবৃত করবে। কলন-বন বিমানবন্দরের মত সিলেট বিমানবন্দর কবে আধুনিকতা আর ব্যাস্ততায় ভরে উঠবে আর সেই বিমান বন্দর থেকে ব্যাটারি চালিত টয়োটা আউরিস গাড়িতে করে আমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলা ব্যাটন বাড়িতে ফিরব সেটা ভবিতব্যই জানে।

সম্ভবতঃ মধ্যবার্ষিকী পরীক্ষার পরের কথা। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা কালীন সময়ে আমি দেখলাম ১ম, ২য় কিংবা ৩য় অবস্থানে আমার নাম নেই, মন খারাপ করে আর ফলাফল না শুনেই আমি স্কুল থেকে পালিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে মন খারাপ করে শুয়েছিলাম কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সাকী আর জসীম এসে উপস্থিত। আমার মন খারাপের কথা শুনে জানালেন যে আমার অবস্থান ছিল ৫ম তাই মন খারাপ করার কোন কারন নাই। বন্ধুদের সাহচর্য্যে মন আবার চাংগা হয়ে উঠলো।

সাকী আমাদের পাঠশালা জীবনের সহপাঠীদের কথা স্মরণ করলেন; গোলাম মোস্তফা, আবদুস সামাদ নজরুল, জুলফিকার, ঊষা, কওসর জাহান, সাইফুল ইসলাম টিপু, সৈয়দ মিফতাহ ফেরদৌস রেজা, এনামুর রহমান চৌধুরী ও অন্যান্যদের কথাও স্মরণ করলেন। আমি সেই দিনে ফিরে গিয়ে গোলাম মোস্তফার মুখস্ত করার ক্ষমতার কথা বললাম, যা ছিল অনন্য সাধারণ। পুরো সমাজপাঠ বই মুখস্থ ছিল তার। কোথায় যে ছিটকে পড়েছেন জীবনের সাগরে আমাদের জানা নেই। নজরুল আমেরিকা গিয়েছিলেন ফিরে এসে সিলেটে পৌর কমিশনার হয়েছিলেন। জুলফিকার ডাক্তার হয়েছিলেন, অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই। কওসর জাহান সিলেটেই আছেন, বড় ব্যাবসায়ী হয়েছেন ফেইসবুকের সুবাদে ভালো যোগাযোগ আছে। সাইফুল ইসলাম টিপু লন্ডনে বাস করেন, তার সাথেও যোগাযোগ আছে ফেইসবুকের সুবাদে, মিফতাহ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সিলেটে গণপূর্ত বিভাগে কাজ করেন আর এনাম সমরিক বাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবস্থায় সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন।

আমাদের পাঠশালা জীবনের সহপাঠীদের কয়েকজনের নাম নিয়েছি কিন্তু ওখানে ইচ্ছে করেই একজনের নাম উচ্চারিত হয়নি। সেই বন্ধুর নাম জসীম আহমেদ। জসীম, সাকী আর আমি এই তিনজনের এক জুটি ছিল, আমরা ছিলাম হরিহর আত্না। আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক পাঠশালা থেকে পারিবারিক, সামাজিক এবং তদুর্ধে এক আত্নীক পর্য্যায়ে উন্মেষ লাভ করে। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আজো অটুট আছে কিন্তু ইতিমধ্যে ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে ডাঃ জসীম আহমেদ চক্কু চিকিতসায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহনকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যে পরলোক গমন করেন। তিনজনের এই জুটির দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের সঠিক কি কারণ ছিল আমার জানা নেই। আমি যদি পিছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, আমাদের মধ্যে যতটুকু মিল ছিল তার থেকে অমিল ছিল বেশী। যেমন জসীমদের অর্থনৈতিক অবস্থা সেই ১৯৬৬ সালেও ছিল আমার কিংবা সাকীর থেকে অনেক ভালো। জসীমের আব্বা সিলেটে প্রথিতযশা চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন। আমার আর সাকীর আব্বা দুজনেই সরকারী চাকুরী করতেন। চাকুরীর সুবাদে সাকীদের পরিবার থাকতেন আম্বরখানা সরকারী কলোনিতে আর আমার আব্বার পোস্টিং ছিল ময়মনসিংহ শহরে কিন্তু সিলেটে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন আমার দাদা, যিনি তখন সিলেটে সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর স্কুলের পাশেই দাদার সাথে আমাদের পারিবারিক বাসস্থানে আমরা বাস করতাম। যতদূর মনে আছে তখনই জসীমদের প্রাইভেট গাড়ী ছিল। আমি ৫ম শ্রেণীর পরে ১৯৬৭ সালে ফিরে যাই রাঙ্গামাটিতে যেখানে আমার আব্বার পোস্টিং ছিল। দশম শ্রেণীতে আবার ফিরে আসি সিলেটে, সেখানে আবার আমরা তিনজন একইসাথে সরকারী পাইলট স্কুলে পড়ি। এরপর জসীম ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যান, সাকী আর আমি সিলেটেই পড়ি। আমি বিজ্ঞানে আর সাকী আর্টস। সাকীর আব্বার অকাল প্রয়াণের পর তিনি মদন মোহন কলেজে বি কম পড়া শুরু করেন, আমি আর জসীম সিলেট মেডিকেল কলেজে আবার একত্রে পড়াশুনা করি। আমরা দুজন চিকিৎসক হই কিন্তু সাকী জার্মানীতে চলে যান।

