সত্যজিৎ রায়ের "ফেলুদা" আর শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের "ব্যোমকেশ" এর পাহাড়সম জনপ্রিয়তায় আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো আরেকটি গোয়েন্দাচরিত্র, বিমল করের "কিকিরা"।
আজকের লেখা এই কিকিরাকে নিয়েই।যদি আগ্রহ থাকে তাহলে পুরো লেখাটি পড়ুন, আগ্রহ না থাকলে পড়ার দরকার নেই।
কিকিরার পুরো নাম কিঙ্করকিশোর রায়। লোকে ডাকে কিকিরা দি গ্রেট বা সংক্ষেপে কিকিরা। এককালে ম্যাজিশিয়ান ছিলেন, বাঁ হাতটায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় একসময় পেশাটা ছেড়ে দিতে হয়।
কিন্তু, ম্যাজিক দেখানোর নেশাটা থেকে যায়।
তথাকথিত অন্যান্য গোয়েন্দার মত কিকিরা ছয়ফুট লম্বাও নন, স্বাস্থ্যও সুগঠিত না, বয়সও বেশি। মোটামুটি গোয়েন্দা বলতে আমরা যেরকম চেহারা কল্পনা করি, কিকিরার চেহারা তার পুরোপুরি বিপরীত।
কিকিরা সিরিজের প্রথম উপন্যাস "কাপালিকরা এখনও আছে" তে যখন কিকিরা প্রথমবারের মত পাঠকের সামনে আসেন তখন তাঁর চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন লেখক বিমল কর, সে বর্ণনা পুরোটাই তুলে দিচ্ছি,
"এমন সময় অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক এসে কামরায় উঠলেন। টিয়াপাখির মতন নাক, তোবড়ানো গাল, গর্তে বসা চোখ। চেহারাটি রোগাসোগা, গায়ে সেই আদ্যিকালের অলেস্টার, মাথায় কাশ্মীরি টুপি ডান হাতে একটা সুটকেট ঝুলছে, বাঁ হাতে খয়েরি বালাপোশ। ভদ্রলোক এতই রোগা যে গায়ে অলেস্টার চাপিয়েও তাঁকে মোটা দেখাচ্ছে না। গলায় মোটা মাফলার জড়ানো।"
এই হলো লেখকের ভাষায় গোয়েন্দার বাহ্যিক গঠন।
কিকিরা রসবোধ প্রবল, অন্যান্য গোয়েন্দাদের মত গম্ভীর হয়ে থাকেন না, মজার উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। একাই আসর মাতিয়ে রাখতে পারেন। কিকিরা ভালো রান্নাও জানেন।
ফেলুদার যেমন তোপসে, ব্যোমকেশের যেমন অজিত তেমনি কিকিরারও কিন্তু সহকারী আছে। এই একটা ব্যাপারে অন্যান্য গোয়েন্দাদের সাথে তার মিল আছে।তার সহকারী দুজন। একজন তারা ওরফে তারাপদ আরেকজন চাঁদু ওরফে চন্দন। তারাপদ চাকরি করে আর চন্দন ডাক্তার। তারা আর চাঁদু দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুও। এদেরকে নিয়েই কিকিরার গোয়েন্দাগিরি।
কখনো তিনি ভয়ঙ্কর কাপালিকের জারিজুরি ফাঁস করে দেন, কখনো নিরুদ্দেশ ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করেন, কখনো রাজবাড়ির ছোরা উদ্ধার করেন।
এভাবেই বিভিন্ন বিচিত্র ঘটনার সমাধান করেন কিকিরা।
তাঁর গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতি ভিন্ন। তিনি যেহেতু ম্যাজিশিয়ান ছিলেন, তাই ম্যাজিকের মাধ্যমেই তিনি বিভিন্ন জটপাকানো সমস্যার জট ছাড়ান।
একেক পরিস্থিতিতে তিনি একেক ধরনের ম্যাজিক দেখিয়ে সমস্যার সঠিক সমাধান বের করেন, এজন্যই তিনি কিকিরা দি গ্রেট।
অন্যান্য গোয়েন্দাদের যেখানে মগজাস্ত্র আর আগ্নেয়াস্ত্র, সেখানে কিকিরার মগজাস্ত্র আর ম্যাজিকাস্ত্র। এই দুইয়ের যৌথ প্রচেষ্টা আর তারাপদ এবং চন্দনের সহযোগীতায় রচিত হয় একেকটি কিকিরা কাহিনী।
বিমল কর অত্যন্ত সচেতনভাবে কিকিরারে স্বতন্ত্রভাবে তৈরি করেছিলেন। অন্যান্য জনপ্রিয় গোয়েন্দাদের তুলনায় আলাদা করে তিনি সৃষ্টি করেছেন কিকিরাকে।
কিকিরার কাহিনীগুলোর সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে, কাহিনীগুলো খুব বেশি জটিল না, অত্যন্ত সাবলীল ও ছিমছাম একেকটি ঘটনা।
কিকিরার কাহিনীগুলোতে খুন, রক্তপাত, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এরকম বীভৎস বিষয়গুলোও কম। তাই, এই কাহিনীগুলো অনেক পাঠকেরই মনজয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং হচ্ছে।
কিকিরা সমগ্র আছে ৩ টি। ৩টি সমগ্রে মোট কাহিনী ১৮টি। কাহিনীগুলো আলাদা আলাদা, একেক রংয়ের, একেক ঢংয়ের।
এখনো যদি কিকিরার কোনো কাহিনী না পড়ে থাকেন, তাহলে আজই শুরু করে দিন, আশা করি সময়টা ভালো কাটবে।
আর যদি কিকিরার সঙ্গে আপনার আগেই পরিচয় হয়ে থাকে, তাহলে তো ভালোই। কিকিরা আপনার এবং আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড হয়ে গেলো।
আপনার বইপড়া আনন্দময় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:২৬