(23শে নভেম্বর, 2000 এ প্রকাশিত। পুরনো লেখা আর রূপকথা বেশি হয়ে যাচ্ছে। কী করি? যা-ই হোক, মন্তব্য প্রত্যাশী হয়ে রইলাম।)
অনেক অনেক বছর আগের কথা, তখন ঈশ্বর সবেমাত্র মানুষ বানাতে বসেছেন। নানারকম জন্তু জানোয়ার গাছপালা তৈরী করে পৃথিবীতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, এখন কেবল মানুষ বানানো বাকি।
ঈশ্বর তাঁর দূতদের ডেকে বললেন, 'আচ্ছা, মানুষকে কী ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বানালে সবচাইতে ভালো হয়?'
আঁতেল গোছের এক দূত ডানা ঝাপটে বললো, 'কাস্ট আয়রন দিয়ে বানান বস, খুব মজবুত হবে।'
আরেক দূত নাক সিঁটকে বললো, 'কী রুচি! কাস্ট আয়রন দিয়ে বানালে পৃথিবীর জলহাওয়ায় ভুগে মরচে পড়ে যাবে না? তখন সেগুলো পরিষ্কার করবে কে, তুমি?'
সেই আঁতেল দূত আমতা আমতা করে বললো, 'কেন, ভালো করে গ্যালভানাইজ করে দেয়া হবে, নয়তো এক পোঁচ শেরারডাইজিং .. ..।' তাকে হটিয়ে দিয়ে আরেকজন বললো, 'উঁহু, এরচেয়ে প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হোক, পোক্ত হবে। মরচেও ধরবে না।'
'এহ্, বুদ্ধু কোথাকার। এরপর মানুষ যখন আগুন আবিষ্কার করবে, তখন সবাই গলে যাবে না?' ভেঙচে উঠলো প্রথম দূত।
'ওহ্, থাম তো তোরা।' ঈশ্বর খেঁকিয়ে উঠলেন। 'বিসমিল্লায় গলদ বাঁধিয়ে বসে আছিস, যতসব গাধার দল। সব্বাই শুনে রাখ, আমি মানুষ বানাবো কাদামাটি দিয়ে।'
'কাদামাটি?' আমতা আমতা করলো এক দূত। 'কাদামাটি দিয়ে মোল্ডিং করবেন কিভাবে বস?'
'সেটা আমার ঠ্যাকা, তোর কী?' ঈশ্বর ধমকে উঠলেন। 'যা তোরা, পৃথিবীর নদীর তলা থেকে তিন পদের কাদা নিয়ে আয়। সাদা, হলুদ আর কালো। আর দেখিস, আনতে আনতে যদি কাদা শুকিয়ে যায়, তাহলে পরীদের ক্যাম্পাসে তোদের আনাগোনা বন্ধ। যা এবার।'
ভয়ে ভয়ে একদল দূত পৃথিবীর দিকে রওনা হলো। আঁতেল দূত মিনমিন করে বললো, 'ঈশ্বর যে কী করেন, বুঝি না, গোসল করতে গেলেই তো কাদা গলে যাবে। এরচেয়ে আমাদের মতো রশ্মি দিয়ে বানালেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো .. ..।'
একমাস খোঁড়াখুঁড়ি করে দূতেরা এক পাহাড় কাদা জোগাড় করলো। তারপর সেই কাদা থেকে ছেঁকে ছেঁকে সব ময়লা বার করা হলো। মিহি তিন তাল তিন রঙের কাদা নিয়ে দূতেরা আবার স্বর্গে ফিরে এলো।
কিন্তু তাদের কাজে খুব সূক্ষ্ম একটা ত্রুটি রয়ে গেলো।
ম্যাটেরিয়াল দেখে ঈশ্বর আহ্লাদে আটখানা। 'বাহ্, বেড়ে কাদামাটি জোগাড় করেছিস তো। বেশ বেশ। তোদের সবার আরো দু'টো করে ডানা গজাক।'
