somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাপের সাতকাহন

০৯ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাকৃতিক বিবর্তনের খেয়ালি ধারায় সৃষ্ট বিবর্তিত সরীসৃপ প্রজাতিয় প্রাণীদের মধ্যে সাপ অন্যতম। আমাদের ভীরু মানসপটে সাপ সাধারণত খুবি হিংস্র প্রাণসংহার কারী প্রাণী কল্পিত হয়ে থাকলেও সাপ মোটেও তেমন ভীতিকর প্রানী নয়। পারত পক্ষে মানুষ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। আক্রান্ত মনে করলেই কেবল নিজের জীবন বাঁচাতে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। সাপ নিয়ে কৌতুহল, ভয় ও কুসংস্কার কোনটারি ঘাটিতি নেই আমাদের দেশে। সঠিক জ্ঞানের অভাবে সাপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্ক। যা বংশানুক্রমে আমরা আজো বহন করে চলেছি। মানুষের এই দূর্বলতাকে পুজি করে সাপ নিয়ে রচিত হয়েছে নানান লোক কথা, জনশ্রুতি, উপখ্যান, গল্প। সৃষ্টি হয়েছিল পেশা, চলে বানিজ্য। তৈরী হয়েছে নানান শিল্প ও ভাষ্কর্য। বেহুলা লক্ষিন্দরের গল্প তো লোকের মুখে মুখে। সাপের কাল্পনিক দূর্লভ মনির কথা বিশ্বাস করা লোকের অভাব নেই আজো আমাদের দেশে। সাপ মিশে গেছে আমাদের লোকজ সংষ্কৃতি, ধর্ম ও ভাষ্কর্যে। সাপকে আরো অধিক রহস্যি করনে সাপ ইচ্ছাধারী অর্থাৎ মাথাটা মানুষের বাকি অংশ সাপের রূপ ধারন করার ক্ষমতা আছে কল্পনা করে তৈরী হয়েছে ভারত বাংলায় অসংখ্য চলচিত্র। সেখানে আমাদের দেখানো হয় সাপ কিভাবে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়, মনুষ্য রূপ ধারন করে কি ভাবে প্রেম করে, খারাপ মানুষের উপর কি ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে, কখনো বা ভালো মানুষের জীবনরক্ষা কারী প্রতীক রূপে। তবে লক্ষ্যনীয় এখানে র্নিবিষ কোন সাপ নয় বরং বিষাক্ত ফনা উঁচিয়ে ফোস ফাস করতে পারা সাপকেই শক্তির আধার হিসাবে কল্পনা করা হয়।
অত্যধিক সাপের ভয় থেকে সূচনা হয় ভক্তির। ভক্তির মোহে পড়ে এক সময় সাপকে দেবতা তুল্য করে চালু হয় সাপের পূজা বন্দনা। হিন্দু সমাজে মনসা পূজা তার জ্যান্ত প্রমান। শক্তির মহাত্ম প্রকাশে ভক্তিতে গদ গদ হয়ে ভক্তকুল শিব ঠাকুরের গলায় লটকে দেয় সাপের প্রতিকৃতি। শিবের এই সাপ বশিকরনে শিবের মহাত্ম যেন বেড়ে যায় আরো শত গুন।

হিন্দুদের এই প্রচ্ছন্ন সর্প ভক্তির হাওয়া সামান্য হলেও পরশ বুলিয়ে যায় পথ হারা ভারতীয় বৌদ্ধ সমাজকে। বৌদ্ধ মিথেও অনুপ্রবেশ করে সাপের কিছু ভূমিকা। জানা যায় এক ঝড় বাদলের রাতে সর্প রাজ তার বিশাল ফনা ছাতার মত মেলে ধরে বুদ্ধকে রক্ষা করে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির কবল থেকে।