আসলে সহপাঠী, সহযাত্রী, সুহৃদ কিংবা বন্ধুত্বের ব্যাবধান করাও সহজ কথা নয়। আমরা অনেকের সাথে একই ক্লাসে পড়েছি কিন্তু সবাই আমাদের বন্ধু হয়নি। জীবন চলার পথে অনেক সহযাত্রী কিংবা প্রতিবেশী পেয়েছি কিন্তু বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন। বন্ধু শব্দটি ছোট হলেও অর্থের ব্যাপ্তি আছে আর এই সম্পর্ক সহজে রাতারাতি গড়ে উঠে না। প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে কোন কৃত্তিমতা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা থাকেনা, মনের সুখ দুঃখ ব্যাথা বেদনার কথা একে অপরের নিকট প্রকাশ করতে পারেন অকপটে, দুর্বল দিক সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার কোন ভীতি থাকে না অর্থাৎ আস্থা ও বিশ্বাস থাকে জলজ্যান্ত। প্রকৃত বন্ধু একে অপরের সাথে হয়ত যোগাযোগ রাখেন কমই কিন্তু আত্নীক যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। এক বন্ধুর বিপদে অন্য বন্ধুর সাহায্য থাকবে অবধারিত। বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে ব্যাক্তি স্বার্থ কিংবা আত্নস্মমানবোধ কিংবা অহংবোধের স্থান থাকে অতি সামান্যই। মতামতের ভিন্নতা সত্যেও একে অপরের ভিন্ন চিন্তা ও চেতনাকে দেবেন প্রাপ্য সম্মান। এধরনের বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় আর অনেকেই মনে করেন ভাল বন্ধুত্ব মানুষকে সঠিক পথ চলতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সঠিক রাখতে ভাল বন্ধুর তুলনা হয়না। কথায় বলে, “ভালো বন্ধু পাওয়া কঠিন, তাদের ত্যাগ করা আরো কঠিন কিন্তু তাদের ভুলে যাওয়া অসম্ভব”; “তোমার চোখের জলকে চেনে সেরকম একজন বন্ধু তোমার মুখের হাসি চেনে এমন অনেক বন্ধুর চেয়ে উত্তম”; কিন্তু যে বন্ধুত্ব সম্পর্কে আমার সবচেয়ে পছন্দের বাণী হচ্ছে, “একজন বন্ধু সেই জন যে তোমাকে ভালোবাসে, তোমার সম্পর্কে ভাবে ও পরিবারের মত তোমাকে সুরক্ষিত দেখতে চায়। একজন বন্ধু জানে তোমারের অন্তরের গভীরে লুক্কায়িত গোপন খবর, সে তোমার বোকাটে রসিকতা নিয়ে যেমন হাসে তেমনি তোমার সাথে কাঁদেও বটে.........তোমার অনুভূতিকে সম্মান করে এবং সর্বদাই তোমাকে সুখী দেখতে চায়......। তারা তোমার হাসিতে লুকিয়ে থাকা বেদনাকে যেমন দেখতে পায় ঠিক তেমনি তোমার একাকীত্বের সময় তোমার পাশেই থাকে .........। কোন মানুষের জীবনে একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধু একটি হীরক খণ্ডের মত রত্ন।।“

গল্প করে করে কিভাবে যে আমরা সাকীর বাসায় পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। বাসায় পৌঁছে এনেটের উষ্ণ অভ্যর্থনা, তারপর সাকীর নিজ হাতে রান্না করা সবজী, পাঙ্গাশ মাছের তরকারী আর বাগার দেয়া ডাল খেয়ে ঢেকুর দিয়ে গল্পের দ্বিতীয় আসর জমালাম। বন্ধুর নিজের হাতে রান্না করা খাবারের স্বাদই অন্যরকম। তিন যুগ জার্মানীতে বসবাস করে জার্মান হয়েছেন সত্যি কিন্তু বাঙ্গালী খাবার খেতে পছন্দ করেন তাও আবার নিজের হাতে রান্না করে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মসুর ডাল, সেটা আবার পাচ ফোড়ন দিয়ে বাগার দিয়ে খেতে হবে।