দূতেরা খুশিতে 'হি ইজ এ জলি গুড ফেলো' আর 'থ্রি চিয়ার্স ফর ঈশ্বর' গান ধরে নাচতে নাচতে নিজেদের ব্যাচেলর মেসে ফিরে গেলো। এখন তাদের মোট চারটা ডানা, স্বর্গে তাদের স্ট্যাটাসই আলাদা। পরীদের চোখে তারা এখন কেউকেটা।
ঈশ্বর তখন পকেট থেকে একটা ব্লু প্রিন্ট বের করলেন। এই প্রিন্ট তাঁর অনেক আগের করা। ব্লুপ্রিন্টে পরিষ্কার করে মানুষের ছবি নানা দিক থেকে আঁকা, ফ্রন্ট এলেভেশন, ব্যাক এলেভেশন, লেফট এলেভেশন, রাইট এলেভেশন আর প্ল্যান।
এছাড়াও ছোটছোট করে মানুষের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি আঁকা আছে। এত ঝামেলা করার দরকার ছিলো না, হও বললেই সব হয়ে যেতো, কিন্তু হাতে কাজকাম নেই বলে তিনি বড্ড বোরড হয়ে পড়েছেন।
ঈশ্বর মনের আনন্দে শিস দিয়ে কাজ শুরু করলেন। এমন সময় তাঁর কানে অত্যন্তু ক্ষীণ একটা চিৎকার ভেসে এলো, 'ঈশ্বর!'
ঈশ্বর একটু বিরক্ত হলেন, কাজের সময় খালি ব্যাঘাত। তিনি গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, 'বলো বৎস।'
'ঈশ্বর গো, আপনার হাতের দিকে তাকান!' আবার সেই সরু গলার চিৎকার ভেসে এলো।
ঈশ্বর চমকে উঠে নিজের হাতের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন, দু'টি কাদামাখা উঁইপোকা সেখানে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়ছে।
'কী চাও তোমরা? এখানে এলে কী করে?' ঈশ্বর শুধালেন।
'আর বলবেন না বস, আপনার ঐ বেআক্কেল জুয়াচোর দূতগুলো আমার আর আমার ভাইয়ের ঢিবি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। নদীর তীরে খোলা মাঠে আমাদের কলোনি ছিলো, ঐ শালারা ভেঙেচুরে সেই ঢিবির সব মাটি কাদা করে দিয়েছে। আমার আত্নীয় স্বজন দারা-পুত্র-পরিবার সব মাঠে মারা পড়েছে গোওওওও .. ..!' একটি উঁই বুক চাপড়ে বিলাপ করে উঠলো।
ঈশ্বর আপন মনে বললেন, 'ব্যাটাদের একটা কোন কাজ দিয়ে শান্তি নেই, একটা না একটা নয়ছয় করে রাখবেই।' তারপর উঁইদের অভয় দিয়ে বললেন, 'ভেবো না, ওদের আমি ভালো করে শাস্তি দেবো। চারটা ডানা গজিয়েছে, তা থেকে তিনটে জরিমানা করে দেবো না হয়। এক ডানা নিয়ে স্বর্গের কোনাকাঞ্জিতে ঘুরে বেড়াবে গাধাগুলো।'
অন্য উঁইটা চোখ মুছে বললো, 'এ তো একচোখো বিচার করলেন স্যার। ওদের ডানা না থাকলেই বা আমাদের কী? এখন আমাদের কী হবে? কত নামীদামী বংশ ছিলো আমাদের, সব সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা বেঘোরে মারা পড়লো। এখন উঁইদের মুখ কে রক্ষা করবে? পোকাদের সমাজে আমাদের নাম রওশন করবে কে?'