রচিত হয় সাপের পা দেখা, দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা, কেঁচো কুড়তে সাপ, দুমুখো সাপ, ইত্যাদি প্রবাদ বাক্যের।
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয় এক সময় প্রাচীন মেসোপ্টেমিয়া, মিসর, গ্রীক,অষ্ট্রেলিয়া,দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রীকায় ধর্ম, সংষ্কৃতিতে, একদা গুরুত্ব পূর্ণ স্থান দখল করেছিল সাপ। চীনা মিথ অনুসারে “নুয়া”ই (যার সারা শরীর সাপ হলেও মাথাটা ছিল দেবীর) প্রথম কাদা মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করে। গ্রীক দেবী “মেডুসা”র চুলের বদলে ছিল মাথা ভর্তি সাপ। বাইবেলের বর্ননা মতে স্বর্গীয় উদ্যান ইডেনে ঈভকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিষিদ্ধ জ্ঞান বৃক্ষের ফল সরবরাহ করে এই সারপেন্টে বা সাপ। অনুন্নত জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া দেশগুলুর কথাই বা শুধু কেন বলি পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত দেশ গুলো সাপের এই মিথ জ্বরের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে নি এখনো। সাপ মিথকে ভিত্তি করে তারাও তৈরী করেছে অনেক কাল্পনিক ছবি ও গল্প। তবে ছোট খাট নয়, তারা মাথা ঘামায় পাইথন(অজগর), বোয়া, আনাকোন্ডার মত বিশাল বিশাল সাপ নিয়ে।
সাপের আকার আকৃতির প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস নিয়ে জীব বিজ্ঞানীরাও বহুদিন ছিলেন ধোয়াসাচ্ছন্ন, ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। তাদের মতানৈক্যের কারন ছিল বিশ্বাসযোগ্য ফসিলের অভাব। সাপের হাড়ের গঠন খুবি ভঙ্গুর হওয়ায় তাঁরা খুঁজে পান নি কোন অকাট্য শক্ত প্রমানের ভিত, আসতে পারেন নি কোন গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে। বিগত কয়েক দশক ধরে চলে তাদের সাপ বির্তক। অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটে ৪ই মার্চ ২০০৯ সালে। দক্ষিন আমেরিকার কলম্বিয়ার পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ উন্মুক্ত কয়লা খনি চেরিজনের কয়লা স্তুপের খাজে পাওয়া যায় ৬০ মিলিয়ন বছরের পুরানো এক বিশাল সাপের ফসিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসরের মত আরেক বিশাল প্রাণীর অস্থিত্বের গন্ধে রোমাঞ্চিত হয়ে নড়ে চড়ে বসেন বিজ্ঞানীরা। অতি বিশাল বা দানব আকৃতির জন্য “টাইটান” আর বর্তমান “বোয়া” প্রজাতির সাথে কিছুটা মিল থাকায় বিজ্ঞানীরা এর নামের প্রথম অংশ রাখেন “টাইটানোবোয়া” আর চেরিজনে পাওয়া গেছে বলে নামের দ্বিতীয় অংশ রাখেন “চেরিজোনেনসিস” অর্থাৎ পুরো নাম দাঁড়ায় “টাইটানোবোয়া চেরিজোনেনসিস”।
সাপ বা সর্প হাতপাবিহীন এক প্রকার সরীসৃপ। বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী, Animalia (প্রাণী) জগতের, কর্ডাটা (কর্ডটা) পর্বের, Vertebrata (মেরুদণ্ডী) উপপর্বের, Sauropsida (সরোপ্সিডা) শ্রেণীর (শল্ক বা আঁশযুক্ত), Squamata (স্কোয়ামান্টা) বর্গের, Serpentes (সার্পেন্টেস) উপবর্গের সদস্যদের সাপ বলে অভিহিত করা হয়।

অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সকল মহাদেশেই সাপের উপস্থিতি দেখা যায়। এখন পর্যন্ত যতোদূর জানা যায়, সাপের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গণ, এবং ২,৯০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে।[১][২] এদের আকার খুব ছোট, ১০ সে.মি. (থ্রেড সাপ) থেকে শুরু করে সর্বচ্চো ২৫ ফুট বা ৭.৬ মিটার (অজগর ও অ্যানাকোন্ডা) পর্যন্ত হতে পারে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত টাইটানওবোয়া (Titanoboa) সাপের জীবাশ্ম প্রায় ১৩ মিটার বা ৪৩ ফুট লম্বা।

