(এ লেখাটি আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছেন। কেউ কি জানেন এর লেখক কে?)
পলিটিক্স ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল এবং মুক্তমোনা ফোরামের বেশকিছু বামপন্থী তথা কম্যুনিউস্ট সদস্যবৃন্দ এই ধারনা পোষন করেন-মার্ক্সবাদ বিনা শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাদের আবেগঘন বক্তব্য -বস্তুবাদি মার্ক্সবাদী দর্শনের স্বরণ না নিলে, সমাজে শোষন হবে স্থিতিশীল। মার্ক্সবাদবিনা শোষন মুক্ত সমাজ তৈরী হবে কি করে? ডঃ অভিজিত রায় এদের একটা উত্তর দিয়েছেন। আমি দিচ্ছি আমার দৃষ্টিকোন থেকে।
অনেক ইতিহাস, দর্শন এবং সমাজবিজ্ঞান ভুলে গেলে এমন চিন্তা বক্ষে ধারণ করা যায়! এবং এই চোরাবালির পাঁকে ডুবে আছেন সব কম্যুনিউস্টরাই।
[১] মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই শোষন বিরোধিতার দর্শন এবং বিপ্লব আমরা দেখতে পাচ্ছি।
বস্তুত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা ধর্ম আন্দোলনই শোষনের বিরুদ্ধে 'মানবিক দর্শনের' উত্তরোন। ইহুদি, ইসলাম, খ্রীষ্ঠান
সব ধর্মেই আমরা দেখছি নবীরা শোষনের বিরুদ্ধে মানবতা প্রতিষ্ঠা করতে শুধু বাণী দিয়েই খান্ত হন নি। যুদ্ধও করেছেন।
ইসলাম কিন্ত প্রথমে দরিদ্র প্যাগানদের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়-এবং ঠিক সেই কারনেই আমরা দেখতে পাই, কোরানের অনেক
আয়াতে 'ধন বৈষম্যের' বিরুদ্ধে বেশকিছু বক্তব্য আছে-জাকাতের ধারনাও সেখান থেকেই এসেছে। বৈভবপূর্ণ জীবনকে
ইসলামে ঘৃণা করা হয়েছে।
মহাভারত পড়ুন। সেখানেও কৃষ্ণ ঠিক এক ই কথা বলছেন। যে লোক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরোন করে,তাকে সরাসরি চোর-ডাকাত বলা হয়েছে।
ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের সময়, বিদুর রাষ্ট্রনীতির যে শিক্ষা পান্ডবদের দেন-সেখানেও দেখবেন এক ই বাণী। বিদুরের বক্তব্য ছিল মোটামুটি এই রকম
(আ) হে রাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য যে সমাজে বেশী-তা স্থিতিশীল নয়। গরীব এবং ধণীদের সম্পদের পার্থক্যেই সমাজে চোর ডাকাত
এবং অরাজকতরা সৃষ্টি হয় (আ) রাজার উচিত-ধনীকে বেশী এবং গরীবদের ওপর করের বোঝা লাঘব করে, সমাজ থেকে বৈষম্য দূর
করা।
[২] কিন্তু ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে বা হিন্দুধর্মের ২৫০০ বছরের ইতিহাসে আমরা কি কোন শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা রাজত্ব দেখি?