'বেশি কপচাসনি।' ঈশ্বর ধমকে উঠলেন, মনে মনে ভারি চটেছেন তিনি। 'যা, তোদের মরা বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে আবার জ্যান্ত করে দোবো'খন।'
প্রথম উঁইটা তখন ভারি লাজুক গলায় বললো, 'হয়েছে কি কর্তা, আমার না আবার এই স্বর্গের জলবাতাস বড় ভালো লাগছে।'
ঈশ্বর একটু খুশি হয়ে বললেন, 'লাগাই উচিত। দেখতে হবে না কে বানিয়েছে?'
উঁইটা আরো লাজুক গলায় বললো, 'তাই বলছিলাম কি, আমাদের দু'জনকে এখানেই রেখে দিন, আমরা আর পৃথিবীতে যাবো না।'
ঈশ্বর গম্ভীর হয়ে বললেন, 'তোদের এখানে রাখলে তো তোরা প্রলয় ঘটিয়ে দিবি। কেটেকুটে জিনিসপত্র নষ্ট করবি। আমার নকশাগুলো নষ্ট করলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে। তার ওপর স্বর্গে আবার কেরোসিন নেই। উঁই ধরলে যে একটু ছিটিয়ে দেবো তারও উপায় নেই।'
দ্বিতীয় উঁইটা জিভ কেটে বললো, 'না না, ছি ছি, তা করবো কেন? তাছাড়া আমরা তো জিনিসপত্র কাটি বাসা বানানোর জন্যে। গোটা বংশ তো নিচে পৃথিবীতেই রয়ে গেলো, বাসা আর কার জন্যে বানাবো বলুন? বড়জোড় এদিক ওদিক দু'চারটে কামড় বসাতে পারি। আর তাছাড়া আমরা তো আপনার ইচ্ছায় জন্মান্ধ, আপনার নকশাপত্রের খোঁজ পাবো কীভাবে বলুন?'
ঈশ্বর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, 'হুম, হেভি লজিক শিখেছিস দেখছি? গুরুমারা বিদ্যে কপচাচ্ছিস আমার সঙ্গে? আচ্ছা যা, তোদের আবদার মেনে নিলাম। কিন্তু তোরা থাকবি কোথায়?'
প্রথম উঁইটা খুশি হয়ে বললো, 'কেন, এই যে এতগুলো কাদা আছে, এর মধ্যেই নাহয় দু'জনে দু'টো ঠাঁই খুঁজে নেবো?'
'দু'জনে দু'টো? তোদের খায়েশ তো কম না? কেন, একসাথে শেয়ার করে থাকতে সমস্যা কী?' ঈশ্বর জিজ্ঞেস করলেন।
'না না না।' আঁতকে উঠলো দু'টো উঁই।
'আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি না।' বললো প্রথম উঁই।
'ও খুব হিংসুটে। আর এতো নাক ডাকে!' দ্বিতীয় উঁই বললো।
'হুম, তোরাও দেখছি আমার দূতগুলোর মতোই কুচুটে রাসকেল।' বিড়বিড় করে বললেন ঈশ্বর। 'কিন্তু এই কাদা আনা হয়েছে মানুষ বানানোর জন্যে, তোদের দিয়ে দিলে ম্যাটেরিয়ালে ঘাটতি পড়ে যাবে না?'
উঁই দু'টো কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ শুঁড় নাড়তে লাগলো।
হঠাৎ ঈশ্বরের মাথায় একটা দুদর্ান্ত আইডিয়া খেলে গেলো। তিনি তুড়ি দিয়ে বললেন, 'ইউরেকা। লোকে আমাকে খামাকা ঈশ্বর ডাকে না।' উঁই দু'টোকে ডেকে বললেন তিনি, 'শোন, তোদের দু'টো সুন্দর আলাদা ঘর আমি দেবো। তবে তোরা সে ঘর থেকে বেরুতে পারবি না। আর মাঝে মাঝে যখন তোদের দাঁড়া কুটকুট করবে, তখন ঘরের দেয়ালে কুটুস করে একটা কামড় দিবি। মনে থাকবে?'