বিষধরদের জন্য বিখ্যাত হলেও বেশীরভাগ প্রজাতির সাপ বিষহীন এবং যেগুলো বিষধর সেগুলোও আত্মরক্ষার চেয়ে শিকার করার সময় বিভিন্ন প্রাণীকে ঘায়েল করতেই বিষের ব্যবহার বেশি হয়। কিছু মারাত্মক বিষধর সাপের বিষ মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকি বা মৃত্যুর কারণ ঘটায়।
ব্যুৎপত্তি
ইংরেজি snake শব্দটি এসেছে প্রাচীন ইংরেজি sanca থেকে, যা এসেছে প্রোটো জার্মানিক *sank-an- (cf. জার্মান Schnake "ring snake", এবং সুইডিশ snok "grass snake" থেকে। এছাড়া প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান শাখা (s)nēg-o- "to crawl, creep" (বুকে হাঁটা); এখান থেকে এসেছে এর সংস্কৃত নাম nāgá বা সাপ।[৩] সাপের অন্য একটি নাম serpent, একটি ফরাসি শব্দ, এটি এসেছে ইন্দো-ইউরোপিয়ান *serp- to creep[৪] এবং এখান থেকেই এসেছে সাপের গ্রীক নাম érpein (ερπω) ও স্ংস্কৃত নাম সর্প।
বিবর্তন
সাপের জীবাশ্ম (fossil) খুব পাওয়া দুরূহ, কারণ সাপের কঙ্কাল ছোটো এবং ভঙ্গুর, যার ফলে অশ্মীভবন (fossilization) খুব একটা হয় না। যদিও দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় পাওয়া ১৫ কোটি বছরের পুরোনো নমুনা থেকে সাপের অস্তিত্ত্ব বোঝা যায়, যেটার গঠন বর্তমানকালের গিরগিটির মতো।[৫] তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যার ওপর ভিত্তি করে এই ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে যে গিরগিটি থেকেই সাপের উৎপত্তি।[৫][৬]
শ্রেণীবিন্যাস
লিলিয়ান শ্রেণীবিন্যাসে আধুনিক কালের সকল সাপ স্কোয়ামান্টা বর্গের সার্পেন্টেস উপশ্রেণীভুক্ত, যদিও স্কোয়ামান্টার ভেতর তাদের রাখার বিষয়টি বিতর্কিত।[১] সার্পেন্টেস বর্গের দুটি অধিবর্গ রয়েছে: Alethinophidia (অ্যালিথিনোফিডিয়া) ও Scolecophidia (স্কোলেকোফিডিয়া)। শারীস্থানিক বৈশিষ্ট্য ও মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-এর সদৃশ্যতার ওপর ভিত্তি করে এই পৃথকীকরণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে কলুব্রইডে (কলুব্রয়েড সাপ) ও অ্যাক্রোকরডিডস অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে, অ্যালিথিনোফিডিয়াকে মাঝে-মধ্যে হেনোফিডিয়া ও সেনোফিডিয়া-এই দুভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া অন্যান্য অ্যালিথিনোফিডিয়ান পরিবার হেনোফিডিয়ার অন্তর্ভুক্ত।[৭] যদিও এখন অস্তিত্ত্ব নেই, কিন্তু Madtsoiidae (ম্যাডসোইডে) নামক পরিবারের বৃহৎ, আদিম, এবং অনেকটা অজগরের মতো দেখতে সাপের অস্তিত্ত্ব প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে ছিলো বলে জানা যায়, যার অনেকগুলো গণের মধ্যে একটা হচ্ছে ওনাম্বি।

স্থান দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সূত্রে Boidae (বোইডে) ও Pythonidae (পাইথনিডে)-কে একই পরিবারভুক্ত হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসে উল্লেখ করেছে।

নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত ১০ টি সাপের সচিত্র বর্ণনা দেয়া হল:
হাইড্রোফিলিস বেলচেরি (Hydrophis Belcheri )

অনেকে ইনল্যান্ড তাইপানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হিসেবে ধারনা করলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হল বেলচেরি। প্রকৃতপক্ষে এটি ইনল্যান্ড তাইপানের চেয়েও প্রায় ১০০ গুন বেশি বিষাক্ত।
সমুদ্রে বসবাসকারী এ সাপটি ০.৫ মিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর মাথা শরীর থেকে ছোট এবং এর পেছনে মাছের মত সাতারে সহায়ক লেজ রয়েছে। এ সাপটি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে বা ঘুমাতে পারে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপটি খুবই ভদ্র স্বভাবের। এটি সাধারনত কাউকে কামড়ায় না। তবে বার বার একে বিরক্ত করলে এটি কামড় দিতে পারে। এ সাপটি নিয়ে বেশি ভয়ের কারনও নেই কারন এটি কাউকে কামড়ালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষ ডুকায় না। তবে কারো ভাগ্য খারাপ হলে এর বিষাক্ত ছোবলে ১৫মিনিটের কম সময়েই তার মৃত্যু ঘটতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম বেলচেরির বিষ ১০০০ এর বেশি লোক বা ২৫ লক্ষ ইদুরকে মারার জন্য যথেষ্ট্য।
তাইপান সর্প পরিবার (Taipan Snake Family)

