somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশু শিক্ষা ২

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছেলের খেলার সাথী হয়েছে আমাদের বাসার কেয়ারটেকারের মেয়ে। বয়সের তফাত দুজনের ২ বছরের মতো। অবশ্য আমার মতো এত খুঁতখুঁতে সাবধানী নয় কেয়ারটেকার পরিবার, তাই উন্মুক্তি সিঁড়ির কোণায় ছোটো মেয়েটা যখন তার ছোটো বোনকে নিয়ে ঝুঁকে নীচের দিকে তাকায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি।

অদ্ভুত এক চরিত্র বলা যায় ময়নাকে। বয়েস ৫ থেকে ৬এর মতো, স্কুলে যায় না, কিংবা তাকে স্কুলে পাঠানোর সঙ্গতি নেই কেয়ারটেকার পরিবারের। সামনে স্কুল আছে অনেক, ঢাকা শহরের নামীদামি স্কুলের পাশেই এই কেয়ারটেকার পরিবারের বসবাস, তবে ঢাকা শহরের স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে মেয়ের ভর্তি হওয়া কিংবা তাকে শিক্ষিত করার সামর্থ্য অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের নেই।

হয়তো ময়নাও একদিন স্কুলে যাবে, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বানী এখনও বড় রাস্তা থেকে এই ছোটো গলিতে ঢুকতে পারে নি। এখানের ৮টা পরিবারের ভেতরে ছোটো ছেলে মেয়ে আছে এমন পরিবার ৩টা। আমাদের ঠিক পাশেই যে পরিবারটা থাকে তাদের ৩ ছেলে মেয়ে, সবাই স্কুলে যায়, সকাল ৭টায় স্কুলের ভ্যান আসে তাদের তুলে নিতে, কখন তারা ফিরে আসে আমি জানি না।

তবে আমি যখন ফিরি তখন মোটামুটি এ রকমই দৃশ্য দেখি, পাশের বাসার কাছাকাছি বয়সের ২ ছেলে মেয়ে ময়না খেলছে সিঁড়িতে। আমার ছেলে তাদের পাশে ছাগলের ৩ নাম্বার বাচ্চার মতো লাফাচ্ছে। বয়েস একটা বড় বিষয়, যেই মানুষটা এখনও সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠতে পারে না, তাকে নিয়ে আর যাই হোক সিঁড়িতে ছোটাছুটি খেলা সম্ভব না। তবে ছেলের অপরিসীম ধৈর্য্য- সে লড়তে না পারলেও হাল ছাড়ে না, সেও সিঁড়ি বেয়ে উঠবার চেষ্টা করে দ্রুত। উপরে উঠে দেখে সবাই নীচে নেমে হাসছে, বিন্দুমাত্র অপমানিত না হয়ে আবার নীচে নেমে আসে।

আমি এই অহেতুক পরিশ্রম দেখে বিরক্ত হই। যদিও ঢাকা শহরের এই ক্ষুদে পরিসরে তেমন আনন্দ নিয়ে দৌড়ানোর সুযোগ নেই, এখানে ছেলেমেয়েদের দুরন্তপনা সিঁড়ি বেয়ে উঠা নামায় সীমিত। প্রতিদিন অন্তত একবার এ কারণে মনে হয় ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাবো।
তবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নয় এই দৃশ্য-হঠাৎ দেখা যায় পাশের বাসার মেয়েটার সাথে ময়নার ঝগড়া লেগে গেছে। পিয়া, পাশের বাসার মেয়েটা বয়েস হয়তো ৬ কিন্তু সাইজে ময়নার দ্বিগুন, গলাবাজিতেও কম যায় না।

পরিবারের প্রভাব দেখি, শব্দচয়ন আর বলবার ভঙ্গিতে। ময়নাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী না, তারও আত্মসম্মানবোধ প্রবল, তাই একই ভাষায় সেও লড়ে যায়। সমস্যা হয় আমার। সেও এই মুখে মুখে অহেতুক তর্ক করা শিখে গেছে। না যাবো না, না করবো না, তোমরা যাও- এইসব কথা শুনলে বিরক্ত লাগে, ঘামে চুপচুপা হয়ে থাকা শরীর নিয়েও তার কসরত কমে না।

মাঝে মাঝে রেগে দরজা বন্ধ করে দিলে কান্নাকাটি করে বাসা মাথায় তুলে ফেলে, কিন্তু নিরুপায় হয়ে এটাও করতে হয় সময় সময়। যাই হোক এইসব নিয়েই ভাড়া বাসায় বসবাস আমার।

নিয়মিত বুঝতে পারি ছেলেটা পিছিয়ে পড়ছে, সে নিজের নাম বলতে পারে না, অন্তত তাকে যে নামে সম্বোধন করা হয়, সেটা যে তার নাম এবং কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে তাকে যে সেটা পাল্টা বলতে হয় এটা সে এখনও শিখে নি। কিংবা শেখানো হয় নি।

তেমন ভাবেই সম্পর্ক কিংবা সম্বোধনের জায়গাটাতে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া দরকার এটাও বুঝে নি এতদিনে। আমরা যে সম্বোধন করি সেও সেটা অনুকরণ করে, আম্মা যখন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেয়ারটেকারকে ডাকে, শফিক পানি ছাড়ো।