সাকী-এনেটে পরিবারের তৃতীয় সদস্য হচ্ছেন তাদের প্রিয় বিড়াল, মিওঁ; এবার এনেটে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার প্রিয় বিড়ালের সাথে। বললেন ও অনেক লাজুক সবার সামনে আসতে চায়না কিন্তু কাউকে জালাতন ও করেনা। একটি ছোট বল দেখিয়ে বললেন এটার ভিতরে খাবার দিয়ে দিলে সে খেলতে থাকে আর খেতে থাকে। সে তখন বসেছিল একটি আলমারির ছাদে ধীরে ধীরে নেমে এল, এনেটে আদর করে ছুয়ে দিলেন। আমি যখন সোফা সেটে বসে গায়ে কম্বল জড়িয়ে গল্প করছিলাম তখন আলতো করে কার্পেটের উপর বসে যেন আমাদের গল্প শুনছিল। বিড়ালরা কি আমাদের কথা বুঝতে পারে? সাকী মনে করেন ভাষা না বুঝলেও অভিভাবকের মানসিক অবস্থান, ইশারা ও অংগভঙ্গি ঠিকই ঠাহর করতে পারে আর তারাও তাদের অংগভংগি, আচার আচরণ দ্বারা নিজেদের প্রকাশ করে। সাধারণতঃ বিড়াল ভদ্র প্রাণী, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। তাই পোষ্য হিসাবে বিড়ালের জুড়ি নেই।

রাতের খাবার খেয়ে গল্প করতে বসলাম। প্রথমেই টেবিলের উপরে রাখা চোখে পড়ল শারমিন আহমদ এর লিখা “তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা” বইটি। সাকী’র বই পড়ার সখ আছে, বেশ ভালো পড়ালিখা করেন, আমাকে ও উদ্বুদ্ধ করেন নানা সময়ে, বিভিন্নভাবে। কখনো কখনো তিনি আমাকে টেলিফোন করে নূতন বইয়ের খবর দেন আবার কখনো পড়া হয়ে গেলে আমরা বইয়ের সমালোচনা ও করি দীর্ঘ সময় ধরে। বইটা সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম বইটা পড়া হয়েছে কিনা। সাকী জানালেন শুরু করেছেন মাত্র এখনও শেষ করা হয়নি। বাংলাদেশ থেকে সদ্য বইটি পাঠিয়েছেন শিরিন, বইয়ের প্রথম পাতায় নব বর্ষের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন শিরিন। এই শিরিনটি কে তা আর জিজ্ঞেস করা হল না। বইটি এপ্রিল ২০১৪ তে প্রকাশিত হয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তাজউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে তার নিজের মেয়ের লিখা বইটিতে কিছু ঐতিহাসিক বিতর্কিত বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন শারমিন। আমি চট জলদি করে বইটি এক নজর দেখে নিলাম। মূল বইয়ে ২৩৮ পৃষ্ঠা আর পরিশিষ্ঠ ২১০ পৃষ্ঠা, সব মিলিয়ে 4৪৮ পৃষ্ঠার বেশ মোটা বই, ব্যাতিক্রমী বেশ বড় সড় পরিশিষ্ঠ। আমি প্রথম পাতা পড়ে নিলাম, “যাত্রা হল শুরু” তে শিমি মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে তার লিখা শুরু করেছেন। এরিক এরিকসন মানুষের জীবনের সাইকোসোশাল (মনো-সামাজিক) পর্য্যায়কে মোট আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। আমি বইটি সাথে নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম, ভাবলাম বার্লিনে ৪ দিন থাকাকালীন সময়ে পড়া শেষ করে ফেলব। এই মর্মে সাকীও সায় দিলেন। রাতের গল্প খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী করা গেলনা, সাকী বললেন, কাল যেহেতু দীর্ঘক্ষণ গাড়ী চালাতে হবে তাই ভালো ঘুম হওয়া চাই। আমি বললাম কাল যেতে যেতে গল্প সারা যাবে।
ড্রইং রুমের সোফাকে খুব দ্রুতই বড় একটা বেডে রূপান্তর করে দিয়ে সাকী জানালেন, এনেটের সাথে তার বিয়ে উপলক্ষে তার শাশুড়ি এই সোফা বেড তাদের উপহার দিয়েছিলেন। ২৭ বছরের পুরনো হলে ও এই স্মৃতিময় বেড আজো তার শোভা আর সৌন্দর্য্য ধারণ করেছে। আমি “নেতা ও পিতা” বইটি পড়তে শুরু করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×