সমগ্র পৃথিবীতে না হলেও ভূমিতে বসবাস কারী সাপগুলোর মধ্যে তাইপান সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত এবং প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর প্রজাতির সাপ।এর বিষাক্ত ছোবলে একজন মানুষ সর্বোচ্চ এক ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকারও কোন রেকর্ড নেই।
তাইপান সর্প পরিবারের পাঁচটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইনল্যান্ড তাইপান অনেক বেশি বিষাক্ত। ইনল্যান্ড তাইপানের ক্ষেত্রে এক ছোবলে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এর কয়েক মিলিগ্রাম বিষই ১০০ লোক বা প্রায় ২.৫ লক্ষ ইদুর মারার জন্য যথেষ্ট।
এ সাপগুলো ১.৮ মিটার থেকে ৩.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ংকর ধারনা করা হলেও এরা খুব সহজেই বশ মানে। তবে একে কোন কারনে বিরক্ত করা হলে শিকার জায়গা থেকে নড়ার আগেই এটি প্রচন্ড বেগে কয়েক বার ছোবল দিয়ে দিতে পারে।
ক্রেইট (Krait)

তাইপানের পর এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী সাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত। এ সাপগুলো এশিয়ায় পাওয়া যায় এবং ৯০ সেন্টিমিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়। এরা যেকোন সাধারন কোবরা থেকে প্রায় ১৫গুন বেশি বিষাক্ত। দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও এরা রাতের বেলায় বের হয়। মানুষের শ্লিপিং বেগ, বুট বা তাবুর নিচের লুকানো এই সাপের একটি বড় অভ্যস। ইন্ডিয়ান ক্রেইট ইন্ডায়ার সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ।
ফিলিফাইন কোবরা (Philippine Cobra)

ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর ৩য় সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ এটি। এরা প্রায় ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ক্রেইটের পরেই এরা সবচেয় বিষাক্ত প্রজাতির সাপ। শারীরিক অঙ্গভঙ্গির সাথে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় বলে ফিলিফাইনের সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপগুলো সাপুড়েরা সাপের নাচ দেখানোর সময় বেশি ব্যবহার করে। সকল কোবরার মত এরাও রেগে গেলে মাথার দুইপাশে হুড দেখা যায়।
ইন্ডিয়ান কিং কোবরা (King kobra)

ভূমিতে বসবাসকারী সাপের মধ্যে ৪র্থ বিষাক্ততম সাপ হল ইন্ডিয়ান কোবরা। ফিলিফাইন কোবরার পর এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ। এর সাধারনত ৩.৫ মিটার থেকে ৫.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। এর পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলেও এরা মানুষকে তুলনামুলক কমই কামড়ায়। এ সাপ ছোবলের ভয়ে অন্য বিষাক্ত সাপগুলোকে আক্রমন করে না। তবে অবিষাক্ত সাপই এদের অন্যতম প্রধান খাদ্য। এর বেশি ক্ষুধার্ত হলে বিষাক্ত সাপকেও এমনকি নিজের প্রজাতির সাপকেও হজম করে। এরা জংলি প্রজাতির এবং সাপের খাদক হিসেবে পরিচিত। এরা ছোবলের সময় যেকোন সাপ থেকে বেশি বিষ নিক্ষেপ করে । স্ত্রী কিং কোবরা এর ডিমের চারপাশে বাসা বাঁধে। এর বাসার কাছাকাছি কিছু এলে এটি অশ্বাভাবিক আক্রমনাত্নক আচরন করে। কিং কোবরা খুবই গভীল জঙ্গলের অধিবাসী।
রাসেলস্ ভাইপার (Russell's Viper)