বরং উলটোটাই সত্য। ধর্মগুলি আসলেই শোষনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে।
[৩] মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখলাম। মার্ক্স [১] এবং [২] সম্মন্ধে অভিহিত ছিলেন। এবং তার বক্তব্য ছিল, শোষনমুক্ত এইসব সমাজতান্ত্রিক ধারনাগুলি নেহাত ই ভাববাদি বা আদর্শবাদি ধারণা। তাই এইসব দর্শন শ্রেনীহীন শোষনহীন সমাজ গড়তে ব্যার্থ হয়েছে। তিনি শোষনহীন সমাজতন্ত্রের ধারণাকে বস্তুবাদের ওপর দাঁড় করাতে চাইলেন।
এ লেখাটি আমার নয়। এক বন্ধু গতকাল ই-মেইল করেছেন। ব্লগের বন্ধুদের কেউ কেকেলেখকের
কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে যে 'বস্তুবাদি' দর্শনটির আমদানি করলেন-তা আদপেই ছিল আরেক ধরনের আদর্শবাদ। ফলে যেসব দেশে তথাকথিত মার্ক্সীয় বিপ্লব হয়েছে-সর্বত্রই শোষনের অবসান ত হয় ই নি-বরং গণতন্ত্রের অভাবে কম্যুনিউস্ট বুরোক্রাটদের হাতে মানুষ আরো বেশী শোষিত হয়েছে। এবং গতশতাব্দীর বৃহত্তম গণহত্যাগুলির ৮০% ই কম্যুনিউস্টদেশে সংগঠিত হয়েছে।
[৪] তাহলে ব্যার্থতার ইতিহাস থেকে ইহা পরিষ্কার, হিন্দুধর্ম, ইসলাম বা মার্ক্সবাদ কেহই শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। বরং 'এনলাইটমেন্ট' বা'শাশ্বত সত্যের' নামে আরো নতুন ধরনের শোষনের জন্ম দিয়েছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে
না। হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট এবং মার্ক্সিস্টরা সবাই তাদের মত ও পথ শ্রেষ্ঠ এই স্বপ্নেই বিভোর। তা আজও সত্য।
কোন পণ্ডিত ইসলামিস্ট বা হিন্দুত্ববাদিকে জিজ্ঞেস করুন-মার্ক্স সম্মন্ধে উনারা কি ভাবেন? সবার কাছ থেকে এক ই উত্তর পাবেন। ওই সব সাম্যবাদের ধারনা তাদের তাদের ধর্মেই আছে। কথাটা খুব মিথ্যাও না!
[৫] তাহলে ভুলটা কোথায়? তার আগেও প্রশ্ন করি শোষন মানে কি?
যদি স্যোসাল কনট্রাক্টগুলো মুক্ত থাকে-অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার উৎপাদনশীলতার সাথে যেসব চুক্তিতে জড়িত, তা যদি তার ইচ্ছার ভিত্তিতে হয়ে থাকে-যা ধনতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি-তাহলে শোষন কথাটার স্কোপ কোথায়? আসে কেন? শোষনমুক্ত সমাজের রেফারেন্সটা কি?
আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিন ধরনের শোষন দেখতে পাই ধনতান্ত্রিক সমাজে
অ) 'অজ্ঞানতা' বা অক্ষ্মতাহেতু শোষন বিরোধি আইনের রক্ষাকবচগুলি কাজে না লাগানো
আ) শোষন বিরোধি আইনের রক্ষাকবচগুলিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতায় বৃদ্ধাষ্ঠুঙ্গ দেখানো
ই) শোষন বিরোধি নতুন আইন প্রনয়নে ব্যার্থতা
একটু বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে-ব্যার্থতার আসল কারন-গণতন্ত্রের ব্যার্থতা বা সীমাবদ্ধতা। উদাহরণ দেওয়া যাক। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে নুন্যতম মাইনে ঘণ্টায় সাত ডলার ত্রিশ সেন্ট। এর নীচে কাওকে মাইনে দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। রাষ্ট্র কিন্তু এখানে শোষনের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবটা কি? ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষিক্ষেত্রে বে আইনি মেক্সিকান লেবারদের ঘন্টায় তিন থেকে চার ডলার
দেওয়া হয়। রক্ষাকবচ সত্ত্বেও শোষন অব্যাহত। কারন মেক্সিকান লেবাররা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অক্ষম। যেহেতু তারা নিজেরাই বে আইনি ভাবে আমেরিকাতে আছে। তাহলে শোষনমুক্ত করার জন্যে প্রথমে এদেরকে লিগ্যাল ইমিগ্রান্ট করার দরকার ছিল। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টি করবে না। কারন এদের সমর্থকরা স্মল বিজনেস ওনার। যারা এই শোষন সব থেকে বেশী করে থাকে। রিপাবলিকান চালিত রাষ্ট্র ও এদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেবে না কারন তাহলে পার্টী ফান্ডে ধ্বস নামবে।
কিন্তু দীর্ঘদিন শোষনের এই স্থিতিশীলতা চলতে পারে না। লক্ষ্য করুন ইলিগ্যাল ইমিগ্রান্টরা পথে নেমেছে গত দুবছরে মানুষের দাবি আদায়ের জন্য। এবং আজ নইলে কাল তাদের দাবি স্বীকৃত হবেই। কিন্তু এরজন্যে কি কোন মার্ক্সবাদি এনলাইটমেন্ট দরকার হচ্ছে? না ইসলাম, হিন্দুত্ব, খ্রীষ্ঠান ধর্মের গালভরা ধর্মীয় সমাজতন্ত্রের দরকার হচ্ছে?