সেও সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় চিৎকার করে ডাকে শফিক পানি ছাড়ো। অবশ্য বাসায় এটা এখন বিনোদন হয়ে গেছে, সবাই বাসায় আসলেই একবার না একবার ছেলেকে পানি ছাড়বার হাঁক দিতে হয়। মানা করলেও শুনবে না বাসার মানুষ।
একই সমস্যা হলো সামনের দোকানে, সেখানের দোকানী মানিক- সেও আমার মতোই গিয়ে বলবে মানিক একটা নুডুলস দে। কত হইছে? নে টাকা রাখ।

অন্তত আমার মুখ চেয়ে হলেও মনঃক্ষুন্ন হলেও মানিক কিছু বলে না। ইদানিং তাকে সম্বোধন শেখানোর ব্যপক প্রচেষ্টার পরে লাভ যা হয়েছে মানিকের পদোন্নতি ঘটে নি, রাস্তার সমস্ত ছেলে তার মামুন মামা আর রাস্তার সমস্ত মেয়ে তার ফুপু। অন্তত ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে রাস্তায় নামলেই বলি বাবা আন্টি বলো, খালা বলো, কোনো কোনো মেয়েদের শালী বলতেও সুখ।

এই নিয়েই একদিন কর্ণফুলী মার্কেটের ফুডকোর্টে গিয়ে বসলাম, খাওয়ার মান যাচ্ছেতাই, তবে ছেলের আব্দার সে খাবে এখানে। বসলাম, টেবিলের চারপাশে ক্ষুদে তেলাপোকা ঘুরছে, ময়লা, এবং স্মার্ট তেলাপোকাদের মেরে ফেলা কঠিন, অন্তত অভিযোজন বিবেচনা করলে তেলাপোকার টিকে থাকবার কারণটা আবিস্কার করা দুরহ না।


খাওয়ার হুকুম দিয়ে বসে আছি, খাওয়ার আসলো, সাথে উপরি পাওয়া তেলাপোকার রেস, তেলাপোকা থালার উপর দিয়ে ছুটে পার হয়ে যাচ্ছে, হাতের পাশে সুরসুরি দিচ্ছে, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি এরপরও প্রেমের বিরাম নেই। আমার ছেলে এমনই এক জুটির পাশে গিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে, আমিও সেই জুটির দিকে তাকিয়ে থাকি, সুবিধার নয় তবে কি আর করা যাবে।

হঠাৎ ছেলে এসে বললো, মানিককে বলো খাওয়ার দিতে। পৃথিবীর সমস্ত দোকানী যে মানিক না এটা তাকে কে বুঝাবে?

অনুকরণপ্রিয়তা শিশুদের বড় বৈশিষ্ঠ্য হলেও এটাকে নিয়ন্ত্রিত করতে হয় আদতে। আম্মা সারাদিন পিচ্চিকে নিয়ে থাকে। সেও আম্মার অনুকরণে সারাদিন রান্না করে, এই রমজানে তার নামাজ পড়বার বাতিক উঠেছে। নামাজপাটি বিছিয়ে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই সিজদা দিচ্ছে দেখে নিশ্চিত হই ইশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।

অবশ্য সিজদাও মোটামুটি ষাটাঙ্গ প্রণামের কাছাকাছি একটা ভঙ্গি, আম্মার পাশে সেও নামাজ পড়ছে, নামাজের মাঝখানে উঠে এসে টিভি দেখছে, আবার নামাজ পড়ছে। এইসব দেখে ভালো লাগে। অনুকরণ করতে করতে শিখুক যা কিছু শিখবার।

সেই অনুকরণপ্রিয়তা থেকেই সে শিখেছে কাপড় নোংরা হলে সেটা কাপড়ের ঝুড়িতে রেখে আসতে হয়, আম্মার অনুকরণে যেখানে সেখানে হাত দিয়ে উঁহ নোংরা বলতে শিখেছে। আর সবচেয়ে বেশি শিখেছে ভয় পাওয়া।
হঠাৎ হঠাৎ ছুটে আসে, এসে বলে ভয় পাইলাম। প্রজাপতি ভয় পাইলাম, ঈগল পাখী ভয় পাইলাম। বাবা টিকটিকি। টিকটিকি ভয় পাইলাম।

আজকে দুপুরেও বসে আছি, সে খেলছে, ময়নার কোড নেম খেলা, সে খেলার সাথে খেলতে গেছে, ময়না হঠাৎ করেই সিঁড়ির ময়লা পরিস্কার করা শুরু করলো, আমার ছেলেও মহাউৎসাহে তার সাথে ময়লা পরিস্কার করছে সিঁড়ির।

প্রথমে মনে হলো, গিয়ে একটু ধরে নিয়ে আসি, ময়লা ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা সিঁড়ির ময়লা পরিস্কারের দায়িত্ব তার না, পরে মনে হলো এটাও তার খেলার অংশ, এটা যে কোনো হীন কাজ এই সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই।

যে ধারণা গড়ে উঠে নি, সেটা তৈরি করবার কোনো অর্থ নেই। সে নিজের মতো ময়লা ঘেঁটে বড় হোক, অন্তত কিছু মানুষ শুধুমাত্র এইসব কাজের জন্য নিয়োজিত থাকে, এবং তাদের সমবয়সী কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুরা পারিবারিক সংস্কৃতিতে এইসব মানুষের উপরে অত্যাচার করতে শিখে- অবজ্ঞা করতে শিখে - এই শিক্ষাটা তার না হোক।

১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×