ভয়ংকর দর্শন এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে পঞ্চম।এটি খুবই রাগী ধরনের সাপ। সম্ভবত অন্য যেকোন বিষাক্ত সাপের চেয়ে এ সাপই মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এটি কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং এত প্রচন্ড বেগে শিকারকে ছোবল মারে যে পালিয়ে যাওয়ার আর কোন উপায় থাকে না। এর বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে যারা খামার বাড়ি থেকে শুরু কলে গভীর জঙ্গল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে। এরা সাধারনত ১ মিটার থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে।
ব্লাক মাম্বা (Black Mamba)

আফ্রিকার আতংক এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলো মধ্যে ৬ষ্ঠ। এরা আক্রমনের জন্য খুবই কুখ্যাত। এরা আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর সাপ এবং সাধারন মানুষ এদের থেকে যথেষ্ট সম্মানের সাথেই দূরে থাকে। এটি শুধু প্রচন্ড বিষাক্তই নয় প্রচন্ড আক্রমনাত্নকও। এর কামড় থেকে শিকারের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। এটি ভূমিতে বসবাসকারী সকল সাপ থেকে দ্রুত গতির এবং ঘন্টায় প্রায় ১৬ থেকে ১৯ কি.মি. যেতে পারে। এর বিভিন্ন প্রজাতিও খামারবাড়ি থেকে গভীর বন পর্যন্ত ছড়িযে ছিটিয়ে বাস করে। এ প্রজাতির সাপগুলো প্রায় ৪.৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
হলুদ চোয়াল বিশিষ্ট্য টম্মিগফ (Bothrops Asper)

স্থানীয় ভাবে ফার-ডি-ল্যান্স নামে পরিচিত এ সাপটি ভূমিতে বসবাসকারী সাপগুলো মধ্যে ৭ম বিষাক্ত। এরা প্রচন্ড রাগী ধরনের সাপ এবং সামান্য উত্তেজিত করলেও প্রচন্ড ছোবল মারতে পারে। এ সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর হার খুবই বেশি।এ সাপের কামড়ে মানুষের দেহকোষ এত মারাত্নক ভাবে ধ্বংস হতে থাকে যে শরীরে পঁচন দেখা দেয়। সাধারণত কৃষি জমি এবং খামার বাড়িতে এদের দেখা যায়। এর গড়ে ১.৪ মিটার থেকে ২.৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
মাল্টি-ব্র্যান্ডেড ক্রেইট (Multibanded krait)

এটি ভূমিতে বসবাসকারী পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের মধ্যে ৮ম। সাধারন ক্রেইটের মত এরাও রাতের বেলা খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে। এদেরকে সাধারণত জলাভূমিতে মাছ, ব্যঙ্গ বা অন্য সাপের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। এরা গড়ে ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চীন ও ফিজিতে এদের বেশি দেখা যায়।
টাইগার স্নেক(Tiger Snake)

এরা ভূমিভিত্তিক পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে ৯ম। এরা অস্ট্রেলিয়া বসবাসকারী একধরনের সাপ যারা শরীর প্রচুর পরিমানে বিষ তৈরী করতে পারে। এদেরকে শুষ্ক অঞ্চল, তৃনভূমি, জলাভূমি, মানববসতি সব জায়গায়ই দেখা যায়। এরা সাধারণত ১.২ মিটার থেকে ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
যারারারকুসসু (Jarararcussu)

এরা ভূমিতে বসবাসকারী সাপের মধ্যে বিষাক্ততার দিক দিয়ে ১০ম। এরা প্রতি কামড়ে ৮০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ডুকিয়ে দিতে পারে। এর এক ছোবলে ব্যবহৃত বিষ ৩২ লোক মারার জন্য যথেষ্ট। এদেরকে প্রায়ই গাছে সর্পিলভাবে পেঁছিয়ে থাকতে দেখা যায়। এরা সর্বোচ্চ ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।