[৬] সেই জন্যে স্ট্রাকচারালিস্টরা এনলাইটমেন্ট বিরোধি। ফুকোর নিউহিস্টোরিসিজমে ইতিহাসের গতিকে একমাত্র স্থানীয়
অদূরবর্ত্তী অতীত ও বর্তমানের উপাদান দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়। ব্যাপারটা গণিতের দৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক। সমাজ যেহেতু ক্যাওটিক
সিস্টেম-একমাত্র খুব লোকালাইজড বা কম স্থান এবং কালের পরিসরেই ইতিহাসের ব্যাখ্যায় কার্য-কারণ সম্মন্ধ আনা যায়।
আমার কাছে অবশ্য নিউহিস্টরিসিজমও অতিসরলিকরন লাগে। কারন ভারতের বর্তমান রাজনীতি-হিন্দুধর্মের ৩০০০ বছরের ইতিহাস, ইসলাম, সোভিয়েতের ইতিহাস ইত্যাদি ব্যাতিরেকে বিশ্লেষন করা অসম্ভব-যা স্থান এবং কালে অনেক অনেক বিস্তৃত।
[৭] তাহলে ধর্ম, মার্ক্সবাদ, পোস্টমডার্নিস্ট-সবাই বাতিল। পড়ে রইল কি? শুন্য?
তাও না। সমাজে বিবর্তন ঘটছেই। জৈবিক বিবর্তনের চাহিদাতেই ঘটছে। ভবিষ্যতের সমাজকে আরো সুরক্ষিত করার চাহিদাতেই ঘটছে। বিবর্তন বিজ্ঞানের আরো উন্নতি হলে, সমাজবিজ্ঞানও আরো ভাল ভাবে বোঝা যাবে।
তবে পোস্ট মর্ডানিজমের একটা ব্যাপার স্বীকার করা যাক। হিন্দুত্ব, ইসলাম, মার্ক্সবাদ ইত্যাদি এনলাইটমেন্ট নিয়ে লম্ফঝম্ফ- মানে সমাজকে পরিবর্তনের চেস্টা না করায় ভাল। ইতিহাস বলছে, তাতে শোষন কমে না, অনেক গুন বৃদ্ধি পায়। 'এনলাইটমেন্ট' আসলে শোষনের শতগুন শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।
সুতরাং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার দিকেই লক্ষ্য দেওয়া উচিত। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী এবং আরো কার্যকরী করার মধ্যে ই শোষনমুক্ত সমাজ আসবে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের বয়স মেরেকেটে এক শতাব্দিও না। এবং গণতনন্ত্রে সাধারন নির্যাতিত মানুষের কন্ঠস্বর যত শোনা যাবে-সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দিকে আমরা বিবর্তনের পথেই এগিয়ে যাব। হিন্দুত্ববাদ, ইসলাম, মার্ক্সবাদ দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা
-আসলেই গণতান্ত্রিক বিবর্তনের বাধাস্বরূপ। বরং এই সব দর্শনের যেসব মানবীয় দিক আছে, তা নিয়ে চর্চা করতে বাধা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