উঁই দু'টো কৃতজ্ঞতায় পা জোড় করে হেঁ হেঁ করতে লাগলো।
ঈশ্বর তখন বললেন, 'ও কে, এখন তোরা একটু সরে বোস, আমি মানুষ গড়বো।'
দিনরাত উদয়াস্তু খেটে ঈশ্বর তিন রঙের মশলা মিশিয়ে একে একে গড়লেন হাত পা চোখ নাক কান বুক পেট ঊরূ। স্বর্গের একদানা কিসমিস নিয়ে মানুষের জিভে ঘষে দিলেন, যাতে সে সবসময় স্বাদের সন্ধানে থাকে। মানুষের নাকে দিলেন স্বর্গের ফুলের গন্ধ, কানে দিলেন স্বর্গের বাতাসের শিস। মানুষের বুকে আস্তে করে ফুঁ দিয়ে ফুসফুস তৈরী করলেন, জিলিপির মতো পাকিয়ে তৈরী করলেন খাবার জীর্ণ করার যন্ত্র। একে একে সবকিছু তৈরী করা শেষ করে তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তারপর অ-নে-ক সময় নিয়ে দু'টো জিনিস তৈরী করলেন। প্রথমে মগজ, তারপরে হৃদয়।
মগজের ভেতরের কুঠুরিতে বসিয়ে দিলেন প্রথম উঁইটাকে, আর দ্বিতীয় উঁইটাকে জুতে দিলেন হৃদয়ের গহীনে। দু'জনের জন্যে আলাদা দু'টো ঘর।
কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়। ঈশ্বর কী খামাকা ঈশ্বর হয়েছেন? একটা ছোট গ্যাঞ্জাম তিনি ঠিকই লাগিয়ে দিলেন। হাত আর বাগযন্ত্রের ওপর, মগজ আর হৃদয়, দু'য়েরই সমান নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দিলেন তিনি। অথর্াৎ, সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও, ঊঁই দু'টোর মধ্যে গোলযোগের একটা সম্ভাবনা রয়ে গেলো।
সবশেষে মানুষের অবয়বে হাত বুলিয়ে তাকে জীবন দিলেন তিনি। চোখ খুলে মানুষ দেখতে পেলো, সে পৃথিবীতে। তার পায়ের নিচে মাটি, মাথার ওপরে আকাশ।
এরপর মানুষ একে একে কত কান্ডই না করলো। ঈশ্বর আরাম করে বসে বসে সেসব দেখেন, আর দূতদের ডেকে বলেন, 'দেখলি, দেখলি তোরা? যা, মানুষের পা ধোয়া পানি খা গে।'
তা হলে উঁই দু'টোর কী হলো? এত বিতং করে তাদের কথা দিয়ে অর্ধেক গল্প চালানোর পর তাদের পরিণতি না বলেই গল্প শেষ করার মতলব নাকি?
না। উঁই দু'টো তাদের জায়গাতেই আছে। একটা মগজে, একটা হৃদয়ে। মগজের উঁই মাঝে মাঝে খেয়াল হলে কুটুস করে কামড়ে দেয়, তখন মানুষ কী সব যেন বলে ফেলে। সেই কথার কাঁপন হৃদয়ে পৌঁছে গেলে হৃদয়ের উঁই আবার কুটুস করে কামড়ে দেয়। মানুষ তার চিন্তা-যুক্তি আর আবেগকে এভাবেই কাজে একীভূত করে।
আবার মাঝে মাঝে হৃদয়ের উঁইটা আগেভাগে কামড়ে দেয়। তখন হয়তো মগজের উঁইটার অজান্তে মানুষ কিছু বলে ফেলে, কিংবা করে ফেলে। হয়তো ভুল মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে, কিংবা ঠিক মানুষকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। মগজের উঁইটার কাছে যখন সেই কাঁপন পৌঁছায়, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়।
কিন্তু মানুষ কি আর এসব কথা জানে? জানে না। জানলে কবে কেরোসিন ছিটিয়ে উঁই দু'টোকে দূর করে দিতো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