কিভাবে চিনবেন বিষধর সাপ
বিষধর সাপের চোখের মণি লম্বাটে। বিষধর সাপের বিষদাঁত ও বিষগ্রন্থি আছে। বিষদাঁত লম্বাটে এবং এর মধ্যে ইনজেকশনের সুঁইয়ের মতো নালী থাকে যা সাপের চোয়ালে অবস্থিত বিষগ্রন্থির সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকে। বিষদাঁতের সংখ্যা দুইটি। স্বভাবতই বিষদাঁত দিয়ে দংশনের মাধ্যমে বিষ-রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করা।
কি করবেন না--
-একাধিক শক্ত গিট দেবেন না। এতে হাত বা পায়ের রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন গ্যাংগ্রীন, স্নায়ুতে আঘাতের ফলে মাংশপেশি অবশ হওয়া, গিট দেয়া স্থান ফুলে যাওয়া, রক্তপাত হওয়া বা রক্ত জমে থাকা।
-দংশনের স্থান কেটে রক্ত বের করবেন না।
-দংশনের স্থান কেটে মুখ দিয়ে বা মুরগীর বাচ্চা দিয়ে রক্ত চোষা যাবে না।
-দংশনের স্থানে কোন কিছু যেমন লালা বা থুথু, কাদা, গোবর ইত্যাদি লাগানো যাবে না।
-রোগীকে কোন কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করবেন না।
২-জরুরী চিকিৎসা (ডাক্তার করবেন)
- দংশনের স্থানের চিকিৎসা করা।
-Antibiotic প্রদান করা ।
-ধনুষ্টংকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া।
-লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা।
-নির্দেশিত ক্ষেত্রে Anti-venom প্রয়োগ করা।
জানতে হবে
-প্রথম কথাই হলো সাপ দেখে ভয় পাবেন না। বেশীরভাগ সাপ বিষধর নয়। আবার দংশনের সময় বিষধর সাপের পক্ষেও কার্যকর পরিমান বিষ ঢেলে দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ সাপের বিষ একধরণের পাচক রস। যা সাপকে তার খাদ্য হজমে সাহায্য করে। দংশনের আগে যদি বিষধর সাপ আহার করে থাকে বা অন্য কাউকে দংশন করে থাকে তবে তার বিষথলিতে কার্যকরী ডোজের বিষ সাধারনতঃ থাকে না।
-দংশনের স্থান (হাতে,পায়ে) স্প্লিন্ট দিয়ে ক্র্যাপ ব্যান্ডেজের সাহায্যে বিশ্রামে(Immobile) রাখা। রোগীকে হাটাচলা বা নড়াচড়া করা থেকে বিরত রাখা।
-স্প্লিন্ট দিয়ে ক্র্যাপ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা না গেলে দংশনের স্থানে চওড়া কিছু দিয়ে(যেমন গামছা) শুধুমাত্র একটি গিট দিন এবং প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ৩০ সেকেন্ডের জন্য বাঁধন আলগা করুন যাতে রক্ত চলাচলে কোন সমস্যা না হয়।
-অযথা সনাতন পদ্ধতি যেমন ওঝা, ঝাড়ফুঁক দিয়ে সময় নষ্ট করবেন না, দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
-দংশনের স্থান মুছে নিন ও ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখুন।
-রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, লালা ঝরলে, নাকি গলায় কথা বললে রোগীকে কিছু খেতে দেবেন না।
আরো জানতে হবে
-সাপ অযথা মানুষকে কামড়ায় না। বিরক্ত বা আক্রান্ত না হলে সাপ সাধারনতঃ মানুষকে এড়িয়ে চলে । কাজেই সাপ দেখলে সাপের কাছে না ঘেষাই উচিত।
-অযথা সাপ মারবেন না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-আর যদি মেরেই ফেলেন খালি হাতে সাপ ধরবেন না কারণ সাপ মরার ভান করে পড়ে থাকতে পারে।
-ঘাসের মধ্যে বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে লম্বা বুটজুতো পড়ে হাটুন।
-কোন গর্তে হাত দেবেন না বা পা ফেলবেন না।
-স্তুপকৃত লাকড়ি, খড় সাবধানে নাড়াচাড়া করবে।
-মাছ ধরার সময় মাছের জাল বা চাইয়ের মধ্যে সাপ আটকে আছে কিনা দেখে নিন।
-বেশীর ভাগ সাপ রাতে চলাফেরা করে। কাজেই রাতে চলাফেরার সময় আলো ব্যবহার করুন।
-রাতে জমিতে, ফলের বাগান, মাছের পুকুরে পাহাড়া দেবার সময়, মাটিতে বা মাচায় ঘুমানোর আগে সাবধানতা অবলম্বন করুন।

আমার এ পোষ্টটি আপনাদের কাছে ভালো লেগে থাকলে দয়া করে মন্তব্য করে জানান।আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×